(BRICS) ব্রিকসঃ ভবিষ্যৎবানী থেকে বাস্তবতা
![]() |
| BRICS- সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্রপধানেরা |
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ Jim O’neil ২০০১ সালে পৃথিবীর উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, ও চীনকে নিয়ে
একটি ভবিষ্যৎবাণী করেন, এবং প্রথমবারের মত এই দেশগুলোকে নিয়ে একটি নতুন টার্ম প্রদান
করেন, যার নাম BRIC
(Brazil, Russia, India, China) ।
তিনি বলেন, ২০৫০ সালের মধ্যে এই চারটি দেশ বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ
করবে। তাঁর এই ভবিষ্যৎবাণীর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ, দেশগুলোর জনসংখ্যা
বৃদ্ধির প্রভাব, দক্ষ জনশক্তি, ভৌগোলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার, ইত্যাদি।
২০০১ সালে ব্রিক (BRIC) টার্মটি প্রথমবার
ব্যবহৃত হলেও, ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি ছিলো কেবলই কল্পনা। ২০০৬ সালের জাতিসংঘের ৬১তম
সাধারণ পরিষদে ব্রিকস, একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করার
ঘোষণা দেয়।
২০০৯ সালের ১৬ই জুন, রাশিয়ার ইকতেরিনবার্গ শহরে, রাশিয়ার আমন্ত্রণে
ব্রিকসের প্রথম সামিট অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সময়ে বিশ্বব্যাপী মন্দা মোকাবিলাই ছিলো,
ব্রিকসের প্রথম সামিটের প্রধান লক্ষ্য।
★ BRICS-ব্রিকসঃ কি, কেন এবং কারা
ব্রিকস একটি অর্থনৈতিক জোট যা ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিকসের
মূল লক্ষ্য হচ্ছে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন, বিনিয়োগ, বাণিজ্য
সম্প্রসারণ, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অংশীদারিত্ব, এমনকি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মাঝে রাজনৈতিক
সম্পর্কের উন্নয়ন।
২০১০ সালে এই জোটে নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।
অর্থাৎ, বর্তমানে ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা ৫টি রাষ্ট্র। যার মাঝে এশিয়ার দুটি, ইউরোপের
একটি, আফ্রিকা মহাদেশের একটি এবং ল্যাটিন আমেরিকার একটি দেশ প্রতিনিধিত্ব করছে।
ব্রিকসকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন মেরুকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ
জোট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যেমনঃ
●
ব্রিকসের সদস্য
রাষ্ট্রগুলোতে পৃথিবীর অন্তত ৪২% মানুষ বসবাস করে।
●
ব্রিকসের সম্মিলিত
অর্থনৈতিক পূঁজি ২০.৬ ট্রিলিয়ন ডলার। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের
চেয়েও বেশি।
●
ব্রিকসের নিজস্ব
ব্যাংক ব্যবস্থা রয়েছে। চীনের সাংহাই অঞ্চলে অবস্থিত এই ব্যাংকের নাম "নিউ ডেভেলপমেন্ট
ব্যাংক।" যার অধীনে ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রের নানা প্রকল্পে বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তা
প্রদান করে থাকে।
●
ব্রিকসের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে
অন্যান্য সাধারণ সংগঠনগুলোর মত মনে হলেও, ব্রিকস De-dollarization
বা বিশ্বব্যাপী ডলারের আধিপত্য খর্ব করতে
এবং এর বিপরীতে ভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ শক্তিশালী জোট ও সংগঠনই পশ্চিমা মডেলে তৈরি করা
হয়েছে, কিংবা পশ্চিমা মদদে পরিচালিত হচ্ছে। গ্লোবাল অর্গানাইজেশনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ,
বিশ্বব্যাংক, কিংবা আইএমএফের মত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও বিতর্ক আছে- পশ্চিমা স্বার্থ,
পশ্চিমা নীতি, এবং পশ্চিমাদের আদর্শ অনুসরণ ও মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করার।
ব্রিকস এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের জন্যে একটি হুমকি স্বরূপ। নামে অর্থনৈতিক
জোট হলেও, ব্রিকস জড়িয়ে আছে বিশ্বরাজনীতির আষ্ঠেপৃষ্ঠে।
★ নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NEW DEVELOPMENT BANK)
ব্রিকসের উদ্যোগে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। ব্যাংকটি ব্রিকসের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক, যার মোট সদস্য সংখ্যা, ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রসহ ৯টি দেশ। অন্যান্য ৪ টি দেশ হচ্ছেঃ বাংলাদেশ, উরুগুয়ে, মিশর, ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
ব্রিকসের সমস্ত অর্থনৈতিক লেনদেন এই ব্যাংকের মাধ্যমেই সম্পন্ন
হয়ে থাকে৷ নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হেডকোয়ার্টার চীনের সাংহাই অঞ্চলে অবস্থিত এবং
এর বর্তমান চেয়ারম্যান, ব্রাজিলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দিলমা রৌসেফ।
গত ২০২২ সালের ২৩শে জুন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দেন, ব্রিকসের উদ্যোগে এবং নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অধীনে, নতুন একটি মুদ্রা চালু করা হবে। যা ব্রিকস সদস্য সহ অন্যান্য যেকোন দেশের সাথে অর্থনৈতিক লেনদেন, বিনিয়োগ, ঋন, এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের বিকল্প ও আন্তজার্তিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
যার বেশকিছু প্রমাণ আমরা সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন রাষ্ট্রের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখতে
পাই। যেমনঃ রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধের (২০২২-চলমান) সময় পশ্চিমাদের প্রচণ্ড অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার
কাছ থেকে তেল কিনছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারত এই তেলের দাম পরিশোধ করে চাইনিজ মুদ্রা "ইউয়ান" দিয়ে৷ এতে করে রাশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কে সহজেই এড়িয়ে গেছে। এমনকি বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা কিনা রাশিয়ান সহায়তায় তৈরি হচ্ছে- সেটির আর্থিক লেনদেনও "ইউয়ান" এ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
এতে
করে ব্রিকস রাষ্ট্রগুলোর মাঝে অর্থনৈতিক লেনদেনে এসেছে ভিন্নমাত্রা, একই সাথে আন্তর্জাতিক
মুদ্রা হিসেবে ডলারের বিপরীতে নতুন মুদ্রা চালু হবার সম্ভাবনাও বাড়ছে৷
নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং ব্রিকসের এমন উত্থানকে তাই হুমকি হিসেবে
দেখছে জি-৭, আইএমএফ, ওয়ার্ল্ডব্যাংক সহ অন্যান্য পশ্চিমামুখী আন্তজার্তিক সংগঠনগুলো।
কেননা অর্থনৈতিক জোট হিসাবে ব্রিকস অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে
উঠলে বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রভাব ক্রমশই কমে
আসতে পারে।
★ BRICS- ব্রিকসের সাম্প্রতিক কার্যক্রম ও সম্প্রসারণ
২০২২ সালে চীন ব্রিকসের চেয়ারম্যানশীপ গ্রহন করে, এবং এক দশক পর, জোটটির সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব অনুসারে জোটে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাতিন আমেরিকা, এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে।
চীনের মতে, জোটের সম্প্রসারণের
ফলে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থাৎ গ্লোবাল-সাউথ এর রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক
উন্নয়ন, ও নিজেকের অবস্থান আরো দৃঢ় হবে৷
একদিকে চীন যেমন বিশ্ব রাজনীতিতে শান্তি ও মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসেবে
পরিচিতি পাচ্ছে বিভিন্ন দেশের মধ্যকার বিবাদ মীমাংসা করে, তেমনি ব্রিকসের মাধ্যমে একটি
বৃহত্তর জোটের সৃষ্টি করছে যা পশ্চিমা বিরোধী স্বার্থ রক্ষা করবে।
এখানে চীনের অন্য আরেকটি স্বার্থ হচ্ছে, জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে চাওয়া নতুন
রাষ্ট্রগুলোর প্রায় সকলেই চীনের BRI (Belt and
Road Initiative) প্রকল্পের সাথে
জড়িত। ব্রিকসে সদস্য হতে চাওয়া নতুন রাষ্ট্রগুলো হচ্ছেঃ সৌদি আরব, ইরান, বাংলাদেশ,
সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি।
যুগের পর যুগ ধরে চলমান সৌদি-ইরান বৈরিতাও কমে এসেছে চীনের মধ্যস্থতায়।
এরই মধ্যে দুটি দেশ ব্রিকসে যোগদান করতে ইচ্ছুক হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমা অধীনস্থ
রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ আসতে পারে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতির চেয়েও বেশি প্রভাব
পড়বে অর্থনীতি ও তেলের আধিপত্য নিয়ে।
সৌদি আরব ব্রিকসে যোগদান করলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পশ্চিমাদের
পেট্রো-ডলার অর্থনীতিতে বড়সড় ধাক্কা আসতে পারে। একই সাথে ডলারের পরিবর্তে ভিন্ন মুদ্রায়
তেলবাণিজ্য ধ্বস নামাতে পারে পশ্চিমা অর্থনীতিতে।
তবে এও সত্য, সৌদি-ইরানের নতুন সম্পর্ক কতদিন স্থায়ী হবে, ব্রিকসের
ভেতর চীন-ভারত দ্বৈরথ কি আদৌ কমবে কিনা, এবং ব্রিকস সদস্যদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে
পড়বে কিনা- এসকল আশংকা এখনও রয়েই যায়।
★ BRICS- ব্রিকসে বাংলাদেশ?
২০২৩ সালের জুনের ১৪ তারিখ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ খুব শিগগিরই ব্রিকসের সদস্যপদ
পেতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকসের ১৫তম সামিটে
বাংলাদেশ সদস্যপদ পেতে পারে।
ব্রিকসে যোগদানের ফলে বাংলাদেশ পশ্চিমাদের স্যাংশন, ভিসানীতি সহ নানা চাপের বিরুদ্ধে একটি পালটা রাজনৈতিক চাল খেলতে পারে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত
উন্নয়নে চীন ও রাশিয়ার ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে, জোটে যুক্ত হওয়ায় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের
আরো উন্নতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে পশ্চিমাদের তরফ থেকে আগামীতে বাংলাদেশের ওপর আরো চাপ
বাড়ার সম্ভাবনা রয়েই যায়।
অন্যদিকে, ব্রিকস রাষ্ট্রগুলোতে বাংলাদেশের তেমন রপ্তানি নেই বললেই
চলে৷ বরং, বাংলাদেশ অধিকাংশ আমদানি করে থাকে এসকল দেশগুলো থেকে। ব্রিকসে যোগদানের ফলে
পশ্চিমা বাজারে বাংলাদেশের পোষাক রপ্তানির ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েই যায়।
ভৌগোলিক অবস্থান, রাজনীতি, এবং বাণিজ্য- সবদিক বিবেচনা করে, আশা
করা যায়, বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদান এই দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলেও অর্থনৈতিকভাবে নতুন সম্ভাবনার
সৃষ্টি করতে পারে।
মোহাম্মদ ইরফান সাদিক রাজিন
স্নাতক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
rajinsadik110@gmail.com


No comments