Header Ads

Header ADS

The US Indo-Pacific Strategy, 2022: সহজে বুঝে নিন

THE US INDO-PACIFIC STRATEGY 2022: সহজে বুঝে নিন


Indo-Pacific Strategy 2022


এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল যাকে পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় “ইন্দো-প্যাসিফিক” অঞ্চল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি এমন নয় যে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে হঠাতই মাতামাতি শুরু করেছে। বস্তুত, স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময় অদ্যবধি  এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্বের এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে । 

তবে, বারাক ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট হন তখন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক বৈদেশিক নীতিকে এশিয়া প্যাসিফিকের দিকে ঘোরানোর ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে ট্রাম্প ও বাইডেন সে ঘোষণাকেই অনুসরণ করেন এবং ২০১৯ সালে প্রথমবারের মত “ইন্দো-প্যাসিফিক রিপোর্ট” প্রকাশের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন  ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে একটি মুক্ত, নিরাপদ, নিশ্চিন্ত এবং সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। 

এরই ধারাবাহিকতায়, ২০২২ সালে বাইডেন সরকার “ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি” পেপার প্রকাশ করেন। কৌশলপত্রে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে স্বাধীন (Free), মুক্ত (Open), সংযুক্ত (Connectivity), সমৃদ্ধ (Prosperous), সহনশীল (Resilient) এবং নিরাপদ (Secure) অঞ্চল হিসেবে রূপান্তরের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।    
২০১৯ ও ২০২২ সালের ডকুমেন্ট দুটির সারাংশ ও লক্ষ্য মোটাদাগে এক হলেও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। যথাঃ 
ক) ২০১৯ সংস্করণে রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া শিরোনামে তিনটি পৃথক অধ্যায় থাকলেও,  ২০২২ সংস্করণে রাশিয়ার কোন উল্লেখ নেই; উত্তর কোরিয়ার কথা একবার উল্লেখিত হয়েছে; এবং চীনের কথা প্রায় সমগ্র কৌশলপত্র জুড়েই রয়েছে!
খ) ২০১৯-এর থেকে ২০২২ সংস্করণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আরও নির্দিষ্ট করা হয়েছে; কিভাবে, কোন কোন ক্ষেত্রে ও কোন পদ্ধতিতে অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র ও অংশীদারদের সাথে সংযুক্ত হবে; এবং সেক্ষেত্রে মিত্র ও অংশীজনের ভূমিকা কেমন হবে প্রভৃতি বিষয়গুলো ২০২২ সংস্করণে লিপিবদ্ধ হয়েছে। 

ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, ২০২২- এর লক্ষ্যঃ 

ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্র, ২০২২ বিশ্লেষণে মোটাদাগে পাঁচটি অবজেক্টিভ বা উদ্দেশ্য চিহ্নিত করা যায়। যথাঃ 
১। মুক্ত ও স্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গঠন: ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে কৌশল পত্রে “Advance a free and open Indo-Pacific” তথা মুক্ত ও স্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যটির দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি নতুন অর্ডার বা সিস্টেম তৈরি করতে চায় যেখানে আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। 

এই উদ্দেশ্যটির দ্বারা অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ও সংকল্প পরিষ্কার হয়। যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলের সামুদ্রিক বাণিজ্য, যোগাযোগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রকে যেকোনো হুমকি থেকে মুক্ত রাখতে চান। United Nations Convention on the Law of the Sea (UNCLOS) অনুসারে “মুক্ত ও স্বাধীন” উদ্দেশ্যটি কৌশলপত্র যুক্ত করা হয়েছে। কনভেনশন অনুসারে উদ্দেশ্যটি প্রণীত হওয়ায় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী ভূমিকার বিপরীতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। 

এছাড়াও, বাণিজ্যিক কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে মুক্ত রাখাও জরুরি। পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ অত্র অঞ্চলের বাসিন্দা, গোটা পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি জিডিপি, পণ্য ও সেবা সংক্রান্ত বাণিজ্য, বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রভৃতি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। জাপান, চীন, আসিয়ান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মত অর্থনৈতিক শক্তি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে মুক্ত ও অবাধ রাখতে চায়, এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যও একই (তবে সামরিক হিসেবনিকেশ এক্ষেত্রে ভিন্ন)।  

২। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ অঞ্চল/ রাষ্ট্রের সাথে সংযুক্তকরণঃ কৌশলপত্রের দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি দ্বারা অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও অংশীদারদের মাঝে যোগাযোগ বৃদ্ধির দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কৌশলপত্রে অত্র অঞ্চলের আঞ্চলিক সংস্থার সাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থা, অংশীদার ও আগ্রহীদের মাঝে সংযোগ বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। উক্ত সংযোগের ফলে যুক্তরাষ্ট ও মিত্র এবং অংশীদারদের মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন এবং সাংস্কৃতিক ও সুশাসন বিকাশে পথ সুগম হবে। 

এই সংযুক্তির ফ্রেমে যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলের সফল সংস্থা আসিয়ান ও প্যাসিফিক দ্বীপাঞ্চলকে কেন্দ্রে রেখে তার কৌশলপত্রকে সাজিয়েছে, কেননা আমেরিকার মতে, চীনের সামরিক উত্থানে এই দুইটি জায়গা অধীক ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব এবং টেঁকসই উন্নয়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র ও পার্টনারদের চীনের বলয় থেকে বাহিরে রাখতে চায়। সেজন্য অর্থনৈতিক ও টেঁকসই উন্নয়ন বিবেচনায় কৌশলপত্র মোতাবেক একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র Indo-Pacific Economic Framework (IPEF) গঠন এবং সামরিক কৌশলগত বিবেচনায় কোয়াড-কে পুনরায় জাগ্রত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। 

যদিও বলা হচ্ছে কোয়াডের মূল লক্ষ্য থাকবে আঞ্চলিক ভিত্তিক অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করা এবং সেক্ষেত্রে জবাবদিহিতা, আইনের শাসন ও মানবাধিকার চর্চা করা, তবে অনেক বিশেষজ্ঞদের ভাষায় কোয়াড গঠনের মূল উদ্দেশ্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ন্যাটোর মত একটি সামরিক জোট তৈরি করা।   

৩। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক সমৃদ্ধি আনয়নঃ কৌশলপত্রের তৃতীয় লক্ষ্যটি হল অত্র অঞ্চলে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতি আনয়ন করা। প্রতিটি প্রিন্সিপালই এখানে গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীন ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য। শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের ফলে পারস্পারিক যোগাযোগ ও সৌহার্দ বৃদ্ধি পায়। শান্তিপূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিক অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশে বিশেষত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক। 

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অবকাঠামোগত উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে, তথ্য ও প্রযুক্তি বিকাশে সহায়ক হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতি ফিরে আসবে, এবং যখন অত্র অঞ্চলে শান্তি-প্রবৃদ্ধি-স্থিতি বিরাজ করবে তখন অত্র অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলো ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।  

৪। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা জোরদারঃ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যটি (অনেকের কাছে চিন্তার) হল অত্র অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করা। শুনতে সহজ এবং প্রয়োজনীয় মনে হলেও, এই নিরাপত্তায়নে অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমীকরণ যুক্ত হয়ে যায়, অন্তত অনেক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তাই ভেবে থাকে। অত্র অঞ্চলে চীনের সামরিক উপস্থিতির বিপরীতে প্রতিরক্ষা স্বরূপ নিরাপত্তা জোট গঠনের কথাও উঠে আসে কৌশলপত্রের এ অধ্যায়ে। 

QUAD, AUKUS, INDOCOM, IPS প্রভৃতি ইনিশিয়েটিভে সামরিক ও প্রতিরক্ষা জোরদারের কথা বলা হয়েছে। চীন এই ইনিশিয়েটিভগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ও প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখে যা অত্র অঞ্চলে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ইনিশিয়েটিভগুলোর (যেমনঃ বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, RCEP প্রভৃতি) প্রতি হুমকি স্বরূপ। এজন্য অত্র অঞ্চলে চীন যাদের স্ট্রাটেজিক পার্টনার হিসেবে দেখে তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির অংশ হতে বাঁধা দেয় বা নিরুৎসাহিত করে।  

৫। আন্ত-সীমান্ত হুমকি মোকাবিলায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধিঃ মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাড়িয়ে আছে আন্তঃসীমান্ত ঝুঁকিগুলো। যেমনঃ অবৈধ মৎস্য শিকার, মানব ও মাদক পাচার, সন্ত্রাস ও জলদস্যু, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন, ইত্যাদি আন্তঃসীমান্ত ঝুঁকির আয়তাধীন। এগুলোকে আন্তঃসীমান্ত ঝুঁকি বলা হয় কেননা এ ঝুঁকিগুলো কোন দেশের নির্দিষ্ট সীমানার মাঝে নির্দিষ্ট থাকে না, অন্য দেশের সীমান্তেও ছড়িয়ে পড়ে। 

যেমনঃ পরিবেশগত দুর্যোগ বা দূষণ কোন একক দেশের মাঝে সীমিত থাকে না, পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক কোন একক দেশে নেই, সন্ত্রাসের অবস্থানও কোন একক দেশে থাকে না। ফলে এহেন ঝুঁকি মোকাবিলা কোন একক দেশের পক্ষেও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই আন্তঃসীমান্ত ঝুঁকি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চরম আকার ধারণ করেছে যা মুক্ত ও অবাধ সামুদ্রিক যাত্রা, বাণিজ্য ও যোগাযোগের জন্য চ্যালেঞ্জ।

উক্ত বিবেচনায়, অত্র অঞ্চলের আন্তঃসীমান্ত ঝুঁকি নিরসনে পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্র। এক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক আদর্শে বলীয়ান হয়ে, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার আদলে সমন্বিতভাবে এহেন ঝুঁকি মোকাবিলায় অগ্রসর হওয়াকে কৌশলপত্র গুরুত্ব দিয়ে থাকে।     

লক্ষ্য পূরণে করণীয়ঃ 

ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রে পাঁচটি লক্ষ্য উল্লেখের পাশাপাশি, সে লক্ষ্য কিরূপে বাস্তবায়িত করা যায় তারও কিছু  (দশটি) নির্দিষ্ট উপায় উল্লেখ করা হয়েছে। যথাঃ 

১। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত ও টেঁকসই করতে প্রয়োজনীয় সম্পদের (প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম) যোগান দিতে হবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষত জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে অত্র এলাকায় প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ অধিক ভুমিকা রাখতে পারে। অত্র অঞ্চল ঘিরে যে সকল অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আগমন ঘটেছে সেগুলোকে কার্যকর ও অঞ্চলের দেশগুলোর কাছে আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদের যোগানকে নিশ্চিত করতে হবে। 

২। আসিয়ান অত্র অঞ্চলের সবচেয়ে সফল প্লাটফর্ম যাকে ঘিরে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্র প্রবর্তিত হয়েছে। শুধু এই কৌশলপত্রই নয়, চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ও অর্থনৈতিক জোট- The Regional Comprehensive Economic Partnership (RCEP)ও আসিয়ান কেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে। অতএব, কৌশলপত্রের লক্ষ্য পূরণে যুক্তরাষ্ট্র আসিয়ানকে আরও সক্ষম ও ঐক্যবদ্ধভাবে অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনের দিকে গুরুত্ব দেয়।

৩। চীন আসিয়ানভুক্ত দেশদের কাছে রাখতে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বমূলক একটি নতুন প্লাটফর্ম (RCEP) তৈরির পদক্ষেপ নিয়েছে। একই সাথে অত্র অঞ্চলে চীনের ক্রমাগত বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশকেও চীনের এই অর্থনৈতিক মডেলের কাছে টেনে আনছে। 

সে বিবেচনায়, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রে অত্র অঞ্চলের জন্য একটি কার্যকরি অর্থনৈতিক কাঠামো প্রণয়নের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়।  Indo-Pacific Economic Framework (IPEF) নামক উক্ত অর্থনৈতিক কাঠামোয় অত্র অঞ্চলে আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও অবাধ বাণিজ্যের লক্ষ্যে পারস্পারিক অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। 

৪। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপ্ত্রের অম্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল কৌশলপত্রের লক্ষ্য পূরণে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সহনশীল নীতি অনুসরণ করা। কৌশলপত্রে একবিংশ শতকের আন্তঃসীমান্ত ঝুঁকি প্রসমনে রাষ্ট্রগুলোর মাঝে সহনশীল মনোভাব সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে সাহায্য করবে। কৌশলপত্রে প্যাসিফিক দ্বীপাঞ্চলকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায়। 

প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানাবিধ সমস্যায় এ দ্বীপের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পরেছে। উপরুন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক দ্বৈরথও অত্র দ্বীপাঞ্চলের নিরাপত্তাকে হুমকিতে রূপ দিয়েছে। ফলে, প্যাসিফিক ক্ষুদ্র দ্বীপাঞ্চল সুরক্ষায় ও তাদের বিকাশে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অংশীদারদের মাঝে সমঝোতা ও সহনশীল ভূমিকা রাখার আশ্বাস রাখা হয়েছে।

৫। কৌশলপত্রের একটি সমালোচিত দিক বা আগ্রহের দিক হল ভারত। কৌশলপত্রে ভারতকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের লিডার হিসেবে গ্রহণ করা বা প্রতিষ্ঠার ব্যপারে উল্লেখ করা হয়। ভারতীয় মহাসাগরে ভারতের শক্তিশালী নৌ-সুরক্ষা ব্যবস্থা অত্র অঞ্চল ব্যবহারকারী বৃহত শক্তিকে ভারতকে সাথে নিয়ে তাদের কৌশলপত্র প্রণয়নে আগ্রহী করে তোলে। 

এছাড়া, ভারত নিজেও নিজেকে ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদারের প্রধান অংশীদার হিসেবে জাহির করে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতকে নিয়ে তার প্রতিবেশিদের মধ্যে না না সংশয় ও মতানৈক্য তৈরি হয়েছে যা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রকে নতুনভাবে চিন্তা করা ক্ষেত্র তৈরি করে। 

৬। একটি স্বাধীন, মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক গঠনের প্রয়োজনে অত্র অঞ্চলে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রে এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রাধান্য দেওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে, বিশেষত বাণিজ্য পথকে অবাধ রাখা এবং জলসীমা সংক্রান্ত সংকট বা বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান করা। 

আন্তর্জাতিক সিস্টেমের প্রাতিষ্ঠানিকরূপে এহেন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং টেঁকসই উন্নয়নে দরকার জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা। অতএব অত্র অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে এই নীতিগুলোকে প্রবিষ্ট করানোও কৌশলপত্রের অন্যতম লক্ষ্য। এভাবেই, পশ্চিমা আদর্শ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোবদ্ধ পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং তা অত্র অঞ্চলের বৃহৎ শক্তি চীনকেও এক ধরনের চাপের মধ্যে রাখবে যাতে চীনও তার অর্থনৈতিক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সুশাসন ও জবাবদিহিতাকে প্রাধান্য দেয়।  

৭। প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে সভ্যতায় নানান পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক প্রযুক্তি বিংশ ও একবিংশ শতককে ইতিহাসের সকলের থেকে আলাদা করেছে। তবে, এটাও সত্য যে সে বিকাশে সকলের অবদান বা অংশগ্রহণ বা অধিকার সমভাবে নেই। ফলে, প্রযুক্তির অসম প্রকাশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একধরনের সঙ্কট তৈরি করে, বিশেষত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রের জন্য। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রে সে বিবেচনায় প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

কারণ অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আঞ্চলিক স্থিতি আনয়নে প্রযুক্তির ঘাটতি হ্রাস করতে হবে। অত্র অঞ্চলের দেশগুলো প্রযুক্তির প্রয়োজনে জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে ঝুঁকছে। তবে, চীনের সস্তা মূল্যের প্রযুক্তির আদান প্রদান অত্র অঞ্চলে চীনের গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছে, যার ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

এহেন কৌশলগত অংশীদারিত্ব পরবর্তীতে চীনের জন্য নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে যা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রে অত্র অঞ্চলকে মুক্ত, সহনশীল ও নিরাপদ রাখাতে প্রযুক্তির বিকাশে এবং পারস্পারিক আদান প্রদানের দিকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।  

৮। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্র প্রণয়নের প্রধানতম লক্ষ্য অত্র অঞ্চলে চীনের সামরিক উপস্থিতির বিপরীতে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। কৌশলপত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, কারণ স্নায়ুযুদ্ধ সময়ে সোভিয়েত ও চীনের বিপরীতে প্যাসিফিক অঞ্চলে একধরণের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ডেটারেন্স বজায় ছিলো যার গুরুত্ব সোভিয়েত পতনে হ্রাস পেতে শুরু করে। তবে, চীনের সামরিক উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের পুনরায় ডেটারেন্স প্রতিষ্ঠার ব্যপারে মনোযোগী করে তোলে। 

এই ডেটারেন্স প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো ও জোটকে শক্তিশালী করা; সামরিক প্রয়োজনে তথ্য ও প্রযুক্তি পারস্পারিক আদান প্রদান; শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সেক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির পারস্পারিক সাহায্য প্রদান; ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যে গ্রে জোনগুলো রয়েছে সেখানে কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করা এবং যেকোনো ধরনের হাইব্রিড যুদ্ধ বা সংঘাত মোকাবিলায় মিত্রদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা; যৌথ সামরিক মহড়ার প্রচলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আঞ্চলিক ডেটারেন্স ব্যবস্থাকে দৃশ্যমান করে তোলা ইত্যাদি। 

তবে, এহেন সামরিক ডেটারেন্সের বিষয়টিকে অত্র অঞ্চলের ক্ষুদ্র দেশগুলো, বিশেষত যাদের সাথে চীনেরও কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে তাদের কৌশলপত্রে অংশী হওয়ার ব্যপারে সন্দিহান করে তোলে। কারণ তাদের জাতীয় স্বার্থ একধরনের ভারসাম্যমূলক বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেই চলে। 

৯। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দুই মিত্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার পরিসর আরও বৃদ্ধি করা কৌশলপত্রের অন্যতম লক্ষ্য। চীনের উত্থান এবং দক্ষিণ ও উত্তর চীন সাগরে চীনা ক্ষমতা বৃদ্ধি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য একধরনের চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি, এ দুই দেশের পাশে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার জাপান ও কোরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। 

ফলে, রাষ্ট্র দুটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারণ দেশদুটির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ, একইভাবে অত্র অঞ্চলে নিজের সামরিক উপস্থিতিকে টেঁকসই করতে যুক্তরাষ্ট্রেরও জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে দরকার। ফলে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও আঞ্চলিক স্থিতি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া- ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নে অধিক জোর দেওয়া হয়েছে।  

১০। Quad (Quadrilateral Security Dialogue) একটি কৌশলগত (সামরিক) জোট। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানের মাঝে আলোচনার ভিত্তিতে কোয়াডের সূচনা ঘটে। তবে, সূচনার পর কোয়াডকে নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি বললেই চলে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির মোড় যখন থেকে ইন্দো-প্যাসিফিকের দিকে ঘুরতে শুরু করে, তখন থেকে কোয়াড পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে চলে আসে। ফলে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রে কোয়াডের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

কৌশলপত্র অনুসারে কোয়াড পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হবে অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা; আঞ্চলিক শক্তির মাঝে কৌশলগত ও সামরিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি; সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র উন্মোচন ও সামরিক মহড়ার বিস্তার; অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও মুক্তবাণিজ্যের প্রসার; প্রযুক্তির আদান-প্রদান; এবং জলবায়ু ও স্বাস্থ্যগত সুষম পরিবর্তনে সমন্বিত পদক্ষেপ। 

তবে, কোয়াডকে নিয়ে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার ভিন্ন মত রয়েছে। অর্থাৎ, চীনের উত্থানকে উক্ত দেশগুলো ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে যা যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অনেকটাই আলাদা। যেমনঃ অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের চীনের সাথে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে, আবার কোয়াডের অংশ হিসেবে ভারত মহাসাগরে ভারতের আলাদা জাতীয় স্বার্থ ও কৌশলগত অবস্থান রয়েছে। ফলে, কৌশলপত্রে যদিও কোয়াডের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, তবে বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, কোয়াড প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর হওয়ার পথটি লম্বা হবে। 

অতএব, লক্ষ্য ও লক্ষ্য পূরণে করণীয় দেখে সহজেই অনুমেয় হয় যে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলপত্রের মূল উদ্দেশ্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে কমিয়ে আনা। এক্ষেত্রে অর্থনীতি ও সামরিক উভয় দিক এ কৌশলপত্রে উল্লেখিত হয়েছে। তবে, অত্র অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত অংশীদারিত্ব ক্ষুদ্র দেশগুলোকে কৌশল পত্রের ব্যপারে সন্দিহান করে তুলছে। 

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে যে সামরিক প্রতিযোগিতা অত্র অঞ্চলে বিরাজ করছে তা অত্র অঞ্চলের ভারসাম্যের জন্য নেতিবাচক, বিশেষত ক্ষুদ্র দেশগুলোর জন্য যারা ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করে তাদের বৈদেশিক নীতিকে গড়ে তুলেছে। তবে, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির রাডার এখন ইন্দো-প্যাসিফিকে নিবিষ্ট হয়েছে, ফলে আসন্ন সময়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে সঙ্কটের পরিসর বৃদ্ধি পাবে যার প্রভাব আবশ্যিকভাবে সমগ্র অঞ্চলে গিয়ে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন।    



-লেখক

বদিরুজ্জামান 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 



No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.