চীন মার্কিন বহুমুখী সংঘাত
চীন মার্কিন বহুমুখী সংঘাত
![]() |
চীন |
স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্ব কার্যত সাত কিংবা আটটি বড় সভ্যতা এবং ১৯৫ টি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত। আদর্শিক মিল অমিল দ্বারাই এসব সভ্যতা এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে স্বার্থ চিহ্নিত হচ্ছে, বৈরীতা বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক নির্ণীত হচ্ছে।কতিপয় দার্শনিক এবং রাজনীতি বিশ্লেষক ধারণা করেছিল স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে রাজনীতি দ্বারা সৃষ্ট সংঘাতসমূহ দূরীভুত হবে এবং বিশ্ব আগের তুলনায় অনেক বেশী সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠবে। জনপ্রিয় এই ধারণাটি আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুওয়ামা ‘End of History ‘ নামে প্রচার করেছিলেন। রাজনৈতিক মহল এবং জাতিসংঘও আশাবাদী হয়ে ওঠে এবং ধরে নেয় দীর্ঘকালযাবত দ্বন্দ্বে লিপ্ত বড় বড় শক্তিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সম্প্রীতি স্থাপিত হবে। কিন্তু এই ভ্রম কাটতে বিশ্ববাসীর বেশী সময় লাগে নি। ক্রমেই উপসাগরীয় যুদ্ধ, আফগানস্থান সংকট, ইসরাইল ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব, সিরিয়া সংকট, আফ্রিকায় গৃহযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংকট, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের উত্থান, নিরাপত্তার অজুহাতে বিভিন্ন দেশে অযাচিতভাবে মার্কিনিদের হস্তক্ষেপ এবং সর্বশেষ চীন-ভারত কিংবা চীন-মার্কিন বৈরীতা বিশ্ববাসীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে শান্তি এবং বিশ্ব সম্প্রীতি নেহাতই কাল্পনিক এবং বিমূর্ত একটি ধারণা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীনের উত্থানঃ ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি। ১৮৭১ সালের পর থেকেই এর অর্থনীতি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নাজুক অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব নেতৃত্ব গ্রহনের পর বিশ্বজুড়ে মার্কিনীদের শক্তি ও আধিপত্য আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। সে তুলনায় বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে সুপারপাওয়ার হিসেবে চীনের উত্থান বেশ সাম্প্রতিক।
১৯৫০ এর দশকে চীনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর চীন সরকার নিজেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র হিসেবে পরিচিত করে। যদিও পরবর্তীতে এ সখ্যতা বজায় থাকে নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিভেদের ফলে চীন নিজেকে তৃতীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সোভিয়েত মার্কিন শক্তির খেলায় ভারসাম্য আনতে সচেষ্ট হয়। কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতালাভের পর চীনা প্রেসিডেন্ট মাও সে তুং চীনের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে শিল্পায়ন এবং সমবায়করণের লক্ষ্যে ‘গ্রেট লীপ ফরোয়ার্ড ‘ কর্মসূচি গ্রহণ করেন।কিন্তু এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় এক থেকে চার কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৭৬ সালে মাও সে তুং এর মৃত্যুর পর দেং জিয়াও পিং ক্ষমতালাভের দ্বিতীয় নতুন অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোডম্যাপ প্রণয়ন করেন। গত ৪০ বছরে চীন তাদের বাজার অর্থনীতিতে একের পর এক যুগান্তকারী সংস্কার ঘটিয়েছে। এর ফলাফল ছিল অভাবনীয়৷ ১৯৭৮ সালে চীনের মোট জিডিপি ছিল ১৫০০০ কোটি ডলার। ৪১ বছর পর বর্তমানে তা প্রায় ৮০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৯০ এর দশকের শুরুতে ফিলিপাইনে চীনা মানুষের সংখ্যা ছিল সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র এক ভাগ কিন্তু তারা ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের শতকরা ৩৫ ভাগ সম্পন্ন করত। আশি'র দশকে ইন্দোনেশিয়ায় ২-৩% চীনা ৭০ ভাগ বেসরকারী গার্হস্থ্য পুঁজির নিয়ন্ত্রণ করত। মালেশিয়ায় কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠি চীনা বংশোদ্ভুদ হলেও প্রায় সমগ্র অর্থনীতি তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। এভাবে জাপান ও কোরিয়া বাদে সমগ্র পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতি ক্রমেই চীন নির্ভর হয়ে পড়ে। চীনকে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জিডিপির দেশ হিসেবে ধরা হয়। লন্ডন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘Centre for Economic & Business Research' এর ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি ইনডেক্স থেকে জানা যায় -চীন ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তুত। বর্তমান বিশ্বের মোট সম্পদের ১০% চীনের দখলে। ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে বিশ্বের শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে চীন। অর্থনীতির সাথে পাল্লা দিয়ে মিলিটারী শক্তিরও অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে দেশটি।
অনেক রাজনীতি বিশ্লেষক চীনের আবির্ভাবকে ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে ওয়েলহেল মাইনের জার্মানির আবির্ভাবের সাথে তুলনা দিয়ে থাকেন। ইতিহাসে দেখা যায় যখনই কোনো বৃহৎ শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে তখনই বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেছে। পরাশক্তি হিসেব চীনের আবির্ভাবও এর ব্যতিক্রম নয়। এজন্যই স্যামুয়েল পি হান্টিংটন তার ‘Clash of Civilization' বইয়ে বলেছেন-বিশ্বরাজনীতির খেলায় চীন একটি নতুন খেলোয়ার আর এটি হবে সম্ভবত মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় খেলোয়ার।
চীন মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধঃ গ্রীক দার্শনিক থুসিডিডিস ২৫০০ বছর আগে রচিত তার ‘’History of Peloponnesian war' বইয়ে দেখান তৎকালীন উদীয়মান শক্তি এথেন্সের ক্ষমতার প্রতি আশঙ্কাগ্রস্থ হয়ে প্রতিষ্ঠিত শক্তি স্পার্টা কিভাবে যুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। এভাবে একটি উঠতি শক্তির প্রতিষ্ঠিত কোনো শক্তির জন্য হুমকি হয়ে ওঠার বিষয়টিকে বলা হয় ‘থুসিডিডিসের ফাঁদ'। সম্প্রতি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রাহাম এলিসন ‘Destined for war; Can America & China avoid the Thucydides trap' নামে একটি বই লিখেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন গত ৫০০ বছরে উদীয়মান কোনো শক্তির সাথে প্রতিষ্ঠিত শক্তির দ্বন্দ্বের প্রায় ১৬ টি উদাহরণ আছে যার মধ্যে ১২ টিই শেষ হয়েছে যুদ্ধের মাধ্যমে। শত শত বছর ধরে চলমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই ধারার সর্বশেষ সংযোজন চীন মার্কিন দ্বন্দ্ব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ট ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। তার মধ্যে অন্যতম হল চীনের প্রতি সংঘাতমূলক অবস্থান।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দিনের অভিযোগ চীন মার্কিন কোম্পানিগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি করছে এবং কোম্পানিগুলেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরে বাধ্য করছে। চীন প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর ৪০-৬০ কোটি ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে বলে ট্রাম্পের অভিযোগ। তবে তিনি দাবী করেন তিনি ক্ষমতায় আসার পর চীন থেকে শুল্কারোপের মাধ্যমে কয়েকশ কোটি ডলার পাচ্ছে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, চীন যেন বাণিজ্যনীতিতে পরিবর্তন আনে। আর দেশটি যেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও বেশি পণ্য কিনে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনে।
অপরদিকে চীনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সংঘাত শুরু করেছে। তবে তারাও জানিয়ে দিয়েছে, অর্থনীতিতে বৃহত্তর কাঠামোগত পরিবর্তন আনার ইচ্ছা এই মূহূর্তে তাদের নেই।
এরুপ পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা হয়। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ চীন থেকে আমদানি করা এলুমিনিয়ামে ১০% এবং স্টিলে ২৫% অতিরিক্ত শুল্কারোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।এর জবাবে চীন আমেরিকা থেকে আমদানি করা ১২৮ টি পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক বৃদ্ধি করে। ১৯ মে ২০১৮ বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে দুই দেশের মধ্যে খসড়া চুক্তি সাক্ষরিত হলেও তাতে কোনো ইতিবাচক ফলাফল লক্ষ্য করা যায়নি। বরং দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপ অব্যাহত থাকে।
নভেম্বরের শেষের দিকে জি-২০ সম্মেলনে দুই দেশের বৈঠকের মাধ্যমে জানানো হয় ৯০ দিন পর্যন্ত তাদের মধ্যে শুল্কারোপ স্থগিত থাকবে।যদি এর মধ্যে কোনো সমঝোতা না হয় তবে ২০% শুল্ক ধার্য করা হবে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আবারো তুঙ্গে ওঠে যখন ১ডিসেম্বর ২০১৮ চায়না মোবাইল কোম্পানী হুয়াওয়ের শীর্ষ নির্বাহী মেং ওয়াও ঝুকে গ্রেফতার করে যুক্তরাষ্ট্র।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হুয়াওয়ে ইরানের উপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ৫জি প্রযুক্তির যন্ত্রাংশ বিক্রি করেছে। এতে সত্যিকারভাবে দোষী প্রমাণিত হলে তার ত্রিশ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে চীনার এ্যাপল পণ্য বর্জন করে। ৫মে ২০১৯ যুক্তরাষ্ট্র চীনের ২০০০০ কোটি ডলার পণ্যের উপর ১০% থেকে বাড়িয়ে ২৫% শুল্কারোপের ঘোষণা দেয়। দুই দেশের মধ্যে বিরোধ মেটাতে উভয় পক্ষ পুনরায় ৯ মে ২০১৯ ওয়াশিংটনে বৈঠকে বসেন। কিন্তু কোন সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয় তাদের আলোচনা। ১৩ মে ২০১৯ যুক্তরাষ্ট্রের ৬০,০০০ কোটি ডলারের পণ্যের ওপর শুল্কারোপের ঘোষণা দেয় চীন। আর তা কার্যকর হয় ১ জুন ২০১৯ থেকে। ১৬মে ২০১৯ হুয়াওয়েকে অফিসিয়ালি কালো তালিকাভুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র।এর ৩দিন পর Google ঘোযণা দেয় তারা আর হুয়াওয়েকে এন্ড্রয়েড সেবা প্রদান করবে না। সর্বশেষ গত বছরের ৩১ জুলাই চীন থেকে আমদানি করা সব ধরনের পণ্যের উপর শুল্কারোপের ঘোষণা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমলেও দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্য কমেছে ১০ হাজার কোটি ডলারের। ট্রাম্পের এমন শুল্ক ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতির শিকার হয়েছে মার্কিন কৃষকরাই।কারণ চীনে মার্কিন কৃষিজাত রপ্তানি ২৫০০ কোটি ডলার থেকে নেমে ৭০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।যা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বনিম্ন। এই বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে ২০৩০ সাল নাগাদ মার্কিন উৎপাদন কমে যাবে ০.৩ শতাংশ। পরিবার প্রতি আয় কমবে ৫৮০ ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগও হ্রাস পেয়েছে ব্যাপক হারে। দেশটির রপ্তানির ২০ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে চীনা পণ্যের উপর ট্রাম্পের লাগামহীন শুল্কারোপে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনেক চীনা কোম্পানি। চীন মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে দুই দেশেরই প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। তবে এই বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব শুধু দেশ দুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও এটি এক বিশাল ধাক্কা। বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলো যেমন সিঙ্গাপুর, জাপান, ভারত, হংকং ও দক্ষিন কোরিয়াও অর্থনৈতিকভাবে বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
করোনা মহামারী এবং মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রাঃগত বছরের শেষের দিকে চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারী রুপ ধারণের পর চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। করোনা ভাইরাসের প্রভাব চীন পর্যন্ত যতদিন সীমাবদ্ধ ছিল ট্রাম্প ততদিন এ ব্যাপারে নির্বিকার ছিল এমনকি সঙ্কট সফলভাবে সামাল দেয়ার জন্য চীনা প্রেসিডেন্টের প্রশংসাও করেন ট্রাম্প। কিন্তু আমেরিকায় ব্যাপকভাবে করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর চীনকে আক্রমন করে একের পর এক তীর্যক মন্তব্য করা শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। [যদিও অনেক বিশেষজ্ঞ একে আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচারণা কৌশল বলে অভিহিত করেছেন তবে এমন বিতর্কিত প্রচারণা কৌশল তার নির্বাচনে কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।] মার্চের শুরুতে ১৩জন মার্কিন সাংবাদিককে চীন থেকে বহিষ্কার করার পর কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় ট্রাম্প প্রসাশন। করোনা ভাইরাসকে তিনি চীনা ভাইরাস বলে অভিহিত করেন। হোয়াইট হাউজের বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা পিটার নাবারো প্রচার করেন যে, “চীন করেনাভেইরাসে আক্রান্ত লাখ মানুষকে বিমানে উঠিয়ে সারা পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছে যাতে একটি প্যানডেমিক তৈরি হয়।“ এ কথায় প্রচণ্ড ক্ষেপে ওঠে চীন। উল্টো তারা দাবী করে মার্কিন সেনাদের মাধ্যমেই উহানে ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাস। চীন আমেরিকার মধ্যে চলমান এ বাগযুদ্ধ ক্রমশ বিপজ্জজনক চেহার নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার কারণে চলমান সঙ্কট শীতল যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মি. স্টোকসের মতে- চীন আমেরিকা সম্পর্ক গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে চীন-মার্কিন সংঘাতের প্রভাব এবং এর ভবিষ্যৎঃ হেজেমনিক পাওয়ার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশে এবং দেশের বাইরে মহামারী সঙ্কটে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই করোনা মহামারীতে এখন পর্যন্ত প্রায় এল লাখ ঊনত্রিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় চার কোটি মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। গত এক যুগে সবচেয়ে বেশী সংকুচিত হয়েছে তাদের অর্থনীতি। এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, বিশ্বব্যাপী করোনা প্রতিরোধে অসহযোগীতা এবং প্রসিডেন্ট ট্রাম্পের একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক বিশ্ব নেতৃবৃন্দসহ খোদ আমেরিকান নাগরিকরাই।
অন্যদিকে চীন ইতোমধ্যে মহামারীর ধাক্কা সামলে তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে তৎপর হয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশে করোনা মহামারী প্রতিরোধে তাদের সহযোগীতাও বিশ্বব্যাপী প্রসংশিত হয়েয়ে। চীনা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আলিবাবার কর্ণধার জ্যাক মা করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আরো ৫৪ টি দেশে মাস্ক, কীট এবং অন্যান্য ওষুধ সামগ্রী সরবরাহ করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষনে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্রমে সীমিত হয়ে আসছে এবং বৈশ্বিক অঙ্গনে চীনের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে অবস্থান আরো পাকাপোক্ত করতে এবং মৈত্রীজোট তৈরিতে চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্ট হয়তোবা তাদেরকে বাড়তি সুবিধা দিবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনি দূর্বল হয়ে পড়েছে কিংবা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের মোড়লপনার খুব দ্রতই ইতি ঘটছে এমনটা ভাবা মোটেও যুক্তিসঙ্গত হবে না। চীন মার্কিন দ্বন্দ্বের আরেকটি বড় প্রভাবক দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই টহল বাড়াচ্ছে । সেই সাথে দক্ষিণ চীন সাগরে অধিকার প্রতিষ্ঠায় ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানকেও ক্রমশ উসকে দিচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরের জলপথ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই জলপথে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মার্কিন নৌবাহিনীকে প্রায়ই সামরিক অস্ত্রে সুসজ্জিত নৌবহর নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায়।
হান্টিংটনের মতে এই দুই বৃহৎ সভ্যতার দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে তাদের মধ্যকার সংস্কৃতির পার্থক্য।আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্বানুসারে এটা কেবলই স্বার্থের লড়াই, বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। যেটাই হোক না কেনো এই সংঘাত যে আগামী মাস এবং বছরগুলোতে আরো গভীর এবং তীব্র হবে তা সহজেই অনুমেয়। মার্কিন সরকার যখন রাজনৈতিক, কৌশলগত ও সামরিক ক্ষেত্রে বিরোধ ও সংঘাত প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তারা একাধিক ফ্রন্টে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তবে বাণিজ্যক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীল হওয়াায় দুই দেশকেই অনেক হিসেব নিকাশ করে স্বার্থ বিবেচনায় সামনে এগুতে হবে।
আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প পুনরায় আসছেন কি না তার উপর চীনের সাথে মার্কিন সম্পর্ক অনেকটাই নির্ভর করবে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ট্রাম্প যেভাবে মার্কিনিদের মধ্যে চীন বিরোধী মনোভাব ঢুকিয়ে দিয়েছেন তাতে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও আমেরিকার চীন নীতিতে খুব একটা হেরফের হবে না।
পরিশেষে চীন-মার্কিন সংঘাত হয়তো বড় ধরনের বৈশ্বিক বিভেদ তৈরি করতে পারে। এটি হয়তো বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদলের ইঙ্গিত দিচ্ছে নতুবা রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করছে। ঠিক কোনটি ঘটবে তা সময়ই বলে দিবে।
লেখক-
এম জি আজম
শিক্ষার্থী, স্নাতক তৃতীয় বর্ষ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইলঃ azamsrj46@gmail.com


No comments