Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
মার্কসবাদ- সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তার সমন্বয়ে বিকশিত একটি তত্ত্ব। মার্কসবাদ তত্ত্বটি মানব জীবন, ঐতিহাসিক উন্মেষ, পুঁজিবাদী সংকট ও কমিউনিস্ট বিপ্লবের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। জার্মান মহান দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস তার বন্ধু ও একনিষ্ঠ সমর্থক ফ্রেডরিক এংগেলসকে সাথে নিয়ে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মার্কসবাদ তত্ত্বটির বিকাশ ঘটান। ইউরোপে উদ্ভুত হওয়ার কিছু সময় বাদেই মার্কসবাদ বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী দর্শন হিসেবে ছড়িয়ে
পড়ে।
যদিও মার্কসবাদকে ঘিরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নানান তর্ক-বিতর্ক ও সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু কিছু মৌলিক বিষয়ে সকল বিশ্লেষকই ঐক্যমত পোষণ করায় সেই প্রথম থেকে মার্কসবাদ একটা প্রভাবশালী তত্ত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। বিংশ শতকের সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাকে মার্কসীয় দর্শন দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ফলাফল হিসেবে কমিউনিস্ট বিপ্লব ও সংস্কারের নামে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই মার্কসবাদের অনুপ্রবেশ ঘটে।
উৎসঃ
মার্কসের লেখা গ্রন্থগুলো বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে মার্কসবাদ তিনটি প্রধান উৎস থেকে বিকশিত হয়েছে। যথাঃ
১. জার্মান দর্শন
২. ফরাসী রাজনীতি এবং
৩. বৃটিশ অর্থনীতি
মার্কসের প্রথম দিকের লেখাগুলো থেকে বুঝা যায় শিক্ষাজীবনে মার্কসের দর্শন ও আইনি বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো। পরবর্তীতে মার্কস রাজনৈতিক অর্থনীতি (Political Economy) এবং রাজনৈতিক কলাকৌশল (Political Strategy) নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
জার্মান দর্শনের ক্ষেত্রে উইলহেম ফ্রেডরিক হেগেলের ভাববাদী সমাজতন্ত্র, ইয়ং হেগেলিয়ান ও লুডউইক ফুয়েরবাখের বস্তুতান্ত্রিক ব্যাক্ষা মার্কসকে আকৃষ্ট করে। বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ণকালে মার্কস ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি সেখানে হেগেলের ভাব ধারায় প্রভাবিত হন এবং ইয়াং হেগেলিয়ান দলের সদস্যভুক্ত হন।
মার্কসের মৌলিক কিছু আইডিয়া যেমনঃ সুশীল সমাজের সমালোচনা করা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ ইত্যাদি অনেকখানি তার বিখ্যাত গ্রন্থ Critique of Hegel's Philosophy of Right থেকে উদ্ভুত। মার্কস Thesis on Feuerbach থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করেন এবং মার্কসীয় দর্শন প্রতিষ্ঠায় প্রলেতারিয়াদের উত্থানকে আবশ্যিক উল্লেখ করেন। হেগেলের যুক্তিবাদ (Logic) ও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি (Dialectic Methods) মার্কসকে প্রভাবিত করে। মার্কসের জগতবিখ্যাত গ্রন্থ Capital বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় হেগেল কতটা মার্কসকে প্রভাবিত করেছিলেন।
ফরাসী রাজনীতি ও সমাজতান্ত্রিক মুভমেন্ট মার্কসের চিন্তা ভাবনা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কসের শ্বশুর- Baron Von Westphalen সহ তার অধিকাংশ শিক্ষকরাই ফরাসী বিপ্লব ও ফরাসী এনলাইটমেন্টকে শক্তভাবে ধারণ করতেন। মার্কস নিজেও ফরাসী বিপ্লব ও ফরাসী চিন্তাবিদ জ্যা জ্যা রুশোর লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হন।
জার্মান সরকারের নিপীড়ন থেকে বাচতে মার্কস সস্ত্রীক ফ্রান্সে পারি জমান, এবং সেখানে তিনি সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের সাথে পরিচিত হন, যারা ফ্রান্সের শ্রমিক শ্রেণীর নিগৃহীত জীবন ব্যবস্থা মার্কসমে প্রত্যক্ষ করান। ফরাসী সমাজতন্ত্র ও মার্কসের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মার্কসকে হেগেলের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা থেকে দূরে নিয়ে যায়। পক্ষান্তরে, হেগেলের ভাববাদী ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার বিপরীতে মার্কস দেখানোর চেষ্টা করেন ব্যক্তির ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে আধুনিক পুঁজিবাদী শিল্প দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, এবং সমাজতন্ত্র এই বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ করে।
বোনাপার্টিজমের বিকাশ সম্পর্কে মার্কসের অনেক পড়াশোনা করেন এবং প্যারিস কমিউনের প্রকৃতি ও গুরুত্ব কেমন হওয়া উচিত তার একটা নির্দেশিকা মার্কস ফরাসী সোসালিষ্টদের দেন। Class Struggle in France ও The Eighteenth Brumaire নামে মার্কস বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক নিবন্ধ প্রকাশ করেন- যেখানে তিনি রাষ্ট্র (State) ও বিপ্লবের (Revolution) মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা চালান।
মার্কসের মার্কসবাদ তত্ত্বটির তৃতীয় প্রধান উৎস হল ব্রিটিশ অর্থনীতি, যেমনঃ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো, থমাস মেলথ্যাস প্রমুখের অর্থনীতি তত্ত্ব। ফ্রান্সে বসবাসকালে মার্কস ব্রিটিশ অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন, এবং ১৮৪৪ সালের দিকে মার্কস ব্রিটিশ অর্থনীতির উপর যথেষ্ট পান্ডিত্য অর্জন করেন। মার্কস যখন ইংল্যান্ডে পারি জমান, তখন তিনি ব্রিটিশ অর্থনীতি নিয়ে গভীর ও পদ্ধতিগত গবেষণা শুরু করেন। ১৮৪৪ সালে মার্কস বেশ কিছু পান্ডুলিপি রচনা করেন যেখানে তিনি এডাম স্মিথের অর্থনৈতিক তত্ত্বের সমালোচনা করেন, বিশেষত শ্রম বিভাজন (Division of Labour), ঋণ, পারিশ্রমিক এবং ত্রয়ী সামাজিক বিন্যাস প্রভৃতি এই সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলো।
কিন্তু, যখন মার্কস ডেভিড রিকার্ডোর The Principles of Political Economy বইটা পড়েন, তখন থেকেই তিনি তার পান্ডুলিপিতে অর্থনীতি তত্ত্বের বদলে রাজনৈতিক অর্থনীতি (Political Economy) নিয়ে বেশি লেখালেখি শুরু করেন। রিকার্ডোর কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে মার্কস The Poverty of Philosophy বইটি রচনা করেন। এই গ্রন্থে মার্কস লন্ডনে পুঁজিবাদের বিকাশের ইতিহাস গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন, এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজের একটা স্বতন্ত্র জায়গা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
অতএব, যদিও মার্কসবাদ তত্ত্বটি বিভিন্ন উৎস থেকে বিকশিত হয়েছে, কিন্তু সেক্ষেত্রে মার্কস বিচক্ষণতার সঙ্গে এই বিচিত্র বিষয়গুলোকে সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। এক্ষেত্রে জার্মান দর্শন, ফরাসী রাজনীতি ও ব্রিটিশ অর্থনীতি- দার্শনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুধাবনে মার্কসবাদ তত্ত্ব উন্মেষে মার্কসকে সুযোগ করে দিয়েছে।
অনুবাদকঃ বদিরুজ্জামান
![]() |
| বদিরুজ্জামান |
No comments