Header Ads

Header ADS

খাদ্য যখন অস্ত্রঃ ইউক্রেন-রাশিয়া প্রেক্ষাপট

 

 

রাশিয়া যখন ইউক্রেনের প্রধান সমুদ্রবন্দর ওডেসা দখল করে নেয়, তখন থেকেই ইউক্রেনের গম রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন সমীকরণ যোগ হয়। যদি কেউ মনে করে সাম্প্রতিক মস্কো ও কিয়েভের মধ্যকার খাদ্য রপ্তানির যে চুক্তিটি হয়েছে তুরস্কের মধ্যস্থটায় তা আগামী দিনগুলোতে খাদ্য রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা আসলে বিশ্বাস হয়েই থাকবে, কারণ রাশিয়ার সৈন্যরা যেকোনো মূহুর্তে সেই চেতনার বিনাশ ঘটাতে পারেন, অন্তত যতদিন না কোন রাজনৈতিক সমাধান আসে।

একদম শুরু থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনের ওডেসার গুরুত্বপূর্ণ  জায়গাগুলোতে বোমা হামলা শুরু করে, এবং শুরু থেকে আন্তর্জাতিক মহল এই বোমা হামলার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতির সমন্বয়ক জোসে বোরেল ফন্টেলস নিজের টুইটে লেখেন যে রাশিয়ার এভাবে বোমা হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং রাশিয়াকে এর জন্য যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হতে হবে।

রাশিয়ার এমন উগ্র আচরণের পরও গম রপ্তানি চুক্তি কার্যকর হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। যাইহোক, রাশিয়া এখন পর্যন্ত চুক্তির কোন ধারাকে প্রত্যক্ষভাবে লঙ্ঘন করেনি। রাশিয়া নিশ্চয়তা দিয়েছিল বহিঃবিশ্বের খাদ্য আমদানি করা কোন জাহাজে রাশিয়া আক্রমণ করবে না।

সবচেয়ে জরুরী বিষয় হল এই চুক্তি সব পার্টির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ । ইউক্রেনের নিজের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে তার শস্যগুদাম থেকে প্রায় ২২ মিলিয়ন টন গম, ভূট্টা ও অন্যান্য কৃষিপণ্য বাইরের দেশে রপ্তানি করতে হবে। তুরস্ক এই বিশাল পরিমানের পণ্য পরিবহণে সাহায্য করে বড় রকমের মুনাফা লাভ করতে পারবে। আর রাশিয়ার উপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয়া হবে এবং এই শস্য সরিয়ে নিতে রাশিয়াকে- ইউক্রেনের বিশাল অংকের অর্থ দিতে হবে।

“রাশিয়া ইউক্রেনের সমুদ্রবন্দরগুলো দখল করে রেখেছে এবং এই দখলের জন্যই বৈশ্বিক খাদ্য শস্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে”- উপরিউক্ত চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া আন্তর্জাতিক মহলের এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবে। এছাড়াও রাশিয়ার অভিযোগ যে পশ্চিমা দেশগুলো ক্রেমলিনের উপর যেভাবে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তার ফলাফল হিসেবে রাশিয়া খাদ্য শস্যকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ার বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রী সার্গেই লাভ্রেব আফ্রিকায় সফর করেছেন এবং আফ্রিকার দেশগুলোকে ক্রেমলিন থেকে খাদ্যশস্য ও বড় অংশের অস্ত্র সরবারহের আস্থা জানিয়েছেন।  

সম্প্রতি জাতিসংঘের সেক্রেটারি এন্টিনিও গুতারেস ও তুর্কির সহযোগিতায় গম রপ্তানির যে চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়েছে তা কার্যকর হতে বেশ কিছু সময় লাগবে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে কড়া নজরদারি রাখা হবে যাতে শুধু গমই অন্যদেশে রপ্তানি হয় এবং ফেরত জাহাজে যেন কোন অস্ত্রের চালান ইউক্রেনে না পৌছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ওদেসার সীমান্তে যে মাইনগুলো বসানো হয়েছে তা সরিয়ে ফেলতে হবে বা ধ্বংস করতে হবে। তাই মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোকে ইউক্রনের খাদ্য হাতে পেতে এখনো লম্বা সময় ধৈর্য ধরতে হবে।

যাইহোক, এটা এখনো পরিষ্কার নয় এই নতুন করে গম রপ্তানি বিশ্ব বাজারে খাদ্যের দামের উপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে। ইউক্রেন আক্রমনের পরপরই নাটকীয়ভাবে খাদ্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ভোজ্য তৈল, খাদ্যদানা, মাংসের দাম যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। গার্ডিয়ান সংবাদপত্র রিপোর্ট করে,  এর মতে গতবছরের প্রথম দিকের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য দ্রব্যের মূল্য তিনগুন বেড়ে যায়।

এই আকস্মিক খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পৃথিবীর প্রতিটি দেশকেই নাড়া দিয়েছে এবং দেশে দেশে সরকার বিরোধী নানান আন্দোলন পরিলক্ষিত হচ্ছে, যেমনঃ শ্রীলঙ্কা।  শ্রীলঙ্কার গতদুই দশকের সরকার বর্তমান এই সংকট মোকাবিলায় এক কথায় ব্যর্থ হয়েছে, এবং শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। সাব সাহারা অঞ্চলে প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ মারাত্মক খাদ্য সঙ্কটে ভূগছে এবং হোর্ন অব আফ্রিকায় প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষ দুর্বিক্ষে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাধারণভাবে, বিশ্ব খাদ্য সংস্থাই ঐ অঞ্চলে খাদ্য পৌছে দিতে সবচেয়ে বেশি কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এই সংস্থার প্রায় অর্ধেকের বেশি খাদ্য আসতো ইউক্রেন থেকে। এই চুক্তির বাস্তবায়ন না ঘটলে আফ্রিকায় আবারো একটা মানবিক বিপর্যয় ঘটবে।

এই সংকটের জন্য আমরা আসলে কাকে প্রধান হিসেবে দায়ী করবো?

এক্ষেত্রে রাশিয়াই কী ভিলেন?

মজার ব্যাপারটি হল রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমনের অনেক আগে থেকেই বিশ্ব বাজারে খাদ্য-দ্রব্যের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সরবারহে বড় রকমের ব্যাঘাত ঘটা করোনা মহামারীর সাথে সম্পর্কিত; আমদানিকৃত পন্যের দাম বৃদ্ধি জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত;  এবং শস্য ধ্বংস হওয়ার সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত।

খাদ্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি আগে থেকে আন্দাজ করা খুবই কঠিন একটা বিষয়। ২০০৭-০৮ সালের খাদ্য মূল্য বৃদ্ধির পর আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেখানে তারা বলেন যে দীর্ঘদিন যাবৎ কৃষিজাত পণ্য বিস্তারে আন্তর্জাতিক কোন বড় বিনিয়োগ নেই। ফলে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালে গমের রপ্তানিতে অনেক ভাটা পরে। ফলাফল হিসেবে গম ও গমের পরিপূরক অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু রাশিয়াই যে বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য মূল দায়ী এটা ঠিক নয়। ভ্লাদিমির পুতিন প্রথম থেকেই ইউক্রেনের কৃষিক্ষাতকে কব্জায় নিতে চেয়েছে ইউক্রেনকে দুর্বল করার জন্য। রাশিয়া শুধু ইউক্রেনের সমুদ্র বন্দরগুলো ব্লকই করে রাখেনি, আক্রমনের অনেক আগে থেকে আমদানিকারক দেশগুলোকে বিভিন্ন সিগন্যাল দিয়ে এসেছে যেন তারা এই বন্দর ব্যবহার থেকে দূরে থাকে। যুদ্ধ শুরুর পরপরই রাশিয়ান সৈন্যরা শস্যগুদামগুলো দখল নেয়, পাশাপাশি অনেক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিলো ইউক্রেনকে খাদ্য রপ্তানির সুযোগ থেকে এবং এই রপ্তানি থেকে ইউক্রেনের যে অর্থ আসতো তা থেকে বঞ্চিত করা। কিন্তু এই কাজের পিছনে পুতিনের অন্য উদ্দেশ্যও ছিলো। পুতিনের প্রধান বার্তাবাহকের একজন বলেছেন যে রাশিয়া এই খাদ্য ঘাটতির মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে ্তুলতে চেয়েছেন। এছাড়াও রাশিয়ান অর্থনীতিবিদ সারগেই গুরিয়েব বলেছেন এই খাদ্য অবরোধের মাধ্যমে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকেও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল করার প্রচেষ্টা চালাবেন।

সর্বোপরি, রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডেমিট্রি মেদ্ভেদেভ অনেক আগেই বলে গিয়েছিলেন যে রাশিয়া খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে জানে। তিনি তার ডায়রিতে লিখে গিয়েছিলেন যে অনেক দেশ রাশিয়ার উপর খাদ্য সরবারহের জন্য নির্ভরশীল। “এই খাদ্য আমাদের গোপন অস্ত্র , আমাদের শক্তি, আমাদের কৌশল”। (সংক্ষেপিত)

 

অনুবাদকঃ বদিরুজ্জামান

 

মূল লেখকঃ

John Feffer is the director of Foreign Policy in Focus.

https://www.newagebd.net/article/177262/the-weaponisation-of-food

 

  

 

 

 

 

  

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.