ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড: অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরে রাজনীতি
ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড: অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরে রাজনীতি
![]() |
| Belt Road Initiative |
চীন অর্থনৈতিক
উপনিবেশ গড়ার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে বিভোর, সেটি ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড
(ওবিওআর)। যাকে “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ“ ও বলা হয়।
নব্য চীনের নেতা জিনপিং এ প্রকল্পের জন্য
প্রাথমিকভাবে সম্ভব্য ১ ট্রিলিয়ন ডলার
ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছেন যার মাধ্যমে তিনি প্রায় ৬৫ দেশের সাথে স্থল ও জলপথে চীনের
সম্পর্ক স্থাপন করবেন। মূলত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পটি দুই ভাগে বিভক্ত।
প্রথমত, সিল্ক
রোড ইকোনোমিক বেল্ট। যার মাধ্যমে চীন সড়কপথে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ হতে কিরগিজস্থান,
উজবেকিস্থান,
তাজিকিস্থান,
তেহরান (ইরান), ইস্তাম্বুল (তুরষ্ক), মস্কো (রাশিয়া), পোল্যান্ড, জার্মানী, নেদারল্যান্ড হয়ে মাদ্রিদ (স্পেন) পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করবে। দ্বিতীয়ত,
মেরিটাইম সিল্ক রুট বা “টুয়েনন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি মেরিটাইম
সিল্ক রোড“। যার মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, মায়ানমার, শ্রীলংকা, পাকিস্তানের গাওয়াদার, কেনিয়ার মোমবাসা,
জিবুতি হয়ে লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে গ্রীস
ও ইতালীতে প্রবেশ করবে।
প্রসঙ্গত,
ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রস্তাবনাটি আধুনিক
হলেও এর ধারনা প্রাচীন চীনের সিল্ক রোড হতে নেওয়া। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে
অর্থাৎ চীনের হান সম্রাজ্যকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো চিনের "সিল্ক রোড"
নামের ঐতিহাসিক বানিজ্য পথ। এই রোড দিয়ে
এশিয়া, ইউরোপ,
ও আফ্রিকার মধ্যে বানিজ্য সংঘটিত হতো। এই
ধারনা থেকেই মূলত চীনের সাথে সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে এশিয়া ও ইউরোপের ভূ-খন্ড যুক্ত করার পরিকল্পনার নাম "সিল্করোড ইকোনোমিক বেল্ট"
যা ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট এর মধ্যে
অন্তভূক্ত। অন্যদিকে, চৌদ্দ'শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে পনের'শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রাচীন
চীনের মিং সম্রাজ্যের শাসকবর্গরা নৌ-বহরের সাহায্যে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও
দক্ষিন এশিয়া ভ্রমনের মাধ্যমে বানিজ্য করতেন। আজ চীনের প্যারামাউন্ট লিডার শি
জিনপিং যে "মেরিটাইম সিল্ক রোড" ধারনার কথা বলছে এবং ইতোমধ্যে এর জন্য
কাজও শুরু করেছেন এটি মূলত প্রাচীন এই সামুদ্রিক রুটেরই নব্য সংস্করণ। তবে শি
জিনপিং শুধুমাত্র পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না
থেকে তার প্রকল্পটিকে আরও বিস্তৃত আকারে পরিকল্পনা করেছেন।
"ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড" প্রকল্প কি শুধুই বাণিজ্যিক? নাকি এর অভ্যন্তরে রয়েছে রাজনীতির সূক্ষ
চক্র? ২০১৩
সালে চীনের নেতা শি জিনপিং প্রথম "সিল্ক রোড ইকোনোমিক বেল্ট"
ও "মেরিটাইম সিল্ক রোড"
নির্মানের উদ্যোগ ব্যক্ত করেছিলেন। মূলত
বানিজ্য বৃদ্ধি ও অবকাঠামো নির্মান হচ্ছে এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের মূল
লক্ষ্য। সড়কপথ, রেলপথ, পাইপলাইন, সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি অবকাঠামো তৈরী করে এশিয়া,
ইউরোপ, আফ্রিকা এ তিন মহাদেশের বিভিন্ন দেশে
যোগাযোগ ও সম্প্রীতি নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় চীন। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত
হলে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা অঞ্চলের মধ্যে যে অভূতপূর্ব বাণিজ্য বৃদ্ধি
পাবে তা সুনিশ্চিত। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় এর মাধ্যমে চীনের
বাণিজ্যের ছায়াতলে রাজনৈতিক প্রভাব কতটা বাড়বে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে চীন তার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করতে চায়। দক্ষিণ এশিয়ার নব্য উঠতি শক্তি ভারতের সাথে ইতোমধ্যে চীনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতাধীন ছয়টি করিডোরের মধ্যে অন্যতম দুইটি করিডোর দক্ষিণ এশিয়ায়। এর একটি চীনের কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ। অন্যটি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ হয়ে পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওয়াদার (সিপিইসি) পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ। এই সিপিইসি করিডোর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের গিলাটিন-বালাটিস্তান হয়ে খাইবার, পাখতুনখোয়া, পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তান প্রদেশের ভিতর দিয়ে গাওয়াদার সমুদ্রবন্দরে মিলিত হয়েছে।
আজাদ কাশ্মীর বিগত ৭০ বছর পাকিস্তান অধিকৃত হলেও ভারত দাবী করে এটা
তাদের ভূ-খন্ডের অংশ। আর প্রথম
থেকেই ভারতের আপত্তি এখানেই যে, সিপিইসি প্রকল্পটি এই আজাদ কাশ্মীরের উপর দিয়েই যাচ্ছে। গতবছর অনুষ্ঠিত ওআরওবি সম্মেলনে তাই ভারত যোগ দেয় নি। উপরন্তু ভারত চীনের এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের বিকল্প হিসেবে "ফ্রিডম করিডোর"
তৈরির ঘোষণা
দিয়েছে। আবার পাকিস্তানে নির্মিত চীনের সমুদ্রবন্দর গাওয়াদার এর পাল্টা জবাব
হিসেবে দেখা যায় ইরানে তৈরী ভারতের সমুদ্রবন্দর চাবাহার কে। এক্ষেত্রে এটা
স্পষ্টতই যে, এশিয়াতে ক্ষমতার প্রভাব বিস্তারে চীন ও
ভারত উভয়ই লড়াই করছে যদিও এইসব অর্থনৈতিক করিডোর ও সমুদ্রবন্দর কে বলা হচ্ছে শুধুই
বানিজ্যিক আধার।
অন্যদিকে চিনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পকে মার্কিন কেন্দ্রিক ট্রেডিং ব্যবস্থা "ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ" (টিপিপি) ও "দি ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ" (টিটিআইপি) এর বিপরীতে ধরা হচ্ছে যদিও ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প ধারনাটি সম্পূর্ণই চীনের একক। চীনের নেতা শি জিনপিং এ মেগা প্রকল্পকে ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিতে না দেখে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানালেও এটি নিয়ে সঙ্কায় আছেন চীনের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সব প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ। প্রসঙ্গত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড মেগাপ্রকল্পের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর
মধ্যে রয়েছে এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ও সিল্ক রোড তহবিল। এছাড়া সরকারী
ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বিভিন্ন বেসরকারী ব্যাংক এ
প্রকল্পে এগিয়ে আসবে। বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম দুই চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান ইতোমধ্যেই চীনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করা "এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) তে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানানোর পাশাপাশি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ওবিওআর সম্মেলনে অংশগ্রহন করেন নি।
এদিকে ফ্রেঞ্চ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল
রিলেশন্সের প্রধান এলাইস একমান বলেন, “দীর্ঘদিন যাবত্ চীনের এ প্রকল্পের ভূরাজনৈতিক
ফলাফল নিয়ে খতিয়ে দেখছে ইউরোপের দেশগুলো“। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ইউরোপের দেশগুলো লাভবান হবে,
বাণিজ্য অধিকতর প্রসার ঘটবে। কিন্তু
এসব অঞ্চল চীনের প্রভাব বলয়ে চলে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ। এবছরের
শুরুতেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রন এর চীন সফরকালে শি জিনপিং বলেন
যে,
ফ্রান্সের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পে যোগদানের মাধ্যমে ম্যাক্রনকে ইউরোপের
চালিকাশক্তির আসনে বসাতে চায় চীন। এখানে তার বক্তব্যে স্পষ্টতই চীনের অর্থনৈতিক
সম্রাজ্যবাদের আড়ালে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
By- Khalid Mahmud Akash
Department of International Relations
Jahangirnagar University.


No comments