Header Ads

Header ADS

ইউক্রেন সংকট সংক্ষেপিত


 ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যে দ্বন্দ্ব ,সেটা মূলত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে আভিজাততান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ (Putinism) ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব 

   দার্শনিক ইম্মানুয়েল কান্টের “ডেমোক্রেটিক পিস থিওরী”র  পর্যালোচনা এখানে প্রযোজ্য ! 

   ইউক্রেন রাশিয়ার পর ইউরোপের সবথেকে বড় রাষ্ট্র । রাশিয়ার এশিয়ান অংশ বাদ দিলে ইউক্রেনই সবথেকে বড় ইউরোপীয় রাষ্ট্র । 

ইউক্রেন মূলত কৃষি প্রধান ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র । কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকা অবস্থায় ইউক্রেনে শিল্পায়নের ছোঁয়া তেমন একটা লাগেনি । বলা যায় , সোভিয়েতের ভেতরে অবহেলিত একটা অংশ ছিল ইউক্রেন । এই অবহেলা থেকেই পৃথক ইউক্রেনীয়-স্লাভিক জাতীয়তাবাদের উত্থান !

   ১৯৯০ সালে সোভিয়েত অর্থনীতি ভেঙ্গ পড়লে অনেকগুলো রাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউক্রেনও রাশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ! 

  সোভিয়েত আমলের অনেকগুলো পারমাণবিক বোমা ও বোমা বানানোর প্রযুক্তি ইউক্রেনের কাছে ছিল । কিন্তু নতুন রাষ্ট্র হিসেবে কোনপ্রকার যুদ্ধ-সংঘাতে যাওয়ার ইচ্ছা ইউক্রেনের ছিল না । তাই তখন ইউক্রেন শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্রের মতো পারমাণবিক বোমাগুলো রাশিয়ার হাতে তুলে দিয়ে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ হয় । কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের প্রযুক্তি ইউক্রেনের কাছে এখনো রয়েছে , আবার  পৃথিবীতে খনিজ ইউরেনিয়াম মজুদের দিক দিয়ে ইউক্রেনের অবস্থান দ্বিতীয় ! 

  ১৯৯১-২০১৪ -এই ২৪ বছরে ইউক্রেন দেখলো সে রাষ্ট্র হিসেবে সে ইউরোপের সবথেকে পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একটি । কৃষি উৎপাদনে এগিয়ে থাকলেও , ইউক্রেনে শিল্পায়ন হচ্ছে না , বৈদেশিক বিনিয়োগ আসছে না , ইউরোপের গতিশীল বাজারে নিজস্ব পণ্যের বাজার দখল করতে পারছে না , ইউক্রেনের নাগরিকেরা অন্যদেশে চাকরী করার সেনজেন ভিসা সুবিধা পাচ্ছে না  ।

  কারণ ইউক্রেন ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সদস্য নয় । তাই  ইউক্রেনের ভেতরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়ার জন্য ব্যাপক গণভিত্তি তৈরী হয় । 

   এটা সত্য যে , ইউক্রেনে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি , সিভিল সোসাইটির উন্মেষ , রাজনৈতিক আন্দোলন সৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের ফান্ডিং ও সমর্থণ ছিল । 

 

২০১৩ সালের দিকে ইউক্রেন ইইউ’য়ের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে কিন্তু  রাশিয়া তখন ইউক্রেনের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে । কারণ ইতিপুর্বে সেখানে রাশিয়ার একাধিপত্য ছিল  ; রাশিয়ার অভিজাততন্ত্র চাচ্ছিলো না , ইউক্রেনে তাদের একাধিপত্যে টান পড়ুন ! 

সরকারও রাশিয়ার চাপে পড়ে সদস্য লাভের আবেদন ক্যান্সেল করে । এই ঘটনার সূত্র ধরে ইউক্রেনে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় । “Euromaidan” নামক গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতন ঘটে । কিন্তু সরকার পতনের রাশিয়া ভীষণভাবে রুষ্ঠ হয় এবং প্রতিশোধ নিতে শুরু করে । 

   রাশিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় , যেখানে ইউক্রেনের সবথেকে বড় সমুদ্রবন্দর সেবাস্তিপোল অবস্থিত ছিল । এরপর রুশ ভাষাভাষী দোনবাস অঞ্চলে বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলনে মদদ দিতে থাকে । অঞ্চলটির দোনাস্ক ও লুবেনাস্ক জেলা দুটি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় । 


ইউক্রেন বাধ্য হয়ে রাশিয়ার সাথে মিনাস্ক সমঝোতা করে । সমঝোতার শর্ত ছিল  ইউক্রেন ইইউ ও ন্যাটোতে যোগ দিবে না , বদলে রাশিয়া দোনাস্ক - লুবেনাস্ককে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিবে না । 

কিন্তু ক্রিমিয়া দখল করে নেয়ার জন্য রাশিয়ার উপরে অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়া হয় । 


এই ২০১৪ -২০২১ পর্যন্ত ইউক্রেন নিজেকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে । সেনাবাহিনীর সংখ্যা আড়াই লক্ষ থেকে পাঁচলক্ষে উন্নীত করে এবং সকল যুবক বয়সীদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে । ইতিপূর্বে পূর্ব ইউরোপের  পোল্যান্ড , লাটভিয়া , লিথুয়ানিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ন্যাটোতে যোগদান করেছে ।


২০২১ সালে এসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনাস্কি সে উদ্দেশ্যেই  ধাপেধাপে ইইউ ও ন্যাটোতে যোগদানের ফ্রেমওয়ার্ক ঘোষণা করে ।  কিন্তু রাশিয়া এর ঘোষণার জন্যে তীব্রভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় , এবং ইউক্রেনের সীমান্তে ১,৯০,০০০ সেনার সমাবেশ ঘটায় । বেলারুশের সাথে যৌথ সামরিক মহড়া করে যুদ্ধ ভীতি সৃষ্টি করে । 


রাশিয়া চাচ্ছে ইউক্রেন কোনভাবেই যেন ন্যাটো ও ইইউ’তে যোগদান না করে । ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার মোড়লীপনার সমাপ্তি ঘটবে ।পুতিনের ব্যক্তি ইমেজও সংকটে পড়বে ।

কিন্তু   বিভিন্ন সার্ভে অনুসারে ইউক্রেনের ৫২% জনগণ ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে যোগদান করতে চায় , ৬৪% জনগণ ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে । বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনাস্কি তীব্রভাবে রুশবিরোধী ও মার্কিনপন্থী । 

 

এখন পুতিন চাচ্ছে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়ে একটা রাশিয়াপন্থী পুতুল সরকার বসাতে এবং প্রশাসন-সিভিল সোসাইটির ভেতরে গণতন্ত্রপন্থীদের গুম ও ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাতে । ইতিপুর্বে পুতিন এইকাজ রাশিয়া ,  চেচনিয়া , ক্রিমিয়া ও দোনবাস অঞ্চলে করেছে । 


কিন্তু বিভিন্ন কারণে পুতিন এই কাজ করতে সময় নিচ্ছে 

১:  বর্তমানে ইউক্রেন সামরিক দিক থেকে অনেক শক্তিশালী হয়েছে , তাই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানো এতোটা সহজ নয় । 

২: ইউক্রেন বিশাল বড় দেশ , ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে রাজধানী দখল করলে দীর্ঘদিন দখলে রাখা অনেক কঠিন , 

৩: ১৯৪৫ সালের পর এতো বড় সামরিক আগ্রাসন কোন দেশ চালানোর সাহস করেনি । 


কিন্তু পুতিন টেকনিক্যালী ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছে , 

মিনেস্ক সমঝোতা ভেঙ্গে রাশিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে ইউক্রেনের আইনগত ভূখন্ডে সৈন্যপ্রবেশ করিয়েছে । 

রাশিয়া চাচ্ছে ইউক্রেনের দিক থেকে হামলা হোক । তাহলে আগ্রাসন চালানোর জন্য আইনগত মোটিভ পাওয়া যাবে । 

 

কিন্তু ইতিমধ্যে রাশিয়ার উপর ব্যাপক অর্থনৈতিক অবরোধ আসতে পারে । যেমন: 

    ১: জার্মানি রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানী বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে 

    ২: আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে রাশিয়াকে বয়কট করা হতে পারে 

    ৩: রাশিয়ান সেনাবাহিনী , পুলিশ ও পুতিনের সমর্থক অভিজাতদের উপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে । 


যাই হোক , ফুটবলটা রাশিয়ার কোর্টে নেই । যুদ্ধ করলেও রাশিয়া ফেঁসে যাবে , না করলেও ফেঁসে যাবে ।সত্যি কথা হলো ,  আমেরিকা ও ইইউ চাচ্ছে রাশিয়া যুদ্ধে জড়াক । কেবলমাত্র , ইউক্রেনের মানুষ যুদ্ধ চায় না । পৃথিবীর কোথাও সাধারণ জনগণ কখনই যুদ্ধ চায় নি ।


সাজিদ হাসান চৌধুরী অভি

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ 

জাহাঙ্গীরনগর  বিশ্ববিদ্যালয় 

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.