Header Ads

Header ADS

মেদভেদের দেশ রাশিয়া (Russia): সীমান্ত ঘেঁষা যুদ্ধের শঙ্কা (প্রথম পর্ব)

 

রাশিয়ার মেদভেদ

প্রথম পর্বঃ 

    রাশিয়া বৃহৎ। রাশিয়া সুবিশাল। বিস্তৃত ও ফাকা। প্রায় ৬ মিলিয়ন মাইল আয়তন ও প্রায় এগারোটা টাইম জোন নিয়ে রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ। এই বৃহৎ ভূখন্ডের অধিক অংশ জুড়েই রয়েছে ঘন বন, বিশাল বিশাল হ্রদ, বরফাচ্ছাদিত নির্জন তুন্দ্রাঞ্চল, Teppe, Taiga, এবং সারি সারি পর্বতমালা। রাশিয়ার এই সুবিশাল আয়তন আমাদের সকলেরই কৌতূহল ও আগ্রহের জায়গা। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, রাশিয়াও সেখানে আছে: আমাদের পূর্বে বা পশ্চিমে!, অথবা উত্তরে বা দক্ষিণে!


    রাশিয়ার প্রতীকও রাশিয়ার বৃহৎ আকারকে প্রতিনিধিত্ব করে আর তা হল রাশিয়া ভালুক (Russian Bear)। রাশিয়ার মত, রাশিয়ার ভালুকও আকারে বিশাল। এই বিরাট ভালুকেরা এ ভূখন্ডে চড়ে বেড়ায়, কখনো শীতঘুমে যায়, কখনো গর্জনে গর্জনে গহীন অরণ্য মাতিয়ে রাখে, কখনো নিজের সীমানা নির্ধারণ ও রক্ষায় ভয়ংকর ও হিংস্র হয়ে ওঠে।  বস্তুত Bear শব্দটি এসেছে রুশ ভাষা থেকে। তবে, বাকী বিশ্বের মত রাশিয়ার অধিবাসীরা একে ভালুক নামে ডাকে না, তাদের কাছে ভালুক এত হিংস্র বা ভয়ংকর নয়। তারা ভালুককে “আদর করে” Medved নামে ডাকে। মেদভেদ শব্দের অর্থ যে প্রাণী অধিক মধু পছন্দ করে।  এশিয়া ও ইউরোপের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে অবস্থিত রাশিয়ায় প্রায় দেড় লক্ষ মেদভেদব বা ভালুক রয়েছে।


    পশ্চিম রাশিয়ার সীমারেখা ইউরাল পর্বত বেয়ে চলে গেছে। পূর্ব রাশিয়া সেই তুদ্রা আঞ্চল ছাড়িয়ে বেরিং সাগর ও প্রশান্ত সাগরে গিয়ে মিশেছে। এমনকি, এ একবিংশ শতকে এসেও, একটি মাঝারি গতির ট্রেনকেও দশটি দিন এক নাগারে চলতে হবে যদি পূর্ব রাশিয়া থেকে পশ্চিম রাশিয়ায় পৌঁছাতে চায়। তবে, রাশিয়ার নেতৃবৃন্দের মস্তিষ্ক কিন্তু ট্রেনের আগে ছোটে। তারা জানে এ বিরাট দেশের অভ্যন্তরীণ পার্থক্য ও মিলের জায়গা কোনগুলো। তারা বস্তুত সে বিবেচনায় নীতি প্রণয়ন, অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। 


    রাশিয়ার জটিলতাকে বুঝাতে লেখক মহলে প্রায়শই ১৯৩৯ সালে রাশিয়াকে নিয়ে উইন্সটন চার্চিলের করা একটি বক্তব্যকে উদ্ধৃতি করেন, “ রাশিয়া হল অনেকগুলো ধাধার এক মহা গোলক ধাঁধাঁ”। তবে অন্যেরা বাক্যটি পূরণ করতে আরও খানিকটা সংযোজন করেছেন, “সে গোলক ধাঁধাঁর বন্ধ দরজা চাবি দিয়ে খুলে যায়। আর সে চাবিটা হল রাশিয়ার “আপন/ জাতীয় স্বার্থ”। তারও সাত বছর বাদে সে চার্চিল-ই গোলক ধাঁধাঁর বাধা দূরীকরণ চাবি প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “ আসলে ধাঁধাঁতো ধাঁধাঁই, ভিতরে যাহার ফাকা। লোকে যেমনটি বলে রাশিয়ার সে তুলনায় অনেক নড়বড়ে। তাদের সামরিক শক্তিও দুর্বলের ন্যায় রুগ্ন।” তবে চার্চিলের কথা কী স্টালিনের ক্ষেত্রে খাটে? বা এ জমানার পুতিনের বেলায় খাটে? অবশ্যই নয়। রাশিয়ার সে গণতন্ত্রিক ধারার মৃত্যু অনেক আগেই হয়েছে, তবে পুতিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কেন্দ্রে রয়েছে সেই চাবি! রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থ! 


রাশিয়ার সীমানা ও সার্বভৌমত্বঃ   


    পুতিন যখন ঈশ্বর আর পর্বত নিয়ে ভাবে না, তখন পুতিনের মাথায় হয়তো পিৎজার কাহিনী ঘুরেফিরে। আরও সহজ করে বললে পিৎজার একটি স্লাইস নিয়ে পুতিন রসনা তৃপ্তির স্বপ্ন দেখে! ভৌগোলিক বিচারে পোলান্ড হলো পুতিনের সেই প্রতীক্ষিত পিৎজা স্লাইস। এই পোলান্ড জুড়ে রয়েছে এশিয়া-ইউরোপের প্রাকৃতিক বিভাজন: উত্তর ইউরোপীয় হাজার মাইল দীর্ঘ ও তিনশত মাইল প্রস্থের সমভূমি যা ফ্রান্স থেকে ইউরাল পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সমভূমির উত্তরে রয়েছে বাল্টিক সাগর এবং দক্ষিণে কারপাথিয়ান পর্বতমালা (Carpathian Mountains)। উত্তর ইউরোপীয় সমভূমি উত্তর ও পশ্চিম ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, উত্তর জার্মানি, এবং প্রায় সমগ্র পোলান্ড জুড়িয়ে বিস্তৃত।  


Russia-Political-Map-Regions-and-Cities

    রাশিয়ার চোখে এই ভূমি দোধারি তলোয়ার। বস্তুত, রাশিয়ার সেনাদলের চলাচল ও যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবারাহের মাধ্যমে মস্কোকে শত্রুর হাত হতে রক্ষার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পোলান্ডের ভূমি যদি রাশিয়ার দরকার পরে তবে তা হবে খুব সরু করিডোর। কিন্তু সংকট শুরু হয় করিডোরের শেষ প্রান্তে। রাশিয়ার সীমানার কাছাকাছি করিডোরের মুখ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে বা চওড়া হয়েছে। যখন সম্পূর্ণরূপে করিডোর শেষ হয় তখন প্রায় দুহাজার মাইলের অধিক রাশিয়ার সীমানা শত্রুদের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। মস্কো ও রাশিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহর এই সীমানায় অবস্থিত।


    শুধু পুতিন নয়, অন্য যেকোন শাসকের পক্ষেও এই বিশাল সীমানাকে সম্পূর্ণভাবে ও শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বা চ্যালেঞ্জিং কাজ। তবে, পোলান্ডের এই দীর্ঘ করিডোর হয়ে রাশিয়া খুব কমই আক্রান্ত হয়েছে। এর অন্যতম কারণ আক্রমণকারীর পক্ষে এই দীর্ঘ করিডোর পারি দিয়ে যুদ্ধের রসদ ও সরঞ্জাম সরবারাহ ব্যবস্থা করা অনেকক্ষেত্রেই কষ্টসাধ্য, এছাড়াও রাশিয়ার শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রতিরোধও শত্রুকে হারিয়ে দিতে পারে। এ পথে ঘটা ইতিহাসের দুটি বড় উদাহরণ এক্ষেত্রে দেওয়া যায় নেপোলিয়নের মস্কো দখল ও পরাজয়, এবং হিটলারের মস্কো দখল ও পরাজয়। 

    তবে, রাশিয়ার দূর প্রাচ্যের বা দূর পূর্বের ভৌগোলিক অবস্থান রাশিয়ার সহায়ক। একধরনের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। রাশিয়ার এশিয়া অংশে রাশিয়ান সৈন্য বা আক্রমণকারীর সৈন্য চলাচল খুবই কঠিন ও দুর্বিষহ একটা কাজ। এ পরিস্থিতিটা ইউরাল পর্বত পর্যন্ত। হয়তো আক্রমণকারী সহজে মাইলের পর মাইল ভূখন্ড দখল করে ফেলতে পারে, তবে এই দীর্ঘ দুর্গম পথে দরকারি রসদ সরবারাহের সুযোগ খুবই কম। আর প্রতিঘাতের সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। 

    উপরোক্ত বর্ণনার বিবেচনায় আপনার এমন ধারণা হতেই পারে যে কেউ-ই কখনো রাশিয়ায় আক্রমণের ইচ্ছে পোষণই করেনি, বা পূর্বের কতিপয় উদাহরণ থাকলেও, বর্তমানে সে ইচ্ছে সব মাটি হয়ে গেছে। কিন্তু, রাশিয়ানরা এভাবে ভাবে না, এবং সে না ভাবা টা-ই বরং যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয়। গত পাঁচ শতকে, পশ্চিমা ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা বেশ কয়েকবার রাশিয়া দখল করেছে। ১৬০৫ সালে, পোলান্ডের হাতে মস্কো দখল, ১৭০৮ সালে একই পথে সুইডিশ রাজা  দ্বাদশ চার্লসের হাতে মস্কোর পতন, ১৮১২ সালে নেপোলিয়ন কর্তৃক মস্কো দখল, ১৮৫৩-৫৬ সালের ক্রিমিয়া যুদ্ধ, এবং সর্বশেষ দুই দুইটি মহাযুদ্ধ ইত্যাদি রাশিয়ানদের ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করে। 

    ১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একদম শেষে জার্মান অধিকৃত কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের বিরাট একটি অংশ রাশিয়ার হস্তগত হয়। পরবর্তীতে সে অঞ্চল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ক্রমেই সোভিয়েত ইউনিয়নের আয়তন পুরাতন রুশ সাম্রাজ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তবে সোভিয়েতের এহেন বিকাশ অন্য মহা শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমীকরণে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে, ১৯৪৯ সালে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার রাষ্ট্রের সমন্বয়ে ন্যাটো গঠিত হয়।

    ন্যাটো গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো সোভিয়েতের বিস্তারে লাগাম টানা, এবং সোভিয়েতের সামরিক হুমকি থেকে পশ্চিম ইউরোপকে রক্ষা করা। ন্যাটো প্রতিষ্ঠার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার নেতৃত্বে সোভিয়েতের সকল রাষ্ট্রের সহযোগে ১৯৫৫ সালে ওয়ারশ প্যাক্ট গঠিত হয়। এই চুক্তির বিনিময়ে সোভিয়েতের দেশগুলো পারস্পরিক নিরাপত্তার প্রয়োজনে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়। ওয়ারশ প্যাক্টকে নিয়ে এতো আশা যেন একরকমের দুরাশা হয়েই থাকে। ১৯৮০'র দশকে এ চুক্তির কার্যকারিতা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে এবং বার্লিন দেয়াল পতনের প্রেক্ষাপটে প্যাক্টের কবর রচিত হয়। 

    সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি পুতিনের অকৃত্রিম ও অকুণ্ঠ ভালবাসা থাকলেও, শেষ সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের প্রতি পুতিনের ক্ষোভ ছাড়া ভালবাসা ও শ্রদ্ধা কখনো জন্মায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই মহান যাত্রার আকস্মিক সমাপ্তিতে পুতিন গর্বাচেভকে দায়ী করেন। পুতিনের ভাষায় গর্বাচেভ ন্যাটোর বিপরীতে সোভিয়েতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জোরদান না করাতেই “ গত শতাব্দী সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয় বা ছন্দ পতন ঘটে, অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।" তখন থেকে রাশিয়ার দিকে ন্যাটোর ক্রমাগত অগ্রসর হওয়ার রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য চরম দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নের। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ টি নতুন রাষ্ট্র হয়।

NATO Country Joining Date

    রাশিয়া প্রথম থেকেই এই প্রতিবেশীদের সাথে একটি বিষয় পরিষ্কার হতে চেয়েছে রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর কোনরূপ অনুপ্রবেশ রাশিয়া মেনে নিবে না, এবং সে জন্য নতুন স্বাধীন হওয়া দেশগুলোকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত না হতে বিভিন্নভাবে রাশিয়া চাপ দিয়ে এসেছে। কিন্তু তা সত্বেও রাশিয়ার সীমান্ত ঘেষে  ন্যাটোর অগ্রগতি রাশিয়া থামাতে পারেনি। ১৯৯৯ সালে চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, এবং পোলান্ড ন্যাটোতে যোগদান করে; ২০০৪ সালে বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, রোমানিয়া, এবং স্লোভাকিয়া একযোগে ন্যাটোতে যোগদান করে; সর্বশেষ আলবেনিয়া ২০০৯ সালে এবং ২০২৩ সালে ফিনল্যান্ড ও ২০২৪ সালে সুইডেন ন্যাটোতে যোগদান করে।

    অন্যান্য বৃহৎ শক্তির ন্যায়, রাশিয়াও আগত শতকের সম্ভাব্য বিবিধ পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করে, কারণ এ সময়ের মাঝে যে-কোন কিছুই ঘটতে পারে। বস্তুত এরূপ ভবিষ্যৎ ভাবনার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। আসলে গত শতাব্দীর পূর্বে  কেউ কি ভেবেছিলো আমেরিকা রাশিয়ার মুখোমুখি দাঁড়াবে?, রাশিয়ার সীমান্তের একদম কাছাকাছি আমেরিকান সামরিক স্থাপনা তৈরি করবে? আবার, একই সাথে দীর্ঘ ৪৫ বছর থাকার পরও মাত্র পনেরো বছরের মাথায়, অর্থাৎ ২০০৪ সালে সোভিয়েতের সাবেক দেশগুলো রাশিয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটোতে যোগ দিবে? তাই এরূপ প্রশ্ন ও ইতিহাসের শিক্ষা রাশিয়ানদের রাশিয়াকে অন্যভাবে দেখতে ও গড়তে সাহায্য করেছে। 

চলবে...




ভাবানুবাদক:

বদিরুজ্জামান 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 


মূল বই: 

Prisoners of Geography: Ten Maps That Explain Everything about the World.


লিখেছেন:

Tim Marshall,

A former foreign correspondent for Britain's Sky News Television



No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.