কার্ল মার্ক্স (karl marx): আধুনিক সময়ের প্রভাবশালী দার্শনিক

কার্ল মার্কস
কার্ল মার্কস আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী তাত্ত্বিক হিসেবে স্বীকৃত। আধুনিক সমাজতন্ত্র (socialism) ও সাম্যবাদ (communism) মার্কসীয় চিন্তা-ভাবনা দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত। কাল মার্কস শুধু একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদই ছিলেন না, তিনি পাশাপাশি দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদও ছিলেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার পান্ডিত্য লক্ষণীয়। উনবিংশ শতক থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ তার চিন্তা ও কার্য-প্রণালীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। বাম-রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মার্কস “মহান শিক্ষক” হিসেবে বিবেচিত। কার্ল মার্কস তার বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সহযোগিতায় যে যুগান্তকারী চিন্তা ও কার্যপ্রণালীর বিকাশ ঘটিয়েছিলেন তাকে সোজা ভাষায় মার্কসবাদ বলে।
৫ মে, ১৮১৮ সালে জার্মানির ত্রিয়ারে, এক ইহুদি পরিবারে কার্ল মার্কস জন্ম গ্রহণ করেন। পারিবারিক সু-শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ক্ষেত্রে মার্কস কৃতিত্বের পরিচয় দেন। বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কস যথাক্রমে ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ণকালে বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রেডেরিক হেগেলের কাল্পনিক সমাজতন্ত্র মার্কসকে আকৃষ্ট করে এবং তিনি হেগেলের youth hegelians দলের সদস্যভুক্ত হন। ১৮৪০ সালে কার্ল মার্কস জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ডিক্টরাল থিসিস জমা দেন এবং পরবর্তী বছর, ১৮৪১ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনৈতিক উদারবাদী মনোভাবের কারণে মার্কস পেশা জীবনে আর্থিক ভাবে সফল হতে পারেন নি। প্রাথমিক ভাবে তিনি জার্মানির কোলেগানের সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা ''rheinische zeitung' এ সম্পাদকের চাকরি গ্রহণ করেন। সম্পাদনায় দক্ষ হওয়া পাশাপাশি পত্রিকার দর্শনকে সমর্থন করে লেখালেখি করে খুব দ্রুতই তিনি পত্রিকার পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পত্রিকাটির এই জনপ্রিয়তা প্রুশিয়ান সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। মার্কস যখন মোসেল উপত্যকায় কৃষকদের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে একটা বড় নিবন্ধ রচনা করেন তখন থেকেই পত্রিকাটির উপর প্রশিয়ান সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
১৮৪৩ সালে মার্কস- জেনি ভন ওয়েস্টফেলিয়াকে বিয়ে করেন। তিনি প্রুশিয়ান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে বাচতে ফ্রান্সে পারি জমান। ফ্রান্স গিয়ে তিনি ফরাসি সোসালিষ্ট চিন্তাবিদদের সংস্পর্শে আসেন এবং প্রথমবারের মতন উপলব্ধি করেন ফ্রান্সের শ্রমিক শ্রেণী কতটা দারিদ্র্য ও দুঃসহ জীবন অতিবাহিত করছে৷ ফ্রান্সে কার্ল মার্কসের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিলো ফ্রেডেরিক এংগেলসের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠা।
১৮৪৪ সালে the conditions of working class in London নামক ধ্রুপদি রচনার হাত ধরেই এংগেলসের সাথে মার্কসের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। উভয়ে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে- একে অন্যকে সহায়তা করে গেছেন, যদিও সেক্ষেত্রে এংগেলসের ভূমিকা ছিলো সর্বাধিক। এংগেলসের বইটি পড়ে ঐ একই বছর মার্কস economic and philosophical manuscript নামে একটা নতুন গ্রন্থ রচনা করেন যেখানে তিনি ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও ব্যাক্তি মর্যাদাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
১৮৪৪ সালে মার্কস দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ আরনল্ড রোগেকে নিয়ে Franco-German Annals শিরোনামে একটি পত্রিকা চালু করেন। এই পত্রিকায় দর্শন, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনেক লেখালেখি হত। শ্রমিক শ্রেণীর সাথে বসবাসের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে এবং ইতিহাস, অর্থনীতি, দর্শন ও রাজনীতির উপর মার্কসের বিশদ পান্ডিত্য়ের কারণে মার্কস ধীরে ধীরে পোক্ত কমিউনিস্ট হয়ে ওঠে।
তিনি তার চিন্তা ও দর্শনের সাহায্যে পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে যে সীমারেখা টেনে দেওয়া আছে তাকে আঘাত করতে শুরু করেন। মার্কস বলেন, পুঁজিবাদে যেখানে শ্রমিকশ্রেণী পণ্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাদের সৃজনশীল শ্রমকে বিনিয়োগ করে- সেখানে পুঁজিবাদী শ্রেণী সেই শ্রমকে পারিশ্রমিক আকারে বাজারদরে মূল্যায়িত করে। এভাবে অ-শ্রমজীবী পুঁজিবাদী বুর্জোয়ারা উৎপাদন উপকরণের মালিক হওয়ার অজুহাতে বিশ্বের সম্পদকে হাতিয়ে নেয়- আর বেতনভুক্ত শ্রমজীবী শ্রেণী আজীবন প্রলেতারিয়া হয়েই খেটে মরে।
মার্কসের Franco-German Annals নিবন্ধটি প্রকাশিত হলে ফরাসী সরকার ক্ষেপে ওঠে। নিবন্ধটির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৮৪৫ সালে মার্কসকে ফ্রান্স থেকে বিতারিত করা হয়, এবং পরবর্তীতে মার্কস বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে আশ্রয় গ্রহণ করে। ব্রাসেলসে থাকাকালীন মার্কস ও ফুয়েরবাখের মধ্যে চিঠি বিনিময় হতো। ব্রাসেলসে বসে এংগেলস ও মার্কস The German Ideology ও The Holy Family নামে দুটি বিখ্যাত বই রচনা করেন।
The German Ideology গ্রন্থে মার্কস প্রথম তার বিখ্যাত Historical Materialism বা ঐতিহাসিক বস্তুতান্ত্রিকতাকে পাঠকদের সামনে উপস্থাপনা করেন। কার্ল মার্কসের মতে, ইতিহাস বস্তুতান্ত্রিক- অর্থাৎ একটা সমাজের মূলভিত্তি ঐতিহাসিক বস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থার উপর গড়ে ওঠে এবং সেই উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন বা প্রথা তৈরি হয় এবং নিয়ন্ত্রক হিসেবে রাজনৈতিক পরিকাঠামো (Political Superstructure) গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে মার্কস The Poverty of Philosophy গ্রন্থটি রচনা করেন, সেখানে তিনি অর্থনৈতিক জীবন প্রণালীর ঐতিহাসিক বস্তুতান্ত্রিক ব্যাক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
১৮৪৬ সালে মার্কস ইউরোপের সকল সোসালিষ্টদের সমন্বয়ে Communist Correspondence Committee গঠন করেন। পরবর্তী বছরে লন্ডনে সোসালিষ্ট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ইউরোপীয় কমিউনিস্ট লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। লীগের পক্ষ থেকে মার্কসকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং উপহার স্বরূপ লীগ মার্কসের নিকট থেকে জগৎবিখ্যাত The Communist Manifesto বইটি লাভ করে। মার্কসের এই বইটি রচনার পিছনে এংগেলসের The Principles of Communism বইটি অনুপ্রেরণা প্রদান করে।
The Communist Manifesto বইটি ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশিত হয়৷ প্রকাশের পরপরই বইটি বিশ্বের সবচেয়ে রেডিক্যাল ও প্রভাবশালী গ্রন্থে পরিনত হয়। গ্রন্থটির সূচনাতেই মার্কস বলেছেন “ মানব সমাজের ইতিহাস – শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস”। এই বাক্যটি অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের নিকট মার্কসবাদের সারাংশ হিসেবে পরিচিত। বইটিতে ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে কেন্দ্রীয় বন্টন নীতিকে প্রাদান্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে- অর্থাৎ উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা ব্যক্তির থেকে সরিয়ে কমিউনের কাছে দিতে হবে। কোন ধরনের ব্যক্তি মালিকানা থাকতে পারবে না।
কার্ল মার্কস ও এংগেলসের মতে, কমিউনিজম প্রতিষ্ঠায় প্রথম পদক্ষেপটি হল বুর্জোয়া বা ধনিক শ্রেণীকে হাটিয়ে প্রলেতারিয়া বা শ্রমিক শ্রেণীকে ক্ষমতায় বসানো। তাদের মতে, এই প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেই প্রকৃত গণতন্ত্র অর্জন সম্ভব। গ্রন্থের ৩য় অংশে শ্রেণী বৈষম্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে সমতার ভিত্তিতে সমাজ গঠন ও সম-উন্নয়ন ভোগের অধিকারকে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এই কারণগুলির জন্যই The Communist Manifesto গ্রন্থটি বিশ্ব দারিদ্র্য- নিপীড়িত জনগণের কাছে এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ১৯ ও ২০ শতকে অনেক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
The Communist Manifesto র জনপ্রিয়তা বেলজিয়ান সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। তারা মার্কসকে বেলজিয়াম ছাড়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। বেলজিয়াম থেকে মার্কস আবার জার্মানি যান, কিন্তু প্রুশিয়ান সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেন। বিচারকদের উদারতায় তিনি মুক্তি পান এবং আবারো ফ্রান্সে যাত্রা করেন। অবশেষে সেখানেও না টিকতে পেরে মার্কস ১৮৪৯ সালে লন্ডনে পারি জমান। সেখানেই জীবনের বাকী দিনগুলো তিনি পার করেন। লন্ডনে মার্কস The New York Tribune পত্রিকায় চাকরি নেন, কিন্তু বেতন কম হওয়ায় আর্থিক দিক দিয়ে অনেকাংশেই এংগেলসের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
লন্ডনে মার্কসের বেশিরভাগ সময় কাটতো বৃটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে। সেখানে বসে তিনি অনেকগুলো বই রচনা করেন। কিন্তু অর্থাভাবে সেই লেখার বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়নি। সমগ্র ইউরোপব্যাপী উদারতাবাদীদেএ কাছে মার্কস সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হয়ে ওঠেন। ১৮৬৪ সালে লন্ডনের সেন্ট মার্টিন হলে International Workingmen's Association থেকে একটা সম্মেলনের আহবান জানানো হয়৷ মার্কসকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অবশেষে, ১৮৬৭ সালে কার্ল মার্কস তার দ্বিতীয় যুগান্তকারী গ্রন্থ Das Kapital এর প্রথম অংশ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে তিনি ২য় ও ৩য় অংশও সম্পাদনা করেন, কিন্তু চতুর্থ অংশ এংগেলস তার মৃত্যুর পরে প্রকাশ করেন।
১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ এই মহান দার্শনিক মৃত্যুবরণ করেন। মার্কসকে লন্ডনের হাইগেট সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়। তার কবরের বেদীতে বড় করে লেখা " Workers of all lands unite". এটি কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো গ্রন্থের সর্বশেষ বাক্য। তার মৃত্যুর পর ফ্রেডেরিক এংগেলস মার্কসের বেশকিছু অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনা করেন। অবশেষে, ১৮৯৫ সালে এংগেলস মারা যান। কিন্তু এই মহান চিন্তক তার রেডিক্যাল ও প্রভাবশালী আইডিয়ার সাহায্যে পৃথিবীর পুরানো ধাচকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তিনি সব যুগের জন্য অন্যতম একজন প্রভাবশালী দার্শনিক হয়েই থাকবেন।
অনুবাদকঃ বদিরুজ্জামান
মূল লেখকঃ
Dingping Guo Fudan University Shanghai, China


No comments