তিব্বত: চীনের গ্রেট ওয়াটার টাওয়ার (৭ম পর্ব)
তিব্বত: চীনের গ্রেট ওয়াটার টাওয়ার
![]() |
| China in Tibet |
হিমালয় চীন ও ভারতের মাঝে প্রাকৃতিক বাঁধা হিসেবে রয়ে গেছে। চীনের সাথে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তানের সীমানা জুড়ে রয়েছে হিমালয়ের পাশের কারাকোরাম পর্বতশ্রেণী।
চীনের প্রাকৃতিক গ্রেটওয়াল হলো হিমালয় ও কারাকোরাম, একই সাথে ভারতের ক্ষেত্রে এই হিমালয় ও কারাকোরাম পর্বত ভারতের গ্রেটওয়াল যা ডিঙিয়ে কোন শত্রুর আক্রমন খুবই কদাচিৎ। এই প্রাকৃতিক দেওয়াল পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ দেশদুটিকে বিভক্ত করেছে, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে।
প্রাকৃতিক বিভক্তি কিন্তু উভয়ের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে চাপিয়ে রাখতে পারেনি। সীমান্তবর্তী কিছু অঞ্চল নিয়ে চীন ভারতের দ্বন্দ্ব, সংকট, সংঘাত ও যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে। চীনের দাবী ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল প্রদেশ চীনের, আবার ভারতের দাবী বৃহত্তর কাস্মীরের আকসাই চিন অঞ্চল ভারতের।
তবে দ্বন্দ্ব যতটা তীব্র হোক, দুদেশের সমরাস্ত্র এই প্রাকৃতিক দেওয়াল টপকে যেতে পারে না। উভয়ের মাঝে বড় আকারের যুদ্ধ হয়েছিলো ১৯৬২ সালে। এটা ছিলো অনেকটা পাহাড়ি যুদ্ধ। তবে, যুদ্ধের শঙ্কা কমে যায়নি। তবে, উভয় দেশে বিচক্ষণতার সাথে সীমান্ত সংকট সমাধানের চেষ্টা করে চলেছে।
প্রায় কয়েক দশক আগেও, এ পথে চীনের সাথে ভারতের বাণিজ্য ছিলো খুবই অল্প। আর ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনাও কম। এর কারণও তিব্বত-ভারতীয় সীমারেখা। চীন যেকোনো মূল্যেই হোক তিব্বতকে তার কাছে চায়। তিব্বতের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চায়। ভূরাজনৈতিক এক শংকা চীনের মাঝে কাজ করে।
অর্থাৎ যদি তিব্বতের উপর চীনের নিয়ন্ত্রণ না থাকে, সে শূন্যস্থান ভারত অতি দ্রুত পূরণ করবে। ভারত হয়তো তিব্বতীয় মালভূমিতে তারা সেনানিবাস গড়ে তুলবে। এভাবে ভারত চীনের কেন্দ্রভূমিতে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করবে, এবং তিব্বত হতে প্রবাহিত হওয়া চীনের বৃহৎ নদী: ইয়েলো, ইয়াংঝি ও মেকং এর উপদ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করবে। এজন্যই তিব্বতকে চীনের ওয়াটার টাওয়ার বলা হয়।
এ প্রবাহ থেকে যে পরিমাণ পানি কেন্দ্রের দিকে ছুটে যায় তার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করে তার সমান। তবে, চীনের জনসংখ্যার আধিক্য তিব্বতকে চীনের জন্য আরও জরুরি করে তুলেছে।
বিষয়টি এমন নয় যে ভারত তিব্বত দখল করলে চীনের দিকে প্রবাহিত নদীর পানি সরবরাহ আটকে দিবে, বিষয়টি হল ভারতের এমন করার সক্ষমতা রয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী চীন চেষ্টা চালিয়েছে যে এমনটি যেন না হয়। তিব্বতে চীনা হান'দের স্থায়ী হওয়া ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের মুভমেন্ট রয়েছে।
অনেক জনপ্রিয় লেখক, অভিনেতা, এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চীনের তিব্বত দখলকে বে-আইনি হিসেবে উল্লেখ করে, এবং তিব্বতের ধর্মীয় কাছে চীনাদের হস্তক্ষেপকের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে আসছে। তবে, এহেন নিন্দা বা প্রতিবাদে চীন খুবই মাথা ঘামিয়ে থাকে।
তবে, হলিউড অভিনেতা বা পশ্চিমা রাজনীতিবিদেরা তিব্বত নিয়ে কথা তোলে তখন স্বাভাবিকভাবে চীন বিরক্ত হয়। তবে, চীন এহেন কথাবার্তায় ভীত বা শংকিত হয় না, শুধু বিরক্ত হয়। চীন তিব্বতকে মানবাধিকারের ভিত্তিতে দেখে না, বরং ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তার বিচারে দেখে। তাই চীনাদের কাছে, পশ্চিমাদের তিব্বত প্রেম চীনের নিরাপত্তাকে নিয়ে প্রশ্নতোলার শামিল।
এহেন প্রেম আদতে চীনের নিরাপত্তাকে ভংগুর করে দেয় না, বা করবেও না। বস্তুত, এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নির্ভর করতে পারে হান'দের বিরুদ্ধে যদি স্থানীয় তিব্বতীয়রা বড় ধরনের কোন আন্দোলন বা সংগ্রামে লিপ্ত হয় সেক্ষেত্রে। ফলে জনসংখ্যা ও ভূরাজনৈতি তিব্বতীয়দের স্বাধীনতাকে অবনমিত করে রেখেছে।
চীনারা তিব্বতীয়দের স্বাধীনতাকে মাটিচাপা দিয়েছে, মালভূমিতে উন্নয়ন ছড়িয়ে দিয়েছেন, আদতে অবকাঠামোগত। ১৯৫০ সালে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির স্বেচ্ছাসেবী আর্মি তিব্বতের সাথে কেন্দ্রভূমিকে যুক্ত করতে রাস্তা, রেললাইন ইত্যাদি নির্মাণ শুরু করে।
এভাবেই এই প্রাচীন সাম্রাজ্যকে চীনারা আধুনিক দুনিয়ায়, আধুনিক প্রযুক্তির ছোয়া দিয়েছেন। তবে এত উন্নয়নের পিছনে অন্য কাহিনী ছিলো: হান'দের তিব্বতে অভিবাসন।
এক সময় ভাবা হতো তিব্বতের তীক্ষ্ণ বরফের শীলা, পাথুরে পাহাড় ও তিব্বতীয় উপত্যকায় কোনভাবেই রেললাইন বসানো যাবে না। এমনকি যে ইউরোপীয় প্রকৌশলীরা ইউরোপকে একত্র করতে আল্পস পর্বতকেও হার মানিয়েছে, তারাও তিব্বতে রেললাইন বসানোকে অসম্ভব বলে উল্লেখ করছেন।
যেমন ১৯৮৮ সালে ভ্রমণ পিপাসু লেখক পল থেরক্স তার তিব্বত ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে “রাইডিং অন আইরন কোস্টার” বইখানা লেখেন। যেখানে তিনি বলেন, “তিব্বতের কুনলুন পর্বত শ্রেণি দেখে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় চীনা রেলগাড়ী কখনো লাসা অবধি আসবে না।”
কুনলুন পর্বতশ্রেণী ঝিনঝিয়াংকে তিব্বত থেকে আলাদা করেছে। এ বিভক্তিকে থেরক্স প্রশংসা করেছেন এটা বলে, “ভাগ্যিস কুনলুন ছেদ টেনে দিয়েছে, আমি ভেবেছিলাম রেলে করে তিব্বত যাবো, তিব্বতের সৌন্দর্য দেখবো। তবে সে ভাবনা কখনো যে সত্যি হবার নয় তা কুনলুন দেখে বুঝলাম।”
তবে, চীনারা সে অসাধ্য সাধণ করেছে। আসলে এ অসাধ্য চীনারাই সাধন করতে পারতো। ২০০৬ সালে চীনা ভূখণ্ড থেকে তিব্বতের রেল পথ খুলে দেওয়া হয়। চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিন তাও এ রেলপথ উদ্ভোদন করেন। এখন সাংহাই থেকে বেইজিং এ যাত্রী ও কাচামাল সমেত চীনা দিনে চারবার প্রদক্ষিণ করে।
এই প্রদক্ষিণে চীনা ভূখন্ড থেকে আধুনিক প্রযুক্তি যেময়ন: কম্পিউটার, রঙিন টেলিভিশন, এবং মোবাইল ফোন তিব্বতে আসা শুরু করে। এছাড়াও, এ পথে অসংখ্য পর্যটক তিব্বত ভ্রমনের উদ্দেশ্যে আসে যা তিব্বতের স্থানীয় অর্থনীতিকে চাংগা করে তোলে।
তিব্বতের প্রাচীন ভূমিতে চীনাদের বদলৌতে আধুনিকতার ছোয়া লাগে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়, বিশেষত চিকিৎসা ও শিক্ষায়, এবং চীনারাই তিব্বতের স্থানীয় পণ্য বহি:বিশ্বে বাজারজাত শুরু করে। তবে এসকল কাজের সুবিধার্থে তিব্বতে লক্ষ লক্ষ হান'দের প্রবেশ ঘটে।
তবে, তিব্বত সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে। তিব্বতকে নিয়ে গড়ে ওঠা ফ্রি তিব্বত মুভমেন্টের ভাষায় যে হারে হান’'রআ তিব্বতে স্থায়ী হয়েছে সে হিসেবে তিব্বতীয়রা এখনো সং্খ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। তবে চীনা সরকার এক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করে।
তারা বলে তিব্বত একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল যার প্রায় নব্বই শতাংশ নাগরিকই তিব্বতীয় স্থানীয়। এখানে আসলে দুইটি পক্ষই নিজেদের দাবীকে অনেক অতিরঞ্জিত করে বলে, তবে এক্ষেত্রে সরকারি ভাষ্যই বেশি অতিরঞ্জিত।
সরকারের দেওয়া পরিসং্খ্যানে ঐ সকল হান'দের উল্লেখ নেই যারা কোনরূপ নিবন্ধন ছাড়াই তিব্বতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। কিন্তু, সাধারণ যেকোনো পর্যবেক্ষকের চোখে ধরা পড়বে যে তিব্বতের স্থানীয়রা হান’ অভিবাসীদের দ্বারা নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের স্বীকার হচ্ছে।
একদা মাঞ্চুরিয়া, ইনার মংগোলিয়া ও ঝিনঝিয়াং প্রদেশের সং্খ্যাগরিষ্ঠ নৃগোষ্ঠী ছিলো যথাক্রমে মাঞ্চুরিয়ান, মংগোলিয়ান ও উইঘুর। কিন্তু এখন এই জনপদের সং্খ্যাগরিষ্ঠ হলো হান’ চীনারা, এবং একই বিষয় তিব্বতের ক্ষেত্রেও সত্য। ফলে, ক্রমে এই অঞ্চলগুলিতে হান'দের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যেমন: ২০০৮ সালে তিব্বতীয় স্থানীয়রা হান'দের অভিবাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে, যা ক্রমে দাংগায় রূপ নেয়। স্থানীয়রা হান'দের ঘর বাড়ি ও সম্পদে লুটপাট চালায়। দাংগায় প্রায় ২১ জন হান চীনা নিহত হন এবং শত শত হান চীনা আহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনা সরকার তিব্বতে ফ্রি তিব্বত মুভমেন্টের সাথে জড়িতদের ধরপাকর শুরু করে।
সরকারের এহেন আচারণের বিরুদ্ধে তিব্বতীয় বৌদ্ধ যাজকেরা প্রতিবাদ জানায়, এমনকি অনেক যাজক নিজের শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহুতি প্রদান করে। এ ধরনের ঘটনা গোটা বিশ্বের নজর কারে, কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন থাকে এবং তিব্বতীয় ভুমিতে হান'দের পুনর্বাসন বজায় রাখে।
চীনের কেন্দ্রীয় ভূখন্ডের যে বিশাল জনগোষ্ঠী তারাও মূল কেন্দ্র ছেড়ে বাহিরে বের হতে শুরু করে। ইতিহাসে এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে যেমন: আমেরিকানরা স্থানীয়দের ভুমি কেড়ে নিয়েছে সেখানে আমেরিকান বসতি স্থাপন করেছে, চীনারাও ঠিক সেভাবে তার বর্ধিত জনগণের চাহিদার খোরাক অনুযায়ী তিব্বতে হানদের পুনর্বাসনে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিব্বত ছাড়িয়ে চীনের সীমানা ক্রমে পাকিস্তান, তাজিকিস্তান ও কিরগিস্তান হয়ে সেন্ট্রাল এশিয়ার সবচেয়ে বড় অংশ কাজাখস্তানে মিশেছে। এদের অধিকাংশই পাহাড়ি জমি, অনুর্বর, পশুচারণ ভূমি। তবে, চীনের কাছে এই পথ অনেক পরিচিত, অন্তত চীনের ইতিহাসে। এই পথ দিয়েই চীনের প্রাচীন সিল্ক ব্যবসা পরিচালিত হত।
চীনের বিখ্যাত সিল্কের চাহিদা এশিয়া ও ইউরোপের সর্বত্র খুঁজে পাওয়া যায়। অনেকে বলে থাকে পাহাড় ও মরুর মাঝে এ সীমানা চীনের দুর্বল সীমান্ত, কিন্তু এ সীমানার অনেক অনেক ভিতরে চীনের কেন্দ্রভূমি। এ পথ পাড়ি দিয়ে কাঝাখরা, বা প্রাচীন কালে পার্সিয়ান ও অটোমানরা বা বর্তমানের রাশিয়াও চীনকে আক্রমণ করবে না।
ভাবানুবাদক:
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল বই:
Prisoners of Geography: Ten Maps That Explain Everything about the World.
লিখেছেন:
Tim Marshall,
A former foreign correspondent for Britain's Sky News Television
চীন পর্বঃ
রাশিয়া পর্বঃ
1. মেদভেদের দেশ রাশিয়া (Russia): সীমান্ত ঘেঁষা যুদ্ধের শঙ্কা (প্রথম পর্ব)
2. কি'ভেন রুশের (Kievan Rus) দেশ রাশিয়াঃ মস্কো থেকে সাইবেরিয়া (পর্ব ২)
3. উষ্ণ জলের দিকে রাশিয়ার যাত্রা (পর্ব ৩)
4. রাশিয়ার রাজনৈতিক অস্ত্রঃ জ্বালানী ও ইউরোপের শীত (চতুর্থ পর্ব)


No comments