শক্তি ভারসাম্য (Balance of power) আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে কিভাবে এবং কেন প্রভাবিত করে?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রাজনৈতিক অংশ অধ্যায়ণ বা অনুধাবনে যে ধারণা বা কনসেপ্টটি বেশি উচ্চারিত হয়- তাহল শক্তি ভারসাম্য বা (Balance of Power)। শক্তি ভারসাম্য ধারণাটির সাধারণ সংজ্ঞা হতে পারে অসম শক্তির ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনয়ন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্কলাররা Balance of Power-এর বিভিন্ন ও বৈচিত্র্যময় সংজ্ঞা দিয়েছেন যা প্রায়শই সাধারণ পাঠক ও শিক্ষার্থীদের নিকট Balance of Power ধারনাটিকে অস্পষ্ট করে তুলেছে।
যদি বিশ্লেষণের ভাষায় বলি, শক্তি ভারসাম্য ধারণাটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শক্তির অসম বন্টণকে সমবন্টন পর্যায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কাজ করে।
প্রথাগত ভাষ্যমতে, শক্তি ভারসাম্য সাধারণত এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করে যেখানে রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে অন্যের দ্বারা শাসিত বা প্রভাবিত হবে না, বা ক্ষমতাশীলকে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেও দিবেনা।
কিন্তু ব্যবহারিক দিক দিয়ে, শক্তি ভারসাম্য ধারণাটি রাষ্ট্রগুলোর কিছু পলিসির কথা বলে যার প্রধান লক্ষ্যই থাকে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা। কেননা রাষ্ট্রেগুলো শক্তির অসম বা ভারসাম্যহীন অবস্থাকে নিজেদের স্বার্থ (ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে) এবং টিকে থাকার (দুর্বল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে) জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
- দক্ষ ও বিচক্ষণ (যেমনঃ জাপান, জার্মান) বা দুর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো (যেমনঃ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া) উভয়ই যখন তাদের সক্ষমতার মাধ্যমে শক্তি ভারসাম্য তৈরিতে সক্ষম না হন, তখন তারা অন্য প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সাথে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক জোটে (যেমনঃ ন্যাটো) যুক্ত হন। অথবা বিকল্প কোন পন্থা অবলম্বন করেন যাতে তাদের সম্ভাব্য হুমকি দানকারীর থেকে নিজের নিরাপত্তা বা স্বার্থ বা টিকে থাকা প্রভৃতির ক্ষেত্রে একটি স্থিতিশীল অবস্থা তৈরিতে সক্ষমতা হন।
রিয়ালিস্ট তাত্ত্বিকদের দৃষ্টিতে যেকোনো রাষ্ট্র তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কে হাসিল করতে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিবেন। কিন্তু, মজার ব্যাপার হল শক্তি ভারসাম্য ধারণাটি রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধির এই স্বাধীনচেতা মনোভাবে লাগাম টেনে দেয়। কেননা, এভাবে সামরিক শক্তির ধারাবাহিক বিকাশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্যকে বদলে নৈরাজ্য তৈরি করবে অর্থাৎ Balance of
Terror প্রতিষ্ঠা পাবে। যেমনঃ স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরাশক্তিদের মধ্যের অস্ত্রের আধুনিকায়ন একটি সন্ত্রস্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরি করেছিলো, ফলে শক্তির ভারসাম্য তৈরিতে নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ক বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মধ্যে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির আধুনিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেছেন প্রতিটি শক্তি ভারসাম্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত বা প্যাটার্ন ফলো করে থাকে। যথাঃ
- · আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বহুসংখ্যক রাষ্ট্রের উপস্থিতি থাকে;
- · আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নৈরাজ্যপূর্ণ এবং সেখানে কোন কেন্দ্রীয় সরকার নেই;
- · স্বাভাবিকভাবে সম্পদ ও সক্ষমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি অসম অবস্থা তৈরি করে;
- · সীমাবদ্ধ সম্পদের জন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এক নিরন্তর প্রতিযোগিতা ও বিরোধিতা চলে আসছে; এবং
- ·
আধিপত্যবাদী বা ক্ষমতাধরদের স্বার্থের জন্যই এই ভারসাম্য অবস্থা তৈরির প্রয়োজন পরে।
যদি কথাগুলোকে গুছিয়ে বলি তাহলে আন্তর্জাতিক অবস্থায় যে চিরস্থায়ী নৈরাজ্য (Anarchy) বিরাজমান এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার সম্পদ ও শক্তির যে অসম প্রতিযোগিতা তা রাষ্ট্রগুলোকে আন্তর্জাতিক সিস্টেমে একটি সমতার বিধান তৈরি করতে বাধ্য করে। এই ভারসাম্য অবস্থায় বৃহৎ বা ক্ষুদ্র সকল রাষ্ট্রের সাধারণ চাহিদা (common interest) অর্জিত হয় পাশাপাশি বহির শক্তির থেকে নিজেদের সার্বভৌমত্বও রক্ষিত হয়।
শক্তির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থায় মহাশক্তিধরেরা তাদের শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার দরুন এই ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ভুমিকা পালন করে। এছাড়াও নির্দিষ্ট একটি হেজেমনিক বা শক্তিধর রাষ্ট্র সিস্টেমের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিক সাহায্য, প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ (Public Goods), ও আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যকর ব্যবস্থায় দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে টিক্রত থাকার সামরিক সুরক্ষা প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়। যেমনঃ স্নায়ুযুদ্ধকালীন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোকে সামরিক সুরক্ষা দিয়েছে, বর্তমানে ইস্রাইল, জাপান, ফিলিপাইনকেও দিচ্ছে। এছাড়াও, হেজেমনিক শক্তি তার মতাদর্শ ও অনুশাসন ( Institutions) গুলোকে সিস্টেমের অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে একটি ভারসাম্য অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।
সর্বোপরি, যদিও প্রভাবশালী রাষ্ট্রটি সিস্টেম থেকে অনেক বেশী সুবিধা আদায় করে, তবুও এই সিস্টেমকে ধরে রাখতে শক্তি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব কিন্তু তারই পালন করতে হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনুধাবনের ক্ষেত্রে আরেকটি কনফিউজড বিষয় হল শক্তি ভারসাম্যের সাথে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বের সম্পর্কটি কেমন হবে তা নির্ণয়ে। মজার ব্যাপার হল এখানে যে রাজনৈতিক স্থায়িত্ব (Stability) শব্দটি চয়ন করা হয় সে নিজেই একটি বিতর্কিত ইস্যু। যেমনঃ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব দ্বারা অনেকে যুদ্ধ বা সংঘাতহীন একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশের কথা বলেন- কিন্তু এই স্থায়িত্ব দ্বারা আবার শক্তি বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রতিযোগিতাকেও বুঝায় যা পরোক্ষভাবে সংঘাতকে উস্কে দেয়। যেমনঃ স্নায়ুযুদ্ধ কালে একটা স্থিতিশীল অর্থাৎ যুদ্ধহীন অবস্থা থাকলে, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে অসম অস্ত্র তৈরি প্রতিযোগিতা, অন্যান্য দেশগুলোকে একটা নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
মহাশক্তিধরেরা শক্তি ভারসাম্য বজায় রাখার কিছু পদ্ধতি বা কৌশল ব্যবহার করেন। যথাঃ
·
ভাগের রাজনীতি (Divide & Rule)
·
ক্ষতিপূরণ প্রদান
·
নিরপেক্ষ বা বাফার জোন সৃষ্টি
·
অন্ত্রবৃদ্ধি ও নিরস্ত্রীকরণ
·
হস্তক্ষেপ
·
জোট গঠন ইত্যাদি।
অনেক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, শক্তি ভারসাম্য তত্ত্বের আলোকে বহুপাক্ষিক (Multipolar) বিশ্বব্যবস্থা থেকে একপাক্ষিক (Unipolar) বা দ্বিপাক্ষিক (Bipolar) আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে বেশি স্থিতিশীল বলেছেন। তাদের মতে বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থায় হুমকির প্রকৃত স্বরূপ মূল্যায়ন বা চিহ্নিত করা খুবই জটিল প্রক্রিয়া, এবং এই ব্যবস্থায় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপানো নীতিতে (Puss the buck) বিশ্বাস করে। অন্যদিকে দ্বিপাক্ষিক বিশ্বে দুইটি মহাশক্তি থাকে, এবং তারা প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার শক্তির প্রতিযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চায়। যেমনঃ স্নায়ুযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের এই প্রক্সির মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে চেষ্টা করেছে- ফলস্বরূপ প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে সমগ্র তৃতীয় বিশ্বে।
অতএব আমরা দেখতে পাই, শক্তি ভারসাম্য ধারণাটির বিভিন্ন বিচিত্র রূপ ও ব্যবহার রয়েছে। সাধারণ ভাষায় শক্তির সমতার কথা বলা হলেও, বৃহৎ শক্তিদের দৃষ্টিতে Balance of Power হল একটি স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যাতে তাদের স্বার্থগুলো খুব সহজে অর্জন হয়।
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়





No comments