Header Ads

Header ADS

সভ্যতার সংঘাত (Clash of Civilizations) ও ৯/১১ পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি

সভ্যতার সংঘাত (Clash of Civilizations) ও ৯/১১ পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি


  

গত শতাব্দীর একদম শেষের দিকে, অধ্যাপক সামুয়েল পি. হান্টিংটন, স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন ধারা-প্রকৃতির অনুধাবনে “স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর সভ্যতার সংঘাত” (Post-Cold War Clash of Civilizations) শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। গত শতকের সত্তরের দশক থেকেই কিভাবে এই ক্রমবর্ধীয়মান বিশ্বায়নের দুনিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধ (Values), আদর্শ (Norms) , এবং বিশ্বাস (Belief) এর পাশাপাশি সহবস্থান এক প্রকার অসম্ভব হয়ে উঠছে- তার উপর বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। ১৯৯৩ সালে সামুয়েল হান্টিংটন বিখ্যাত ফরেন এফেয়ার্স ম্যাগাজিনে “সভ্যতার সংঘাত” নিবন্ধটি প্রকাশ করেন, এবং খুব দ্রুতই লেখাটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। ফলে তার তিন বছর পরেই, অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে প্রবন্ধটিকে বই আকারে প্রকাশ করে তার ধারণাটিকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। 

১৯৫৭ সালে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা এক বক্তব্যে “সভ্যতাদ্বয়ের মধ্যে সংঘাত” শীর্ষক ধারনাটির উৎপত্তি ঘটে ব্রিটিশ প্রাচ্যবাদী বার্ণার্ড লিউসের হাত ধরে। লিউস এখানে ‘সভ্যতাদ্বয়’ বলতে ইসলামিক বিশ্ব এবং পশ্চিমা বিশ্বকে নির্দিষ্ট করেছেন, এবং এই উভয় বিশ্বের স্বকীয় মূল্যবোধের মধ্যে যে ভিন্নতা তা যে আবশ্যিকভাবে একটি বৃহৎ সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে তা বুঝাতে ‘সংঘাত’ শব্দটির চয়ন করেছেন। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধকালীন পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শিক দ্বন্দ্বের কাছে লিউসের এই সংঘর্ষের ধারণাটি তেমনভাবে উচ্চারিত হয়নি। 

যাইহোক, চারদশক পর লিউসের “সভ্যতাদ্বয়ের মধ্যে সংঘাত” ধারণাটিকে উন্মেষ ঘটাতে সামুয়েল হান্টিংটন “সভ্যতার সংঘাত” ধারনাটির অবতারণা করেন। সামুয়েল হান্টিংটন জোর দিয়ে বলেন যে যেহুতু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে স্নায়ুযুদ্ধের আদর্শিক দ্বন্দ্বের ইতি ঘটেছে, সেহেতু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হেজমনিক ক্ষমতার বিকাশকে চলমান রাখতে নতুন দ্বন্দ্ব হিসেবে মুসলিম বিশ্বের আদর্শ বনাম পশ্চিমা মূল্যবোধের বৈপরীত্বকে পুঁজি করে তাদের বৈদেশিক নীতিকে নতুনভাবে সংস্কার করেন। বার্নার্ড লিউসের বক্তব্যকে পুঁজি করেই হান্টিংটন বলেন, এই দুই বিশ্বের মধ্যকার মূল্যবোধ ও আদর্শগত যে পার্থক্য তা তাদের একত্র হতে বাধা প্রদান করবে, এবং সেক্ষেত্রে রাজনীতির বাহিরের যে নিরাপত্তা সঙ্কটগুলো রয়েছে যেমনঃ জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্রতা, লিংগ বৈষম্য ইত্যাদিকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।  

সাধারণত সমাজ বিজ্ঞানে কোন একটি ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞদের বর্ণনার মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত ধারনাটি খুব কম বিশেষজ্ঞদের কাছে বিতর্কিত সাব্যস্ত হয়েছে কারণ ধারনাটি অনেকাংশেই মৌলিক। এছাড়াও নীতি নির্ধারণ অনুধাবনের ক্ষেত্রে যে এই ধারনার যে প্রয়োজনয়ীতা রয়েছে তা হান্টিংটন ছাড়া কেউ হয়তো গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। যাইহোক, ৯/১১ ঘটনাটি হান্টিংটনের ধারণাকে আন্তর্জাতিক রূপ দান করে এবং বিশেষজ্ঞদের আলোচনা কেন্দ্র্বিন্দুতে পরিণত করে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে হান্টিংটনের তত্ত্বের বিকাশ ঘটে- অর্থাৎ মিডিয়াগুলো প্রচার করতে থাকে, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বে, এই ৯/১১ বিমান হামলাটি আসলে মুসলিম ও পশ্চিমা বিশ্বের মূল্যবোধ্যের যে পার্থক্য তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যান্তরে রিপাব্লিকান সমর্থিত নিউজ মিডিয়াগুলো ঘটনাটিকে মুসলিমরা কিভাবে পশ্চিমাদের আদর্শ ও মূল্যবোধকে আঘাত করছে বা করবে তার প্রাথমিক স্তর হিসেবে দেখিয়েছে। একধরণের মুসলিম বিদ্বেষী (ইস্লামোফোবিক) পরিবেশ যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে তৈরি করা হচ্ছিলো।  

কিন্তু রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে জুনিয়র বুশ বা বারাক ওবামাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে এই সন্ত্রাসী হামলার জন্য ইসলাম ধর্মকে নির্দিষ্ট করতে দেখা যায়নি। জুনিয়র বুশ আফগান যুদ্ধের সূচনায় তার ডকট্রিনে “ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” না বলে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” সামরিক নীতিটি গ্রহণ করেন। হামলার সপ্তাহ খানেকের মাথায় জুনিয়র বুশ বলেন, এই হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীরা   ইসলামের মৌলিক আদর্শ বহির্ভুত কাজ করেছে, ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে সন্ত্রাসী হামলা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাই আল-কায়েদাকে এমন ধর্মীয় অনুভূতিকে নিকৃষ্টভাবে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে তাদের সমূলে উৎখাত করতে হবে। কয়েক বছর পর বারাক ওবামা যখন মিশরের কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখছিলেন, তখন সাংবাদিকরা তাকে সভ্যতার সংঘাত ও মার্কিন মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে মুসলিম বনাম পশ্চিমা বিশ্বের মূল্যবোধের বৈষম্য বিষয়ক কোন সাংঘর্ষিক বিধান নেই। কিন্তু মজার বিষয় হল, মুসলিম বা আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামনে বুশ বা ওবামার এমন উদারনীতিক বক্তব্য থাকলেও, খোদ আমেরিকায় ফক্স নিউজ চ্যানেলের মত কিছু ডানপন্থী মিডিয়া ও কিছু ইভাঞ্জেলিক ক্রিশ্চিয়ান রাজনৈতিক নেতার কল্যাণে ইসলামিক আদর্শকে আমেরিকান মূল্যবোধের জন্য বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিলো, এবং এই দুই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটের হিসেব করতে থাকায়, এই অপপ্রচারে কোনরূপ বাধা দেয়ার সাহস পর্যন্ত করেন নি। অবশেষে ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি বললেন, “আমি মনে করি, ইসলাম আমাদের ঘৃণা করে……ইত্যাদি ইত্যাদি”। ফলে  ডোনাল্ড ট্রাম্প  দেশে চলা ইস্লামিক আদর্শ বিরোধী শিবিরকে আকৃষ্ট করলেন এবং দেশের ৪৫ তম রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন।  

হান্টিংটনের মতামতের সত্য বা মিথ্যা আসলে এই নিবন্ধ বা বইটির গুরুত্বকে বাড়িয়ে দেয়নি, বরং এই নিবন্ধটি জরুরী দুইটি প্রশ্নোত্তরের চেষ্টা করেছে। যথাঃ ১. স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর বিশ্বরাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে তার একটা রোডম্যাপ আমাদের দিচ্ছে, এবং ২. বিশ্বায়নকে ঘিরে যে নানা আশা-আকাংখা বা ভয়ের যে পেন্ডোরা বক্সটি রয়েছে তা খোলার খানিক চেষ্টা করেছে। এই দুটি দিক বাদে, হান্টিংটনের পশ্চিমা বনাম মুসলিম মূল্যবোধের সাংঘর্ষিক সহবস্থান কেন্দ্রিক আলোচনা আসলে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু তার মত একজন রিয়ালিস্ট একাডেমিক কেনই বা এমন খাপছাড়া ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করলেন? এর কারণ হতে পারে স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের জায়গায় নতুন কোন এক্টরকে শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, এবং এই নব গঠিত শত্রুকে রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে অনেক পরিবর্তন আনা। মজার ব্যাপার এবার সেই শত্রুটি হল “ইসলামিক মৌলবাদ” (Islamic Fundamentalism)।   

স্নায়ুযুদ্ধকালে, প্রায় ৫০ বছর, বিশ্বে দুই সেকুলার আদর্শের দ্বন্দ্বের দৌড় প্রতিযোগিতা দেখা যায়; যুক্তরাষ্ট্র উদার গণতন্ত্রকে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন গ্লোবাল কমিউনিজমকে পুঁজি করে একে অন্যের বিরোধীতা করতে থাকে। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি কমিউনিজমের রথকে থামিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র বলতে শুরু করে এই প্রতিযোগিতায় তাদের আদর্শের ব্যাপ্তী ও গ্রহণযোগ্যতার তুলনায় সোভিয়েতের অনেক ঘাটতি ছিলো, তাই সোভিয়েত প্রতিযোগিতা থেকে এমনিতেই ছিটকে পড়েছে, এবং এই পড়াটা খুবই স্বাভাবিক সোভিয়েতের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্যমতে, পশ্চিমা উদার গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন ও আর্থ-সামাজিক স্বাধীনতাই সোভিয়েতের এক-পেশিওয়ালা আধিপত্যবাদী চেতনা থেকে বিশ্ববাসীকে মুক্তি দিয়েছে।    

গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকেই আধুনিক বিশ্বায়নের ডালপালা মেলতে শুরু করে, আন্তরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ ও জানাশোনা ত্বরান্বিত হয়। বিশ্বায়ণ অনেক কিছুর সাথে ধর্মকেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিসীমায় পুনঃপ্রয়োগ ঘটায়। উল্লেখ্য, ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির মাধ্যমে সেকুলার রাজনৈতিক কাঠামো গঠনে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে ধর্মকে সরিয়ে নেয়া হয় বা একধরণের কোণঠাসা করে রাখা হয়। ত্রিশ বছরের যুদ্ধ, দুই মহাযুদ্ধ, শীতল যুদ্ধ এবং সোভিয়েতের পতন আবারো সেকুলার আদর্শকে পাশ কাটিয়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতি নির্ভর অন্ত ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠে, এবং স্বভাবতই ধর্ম- সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত।

যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলাটি আন্তর্জাতিক সংঘাতের ক্ষেত্রে ধর্ম ও সংস্কৃতি, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ার উচ্চারিত নতুন ধারণা “ইসলামিক মৌলবাদ” কীরূপ ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়। ইসলামিক মৌলবাদ ধারণাটির বিকাশ ঘটে মূলত আল-কায়েদা গ্রুপটাকে বুঝাতে কারণ তখন পর্যন্ত তারাই বিশ্বে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ- অর্থাৎ ইসলামিক আদর্শকে পুঁজি করেই তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমকেই পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞ ও নীতি নির্ধারকেরা হান্টিংটনের এই সংঘাত বলতে দুইটি সংস্কৃতির মধ্যকার সংঘাত হিসেবে নির্দিষ্ট করা শুরু করে। যথাঃ পশ্চিমা খ্রিস্টান সংস্কৃতি বনাম মুসলিম সংস্কৃতি, এক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্ব বলতে “গোরা মুসলিম বা ইসমালি মৌলবাদী” সংস্কৃতিকেই তারা বুঝিয়েছেন।  

অনেক বিশ্লেষকরা এটাও মনে করেন যে ৯/১১ ঘটনার অনেক আগে থেকেই ‘’সভ্যতার সংঘাত’’ ধারনাটি প্রতীয়মান হয়। উদাহরণ হিসেবে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর ইসলামিক উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর কথা তারা উল্লেখ্য করেছেন যারা ইসলামিক মৌলবাদী আদর্শ অনুসরণে সব কিছুর আমূল পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, ৯/১১ ঘটনাটিকে শুধু সংস্কৃতির দর্পনে ব্যাখ্যা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ধর্মের বৈরী রূপকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হান্টীংটনের অভিসন্দর্ভকে জীবিত করার প্রবণতাও কিন্তু সম্পূর্ণ গ্রহণ করা যায় না। অনেক বিশ্লেষক আন্তর্জাতিক সংঘাত গবেষণায় ধর্মকে গ্রহণ করলেও পশ্চিমা খ্রিস্টান বনাম ইসলাম এরূপ কোন সমীকরণ মানতেই নারাজ।  (সংক্ষেপিত)

  


মূল লেখকঃ 

জাফরি হাইনেস 

Huntington’s Clash of Civilizations’ Today: Response and Development

প্রকাশ কালঃ মে ০১, ২০১৮ 

নেয়া হয়েছেঃ e-ir.com সাইট থেকে 


অনুবাদকঃ

বদিরুজ্জামান

শিক্ষানবিশ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিক্রমা

Email: 03irshobuz@gmail.com

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.