Header Ads

Header ADS

রহস্যে ঘেরা সভ্যতার আরেক নাম ইনকা

 

মাচুপিচু 


পৃথিবীতে যতোগুলো সভ্যতা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম অদ্ভুত এক সভ্যতা হলো ইনকা। ইনকা সভ্যতাকে এথনিক গ্রুপও বলা হয়।  প্রাচীন পৃথিবীর অনেক সভ্যতাই এখনো মানুষের কাছে রহস্য।  প্রত্মতাত্ত্বিকেরা নানা খনন কাজ চালিয়ে এগুলো আবিষ্কার করে। ইনকা সভ্যতা আবিষ্কার হয় ১৯১১ সালে আমেরিকার এক প্রত্মতাত্ত্বিকের মাধ্য্যমে। ইনকা সভ্যতার রাজধানী ছিলো কুস্কোতে যা বর্তমানে পেরুতে অবস্থিত। ইনকা সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিলো ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া, উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনা, উত্তর চিলি ও দক্ষিণ কলম্বিয়া। ইনকা সভ্যতা ১৪০০-১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে ছিলো। প্রাচীনকালের শক্তিশালী ও মেধাবী জাতি হিসেবে তারা পরিচিতি পায়। ইনকা সভ্যতার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর। আন্দিজ পর্বতমালার পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যে বিস্তার রয়েছে এ পর্বতমালাতেই ইনকাদের বসবাস। সুবিশাল সাম্রাজ্যে চলাচলের জন্য তারা তৈরি করেছিলো সড়ক পথ যা ইনকা ট্রেইল নামে পরিচিত। বিভিন্ন উপত্যকা ও দুর্গম গিড়ির মধ্য দিয়ে চলে গেছে ইনকা ট্রেইল। কোনো কোনো পথ ১৬০০০ ফুট পর্যন্ত উপরে।
 

নকা শাসকেরা ছিলো অভিজাত রাজকীয় বংশের। সাধারণত তাদের সম্রাটদের ইনকা নামে ডাকা হতো। পরবর্তীতে অবশ্য জানা যায় তাদের সাপা ইনকাও বলা হতো। রাজকীয় পরামর্শ সভার মাধ্যে এরা তাদের সাম্রাজ্য পরিচালনা করতো। উত্তরাধিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ পুত্রকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। সাধারণত বড় ছেলেকেই নির্বাচিত করা হতো। ইনকাদের সময় অভিজাতদের একটি কাউন্সিল ছিলো, অনেক সময় তারাও শাসনকার্যে সহায়তা করতো। ইনকার রাজ্য জয় করার পরে সে রাজ্যের সম্রাটদের মেরে ফেলতো না, যদি সে সম্রাট ইনকা আইন মেনে নিতো, বিদ্রোহ না করতো, কর দিতো আর শস্য ভান্ডার মজুদ রাখতো। ইনকা সমাজে কঠোর কর ব্যবস্থা ছিলো। মেয়েদের নির্দিষ্ট পরিমাণ কাপড় বুনতে হতো, পুরুষের খনিতে ও সেনাবাহিনীতে কাজ করতো।  জনগনকেও কর দিতে হতো। পরিশোধ করতে না পারলে রষ্ট্রের কাজ করে দেওয়ার মাধ্যমে শোধ করে দিতো। জনগণকে শষ্যের একাংশ মজুদের জন্য রেখে দিতে হতো। সাম্রাজ্যজুড়ে ছিলো স্টোর হাউজ। ৩-৭ বছরের খাবার মজুদ করে রেখে দিতে হতো।  

যেহেতু তারা আন্দিজ পর্বতমালায় থাকতো তাই তাদের চাষাবাদও হতো উপত্যকা ও পাহাড়ি ঢালে। মানব সভ্যতায় আলু ইনকাদেরই অবদান। আলু ও ভুট্টা প্রধান খাদ্য হলেও ওল, নীল-শ্যাওলা, কাচা মরিচ, সামুদ্রিক মাছ মাংস শুকিয়ে নোনা করে খেতো। গিনিপিগ ও লামার মাংসও খেতো। তাদের অত্যন্ত প্রিয় খাবার ছিলো “চিচা” যা পেরুতে এখনো জনপ্রিয়। ভূট্টা পিষে এই চিচা নামক পানীয় তৈরী করা হতো।

ইনকারা লামার উল দিয়ে পোশাক তৈরি করতো। সুতির কাপড়ও পড়তো। যারা সমাজে অভিজাত ছিলো তারা গলায় ধাতু ঝুলিয়ে রাখতো। পায়ে তারা স্যান্ডেল পড়তো, সেসময় মেয়েরা এক ধরণের শাল পড়তো যার নাম মানতাস।  ইনকারা যৌথ পরিবারে বসবাস করতো। পাথর ও ইট দিয়ে ঘর বানানো হতো। ইনকাদের নির্মাণশৈলী মনোরম। মিশরের ফিরাউনদের মতো তাদের সম্রাটও ডেমিগড মর্যাদার অধিকারী ছিলো। বিভিন্ন দুর্গ ও শহরের পাশাপাশি পুরো সাম্রাজ্য জুড়ে চৌদ্দ হাজার মাইল রাস্তা নির্মাণ করে। দেয়াল নির্মাণ করতে গিয়ে পাথর কাটাতে তারা কোনো আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিলো কি না তা জানা যায়নি। তাদের নিদর্শনগুলো রহস্য হয়ে থাকার কারণ হলো স্বর্ণ ও রৌপ্যের অত্যাধিক ব্যাবহার। স্বর্ণের প্রতি ইনকাদের আগ্রহের আরেকটি কারণ হলো তারা স্বর্ণকে সূর্যদেবের প্রতীক ভাবতো।  তাই মন্দিরগুলোতে তারা প্রচুর স্বর্ণ ব্যবহার করতো।

ইনকারা ছিলো প্রবল ধার্মিক, বহুদেবতায় বিশ্বাসী। তাদের প্রধান দেবতার নাম ভিরাকোরা যাকে ইনকাদের স্রষ্টা বলা হতো। ইনতি নামের আরেকজন দেবতা ছিলেন, ইনি ছিলেন সূর্যদেব। ইনকাদের মূলত বলা হয় সূর্যের সন্তান। উঁচু পাহাড়ের উপর তৈরি করতো উচু মঞ্চ, সমাজে পুরোহিতদের অনেক সম্মান দেওয়া হতো। বিশ বছর বয়সে সে সমাজে বিবাহ করার ব্যবস্থা ছিলো। সবচেয়ে সুন্দরী তরুণীকে পাঠানো হতো কুস্কোতে, যাকে সম্রাটের স্ত্রী হিসেবে মনোনীত করা হতো।

ইনকারা রক্তপিপাসু না হলেও তারা মোটামোটি নিষ্ঠুর ছিলো।  তারা নরবলী পছন্দ করতো। তাদের একটি অদ্ভুত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নাম হলো “কাপাকোচা”। এই অনুষ্ঠানে দেব-দেবীদের সন্তুষ্ট করার জন্য শিশুদের বলি দেওয়া হতো। সম্প্রতি কিছু শিশুদের মমী আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলো গবেষণা করে বোঝা গেছে বলির আগে কিভাবে শিশুদের মোটাতাজা করা হতো, কিভাবে রাখা হতো, পরিচর্যা করা হতো। গ্রামগুলো থেকে হঠাৎ সুদর্শন শিশুগুলো হারিয়ে যেতো। মূলত বলির জন্য এদের লুকিয়ে ফেলা হতো। আশেপাশের যেসব উপজাতিকে ইনকারা পরাজিত করতো তাদের দলপতির স্বাস্থ্যবান ও সুন্দর শিশুকেও অনেকসময় নির্বাচন করা হতো। বলির শিকার এমন তিন শিশুর দেহাবশেষের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। প্রথম দুজন মেয়ে, তাদের বয়স যথাক্রমে ১৫ ও ৬, তাছাড়া ৭ বছরের একটি ছেলে শিশু ছিলো।

বলির অনুষ্ঠান কুচকোতে হতো, তার পূর্বে ধর্মীয় মহাযজ্ঞ চলতো। শহরের সবাই সেখানে হাজির হতো। বাছাইকৃত তিন শিশু নাচ, গান আর বুদ্ধির খেলায় উত্তীর্ণ হল। উপস্থিত সবাই এদের কুর্নিশ করে সম্মান জানায়। মেয়েদের সাজানো হয় অতি মনোরম পোশাকে এবং মাথায় থাকে অলিভ গাছের পাতার মুকুট। এক মাস ধরে তাদের পরিচর্যা করা হতো, তাদের উৎকৃষ্ট খাবার খাওয়ানো হতো, চারদিক থেকে তাদের জন্য নানা উপহার সামগ্রী আসতো। ৭ বছরের ছেলেকেও সাজিয়ে রাজমুকুট পড়ানো হলো। সাথে সাথে সুন্দর ও বাহুবদ্ধ তরবারী ছিলো। কিজকোতে কাপাকোচা অনুষ্ঠান শেষ হবার পর তিন শিশুকে নিয়ে দূরে লুলাইমাকো পর্বতে যাত্রা করতো।

পর্বতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তাদের ঘিরে নানা রকম নৃত্য পরিবেশনা করা হতো।  সূর্যদেবতার উদ্দেশে প্রার্থনা শেষ করে শিশুদের “চিচা” নামক পানীয় খাওয়ানো হতো। এটি খাওয়ার পর মানুষের তীব্র ঘুম পয়ায়, তারপর তার আর কোনো জ্ঞান থাকে না। তাদের লুলাইমাকে পর্বতের গুহায় রেখে আসা হতো যেখানে তারা চিরনিদ্রায় শায়িত হলো।  ইনকারা বিশ্বাস করতো এই শিশুরা কখনো মারা যাবে না, তারা দেবদূত হয়ে ফিরে আসবে তাদের নিজস্ব বংশে  তাদের রক্ষা করতে।

                                  

বিস্ময়কর মাচুপিচু

পৃথিবীতে সবচেয়ে বিস্ময়কর স্থান হলো মাচুপিচু। ধারণা করা হয় ১৪৫০ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। স্প্যানিশরা ইনকাদের সব শহর ধ্বংস করলেও মাচুপিচুর সন্ধান পায়নি।  পেরু থেকে ৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে আন্দিজ পর্বতমালার কোরডিংয়েরা দে ভিল কাবাম্বা এলাকায় অবস্থিত এই মাচুপিচু। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শহরটির উচ্চতা প্রায় ২ হাজার ৪০০ মিটার বা ৭ হাজার ৮৭৫ ফিট। এতো উচুতে ইনকারা সেকালে কিভাবে জীবন যাপন করতো সেটা একটা বিস্ময়। এই মাচুপিচু শহরের নির্মাণ ইতিহাস প্রত্মতত্ত্ববিদেরা এখনো খুঁজে পাননি। এই মাচুপিচু  নির্মাণকালে এই ইনকাদের ছিলো স্বর্ণযুগ।  সেসময় ‘পাচাকুটেক ইনকা ইউপানকি’ ও ‘টুপাক ইনকা ইউপানকি’ রাজত্ব করছিলেন।  যেহেতু নির্মাণের ইতিহাস জানা যায়নি তাই এতো উচু স্থানে কেনো শহর নির্মাণ করা হয়েছিলো তা বোঝা যায় না, অনেকের তীর্থস্থান, অবকাশ যাপন কিংবা কয়েদখানা হিসেবে ব্যবহারের জন্যও বানানো হয়েছিলো।  এই মাচুপিচুতে ১৪০ টি মোট স্থাপনা রয়েছে। সিঁড়ি রয়েছে ১০০ টির বেশি।  উঁচু পর্বতে যেনো পানি প্রবাহ ভালোমতো হয় তাই রয়েছে প্রচুর ঝর্ণা যেগুলো পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিলো। সেগুলোকে আবার ছোটো খালের মাধ্যমে একটিকে আরেকটির সাথে যুক্ত করা হয়েছে।  সেচকাজ, কৃষিকাজের জন্য এভাবে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।

অতিরিক্ত লোকসমাগম মাচুপিচুর বেশ ক্ষতি করেছে। তাই গবেষকেরা এটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বন্ধ করার চিন্তাভাবনা করছেন। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো মাচুপিচুকে তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকার অন্তর্ভূক্ত করে। বর্তমানে এটি বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়ের মধ্যেও একটি।

স্প্যানিশরা ইনকা সাম্রাজ্য দখল করে নেয় ১৬০০ শতাব্দীতে। রাজধানী কোস্কো থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত মাচুপিচু শহর। এতো কাছে হওয়া সত্ত্বেও তারা সেসময় এ শহর সম্পর্কে ধারণা পায়নি। তবে একটি মতবাদ আছে যে, গুটিবসন্ত হয়ে এখানকার সব লোক মারা যায়। জন বিচ্ছিন্ন থাকায় শহরটি জঙ্গলে ভরে যায়। ১৯১১ সালে হিরাম বিংহাম এটি আবিষ্কারের পর মানুষ মাচুপিচু সম্পর্কে জানতে পারে।

ইনকা বংশের মতো সমজাতীয় মানুষ বর্তমানে সান সাবিস্তান, সান জেরিনিমো, কুস্কো, পেরুতে অবস্থান করছে।

রোনাল্ড এলওয়ার্ড বলেছেন যে, সমসাময়িক ইনকা আভিজাত্য পরিবারগুলোতে প্রাক কলম্বিয়ার সময় থেকেই একটি ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়।

ইনকা সভ্যতার অবদান

ইনকারা ছিলো অত্যন্ত সাহসী ও যুদ্ধবাজ জাতি, তাই তারা মাচুপিচুতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বসতি গড়তে পেরেছিলো। সিমেন্ট, বালু না শুধু পাথর কেটে একটি অন্যটির খাজে এমনভাবে স্থাপন করেছে যে, প্রবল ভূমিকম্পন এলাকায়ও ধ্বংস হয়নি। তাদের স্থাপত্য কৌশল ছিলো অনন্য।

তারা দেয়াল নির্মাণে আমূল পরিবর্তন আনে। খাদ্যবস্তু ও সংরক্ষণীয় বিদ্যায় তারা ছিলো পারদর্শী। সেচ ব্যবস্থায় তাদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। ঝর্ণার পানি প্রতিটি বাড়ির সামনে পৌছে দেয়ার জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছিলো। এভাবে কৃষিতেও তারা ব্যাপক উন্নতি করে। ইনকারা মুদ্রা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। মানব সভ্যতায় আলু ইনকাদের অবদান।

পরিশেষে কিছু কথা বলতে চাই, যেকোনো সাম্রাজ্য সমৃদ্ধ ও জনসংখ্যায় বিশাল হয়ে গেলে, সেই সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ইনকা রাজারা শেষদিকে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যায়। সেই সুযোগে স্প্যানিশরা বারবার আক্রমণ করে ক্রমশ দুর্বল করে দেয় তাদের। ১৫৩৩ সালে স্প্যানিশরা ইনকা সম্রাট আতাউল্পাকে পরাজিত ও হত্যা করে। তখন থেকেই ইনকারা হারিয়ে যেতে থাকে। ইনকাদের অনেক শেষ আশ্রয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই একটি জাতি, একটি সভ্যতা কালের সাথে সাথে ইতিহাস হয়ে যায়।


নিশাত তাসনিম

শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.