মধ্যপ্রাচ্যের পানি সংকট | পানি কেন্দ্রিক রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ
"Whoever controls the river, controls the land" - Middle Eastern Proverb
![]() |
| Middle East |
পানি কি শুধুই খাবার পানীয়? নাকি এটি প্রাকৃতিক সম্পদ, যুদ্ধের অস্ত্র; এমনকি রাজনীতি-কূটনীতির টুলস ও হতে পারে?পারে! অঞ্চলভেদে পানির পরিমাণ, উপযোগ, সংকট এবং পানির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বদলে দিতে পারে পানির উপযোগ। তৈরি করতে পারে সংঘাত ও যুদ্ধের। এমনকি সেটা ছড়িয়ে যেতে পারে একদেশ থেকে অন্যদেশে, বৃহৎ একটি অঞ্চলে।স্পেশালি- সেটা যদি হয় মরু অঞ্চলে, সেক্ষেত্রে পানি শুধু দৈনন্দিন ব্যবহারের বস্তুই নয়, বরং আস্ত একটা রাজনৈতিক টুল!
ঐতিহাসিক টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস রিভার কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল প্রাচীনতম মানবসভ্যতা মেসোপোটেমিয়া। যার অধিকাংশই পড়েছে মর্ডান ডে ইরাকে, বাকিটা সিরিয়া এবং কুয়েতে। ইরাকের বসরা অঞ্চলের নিম্নাংশে এই দুই নদীর মিলিত স্রোতধারা একত্র হয়ে তৈরি করেছে 'Shatt al arab' নামক বৃহৎ জলাশয়। এই শাত-ইল-আরব কে কেন্দ্র করে বহুদিন ধরে ইরান-ইরাক বিবাদ চলছে। শাত ইল আরবের পশ্চিমে ইরাক-কুয়েত জলসীমায় খোর আবদুল্লাহ নিয়েও রয়েছে বিবাদ, যার কারণে সাদ্দাম হুসেইন কুয়েত দখল করে নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে,পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নদ নীলনদ এর দান হচ্ছে মিসর। এই মিসরেও বর্তমানে নীলনদে বাঁধ দেওয়াকে কেন্দ্র করে চলছে সংঘর্ষ। সৌদি আরবের বড় বড় কৃত্রিম লেকগুলোও শুকিয়ে এসেছে, সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধে শুকিয়ে গেছে সিরিয়ার শতাধিক হৃদ ও বড় জলাশয়। এ থেকে মোটামুটি ধারণা করা যায়- মরু অঞ্চলে পানির সল্পতা, নদ-নদীর গুরুত্ব এবং জলাশয় কেন্দ্রিক রাজনীতি। প্রিয় পাঠক, আজকের আলোচনার বিষয় মধ্যপ্রাচ্যের নদ-নদী তথা পানি কেন্দ্রিক রাজনীতি ও সংঘর্ষের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ।
মধ্যপ্রাচ্য নামকরণের ইতিহাসঃ
ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য বলতে আমরা বুঝি পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার কিছু দেশের সমষ্টি। যার পুরোটাই মরু অঞ্চল। এই অঞ্চলের অধিকাংশই আরব জাতিভুক্ত; তবে নন-আরব কিছু দেশও এর মাঝে রয়েছে।বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্য প্রথমবারের মতো আন্তজার্তিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বিবেচিত হয়।
"Middle East" শব্দটি ১৯০২ সালে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন আমেরিকান নেভাল স্ট্র্যাটেজিস্ট এডমিরাল আলফ্রেড থ্যায়ার মাহান৷ মূলত তৎকালীন ভারত, ইউরোপ এবং অটোম্যান সাম্রাজ্য কে আলাদা করতেই তিনি এই শব্দটি প্রথমবার ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ আর্মি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এ অঞ্চলকে নিয়ে আলাদা একটি "মিডেল ইস্ট কমান্ড" গঠন করে। এছাড়াও, সোভিয়েতরা এই অঞ্চলের নাম দিয়েছিলো 'সেন্ট্রাল ইস্ট' এবং 'নিয়ার ইস্ট' (Central East and Near East) নামে। ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যপ্রাচ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলো, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক শাসকই সোভিয়েতপন্থী রাজনীতি করতেন।
মধ্যপ্রাচ্যের পানি সমস্যা
মধ্যপ্রাচ্য একটি মরু অঞ্চল, তীব্র দাবদাহ ও রুক্ষ পরিবেশের জন্য খুব বেশি গাছপালা জন্মায় না। যার ফলে এ অঞ্চলে দিনদিন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।MENA এর মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা। সারা বিশ্বের ৭% মানুষের বসবাস এই অঞ্চলে, অথচ জাতিসংঘ ঘোষিত মধ্যপ্রাচ্যের ১৭টি দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পানিশূন্যতায় ভুগছে। যার ফলে এই অঞ্চলের মানুষদের মাঝে রোগের প্রকোপও বাড়ছে দিনদিন। মধ্যপ্রাচ্যের নানা ইতিহাসে জড়িয়ে আছে এই পানি ও নদী। প্রাচীনতম সভ্যতা মেসোপোটেমিয়া থেকে শুরু করে।
সালাউদ্দিন আইয়ুবী (রাঃ) এর জেরুজালেম জয়ের সাক্ষী টাইবেরিয়া লেক কিংবা কারবালার ময়দানে ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক ফোরাত নদীর পানি খেতে না দেয়ার মত বর্বরতা- সবকিছুতেই যেন জড়িয়ে আছে পানির নাম। অথচ, ইদানীংকালে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে এইসব ঐতিহাসিক অনেক জায়গাই আজ শুধুই শুষ্ক এক উদ্যানে পরিণত হয়েছে।
ইরান
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় হ্রদের নাম "লেক উর্মিয়া"। এটি উত্তর-পশ্চিম ইরানের তুর্কি-ইরাক সীমান্ত লাগোয়া এলায় অবস্থিত।
![]() |
| লেক উর্মিয়া |
আশির দশকের ইরাক-ইরান যুদ্ধের কারণে লেকটির ভয়াবহ ক্ষতি হয়। অসংখ্য লাশ, অস্ত্র ও রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র এই লেকে ফেলার কারণে লেকের পানি বিষাক্ত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন এলাকায় মাছ ও জলজ প্রাণী মরে ভেসে ওঠে। এই ঘটনার পর থেকেই লেকটির আয়তন ও পানির পরিমান কমতে শুরু করে। ১৯৯০ সালে জরিপ অনুযায়ীও এটিই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম হ্রদ, কিন্ত তা আজ আর নেই৷
ইরান শিল্পায়নের জন্য লেকটিতে দেড়শো'রও অধিক বাঁধ দিয়েছে এবং যত্রতত্র পানির গতিবিধি আটকে দিয়েছে যার ফলে লেকের আয়তন বছরের পর বছর ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। আগে লেকটিতে ফেরী ও লঞ্চ চলাচল করতো এবং লেকের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রত্যন্ত দ্বীপে মানুষের বসবাস ছিলো। কিন্ত পানির স্তর হ্রাস পাওয়ায় বিভিন্ন দ্বীপ এখন সম্পূর্ণ উদ্যানে পরিণত হয়েছে। ফেরী চলাচল অনেকাংশেই কমে গেছে, পর্যটন ব্যবসায়ও ধ্বস নেমেছে। ক্রমাগত খরা, বৃষ্টিপাতহীনতা, অধিক পানির ব্যবহার লেকটির আয়তন অর্ধেক করে তুলেছে দু'দশকের মাঝেই।
এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে ইরান পানি সংকটে পড়তে পারে এমন আশংকা বিশেষজ্ঞদের। ইরানের জন্য আগামীর এই সংকটে পানি একটি যুদ্ধ ও সংঘাতের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র- ইরাক ও তুর্কি সীমান্তে ইরান বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়েছে, যার ফলে পানি সংকট শুধুমাত্র ইরানের একার সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না, বরং এটি একটি আঞ্চলিক ও বৃহৎ সংকটে রূপ নিতে পারে।
ইরাক
ইরাকের পানির মূল উৎস টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদী। এই ঐতিহাসিক নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিলো বিখ্যাত মেসোপোটেমিয়ান সভ্যতা। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই দুই নদীর একটিরও সূচনা ইরাকে নয়, দুটোর উৎপত্তিই তুর্কি থেকে। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী তুরস্ক থেকে সিরিয়া হয়ে ইরাকে প্রবেশ করেছে। যার ফলে নদীদুটির মূল স্রোত, গভীরতা ও পানির প্রবাহ ইরাকে এসে অনেকাংশেই কমে গেছে।
ইরাকের জাতীয় তথ্য মতে, "ইরাকের পানির ৭১% নিয়ন্ত্রণ করে তুর্কি, ৬% ইরান এবং ৪% সিরিয়া।" এ থেকে খুব সহজেই বোঝা যায়, ইরাক তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপর পানির জন্যে কতটা নির্ভরশীল। ৮১% পানি পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আসলেও, এই সম্পূর্ণ পানির উৎস কিন্তু- এই দুটো নদীই।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তুর্কি ইউফ্রেটিস নদীতে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২০টি স্থানে বাঁধ দিয়েছে। সর্বশেষ 'The Ataturk Dam' যা কিনা পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম বাঁধ।এর ফলে ইউফ্রেটিসের পানি প্রবাহ সিরিয়ায় এসেই অর্ধেকে নেমে গেছে। সিরিয়ান কর্তৃপক্ষ একই নদীতে প্রায় এক ডজন বাঁধ নির্মাণ করে ইউফ্রেটিস নদীকে মরা গাঙে রূপান্তর করেছে।
যার ফলে, ইরাকে ইউফ্রেটিস নদী প্রবেশ করলেও- তার পানি নেই বললেই চলে। ইরাকের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে নদীটি প্রবেশ করে মৌসুল শহরে এসেই মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। অথচ, বসরায়- টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের মিলিত স্রোতধারা কে বলা হতো "The venice of the middle east"
অন্যদিকে, টাইগ্রিস নদীতেও তুর্কি এক ডজন বাঁধ নির্মাণ করেছে। সর্বশেষ নির্মিত ''ILlSU Dam' এর কাজ শেষ হয় ২০১৮ সালে। টাইগ্রিস নদীর উপনদী এবং শাখানদী গুলো ইরানে অবস্থিত, ইরান এই নদীগুলোতে ৬০০'র অধিক বাঁধ নির্মাণ করেছে- যার ফলে, টাইগ্রিসের শাখানদীগুলোর পানি ইরাকে প্রবেশ করেনা বললেই চলে।
অন্যদিকে, টাইগ্রিস নদীর পানিও তুর্কি থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কমে এসেছে। ইরাকের বাগদাদে এসে টাইগ্রিসের পানির গভীরতা এতোটাই কমে গেছে যে- মানুষ চাইলে টাইগ্রিস নদী হেঁটেও পার করতে পারবে।
কিন্ত এই অবস্থার জন্য দায়ী কারা? শুধুই কি পার্শ্ববর্তী দেশের বাঁধ নির্মাণ, নাকি অন্য কিছু? বিগত ৪০ বছরে ইরাক- ভয়াবহ ৩টি যুদ্ধ ও প্রচুর রাজনৈতিক অস্থিতিশীল সময় পার করেছে।
১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাক কুয়েত দখল করার চেষ্টা করে। স্নায়ুযুদ্ধের শেষের সময়ে ইরাকের এই যুদ্ধেহী মনোভাবে কেউ সাড়া দেয়নি, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা ও বিমান হামলা করে ইরাকি বাহিনী কে খেদিয়ে দেয়। কিন্তু শুধু যে যুদ্ধে ইরাকের সেনাদের ক্ষতিই হয়, তা নয়। ৬টি হাইড্রো-ইলেক্ট্রিক রিভার ড্যামের ৪টিই ধ্বংস হয়ে যায় যুদ্ধে। ইউএন সিকিউরিটি কাউন্সিল এই ভয়াবহ অবস্থাকে "Pre-industrial age'' এর সাথে তুলনা করে সতর্কতা জারি করে। তৎকালীন সময়ে
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ইরাকের এই সংকট যে আগামীতে আরো ভয়ানক আকার ধারণ করবে, সে বিষয়ে বেশ কয়েকটি থিসিস প্রকাশ করে। কিন্তু সাদ্দাম প্রশাসন তেমন একটা গুরত্ব দিয়ে দেখেনি কিছুই।
৯৩' সালে সাদ্দাম বসরার শাত আল আরব অঞ্চলে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন, এবং টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে অংশটুকু বনাঞ্চল ছিলো, তা ধ্বংস করে দেন। দুই নদীর মধ্যবর্তী এই অঞ্চলটুকুই ইরাকের একমাত্র বনাঞ্চল এবং জলাভূমি। এছাড়া সম্পূর্ণ ইরাক কেবলই মরুভূমি। সাদ্দামের ভুল সিদ্ধান্তে, পানি প্রবাহ বিঘ্নিত হয় এবং নদী শুকিয়ে যায়। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ ছিলো যে, ১২০০ মানুষ শুধুমাত্র পানিবাহিত রোগে ভুগেই মারা যায়। এবং প্রায় ৫০হাজার মানুষ অঞ্চলটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধ বলতে যা বোঝায়, তা সবাই জানেন। ২০০৩ সালে আমেরিকা অন্যায়ভাবে ইরাক দখল করে এবং ইরাকের ওপর এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ, সাদ্দাম ও গোঁড়া ধর্মীয় জনগোষ্ঠী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। ব্রিজ, কালভার্ট, ওয়াটার ফ্যাসিলিটি, সুয়েজ সিস্টেম অসংখ্য ইনফাস্ট্রাকচার ভাঙতে থাকে।
২০০৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী- ৪০% ইরাকি নিরাপদ পানির সংকটে ভুগছেন এবং ৭০% মানুষের নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে।
আমেরিকা যদিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো ২৩ মিলিয়ন মানুষের জন্য পানির ব্যবস্থা করবে, কিন্তু তা আদৌ আলোর মুখ দেখেনি.
২০০১ সালে ইরাকে শুরু হয় নতুন রাজনৈতিক সংকট। আইএসের উত্থানে ইরাকের সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। সেনাবাহিনী যুদ্ধ না করে আইএস কে গ্রহণ করে নেয়, স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু এতে সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি।
আইএস ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় শহর, বিশেষ করে মৌসুল দখল করে, রামাদী শহরের ড্যাম দখলে রাখে। এতে করে দক্ষিণাঞ্চলের সকল মানুষ পানির অভাবে জিম্মি হয়ে যায়।
আইএস খুব দক্ষতার সাথেই পানিকে অস্ত্রের মত ব্যবহার করেছে। রামাদি, ফেলুউজা ইত্যাদি শহর দখল করে, রামাদির ড্যাম কে নিয়ন্ত্রণ করে- অন্যান্য অঞ্চলকেও আইএসের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করেছে। পানিহীন অঞ্চলে, পানিই যেহেতু অস্ত্র; তাই আইএসের এই ট্যাকটিক্স তাদের অবস্থান শক্ত করতে কাজে লেগেছে।
অন্যদিকে, আইএস টিকরিট শহরের ওয়াটার ফ্যাসিলিটিকে বিষাক্ত ক্যামিকেল দিয়ে দূষিত করে দেয়। এতে আশেপাশের সকল সরকার নিয়ন্ত্রিত শহর ও রাজ্যগুলো নিরাপদ পানির সংকটে পড়ে। যার ফলে ইরাক সরকারের আইএস কে নুন্যতম বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতাও লোপ পায়।
ইরাকের বর্তমান অবস্থাঃ
এতদিনের যুদ্ধ, রাজনৈতিক সংকট এবং নানা সমস্যায় ইরাকের নিরাপদ পানির সাপ্লাই অনেকাংশেই ব্যাহত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অসংখ্য বাঁধ ও ওয়াটার ফ্যাসিলিটি, দুষিত হয়েছে নদী। কিন্তু ২০১৮ সালে, ইরাক সরকার সবকিছুর আমূল পরিবর্তন আনতে ১০০ বিলিয়ন ডলারের একটি মেগা প্রজেক্ট হাতে নেয়। এর মূল থিম ছিলো- উত্তর থেকে দক্ষিণের শাত আল আরব পর্যন্ত পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, নদীতে ড্রেজিং করা এবং দুষিত পানি রিসাইকেল করা।
কিন্তু প্রজেক্টটি আলোর মুখ দেখার আগেই পানির তীব্র সংকট দেখা দেয় দক্ষিণের বসরা অঞ্চলে। পানির জন্যে দাঙ্গা শুরু হয়, প্রায় একশো মানুষ দাঙ্গায় নিহত হয়। আহত হয় আরো বেশ কয়েকশো। আটক করা হয় প্রায় ৬শতাধিক নাগরিককে। অথচ, পানি যে কোন দেশেই মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দক্ষিণের জনগোষ্ঠীরা অসংখ্য সরকারি অফিস ও কার্যালয় ধ্বংস করে দেয় এবং পানির জন্যে ইরাকে প্রায় আরেকটি গৃহযুদ্ধ লাগার উপক্রম হয়েছিলো।
এই লক্ষনগুলোই বলে দেয়-
আগামীর দিনগুলোতে ইরাক যে ভয়াবহ পানির সংকটে পড়তে যাচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
জর্ডান
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শুষ্ক দেশ জর্ডান। দেশটিকে পানি সল্পতা এতোটাই কমে গিয়েছে যে- এক গবেষণায় দেখা গেছে, জর্ডানের কিছু কিছু অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এক বছরে ১মিটারেরও বেশি নিচে নেমে গেছে। যার ফলে দেশব্যাপী পানিশুন্যতা মহামারী আকার ধারণ করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বেশকিছু আঞ্চলিক সমস্যা। যেমনঃ
১. পার্শ্ববর্তী দেশ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং অতিরিক্ত পরিমাণে সিরিয়ান শরনার্থীর জর্ডানে প্রবেশ। সিরিয়ার যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে, যার ফলে লাখো সিরিয়ান নাগরিক পার্শ্ববর্তী দেশে ছুটছে- নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের খোঁজে। এর প্রভাব পড়েছে জর্ডানেও। জর্ডানের আর্থসামাজিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটেছে বিগত কয়েক বছরে। সেখানে আশ্রয় নেয়া সিরিয়ান নাগরিকদের জন্য পানির ওপর প্রচন্ড চাপ পড়েছে পুরো জর্ডান জুড়েই।
কিন্তু জর্ডানের সরকার সৌদি যুবরাজ ও তুর্কির সাথে হাত মিলিয়ে সিরিয়ায় বিদ্রোহী সেনা রপ্তানি করে আরব বসন্তে পরোক্ষভাবে মদদ দিয়েছিলো। এর ফলে সিরিয়ার আসাদ বাহিনীর সাথে জর্ডানের শরনার্থী প্রত্যাবর্তন সহ অন্যান্য বিষয়ে কূটনৈতিক আলোচনার সুযোগ অনেকাংশেই স্তিমিত হয়ে পড়ে। আজও, হাজার হাজার সিরিয়ান জর্ডানে বসবাস করছে- আসাদ বাহিনীর ভয়ে। যার প্রভাবে জর্ডানে শুধু পানির সংকটই দেখা দেয়নি, তার সাথে বেড়েছে সন্ত্রাসের দৌরাত্মও।
২. ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ ও জর্ডানের ফিলিস্তিনি শরনার্থী সমস্যা।ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা আজকের নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ সংঘর্ষ ও এর রেশ নতুন। যার ফলে প্রতিনিয়তই শরনার্থীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জর্ডানকে।
৩. পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর নদীর ওপর দখলদারিত্ব ও পানিকে রাজনৈতিক 'অস্ত্র' হিসেবে ব্যবহার। (জর্ডান নদী কেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব উল্লেখযোগ্য)
চীনের দুঃখ হোয়াংহো হলে, জর্ডানের দুঃখ তার প্রত্যেকটা নদী। এমনিতেই মরুর রুক্ষ দেশ। তার উপর জর্ডানের প্রতিটি নদীর অবস্থান সীমান্ত তীরবর্তী; যাদের প্রবাহ- দুই দেশের সীমান্তে। ফলে, জর্ডানের সব নদী নিয়েই অল্পবিস্তর দ্বন্দ্ব রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে। বিশেষত- জর্ডান নদী উত্তর-জর্ডানের সীমান্তরেখা থেকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণের সীমান্তরেখায় এসে 'Dead sea' তে মিলেছে। জর্ডানের হয়তো জর্ডান নদী নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হতো না, পার্শ্ববর্তী দেশটা যদি ইসরায়েল না হয়ে অন্য কেউ হতো।
কিন্তু ইসরায়েল জর্ডান নদী বেশ কয়েকবার দখলে নিয়েছে। বাঁধ দিয়েছে অবৈধ ভাবে। একইসাথে- জর্ডান নদীর একটি অংশকে পার্ক হিসেবে তৈরি করেছে। কৃত্রিম এই পার্ক তৈরির উদ্দেশ্য যদিও ধর্মীয়।
জেসাস ক্রাইস্ট এই ঐতিহাসিক জর্ডান নদীতেই ব্যাপটাইজড হন। যারফলে, এই জর্ডান নদীর পানিতে অন্তত একবার হলেও আসতে ভীড় করেন দর্শনার্থীরা। আর এই ধর্ম ও পর্যটনশিল্প কে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল 'জর্ডান নদীর পানি' অবৈধভাবে দখলে রেখেছে।জর্ডানের আরেকটি সীমান্তবর্তী নদী 'ইয়ারমুখ নদী'। ইয়ারমুখ জর্ডান নদীর শাখা-নদী হলেও, ইয়ারমুখ নদীর প্রবাহ জর্ডান নদীর উলটো দিকে। উত্তর জর্ডান থেকে নদীটি ধীরে ধীরে উত্তর-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। সিরিয়া-জর্ডান সীমান্তে এসে নদীটি 'Al-wehda lake' এ এসে মিলিত হয়েছে। সিরিয়া এই লেকটিতে বড়সড় একটি বাঁধ নির্মাণ করে সম্পূর্ণ লেক এবং ইয়ারমুখ নদীর পানি দখলে রেখেছে। যার ফলে ইয়ারমুখ নদীর পানি জর্ডানের অভ্যন্তরে পৌছায়না বললেই চলে।
World resources Institute এর পানি বিষয়ক পরিচালকের মতে- জর্ডান, ইরাক ও ইরানের আবহাওয়া ক্রমাগত খরা অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে, আগামী ৫-১০ বছরে এই দেশগুলোয় ভয়াবহ পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। যার ফলে- এই সম্পূর্ণ মরু অঞ্চলে পানি কেন্দ্রিক সংকট ও সংঘাত শুরু হতে পারে।
ইথিওপিয়া, মিশর ও নীলনদের মুড়িঘণ্টক
নীলনদ পৃথিবীর বৃহত্তম নদ ও অন্যতম আশ্চর্যজনক এক নদ যা আফ্রিকার দক্ষিণ দিক থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়েছে। নীলনদের সাথে যুক্ত রয়েছে আফ্রিকার ১১টি দেশ। যেহেতু ১১টি দেশের কৃষি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, মৎস ও নিরাপদ পানির উৎস এই বৃহৎ জলাশয়- সুতরাং এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ ও সংঘাত লাগাটাই স্বাভাবিক।নীলনদের দুটি অংশ- সাদা নীলনদ ও নীল নীলনদ। সাদা নদের উৎপত্তি উগান্ডার ভিক্টোরিয়া লেকে৷ সাদা নদ অত্যন্ত দীর্ঘ, বৃহৎ এবং অধিক এলাকার ওপর প্রবাহমান। কিন্তু সাদা নদের পানি খুবই কম।
অন্যদিকে, নীলনদের আরেক অংশ- নীল নীলনদের উৎপত্তি টানা লেকে, যা ইথিওপিয়ায় অবস্থিত৷ এই নীল অংশটি অধিক পানি প্রবাহিত করে, নীল নদের৷ (WHO এর তথ্য অনুসারে নীল নদের ৮০% উৎপাদন করে ব্লু নাইল) যদিও এটি আকারে ছোট, ইথিওপিয়া থেকে উৎপন্ন হয়ে এটি সুদানের খারতোউম অঞ্চলে এসে সাদা নীলের সাথে মিলেছে।
![]() |
| The Nile River |
গত ১০বছর যাবত নীলনদকে ঘিরে চলছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সংঘাত ও ষড়যন্ত্র। এবং সম্পূর্ণ আফ্রিকা জুড়েই তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। ব্লু নাইল বা নীল নদের প্রবাহ ইথিওপিয়া থেকে শুরু হয়ে সুদানের খারতোউমে এসে মিলিত হয়েছে। ইথিওপিয়া, চাচ্ছে ব্লু নাইলের আপারস্ট্রিমে অর্থাৎ উৎপত্তিস্থলের কাছেই- আফ্রিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করতে।
"The Grand Ethiopian Renaissance Dam" নামক এই ড্যামটি হতে চলেছে আফ্রিকার সর্ববৃহৎ ড্যাম, যা কি না আয়তনে গ্রেটার লণ্ডনের চেয়েও বৃহৎ। আর ১৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা এই ড্যামের আওতাভুক্ত হবে। একইসাথে ইথিওপিয়ার প্রায় ৭৫ মিলিয়ন নাগরিক বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ সহ অন্যান্য যাবতীয় সুবিধা পাবে এই হাইড্রোইলেক্ট্রিক ড্যামটির মাধ্যমে।
ইথিওপিয়ার সরকারের তথ্য মতে, "ইথিওপিয়ার বর্তমানে সর্বসাকুল্যে ৪হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়ে। যেখানে এই ড্যামটি তৈরি হলে, এর মাধ্যমেই ৬-৭০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে।" তাই ইথিওপিয়া শুধু যে স্বয়ংসম্পূর্ণই হতে চাচ্ছে, তাই নয়, বরং 'বিদ্যুত ও জ্বালানী' আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও রপ্তানি করতে চাচ্ছে। যার ফলে হয়তো ইথিওপিয়া অর্থনৈতিকভাবে আফ্রিকায় নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচতি লাভ করবে।
অন্যদিকে, নীলনদের সবচেয়ে ডাউনস্ট্রিমের দেশ মিশর। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির প্রাচীন মিথোলজি, সভ্যতা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রতিটি জনপদই এই নীলনদের ওপর নির্ভরশীল। প্রবাদে আছে "মিশর হচ্ছে নীলনদের দান"। এই নদীর তীর এবং নদীকে কেন্দ্র করেই মিশরের সমাজ ও সভ্যতা গড়ে উঠেছে।
কিন্তু ইথিওপিয়ার এই নীলনদের ওপর বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনার জন্য মিশর অনেকটাই চিন্তিত। শুধুই চিন্তিতই নয়, বরং দুটি দেশই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে যেন অপেক্ষা করছে।
![]() |
| ইথিওপিয়ান ড্যাম |
এর যৌক্তিক কারণও আছে- বিগত ৩০-৪০ বছরে নীলনদের পানি অনেকাংশেই কমে গেছে, গতিপথ বদলে গেছে। সেজন্যে মিশরের বহু কৃষিজমি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার কৃষক কৃষিজমিতে যথেষ্ট পানি না পাওয়ায় বাসস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। মিশরের অনেক লেক, জলাশয় ও নীলনদের অনেক শাখা প্রশাখা এখন সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। সেজন্যে নীলনদের ওপর ইথিওপিয়ার বাধ নির্মাণ মিশরের জন্য গলার কাটার মতো। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ এবং যুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও শেষ মুহুর্তে তা মাঠে গড়ায়নি।
মিশর এমনিতেই গত দু দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে এই ড্যাম তৈরির কাজ শুরু হলে মিশর প্রচণ্ড বিপাকে পড়ে। কেননা, ড্যামটি তৈরি হলে ৫ বছরে ড্যামটি যে পরিমাণ পানি ইথিয়পীয় অঞ্চলে জমা করবে, এতে মিশরের অর্ধেক কৃষিজমি ও নদী শুকিয়ে যাবে। মিশর তাই বেশ কয়েকবার ড্যাম তৈরির কাজে বাগড়া দেবার চেষ্টা করেছে। সুদান ও ইরিত্রিয়ায় বিদ্রোহী অস্ত্রধারী গ্রুপ পাঠিয়ে ও ফান্ডিং করে ইথিওপিয়ায় নৈরাজ্য তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে।
এমনকি প্রকল্পটির মূল হর্তাকর্তারাও প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যার শিকার হয়েছে। এনিয়ে ইথিওপিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে। অনেকেই দায়ী করেছে এর পেছনে 'মিশরের সরকারের হাত আছে।' যদিও মিশর বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, মিশর এই বাঁধ নির্মাণে বাঁধা দিতে ইথিওপিয়ার সাথে যুদ্ধে যেতেও প্রস্তুত।
তবুও এই ড্যামের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়নি। ইথিওপিয়ান প্রাইম মিনিস্টার আবু আহমেদ এতকিছুর পর একদিন জনসম্মুখে বললেন, 'কোন শক্তিই এই ড্যাম নির্মাণ থেকে আমাদের বিরত রাখতে পারবে না। কেউ যদি যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়, তৈরি আমরাও।' যার ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে।দীর্ঘদিন যাবত নানা আলোচনা এবং কূটনীতিকদের বিভিন্ন সংলাপও কোন সঠিক সমাধান এনে দিতে পারেনি সমস্যাটির। অন্যদিকে, ইথিওপিয়ার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র সুদানও চিন্তিত খরা মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাবার।
যদিও, এতকিছুর মধ্যেই- এই বিতর্কিত বাঁধ গত ২০২১ সালের জুলাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে (আংশিক) উদ্ভোদন করেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে ড্যামটি থেকে আংশিকভাবে ইলেক্ট্রিসিটি উৎপন্ন হচ্ছে, তবে মূল কাজ শেষ হতে আরও ৪-৫ বছর লাগবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এখানেই যে, ইথিওপিয়া কি আদৌ শান্তিপূর্ণভাবে প্রকল্পটি শেষ করতে পারবে নাকি আবারও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে? অন্যদিকে মিশর কি আদৌ কূটনৈতিকভাবে কোন সমাধানের পথে আসতে পারবে, নাকি যুদ্ধই এনে দেবে সমাধান?
দুবাইয়ের পানি সংগ্রহে অভিনব প্রযুক্তি
ইথিওপিয়া যেমন ড্যাম তৈরি করে বৈপ্লবিক উপায়ে আফ্রিকায় ছড়ি ঘোরাতে চাচ্ছে, আরব আমিরাত ইতিমধ্যেই সেরকম প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে মধ্যপ্রাচ্যের পানি দখলের দৌড়ে রাজা বনে গেছে।
আরব আমিরাত শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সমগ্র বিশ্বেরই শুষ্ক দেশগুলোর একটি। দেশটিতে কোন নদ-নদী নেই, নেই কোন প্রাকৃতিক লেক এমনকি দেশটিতে বছরে মাত্র ১০ দিন বৃষ্টিপাত হয়। দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল কিছুদিন আগেও মরুভূমিতে পরিপূর্ণ ছিল, আর ৮৫% পানিও ছিলো লবণাক্ত। এমনকি সীমান্তে রয়েছে সমুদ্র- যার পানিও লবণাক্ত। এর ফলে, আরব আমিরাতে তীব্র পানি সংকট লেগেই থাকতো।কিন্তু দুবাই শহরের যেমন ট্রান্সফরমেশন আমরা দেখেছি- তেমনি ট্রান্সফরমেশন এসেছে তাদের ওয়াটার টেকনোলজিতেও।
যেহেতু তাদের নিজস্ব কোন নিরাপদ পানির উৎস নেই, তাই তারা সমুদ্রের লবণাক্ত পানিই সংগ্রহ করা শুরু করে। পরবর্তীতে তারা বৃহৎ এলাকা জুড়ে বেশ কয়েকটি শিল্প এলাকার মতো তৈরি করে, যেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন লিটার লবণাক্ত পানি 'ডিস্যালাইনেশনের' মাধ্যমে লবণ-মুক্ত করে খাবার উপযোগী করে তোলে। এর মাধ্যমে দুবাই প্রথমত নিরাপদ পানির উৎস যেভাবে তৈরি করলো একইসাথে কৃষি, পশুপালন, মৎসপালন সহ অন্যান্য কাজের জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করে ফেললো।
পরবর্তীতে পানি থেকে মুক্ত করা লবণ তারা পাঠিয়ে দিলো মেঘে। প্লেনযোগে প্রচুর পরিমাণে লবণ তারা মেঘের উপরে ফেলতে লাগলো, এতে মেঘের আদ্রতা বৃদ্ধি পেলো যার ফলে আরব আমিরাতে যেখানে বছরে ১০দিন মাত্র বৃষ্টিপাত হতো, সেখানে এখন প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টিপাত তৈরি করার মত সামর্থ্য তাদের হয়েছে। একে বলে 'ক্লাউড সিডিং টেকনোলজি'। তাদের তৃতীয় ধাপ আরো মজার। তারা মেঘ থেকে তৈরি হওয়া বৃষ্টিকে আটকে ধরবার জন্য বৃহৎ একটা ড্যাম তৈরি ফেললো, যাতে নিরাপদ ও মিঠা পানি সমুদ্রে গিয়ে মিশতে না পারে। এরফলে তারা নিরাপদ পানির একটা বৃহৎ জলাশয় এবং সংরক্ষণাগার করে ফেললো।
![]() |
| ক্লাউড সিডিং |
এভাবে মাত্র ৫-১০ বছরে দুবাই শহর যেমনি বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে আরব আমিরাতের পানির সংকট, আর পানির সংকট কেটে যাওয়ায় আর্থসামাজিক অবস্থার রাতারাতি উন্নতি ঘটেছে। পানি এখন শুধুই খাবার পানীয় না আরব আমিরাতের কাছে, এটি একটি ব্যবসায়িক পণ্য যা পার্শ্ববর্তী শুষ্ক দেশগুলোয় রপ্তানি করা যায়, একই সাথে পানির মাধ্যমে কৃষি, মৎস ও পশুপালন সহ নানা কাজের অগ্রগতি হচ্ছে দুবাইয়ে। এককথায় পানি আমিরাতের চালচিত্র সম্পূর্ণভাবে পালটে দিয়েছে।
দুবাই কি পানিকে রাজনৈতিক ও যুদ্ধের টুলস হিসেবে কাজে লাগাতে পারে?
যে দেশ তার আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখে গেছে, সে জানে তাকে আক্রমণ করলেও শত্রুপক্ষের ক্ষতিই বেশি হবে। আবহাওয়ার ক্রমাগত পরিবর্তন করে শত্রুসেনাদের পর্যুদস্ত করা দুবাইয়ের জন্য খুবই সহজ। যেহেতু, বিষয়টি মরু অঞ্চলের পানি কেন্দ্রিক, আবহাওয়া কেন্দ্রিক- সেক্ষেত্রে দুবাই যেন আরো একধাপ এগিয়ে।
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুবাই তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু, কি হবে- যখন অর্থের ভাণ্ডার, অস্ত্রের ভাণ্ডার, টেকনোলজি, আবহাওয়া সকল কিছু একত্র করে আমিরাতের মত একটি ছোট্ট রাষ্ট্র তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর উপর কর্তৃত্ব চালাবে? কিংবা ধরুন— আরবের সাগরগুলোতে কর্তৃত্ব চালানোর চেষ্টা করবে?
যদি ডিস্যালাইনেশন প্রসেস অন্যান্য রাষ্ট্রও গ্রহণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে সমুদ্রের পানি নিয়েও কাড়াকাড়ি লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু না, অন্তত ভবিষ্যতে না...
ইসরায়েলের নতুন অস্ত্র - 'পানি'
কি ধাক্কা লাগছে? পানি অস্ত্র হতে পারে ভেবে? যদি বলি, পানি ইতোমধ্যেই অস্ত্র হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে পৃথিবীর কোথাও কোথাও?
হ্যাঁ। মধ্যপ্রাচ্যের গলার কাটা ইসরায়েলই পানিকে অস্ত্রের মত ব্যবহার করছে।
মানব সভ্যতার সূচনালগ্নের কয়েকটি গ্রামের মাঝে একটি হচ্ছে 'জেরিকো' গ্রাম বা জেরিকোর উদ্যান। জেরিকোর এই উদ্যানেই পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রাম প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো যেখানে বাস করতেন প্রায় ৮০০ মানুষ।
বর্তমানে এই জেরিকো গ্রাম ইসরায়েলের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল জেরিকোর চারপাশের কৃষিজমি দখলে নিয়ে মরু অঞ্চলে চাষাবাদ করছে, যেখান থেকে উৎপন্ন হচ্ছে- আনারস, আতা, আঙুর সহ বিভিন্ন ফল।
কিন্তু ইসরায়েল এই চাষাবাদ করার মত পানি পাচ্ছে কোথা থেকে? এজন্যে ইসরায়েলীদের ভূ-গর্ভস্থ পানি ও জর্ডান নদীর ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। যার ফলে, জর্ডান নদীর পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে খোদ জর্ডান নদীতীরের মানুষ, জর্ডান রাষ্ট্র ও অকুপাইড ওয়েস্ট ব্যাংকের নাগরিকরা।
১৯৯৫ সালের 'অসলো-২' আইন তৈরি করে ইসরায়েল 'জর্ডান নদী এবং মাউন্ট একুইফার' এর পানির ৮০% মালিকানা ছিনিয়ে নেয় জর্ডান ও ওয়েস্ট ব্যাংকের কাছ থেকে। এর ফলে জর্ডান তাদের ঐতিহাসিক জর্ডান নদীর মাত্র ২০% পানির মালিকানা দাবি করতে পারে এবং এই ২০% পানির মাঝে ওয়েস্ট ব্যাংকের নাগরিকদের ভাগও জড়িত। যার ফলে প্যালেস্টাইনের ওয়েস্ট-ব্যাংকে এবং জর্ডানের পশ্চিমে প্রচণ্ড পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
![]() |
| জর্ডান নদী |
কিন্তু এখানে পানি কিভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে?
আগেই বলেছি, ইসরায়েল জেরিকো গ্রামে পানিতে বাঁধ দিয়ে নানান কৃষিকাজ করছে। এরফলে আশেপাশে প্যালেস্টাইনের মালিকানাধীন জেরিকো অংশের কৃষিকাজ সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে।
সম্প্রতি 'The Washington Post' একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে "পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রাম জেরিকোর বিখ্যাত কলা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।"কারণ, ইসরায়েলের ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার ও জর্ডান নদীর পানির দখলের জন্য, আশেপাশের অঞ্চলের কেউ পানিই পাচ্ছেনা।
যার ফলে, কৃষিজমি শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে; এতে প্যালেস্টিনিয়ান কৃষকরা উপায় না পেয়ে জমি ছেড়ে অন্য দিকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন৷ ফলে, ইসরায়েল কৌশলে ধীরে-ধীরে এই কৃষিজমির মালিকানা পেয়ে যাচ্ছে, কোনপ্রকার যুদ্ধ কিংবা সংঘাত ছাড়াই।
অন্যদিকে, ইসরায়েল ২০০৭,২০০৯,২০১২,১৩,১৪ ও সবশেষ ২০১৯-২০ সালের সংঘর্ষে প্যালেস্টাইনের অসংখ্য ওয়াটার ফ্যাসিলিটি ও গভীর নলকূপ ধ্বংস করে দিয়েছে। যার ফলে, লাখ লাখ প্যালেস্টিনিয়ান নিরাপদ পানির অভাবে ভুগছে।
কিন্তু, ইসরায়েল তো পানিকে অস্ত্রের মতই ব্যবহার করবে। তাই না?
তাই তারা প্রথমে যেমন পানির ফ্যাসিলিটি ধ্বংস করে এবং পানিতে বাঁধ দিয়ে পানির সংকট সৃষ্টি করলো। একই সাথে তারা নিয়ে আসলো সমাধান!
সমাধান হিসেবে ইসরায়েল- Mekarot নামের একটি ন্যাশনাল কোম্পানি সৃষ্টি করলো। যারা উচ্চমূল্যে পানি বিক্রি শুরু করলো।
যেসব প্যালেস্টিনিয়ান দীর্ঘদিন নিরাপদ পানির অভাবে ছিলেন, তারা অসহায় হয়ে, না পেরে উচ্চমূল্যে এই ইসরায়েলী কোম্পানীর পানি কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে ইসরায়েল যেমন ব্যবসা করতে পারছে, ধনী হচ্ছে; একই সাথে প্যালেস্টিনিয়ানদের কন্ট্রোলে রাখতে পারছে- চেকে রাখতে পারছে। চাইলে, মনোপলি মার্কেটের মতো পানির মূল্য বৃদ্ধি করে প্যালেস্টাইন নাগরিকদের পথে বসিয়ে দিতেও পারছে। এমনকি,
পানি বিক্রয় বন্ধ করে দিয়ে- গোটা ওয়েস্ট ব্যাংকবাসীকে পানির অভাবে মেরেও ফেলতে পারবে ইসরায়েল- যখন তখন! কোন ঢাল-তলোয়ার, ট্যাংক-কামান কিছুরই প্রয়োজন নেই, শুধু একটি কোম্পানির একটি ডিসিশন ধ্বংস করে দিতে পারে হাজারো ফিলিস্তিনি প্রাণ। অর্থাৎ, পানি এখন শুধুই পানীয় নয়। এটি একটি মোক্ষম অস্ত্র, যার কাছে একটা গোটা রাষ্ট্র বন্দী!
অন্যদিকে, গাজা উপত্যকার ৯০-৯৫% পানি মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী। স্যানিটেশন সহ অন্যান্য কাজের জন্য যে পানি ব্যবহার করা হয়, সেটিই পান করতে হচ্ছে গাজাবাসীদের। ইসরায়েল থেকে কোন পানি গাজায় ঢুকতে পারে না৷ যেসব ওয়াটার ফ্যাসিলিটি ছিলো, সেগুলো দীর্ঘদিনের সংঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে, গাজাবাসীদের পানিবাহিত বিভিন্ন রোগশোকে ভোগা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার কোন সমাধান নেই।
আগামীর মধ্যপ্রাচ্য ও পানি সংকট
![]() |
| সিরিয়া গৃহযুদ্ধ |
মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া ব্যতীত মোটামুটি সকল রাষ্ট্র নিয়েই আলোচনা করা হলো। সিরিয়া বাদ রাখার মূল কারণ হলো— পানির জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি যেসব সমস্যা বা সংঘাতে পড়বে আগামীতে, সিরিয়া ইতিমধ্যেই সেগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে। এর বড় কারণ- সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধের কারণে যে যেভাবে পারছে বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে রাখছে, এখানে বিভিন্ন পরাশক্তিও সক্রিয় অবস্থানে আছে, আছে বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীও। তাই পানি যেসব গোষ্ঠীর বা পরাশক্তির দখলে আছে, যুদ্ধের নাটাইও তাদের দখলে।
আলেপ্পো শহর ছিলো বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটি, আমেরিকা প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়েছিলো শুধুমাত্র আলেপ্পো শহরে বিদ্রোহীদের সক্রিয় রাখতে। তুর্কি ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাষ্ট্রই আলেপ্পো কে নিয়ে নতুন সিরিয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন।
কিন্তু রাশিয়া হঠাৎই যুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান গ্রহন করলে যুদ্ধের চিত্র পালটে যায়। পাশার দানের মতই আলেপ্পো শহরের শক্ত ঘাঁটি উলটে যেতে থাকে। চারপাশ দিয়ে রাশিয়ান ও আসাদ বাহিনী অবরুদ্ধ করে টানা ৪০ দিন বিমান হামলা করে। ৪০ দিনের পর ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে যারা শেষমেশ বেঁচে ছিলো, তাদের উদ্ধার করা হয়।
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এভাবে অবরুদ্ধ করে বিমান হামলার নজির খুবই কম।
ইদলিবের শাসন এখনও বিদ্রোহীদের হাতে। সেখানে পানির সংকট খুবই তীব্র কেননা সরকারি বাহিনী বাইরে থেকে পানি সংগ্রহের প্রায় সমস্ত উপায় বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে, সেখানে যার কাছে নিরাপদ পানি আছে— তার হয়ে মানুষ লড়াই করছে কিংবা তার অধীনে কাজ করছে। অর্থাৎ, নিরাপদ পানি টাকা বা ডলারের মত কাজ করছে, যার মাধ্যমে কয়েকজন মানুষকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া যাচ্ছে।
এমন আরেকটি ঘটনা ঘটেছিলো ইরাকের মৌসুল অঞ্চলে, সেখানে পানির অভাব এতোটাই তীব্র ছিলো যে সাধারণ মানুষেরা দলে দলে আইএসে যোগদান করেছিলো, কারণ আইএস মৌসুল শহরের পানি নিয়ন্ত্রণ করছিলো।
শুধু মৌসুল কিংবা আলেপ্পো, ইদলিবই নয়— আগামীর বিশ্বে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে পানি হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারে সেটি নীলনদের মতো জলাশয় কে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক বৃহৎ সংঘাত, হতে পারে তা ইসরায়েলের মতো কর্তৃত্ববাদী আচরণ, কিংবা আরব আমিরাতের ন্যায় পানির বহু উপযোগিতা তৈরি করে পরাশক্তি বনে যাওয়া। এমন সংঘাতের আগামী না চাইলে অন্তত আমরা এই মুহুর্তে যা করতে পারি, তা হচ্ছে— "নিরাপদ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার এবং অপচয় রোধ করা।"
মোহাম্মদ ইরফান সাদিক রাজিন
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়









No comments