Header Ads

Header ADS

‘মানুষ’ লইয়া ফেরেশতা ও মানুষের ভাবনা

 ‘মানুষ’ লইয়া ফেরেশতা ও মানুষের ভাবনা

A man feed animals

আমরা কবে মানুষ হব! মানুষ কবে মানুষ হবে! করেছ বাঙালি, মানুষ করনি! প্রভৃতি বাক্যের একটা প্রেক্ষাপট আছে। আমাদের কল্পিত দৃশ্যপটে মানুষকে আমরা আদর্শিক আঙ্গিকে দেখতে চাই। তবে, উক্ত আবেগী উক্তির পেছনে সামান্য ত্রুটি থাকে। অন্তত আমার। আমি গুটি কয়েক মানুষের কার্যকে দেখিয়া, তাও আবার আমি যেমন কার্য দেখিতে চাই তাহা লইয়াই গোটা মানুষজাতিকে বিচার করিয়া লই। হয়তো গ্রাম বাংলার সেই প্রবাদে প্রভাবিত হয় আমার মন “হাড়ির একখানা চাউল টিপিয়াই ভাতের খবর আন্দাজ করিয়া লওয়া যায়।” 

তবে, আবার হঠাৎ মাথায় ঘুরিতে থাকে চাউলের সাথে মানুষের কী মিল চলে! শুনেছি মানুষ যুক্তিশীল/ বিবেকবান জীব। এই যুক্তিশীলতাই মানুষকে বাকী জীবের থেকে আলাদা করেছে। আর তৈরির ধরণ ও প্রেক্ষাপটের ভিন্নতায় যুক্তির মাঝেও পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে। তাই, প্রতিটি মানুষের যুক্তি বা বিবেকের বিচারে একে অন্যের থেকে আলাদা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই আলাদা হওয়াই হয়তো মানুষের মাঝে একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ বা বিকর্ষণ তৈরি করে, বা সহজ করে বললে সহবস্থান, সহনশীলতার পাশাপাশি বিরোধীতা ও দ্বন্দ্বের উদ্রেক ঘটায়। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কোন প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি লাইন পড়েছিলাম, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো যে পাপ।” খুব সাম্প্রতিক সময়ের আগে যতবারই রবী ঠাকুরের এই উক্তিটি মনে পড়েছে, আমি মনে মনে তার বিরোধীতা/ সমালোচনা করেছি।

তবে, একদিন ইউটিউব স্ক্রোলিং করার সময় “The Purpose of Life” শিরোনামের একটি ভিডিও আমার সামনে চলে আসে। এখানে আলোচক ছিলেন Dr. Jaffrey Lang। তিনি একদা নাস্তিক ছিলেন এবং জীবন সম্পর্কে ছিলেন চরম হতাশ। পবিত্র কুর’আন পাঠে তিনি কিভাবে আলোকিত হতে থাকেন সে কাহিনী তিনি তার আলোচনায় উল্লেখ করেন। মজার ব্যপারটি হল, রবী ঠাকুরের করা সে উক্তিটি যে যথাযথ হতে পারে, Dr. Jaffrey Lang-এর আলোচনার একটি অংশের বর্ণনায় প্রথম তা আমার মাথায় খেলে যায়।  

Jeffrey Lang Speech on Islam

সে অংশে Dr. Lang যে আয়াতগুলো নিয়ে আলোচনা করছিলেন, বস্তুত আমরা সে আয়াতগুলো অনেকবারই শুনেছি ও পড়েছি । কিন্তু, মূল আকর্ষণ লুক্কায়িত ছিলো গভীরভাবে আয়াতগুলোকে অনুধাবনের চেষ্টার ভিতরে, যা আমরা হয়তো করিনি। তিনি সুরাহ বাকারার ৩০-৩৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করছিলেন। Dr. Lang বলেন, এ আয়াতগুলো তার নাস্তিক মস্তিস্কে সর্বপ্রথম আঘাত হানে।

যেমনঃ সুরাহ বাকারার ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্‌ ফেরেশতাকুলের দিকে লক্ষ্য করে বলেন, 

“হে নবী মোহাম্মদ সাঃ, এবং আপনি স্মরণ করুন যখন আপনার রব (আল্লাহ) ফেরেশতাদের বললেনঃ নিশ্চয়ই আমি যমীনে খলিফা (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো। ফেরেশতারা বললেনঃ হে আমার রব, আপনি কি সেখানে (যমীনে) এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে/ যারা অশান্তি সৃষ্টি করবে ও পারস্পারিক রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরাই আপনার প্রশংসামূলক গুণগান ও পবিত্রতা ঘোষনা করি। তখন আপনার রব ফেরেশতাদের বললেনঃ নিশ্চয়ই আমি (আল্লাহ্‌) যা জানি, তোমরা তা জান না।”  

Jaffrey Lang- এর পরে ৩১, ৩২ নম্বর আয়াতের অনুবাদ পড়ে শুনালেন, কিন্তু তিনি আটকে গেলেন ৩৩ নম্বর আয়াতের শেষের কথাটায়।

সুরা বাকারার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “(হে নবী সাঃ) অতঃপর, আপনার রব হযরত আদম আঃ-কে  বললেনঃ হে আদম! তুমি তাদেরকে (ফেরেস্তাদেরকে) এ জিনিসগুলোর নাম জানিয়ে দাও। যখন আদম আঃ ফেরেস্তাদের এ সকল জিনিসের নাম বলে দিলেন, তখন মহান আল্লাহ বললেনঃ আমি কি তোমাদের বলিনি যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা প্রকাশ করো ও গোপন করো, আমি তাও অবগত।” 

শেষের কথাটি হলোঃ “তোমরা যা প্রকাশ করো বা গোপন কর, আমি তাও অবগত।” Jaffrey Lang- এখানে প্রথমে বললেন, আসলে ফেরেস্তারা যে জমিনে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষকে না পাঠানোর যে যুক্তিগুলো মূখে উপস্থাপন করছিলেন, তাদের অন্তরে কী ঠিক একই যুক্তি স্থির ছিলো? হয়তো বা হয়তো নয়; আল্লাহই ভালো জানেন। এজন্যই হয়তো আল্লাহ বলে দিলেন, “তোমরা যা প্রকাশ করো বা গোপন কর, তাও আমি আল্লাহ জানি।”

কিন্তু ফেরেস্তারা আসলে কী গোপন করেছিলেন?

বস্তুত, জিন জাতির অভিজ্ঞতার পর্যাবেক্ষণ থেকে ফেরেস্তারা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছিলেন যে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠালে মানুষ হীন স্বার্থের দ্বন্দ্বে রক্তপাত ঘটাবে ও বিশৃংখলা ছড়াবে। এটা সত্য, এবং পৃথিবীর ইতিহাসই তার বড় সাক্ষী। তবে, তাদের অন্তরে গোপনীয় অবস্থায় যে চিন্তাটি লুক্কায়িত ছিলো তা হল যেহেতু মানুষকে আল্লাহ জমিনে খলিফা/ প্রতিনিধি করে পাঠাবেন, সেক্ষেত্রে মানুষের ভিতরে আল্লাহর কিছু সিফাত বা গুণের সন্নিবেশ অবশ্যয়ই থাকবে। ফলে, সে সিফাতের বদলৌতে মানুষের যতটা না মন্দ বা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফেরেস্তারা বুঝেছিলেন, এই সিফাতই মানুষকে আল্লাহর অতি নিকটবর্তী ও প্রিয় সৃষ্টিতে পরিণত করবে। এই ভাবণায় মানুষের প্রতি তাদের ঈর্ষা জন্ম হয়, এবং সে ঈর্ষা থেকেই আল্লাহকে তারা জমিনে মানুষ প্রেরণে নিরুৎসাহিত করেন। 

Jaffrey Lang- এর বর্ণনাটি আমি যখন শুনি আমার তখন রবী ঠাকুরের উক্তিটি মনে পড়ে যায়। আসলেই মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ! 

কিন্তু মানুষ মানুষের উপর কেন বিশ্বাস হারায়?

বিশ্বাস হারায় তার অন্যায়, তার ধোকা, তার অত্যাচার-শোষণ ও অবিচারের বশে। তবে, কুর’আনের মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়েছেন মানুষকে তিনি খুব যত্নে সৃষ্টি করেছেন, তার গুণাবলির সন্নিবেশ মানুষের প্রেষণায় যুক্ত হয়েছে। ফলে, মানুষের ফিরে আসার সম্ভাবনা তার অবিশ্বাসী হওয়ার চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়! 

তবে, মানুষ কিভাবে ফিরে আসতে পারে? মানুষ কিভাবে আল্লাহর দেওয়া সিফাতের খোজ পাইতে পারে?

এক্ষেত্রে মানুষ সম্পর্কে দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের দেওয়া একটা বিশ্লেষণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম তার সেইসব দার্শনিক নামক গ্রন্থে বলেন, “মানুষের জীবনে আদিকাল থেকে যা চলে এসেছে, তা তার জীবনের সমস্যার চরিত্র অনুধাবনের চেষ্টা এবং সমাধানের প্রয়াস। সহস্যা হল অনুধাবনের এ-চেষ্টা এবং সমাধানের প্রয়াস অনন্তকাল ধরেই চলবে। ‘মানুষ’ শব্দের অর্থই তাই। সমাধানে সচেষ্ট সমস্যাপূর্ণ এক জীবন।”


সরদার ফজলুল করিমের ভাষায় সমস্যাপূর্ণ জীবনের সমাধানে সচেষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে যে জিনিসটি প্রয়োজন তাহল যুক্তিপূর্ণ জ্ঞান। এ জ্ঞানের অন্যতম হল পড়া, অনুধাবণ করা, পৃথিবীর দৃশ্যপট নিয়ে চিন্তা করা। 

আল্লাহর খলিফা হিসেবে মানুষের মাঝে যে সিফাতগুলো রয়েছে তা এই সমস্যাসংকুল পৃথিবীতে বসবাস ও আখিরাতের মহাবিপদের দিনের পাথেয় যোগাবার জন্য সহায়ক। তবে, পাথেয় বা সমাধানের পথে এমনিতেই যাওয়া যায় না বা আল্লাহ প্রদত্ত সিফাত এমনিতেই হাতে আসে না। সেজন্য দরকার অধ্যায়ন, জ্ঞানার্জন, জ্ঞানান্বেষণ ও আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে ভাবনা প্রভৃতি।

একটু মিলিয়ে নেন, মহান আল্লাহ এজন্যই হয়তো হেরা গুহায় জিব্রাইল আঃ- এর মাধ্যমে নবী করিম সাঃ-কে তার উম্মতের জন্য আল্লাহ সে বার্তাটিই পৌছে দিলেন যে তোমারা আমার দেওয়া সিফাত যদি খুজে পেতে চাও, তাহলে পড়, চিন্তা কর, গভীর থেকে ভাব, চক্ষু মেলিয়া আল্লাহ্‌র সৃষ্টিকে দেখ। অর্থাৎ, সুরাহ আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াতঃ 

১। “হে নবী সাঃ, আপনি পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সকল কিছুর সৃষ্টা।”

২। “ তিনি (আল্লাহ্‌) মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাটবদ্ধ রক্তপিণ্ড থেকে।”

৩। “ হে নবী সাঃ, আপনি পাঠ করুন। আপনার রব মহিমান্বিত।”

 ৪। “ যেই আল্লাহ্‌ মানুষকে কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন।”

৫। “ মহান আল্লাহ্‌ মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না।”


দুর্ভাগ্যের বিষয়, মানুষ সৃষ্টির সূচনাতে মানুষের যে অপার সম্ভাবনা ফেরেশতারা অনুধাবন করেছিলেন, যে সিফাতের মহত্ত্বে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদা লাভ করলো, যে গুণাবলি মানুষের সমস্যাসঙ্কুল দুনিয়া ও আখেরাতের সফল হওয়ার পাথেয় হল, আমরা মানুষরা কী মানুষের সে সুন্দর দিকটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছি? আমরা কী ব্যক্তিগত আবেগের বশীভূত হওয়ার উর্ধ্বে উঠে একের বা কতেকের ভুলে বা অপরাধে সবাইকে অপরাধী করা থেকে পিছু হেটেছি? আমরা কী আল্লাহ্‌র সৃষ্টির দিকে জ্ঞানান্বেষণের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আল্লাহ্‌র সিফাতের প্রশংসা করেছি? আমরা কী আল্লাহ্‌র প্রেরিত প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি? প্রভৃতি উত্তর খুঁজে দেখা আমাদের জন্য জরুরি। 

বস্তুত, মানুষ কবে মানুষ হবে বা বাঙালি কবে মানুষ হবে? বা মানুষের উপর বিশ্বাস রাখা কী শ্রেয় হবে না পাপ হবে? প্রভৃতি নির্ভর করবে মানুষ তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে কতটুকু সচেতন তার উপর। এছাড়াও, প্রেষণা তাড়িত খারাপ/ নিকৃষ্ট/ঘৃণিত কাজের বাহিরে আল্লাহ্‌র খলীফা হিসেবে, আল্লাহ্‌ প্রদত্ত সিফাতের দরুন মানুষের ভালো হওয়ার, ভালো কাজ করার, ভালোর বিস্তার ঘটানোর, আলোর পথ আবিষ্কারে ফিরে আসার যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে তা স্রষ্টার সৃষ্ট নেয়ামতের মাঝে ছড়িয়ে থাকা জ্ঞানান্বেষণের দরুণ মানুষকে হাসিল করতে হবে। এজন্যই, পবিত্র কুরআনের ন্যায় আমাদের নবী মুহাম্মদ সাঃ-ও বলেছেন, “প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞানান্বেষণ বা ইলম অর্জন করা ফরজ”- (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২২৪)

তবে, জ্ঞানান্বেষণ কী শুধু মানুষকে তার নিজের সিফাত সম্পর্কে-ই সচেতন করে? মানুষকে পবিত্র সিফাতের সমন্বয়ে যে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, জ্ঞানান্বেষণ সে স্রষ্টা ও মানুষের মাঝে কীরূপ সম্পর্ক তৈরি করে, সে বিষয় নিয়ে পরবর্তী আলোচনার চেষ্টা করবো।

তবে, অত্র আলোচনার ভুলত্রুটি মার্জনাপূর্বক, অনুপ্রেরণা দিয়ে, উপদেশ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ করে দিবেন আশা করি। ধন্যবাদ। 



-বদিরুজ্জামান


 





  


  


No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.