নৈতিক অবক্ষয় ও আমাদের করণীয়
![]() |
| মূল্যবোধের অবক্ষয় |
নৈতিক অবক্ষয় ও আমাদের করণীয়
কোন ব্যক্তির মধ্যে এমন আচরণ যা অপরের প্রতি ক্ষমা, মার্জনা, উদারতা, বিনয়ী, ভদ্রতা, সঠিক আচরণ প্রদর্শন অর্থাৎ পূণ্যাবলীর সঠিক বিকাশ ও উৎকর্ষতা কে বলা হয় নৈতিকতা। যা সাধরণত ধর্ম, সামাজিক ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আবার বিশ্বজনীন কল্যাণকর বিষয়সমূহ ও নৈতিকতার আওতা ভুক্ত। বর্তমান সমাজে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতার মত সকল নৈতিক গুণাবলী দিন দিন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। যা জন্ম দিচ্ছে ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয়ের। প্রতিদিনের পত্রিকায় চোখ বুলাতেই এই অবক্ষয়ের শত শত উদাহরণ ভেসে ওঠে। স্বামী-স্ত্রী দ্বন্দ, হত্যা, পরকীয়া, অবৈধ প্রেমের জের ধরে পরস্পরকে হত্যা, নববধূ নির্যাতন, যৌতুকের জন্য পারিবারিক ভাঙন, শিশু নির্যাতন, মা-বাবার সন্তানের হাতে অথবা সন্তান মা বাবার হাতে খুন, জঘন্য ধর্ষণ, গণধর্ষণ,যার ভয়ালো থাবা থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা ৪ বছরের শিশুটিও ইত্যাদি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী (২০০৮-২০১৭) সাল পর্যন্ত ৪৩০৪ জন ধর্ষণ হয়। যেখানে একটি বড় অংক শিশুধর্ষণ। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাচ্ছে দুর্ণীতি। মাদকের ছড়াছড়িও সর্বত্র। তাহলে এই নেতিক অবক্ষয়ের নেপথ্যে কারণ গুলো আমাদেও অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখা উচিত।
অনৈতিকতার শুরুটা বলা যায় পরিবার থেকেই, ধীরে ধীরে তা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবার শিশুর প্রাথমিক শিক্ষালয়। একটি শিশুকে শেখানো নৈতিকতা তার চরিত্রে সহজে গেঁথে যায় ও কার্যকর ভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু বর্তমান পিতামাতা সন্তানদের প্রয়োজনীয় সময় দিচ্ছেনা ফলে শিশু তার পরিবারের এই প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বামী তার নিজ দ্বায়িত্বে অবহেলা করছে, এবং স্ত্রীও তেমনি করছে,ফলে বাড়ছে পরকীয়া, বাড়ছে পারিবারিক ভাঙন। সন্তানেরা হয়ে যাচ্ছে ছন্নছাড়া, বিচ্ছিন্ন ও হতাশাগ্রস্থ, জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে।
দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও বাড়ছেনা সুশিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার হার। পাঠ্যপুস্তক গুলোকে নানা ভাবে বিকৃত করায় নৈতিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুন্দর সম্পর্কগুলো ভেঙে যাচ্ছে বিপরীতে ছাত্র-শিক্ষক অনৈতিক সম্পর্ক হেডলাইন হচ্ছে পত্রিকাগুলোতে। পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে হরদম। এভাবে দুর্নীতির ট্রেনিং সহ, নীতিহীন শিক্ষায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেশের প্রতিভা।
আমাদের একটি বড় ঘাটতি হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষার অভাব। ধর্মবোধের প্রকৃত ভিত্তিই হলো নৈতিকতা। আজকের পিতামাতারা সন্তানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে যতটা চেষ্টারত তাতে ৫০% যদি ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় থাকতো তবে ছেলে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হতে হতো না, অথবা ধর্ষণের জন্য কাঁদতে হতোনা কিংবা চিন্তা করতে হতোনা সন্তানের মাদকাসক্ত হওয়া নিয়ে।
গ্রামে গঞ্জের আনাচ কানাচ থেকে শুরু করে সবোর্চ্চ বিদ্যাপীট বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আজ মাদকের ছড়াছড়ি। যার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে মাদকাসক্তরা যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন অনৈতিক কাজের সাথে। এমনকি সন্তানরা তাদের পিতামাতাকেও হত্যা করতে কুন্ঠাবোধ করছে না। আমি অবাক আর হতাশ হই যখন আমার গ্রামের ছোট ছেলেটিও নেশাগ্রস্থ হয়ে পঢ়ে থাকে ধান ক্ষেতে। ব্যাথিত হই তখন যখন উচ্চ বিদ্যাপীঠ গুলোতে ৩০% ছেলে ৫০% মেয়ে মাদকাসক্তের সাথে জড়িত। গবেষণা করে নতুন কিছু উদ্ভাবনের পরিবর্তে যে মেধা নিয়ে আলোকিত আঙিনায় আসে, সেখান থেকে বের হয় রিক্ত মেধায়, শূণ্য হস্তে।
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে দেশ এগিয়ে যচ্ছে আধুনিকতায়। কিন্তু অপব্যবহারে নৈতিকতায় পিছিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে অধিকহারে। বিদেশী অপসাংস্কৃতি গুলো খুব সহজেই পৌছে যাচ্ছে মানুষের দ্বোরগোড়ায়। আধুনিকতার নামে বাড়ছে উচ্ছৃঙ্খলতা, অশালীনতা, নোংরামী, ব্লাকমেইল, পর্ণো ছবি বিস্তার হচ্ছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল গুলো এমন ভাবে সিরিয়াল গুলো প্রচার করছে যে গুলোতে মায়েরা ছেলে মেয়েদের নিয়ম ও বিষয় ধরে টিভি দেখানো তো দূরে থাক নিজেরাই আসক্ত হয়ে পড়ছে অত্যন্ত প্রবল ভাবে। তাদের দ্বায়িত্বে অবহেলা হচ্ছে এবং সেগুলো অনুসরণে পারিবারিক দ্বন্দ, পরকীয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য আর কি লাগে? যখন একটি দেশের মায়েরা সুকৌশলে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
প্রশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে দূণীতির ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। হতাশাগ্রস্থ হচ্ছে, যুবসমাজ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, লিপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে। এভাবে দেখা যাচ্ছে এ্কটি অনৈতিক কাজকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে হাজারো অনৈতিকতা। কুলুষিত হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক পারিবারিক ও রাজনৈতিক প্রতিটি ব্যবস্থা।
আমাদের দেশের ৯০% মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ইসলাম তো শুধু একটি ধর্মের নাম নয় এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যেখানে ব্যক্তি থেকে আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে নির্দেশনা দেওয়া আছে সুস্পষ্ট ভাবে। কিন্তু আপসোস দেশের ৪০% মুসলিমরাও আজ ধর্ম কে জীবন বিধান হিসেবে নিতে পারিনি।
যে ধর্মগ্রন্থের স্পষ্টবাণী,‘ মুমনিদের বলুন, তারা যেন দৃষ্টিকে নত রাখে, লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য পবিত্রতা আছে। নিশ্চই তারা যা করে আল্লাহ তা সম্পর্কে অবহিত। আর হে নবী মুমিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদেও দৃষ্টিকে সংযত রাখে, এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোকে হেফাজত করে, তাদেও অঙ্গসজ্জা না দেখায়। যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া। (সূরা নূর)
তাহলে এই দেশে কেন ধর্ষণ আর ব্যাভিচারের এই ভয়াবহ অবস্থা।
‘রাসূল সা. বলেন, প্রত্যেক নেশাযাতীয় দ্রব্য আর যাবতীয় মদই হারাম’
অথচ দেশব্যাপী কিভাবে এই মাদকাশক্তির বিস্তার?
“একজন মুমিনের সমীচিন নয় অন্য মুমিনকে হত্যা করা। কেউ করলে তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে চিরদিন থাকবে। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রদ্ধ হয়েছেন, অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। ( সূরা আন নিসা)
‘একজন কে হত্যা করা মানেই পুরো মানব জাতিকে হত্যা করা’ ( হযরত মুহাম্মদ সা.)
তাহলে দেশ জুড়ে কেন এত হত্যাকান্ড?
এভাবে ইসলাম অত্যন্ত সুন্দরভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। অভাব শুধু আমাদের অনুসরণ করার। যাইহোক, শুধু ইসলাম একাই নয়, বাকী মূলধারার ধর্মগুলোর আবির্ভাব হয়েছে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করে, একটি শান্তি- শৃঙ্খলা পূর্ণ সমাজ গঠনে।
আমি মনে করি, এই ভেঙে পড়া সমাজে অবক্ষয় রোধ করতে নিচের কাজগুলো অবশ্যয়ই করতে হবে। যথাঃ
আমাদের পারিবারিক সচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে।পরিবারের সকল সদস্যদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে হবে। চাকরীর পাশাপাশি সন্তানদের সময় দিতে হবে।
ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। ধর্মীয় বিধানকে বোঝা নয় বরং সত্য, নিরাপত্তা, সুন্দর ও শৃঙ্খল জীবনের হাতিয়ার হিসেবে নিতে হবে। প্রতিটি ধর্মই নীতি ও সততার শিক্ষা দেয়।
মাদকাশক্তির বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
সামাজিক ও ধর্মবিরোধী অপসংস্কৃতি চর্চা বন্ধ করতে হবে।
সুস্থ বিনোদন গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে।
তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে সরকারি তদারকী ও পারিবারিক নজরদারি থাকতে হবে।
সর্বোপরি শিক্ষিত সমাজকেই সচেতন হতে হবে। সুশিক্ষা ও নৈতিকতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে অসুস্থ সমাজকে ভেঙ্গে ফেলে নতুন সমাজ গড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে।
রক্তের দামে কেনা মাতৃভূমির আচ্ছাদিত হোক নৈতিকতার ছায়ায়। একটি, দুর্নীতি মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখে হাজারো চিন্তাশীল নিবেদিত প্রাণ।
সাদয়িা আক্তার
আন্তর্জাতকি সম্পর্ক বভিাগ, ৪৫ তম আবর্তন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


No comments