Header Ads

Header ADS

International Monetary Fund (IMF): আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নানাদিক

 

International Monetary Fund (IMF): আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নানাদিক

‘দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশন’ ১৯৩০- আধুনিক শিল্পন্নোত অর্থনীতিকে চরম ধাক্কা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের শিল্প-ভিত্তিক কাঁচামালের দরপতন, আকাশচুম্বি বেকারত্ব, ব্যাংকের পর ব্যাংকের দেউলিয়াত্ব, উৎপাদনশূণ্য কল-কারখানা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ধ্বস প্রভৃতি দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশনের ধাক্কার ব্যপকতাকে বুঝতে সাহায্য করে। ঐতিহাসিকরা বলেন, মহামন্দার করাল আঘাত অধিকাংশ জার্মানকে হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনীতি মেনে নিতে প্ররোচিত করেছে।

 

উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিন্তু সকলের জন্য ধ্বংসাত্মক ছিলো না! বিশেষত অর্থনীতির দিক বিবেচনায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলছিল এবং মহামন্দার ক্ষতি কাটিয়ে উঠে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করেছিলো। 


ইউরোপের যুদ্ধরত দেশ যুদ্ধের কাঁচামালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করত। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেকারদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, উপার্জন বৃদ্ধি পায়, এবং মুদ্রামানে ভারসাম্য আসে। 


তবে, এই সমৃদ্ধি আমেরিকার নীতি নির্ধারকদের মাঝে একটি চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। তাহলো- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা যায়। 


এবাদেও তাদের মাঝে কয়েকটি প্রশ্ন জাগেঃ 

১। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবস্থায় কি আবারও কোন বড় ধাক্কা আসবে? 

২। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানিকারক দেশকে কি আবারও চড়া শুল্ক আরোপ করবে? 

৩। দেশজুড়ে বেকারত্ব কি আবারও বৃদ্ধি পাবে? প্রভৃতি। 


IMF প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী? 

ব্রেটন উডস সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিলো যেন এই অঘটোনগুলো না ঘটে। ব্রেটন উডস সম্মেলনের প্রথমিক লক্ষ্য দুইটি। যথাঃ 

১। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনায় প্রয়োজনে একটি স্থির মুদ্রাব্যবস্থা/ বিনিময় হার তৈরি করা; এবং 

২। শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বানিজ্য প্রসার ঘটানো।


এই দুই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সম্মেলনের পরে বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) চালু হয়। যাহোক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রথম অনুচ্ছেদে IMF প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। যথাঃ 

১. আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সহযোগিতা করা;

২.    আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে সহায়তা করা; 

বেকারত্ব কমিয়ে- কর্মক্ষম জনগণ তৈরিতে ভূমিকা রাখা; 

৩. একটি স্থির বিনিময় হার ব্যবস্থা বজায় রাখা;

৪.   বৈদেশিক মুদ্রা ও পণ্য বিনিময়ে বাধা হ্রাস পাওয়া; 

৫. সদস্য দেশের বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে বিশেষত বাজেট সহায়তা দেওয়া।


Par Value System কী?

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো মুদ্রামাণ ব্যবস্থা বা Par Value System। এই ব্যবস্থাটি ১৯৪৪ সালে IMF যাত্রা করা থেকে শুরু করে ডলার ভিত্তিক মুদ্রামাণ ব্যবস্থার বিপরীতে ১৯৭৩ সালে সোনা ভিত্তিক মুদ্রামাণ ব্যবস্থার প্রচলণ অবদি চালু ছিল। 


আমেরিকান ডলারকে মুদ্রা বিনিময়ের হার ধরে IMF-এর কার্যক্রম শুরু হয়। IMF-এর সদস্যদের ডলারের মানের ভিত্তিতে নিজস্ব মুদ্রামান নির্ধারণ করতে হয়। ডলারের দামের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শতকরা একভাগ পরিবর্তনের বেলায়ও সদস্যদের সাথে আলোচনার প্রয়োজন পড়বে, অর্থাৎ, একটা চেক এন্ড ব্যালেন্স ব্যবস্থা চালু হবে যাকে IMF-এর ভাষায় Par Value System বলা হয়। 


IMF- এ Par Value System কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। যথাঃ 

এই ব্যবস্থায় ডলার অথবা সোনার ভিত্তিতে যেকোন দেশের মুদ্রার একটি স্থায়ী মান নির্ধারিত হত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্য বা বিবিধ কারণে দেশটি এই নির্দিষ্ট মানেই তার মুদ্রা বিনিময় করতো। 

এই ব্যবস্থার অধীনে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে IMF থেকে সাহায্য পেত IMF-এর সদস্যরা। 

ডলার বা সোনার মূল্যে মুদ্রামাণ নির্ধারনে জোর দেওয়া হয়েছিলো এই ব্যবস্থায়।

তবে, ১৯৬০ এর দশক হতে এই মুদ্রামাণ ব্যবস্থা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ফলে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চাপ বৃদ্ধি পায়। অবশেষে, ১৯৭৩ সালে ব্রেটন ঊডস সিস্টেমের পতনের মধ্য দিয়ে মুদ্রামাণ ব্যবস্থার ইতি ঘটে।  


IMF ও মুদ্রামাণ ব্যবস্থাঃ 

প্রাথমিক পর্যায়ে বিনিয়োগকারী, উৎপাদক, ও সদস্য দেশ IMF-এর Par Value System থেকে লাভবান হন। কারণ এই সিস্টেম সকল অংশীদারদের সামনে ডলারের দামের ভিত্তিতে কিভাবে বিভিন্ন মুদ্রামান নির্ধারিত হবে তার স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। 


কিন্তু ডলার কেন্দ্রিক Par Value System ১৯৭০ অবদি চালু ছিলো। কারণ, ১৯৭০ এ যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে মুদ্রামাণের একক থেকে সরিয়ে নেয়, এবং সোনার দামের ভিত্তিতে নতুন করে মুদ্রামান শুরু করে। এই নতুন ব্যবস্থায়ও IMF-এর সদস্যরা অংশী হয়। 


IMF- এর কাজের পরিধি পরিবর্তনঃ  

১৯৭০-এর পরবর্তী IMF-এর কাজের প্রকৃতি অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মুদ্রামান স্থির/ স্থিতিশীল রাখার সাথে আর্থিকভাবে দুর্গতির (Crisis) শিকার দেশে আর্থিক সাহায্য দেওয়াও IMF-এর কাজের একটি অংশ হয়ে ওঠে। 


বস্তুত, IMF ক্রমান্বয়ে নিজেকে একটি অর্থনৈতিক সঙ্কট ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। যে দেশগুলো আর্থিক ও মুদ্রামান জনিত সমস্যায় ভুগছে- IMF তাদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়ক প্রদানের আশ্বাস দেয়। ক্রমেই, IMF দেশগুলোর নিকট সর্বশেষ ভরসা বিন্দুতে (ঋণের ক্ষেত্রে) পরিণত হয়। 


এভাবেই IMF রাষ্ট্রের Balance of Payment বা বাণিজ্য ঘাটতি নির্ধারণ ও সমাধানের একক শক্তিমত্তা লাভ করে। এক্ষেত্রে IMF তার Structural Adjustment Programme (SAP) প্রোগ্রামের আলোকে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের চেষ্টা করে। কিন্তু SAP প্রোগ্রামটি দারিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিপরীত হয়, অর্থাৎ, সরকারি প্রণোদনা বা বাজার ব্যবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ হয়। 


Structural Adjustment Programme (SAP) কী? 

বাণিজ্যে ঘাটতি বা ভারসাম্যহীনতা সমস্যায় বিশ্বের অনেক দেশ আক্রান্ত। এই জটিলতা প্রশমনে বা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও বিশ্বব্যাংক সমন্বিতভাবে কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা (IMF ও WB) বিভিন্ন প্যাকেজ- আকারে সমস্যায় জর্জড়িত দেশের উত্তরণের চেষ্টা চালায়। এই প্যাকেজকে সার্বিকভাবে Structural Adjustment Programme (SAP) বলে। 


এই প্যাকেজগুলো বিভিন্ন ধরণের কাঠামোগত ঋণের ব্যবস্থা করে যাকে Structural Adjustment Loan (SAL) বলে। পাশাপাশি, বিভিন্ন শর্ত ও কৌশলের ভিত্তিতে কোন একটি রাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিতে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে। 


এই ভারসাম্য আনয়নে তারা যে কৌশলগুলোর কথা বলেঃ 

সরকারি অনুদান/ প্রণোদনা হ্রাস করা,  

স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভর্তুকীর পরিমাণ কমিয়ে আনা,

রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারিকরণ, 

মুদ্রামাণ পূনঃমূল্যায়ন,

রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী কাজে সরকারি প্রণোদনা কমানো, 

বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে বিনাশুল্কে দেশের বাজারে প্রবেশের সুবিধা প্রদান, এবং

মুক্ত বাজার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষে দেশের বাজার ব্যবস্থা থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনা। 


প্রাথমিক পর্যায়ে SAP-এর উদ্দেশ্য ছিলো তিনটি। যথাঃ 

১. দেশের ভিতরে বিদেশি বিনিয়োগের পথকে উন্মুক্ত করা,

২. চাহিদা বিবেচনায় অর্থের যোগান বৃদ্ধি, এবং

৩. দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধরে রাখতে কাঠামোগত সংস্কার সাধন। 


SAP-এর প্রধাণ লক্ষ্য ঋণগ্রস্ত দেশকে উপার্জনক্ষম করে তোলা যাতে সে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারে। 


তবে শর্ত থাকে যে, SAP-এর অধীনে ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সুপারিশের প্রয়োজন পড়বে। IMF এক্ষেত্রে দেশকে বেশিমাত্রায় রপ্তানিমূখী হওয়ার জন্য SAP-এর অধীনে সুপারিশ করবে। 


আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের মতে, একটা রাষ্ট্র যত বেশি রপ্তানিমূখী হবে, তত তার উপার্জন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, এবং ঋণের চক্র/বোঝা থেকে রাষ্ট্রটি মুক্তি পাবে। 


IMF কে ঘিরে কিসের এত সমালোচনা?

দুর্ভাগ্যক্রমে, IMF-এর সমার্থকের চেয়ে সমালোচক বেশি। কিছু অর্থনীতিবিদের ভাষায়, বিশ্ব অর্থনীতি আরও কার্যকর হত যদি না IMF থাকতো। IMF এর প্যাকেজ, অর্থাৎ, SAP এর প্রোগ্রামগুলো সংকটকে প্রশমনের বদলে সংকটকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে। 


তবে, অন্য অনেক অর্থনীতিবিদের ভাষায়, যদিও IMF কে অনেক সমালোচনা রয়েছে, তবুও, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক স্থিতি বজায় রাখতে IMF- অনেক রাষ্ট্রের সরকারের (যেমনঃ আফ্রিকা) তুলনায় বেশি কার্যকর ও স্বচ্ছ। 


যদিও তারা IMF এর সংস্কারে সম্মতি দেন, কিন্তু IMF- কে সম্পূর্ণরূপে বাতিলের পক্ষে নন তারা। কারণ, কোন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অভাবে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিক্রমা চরম বাঁধাগ্রস্থ হবে যেমনটি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে।


পরিশেষঃ 

বস্তুত, মানুষের প্রয়োজনীয়তা ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে IMF-কে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকেও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশেষ বিঁধান/ ছাড়ের দরকার। তাহলেই, IMF- এর যাত্রা আরও দীর্ঘায়িত হবে, এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।

  




ভাবানুবাদকঃ 
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়  

 

মূল বই: 
International Relations: The Key Concepts 
By- Martin Griffith, Tarry O'Callagahan & Steven C. Roach











 

 


No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.