বিষয়টি খুবই হতাশা ও দুর্ভাগ্যের যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যে দেশগুলো (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স ও রাশিয়া) যেখানে জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিস্তার ও সংরক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, ঠিক এই রাষ্ট্রগুলোই পৃথিবীর অস্ত্র বাণিজ্যের প্রধান যোগানদাতা। বিশ্বের প্রায় ৯৫ শতাংশ কনভেনশনাল অস্ত্রের (রাসায়নিক, জৈব ও পারমাণবিক অস্ত্র বাদে অন্য অস্ত্রগুলো) যোগান এই রাষ্ট্রগুলো থেকে আসে। বেশিরভাগ নিরাপত্তা বিশ্লেষক বিশ্বাস করতেন যে স্নায়ুযুদ্ধ শেষে এই অস্ত্র বাণিজ্যে একটি ভাটা সৃষ্টি হবে এবং এবং অস্ত্র উৎপাদনের সাথে জড়িত ইন্ড্রাস্ট্রিগুলো তাদের শক্তিকে শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করবে, কিন্তু ২১ শতাব্দীতে এসে অস্ত্র বাণিজ্য আবারো চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
শান্তির ,গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা ইত্যাদির বার্তা আওড়িয়ে বেরানো যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অস্ত্রের যোগান দাতা। বিশ্বের মোট অস্ত্র বানিজ্যের প্রায় অর্ধেকই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যার পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রতি বছর)। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে রাশিয়াকে যেখানে অস্ত্র বাণিজ্যের জন্য প্রধান আসামি করা হয় সেই রাশিয়ার সরবরাহ অস্ত্রের পরিমাণ মোটের এক-দশমাংশ (প্রতি বছর)। এই দুই শক্তির বাহিরে, বৃটেন ও ফ্রান্সও অনেক পরিমাণ অস্ত্র প্রতিবছর রপ্তানি করে থাকে।
এছাড়াও চীন ৩য় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে সস্তায় ভালো পরিমাণ অস্ত্র রপ্তানি করে যাচ্ছে।
যখন অস্ত্র, গোলাবারুদ ও যুদ্ধে ব্যবহৃত সরঞ্জাম এক দেশ থেকে অন্য দেশে ট্রান্সফার বা সরবরাহ করা হয় তখন তাকে অস্ত্র বাণিজ্য বলে। এই ট্রান্সফার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অথবা সামরিক সহায়ক প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে হতে পারে। এই ট্রান্সফারের প্রধান ও একমাত্র বৈধ গ্রাহক হল রাষ্ট্র। কিন্তু কালোবাজারি থেকে বিরাট পরিমাণের অস্ত্র প্রতিবছর বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী, বিপ্লবী সংগঠন ও প্যারামিলিটারি দলগুলো হাতিয়ে নেয়। বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশই যায় ৩য় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের আমদানি করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, যেমনঃ ইসরায়েল, সৌদি আরব, কুয়েত ও আরব আমিরাত।
স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যকে চরমভাবে ব্যহত করেছিলো। ১৯৮০র দশকের তুলনায় ১৯৯০র দশকে অস্ত্রের দাম একদম অর্ধেকে নেমে আসে। ফলাফল হিসেবে অস্ত্র তৈরি শিল্পের ভবিষ্যৎে অন্ধকার নেমে আসে। অন্যদিকে ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ও জনমত অস্ত্র বাণিজ্য বিস্তারেরর ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অস্ত্র শিল্পগুলোর বিরুদ্ধে অস্ত্র উৎপাদনের এথিকস অনুসরণ না করার অভিযোগ আনা হয় এবং দেশব্যাপী বিভিন্ন মুভমেন্ট দেখা যায়। সমালোচকরা অস্ত্র বাণিজ্যের সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়কে যুক্ত করেন, এবং জোর দিয়ে বলেন এই বাণিজ্যই সব ধরনের যুদ্ধের জন্য দায়ী এবং আর্থিক ও হতাহতের দিক থেকে সেই যুদ্ধগুলো মারাত্মক ফলাফল বয়ে আনে। তারা আরও উল্লেখ করেন প্রতি বছরই রপ্তানিকারক দেশগুলো প্রচুর পরিমাণ ক্ষুদ্র অস্ত্র বিক্রি করে, বিশেষ করে কালো-বাজারি করে এবং বিশ্বব্যাপী এই ক্ষুদ্র অস্ত্র ব্যবহারে গড়ে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ খুন হয়।
মজার ব্যাপারটি হল, অস্ত্র প্রস্তুতকারক শিল্পগুলো অন্য ব্যাখ্যা দাড় করাবার চেষ্টা করেন। তারা বলেন এভাবে অস্ত্র বাণিজ্য থেকে সরে গেলে এবং অস্ত্র তৈরি ছেড়ে দিলে রাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্র সংকুচিত হবে, যা সর্বাংশে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নেতিবাচক সাব্যস্ত হতে পারে পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নেও দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। তারা আরো দাবী জানান যে, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি সম্পূর্ণই রাজনৈতিক হিসেব নিকাশের ফল, তাদের তৈরি অস্ত্রই যে এই হীন কাজগুলো করার জন্য তৈরি এটা তারা মানতে নারাজ। তারা উদাহরণ হিসেবে রুয়ান্ডা গণহত্যার ব্যাপারটা নিয়ে আসেন, এবং বলেন যে সেখানে প্রায় ৮ লক্ষ তুতিসিদের আঞ্চলিক দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের মতে রাষ্ট্রগুলো চাইলেই অস্ত্র শিল্পের বিনাশ ঘটাতে পারে কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ও আর্থিক সুবিধা আদায়ের প্রয়োজনে তাদের আবারো সেই মৃত শিল্পকে বাচিঁয়ে তুলতে হবে। যুদ্ধের সকল সিদ্ধান্ত ও ক্ষয়-ক্ষতি সম্পূর্ণটাই রাজনৈতিক স্বার্থের উপর নির্ভরশীল।
সমালোচকরা আরো বলেন অস্ত্র আমদানি করতে ৩য় বিশ্বের দেশগুলোর যে পরিমাণ সম্পদ খরচ হয় তা দিয়ে এই উন্নয়নশীল দেশিগুলো তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে পারতো। কিন্তু অস্ত্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো দাবী করে আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে একটা শক্তির ভারসাম্য অবস্থা ফিরিয়ে আনতে অস্ত্র বাণিজ্যের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। যদিও এই ধরনের বক্তব্য শিল্পগুলো নিজেদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য আওড়ে বেড়ায়, কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে যে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধ ও সংঘাতের ইতিহাস তাদের এই যুক্তিকে কোনভাবেই সমর্থন করে না।
যাইহোক, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যাতে অস্ত্র বাণিজ্যের হার বেড়ে না যায়, এবং অনেকাংশে হ্রাস করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে লম্বা দূরত্বের ব্যালেস্টিক মিশাইল, ল্যান্ড মাইনের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং অস্ত্র রপ্তানি প্রক্রিয়ার উপর কড়া নজরদারি বৃদ্ধি । ১৯৯১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বার্ষিক প্রধান প্রধান যুদ্ধাস্ত্রের আমদানি ও রপ্তানির উপর একটা রেজিষ্ট্রেশন সিস্টেম চালু করতে করতে যদিও এই তথ্যগুলো নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়াটি রাষ্ট্রের ও অস্ত্র শিল্পগুলোর স্বেচ্ছাধীন রাখা হয়েছে। কিন্তু অস্ত্রের কালো বাজারি ঠেকাতে অয়ারে এমন শক্ত পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। আর এই পথ দিয়েই বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্যের একটা বড় অংশ পরিচালিত হচ্ছে।
অনুবাদকঃ বদিরুজ্জামান
মূল বইঃ International Relations Key Concepts.
No comments