Realpolitik: জাতীয় স্বার্থ অর্জনের বাস্তববাদী কৌশল
Realpolitik: জাতীয় স্বার্থ অর্জনের বাস্তববাদী কৌশল
![]() |
| Nixon and Kissinger |
Realpolitik শব্দটির সঠিক পারিভাষিক অর্থ পাওয়া যায় না। Real + Politics = Realpolitik, অর্থাৎ দুটি পৃথক শব্দের মেশালে একাডেমিক দুনিয়ায় Realpolitik শব্দটির আগমন। ইংরেজি ভাষায়ও Realpolitik এর বিকল্প হিসেবে অনেক বিশেষজ্ঞরা Pragmatic Politics, Power Politics প্রভৃতি মিশ্রশব্দ চয়ন করেন। সে বিবেচনায় Realpolitik- এর বাংলা পারিভাষিক হতে পারে বাস্তববাদী রাজনীতি বা প্রায়োগিক রাজনীতি বা চিরায়ত রাজনীতি প্রভৃতি।
রাষ্ট্র গঠনের চিরায়ত লক্ষ্য বিবেচনায় Realpolitik-এর উদ্ভব। অর্থাৎ, হবস বা রুশোর বর্ণনা অনুসারে যে সামাজিক চুক্তির আদলে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষাই রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণই রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক স্বার্থলাভে বা নিরাপত্তা বিধানে সাহায্য করে। Realpolitik- দুই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যথাঃ রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতিতে (Statecraft) , এবং বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও পরিচালনে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত, যেমনঃ Richelieu, Bismarck, Stresemann এবং অভিজ্ঞ কূটনীতিক, যেমনঃ Kissinger প্রমূখ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ে Realpolitik-কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। অনেক বিশেষজ্ঞই Realpolitik-কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান তত্ত্ব Realism বা বাস্তববাদের প্রায়োগিকরূপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ, রিয়েলিজম তত্ত্ব হিসেবে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সম্পর্কের যে স্বরূপ বর্ণনা করেছে, Realpolitik-তার প্রায়োগিক রূপ।
Realpolitik শব্দটির সূচনা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝিতে। ১৮৫৩ সালে প্রখ্যাত জার্মান ঐতিহাসিক Ludwig von Rochau তার বিখ্যাত “Grundsätze der Realpolitik” (যার ইংরেজি অনুবাদ "Principles of Realpolitik") গ্রন্থে সর্বপ্রথম Realpolitik শব্দটি ব্যবহার করেন। গ্রন্থে Realpolitik শব্দটি দ্বারা লুডভিক রাষ্ট্রপরিচালনায় বাস্তব বা চিরায়ত রাজনৈতিক কৌশলকে অনুসরণের দিককে গুরুত্ব দেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দুনিয়ায় Realpolitik শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেন আরেক জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক Friedrich Meinecke ১৯২৪ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ Die Idee der Staatsräson- এ (যার ইংরেজি অনুবাদ “The Idea of State Reason”)।
তবে, Realpolitik রাষ্ট্রীয় কৌশল বা দর্শন হিসেবে অতি প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। গ্রীক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের “পেলোপোনেসিয়ান যুদ্ধ” গ্রন্থে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। তবে আধুনিক সময়ে Realpolitik ধারণাকে বেশি প্রাসঙ্গিক করে তোলেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তার ক্লাসিক গ্রন্থ “দ্যা প্রিন্স”-এর মাধ্যমে। এই গ্রন্থে ম্যাকিয়াভেলি দেখান তৎকালীন ফ্লোরেন্সকে তার বর্তমান ও ভবিষ্যতকে আরও নিশ্চিত ও সু-উচ্চ করতে Realpolitik বা প্রায়োগিক রাজনীতি বিদ্যার গতিপথকে অনুসরণ করে যেতে হবে।
তবে Realpolitik-এর প্রবক্তা বা বক্তা বা ভক্ত যে-ই হোক না কেনো, সকলে রাষ্ট্রকে প্রধান ও একক কর্মক হিসেবে গ্রহণ করে। এই রাষ্ট্র সবসময় তার পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রাখবে এবং সে অনুযায়ী চিরায়ত রাষ্ট্রনীতিকে অনুসরণ করবে যেখানে সকল নীতিগুলো পরিষ্কার করে বলা থাকবে। যেমন ধরুন রাশিয়ার কথা। পুতিন প্রথম থেকেই তার সীমানাঘেঁষা দেশগুলোকে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ হতে নিরুৎসাহিত (বাধা বা হুমকি বা চোখ রাঙ্গানি যেভাবেই বলি আমরা) করে আসছে। এক্ষেত্রে পুতিন চিরায়ত রাজনীতিকে অনুসরণ করছে, অর্থাৎ, নিজের সীমানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আবার ইউক্রেনের মত ছোট দেশগুলোও বৃহৎ শক্তির প্রভাব থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে বা শক্তির ভারসাম্য আনয়নে একইভাবে বাস্তববাদী রাজনীতি কৌশল হিসেবে ন্যাটোতে যুক্ত হতে চেয়েছে, অর্থাৎ, ন্যাটোর নিরাপত্তা বলয়ে তারা রাশিয়ার সামরিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে। তবে, ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় নীতি ন্যাটো সংক্রান্ত বিষয়ে দোটানায় থাকলেও, পুতিনের বক্তব্য এক্ষেত্রে ছিলো পরিষ্কার এবং সকলের অবগত ও স্পষ্ট।
অতএব রাষ্ট্রের রাজনৈতিক লক্ষ্য বা স্বার্থ বা দুশ্চিন্তা প্রভৃতির বিষয় বাস্তববাদী রাজনীতির অংশ অনুসারে পরিষ্কার ও স্পষ্ট থাকতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার রাজনৈতিক বা জাতীয় স্বার্থ অর্জনে সর্বদা শক্তিকে অনুসরণ করবে, অর্থাৎ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বৃহতের সাথে শক্তি ভারসাম্য বজায় রাখবে, আর বৃহত শক্তির দরুন তার স্বার্থ আদায় করবে। এছাড়াও, স্বার্থ আদায়ে যে শক্তির ব্যবহার বা বৃদ্ধি এটি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুনভাবে পরিচিত করাতে পারে, আবার বৃহৎ শক্তিকে আরও সুদৃঢ় করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে এখানে বিংশ শতকের জাপানের কথা বলা যেতে পারে। জাপান উনবিংশ শতকের শেষের দিকে যখন পারিপার্শিক ইউরোপীয় শক্তি এবং আমেরিকার নৌশক্তির প্রভাবে আচ্ছান্ন ছিলো, তখন জাপানও ঐ অঞ্চলে নিজেকে ক্ষমতাধর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শক্তিশালী নৌবাহিনী তৈরি করে। তাদের এই প্রায়োগিক রাজনৈতিক দর্শন কাজে দেয় যখন ১৯০৫ সালে জাপান ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক ও নৌশক্তি সম্বলিত রাশিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধে জয়ে জাপানের একে তো আঞ্চলিক স্বার্থ আদায় হয়, দ্বিতীয়ত বিশ্বরাজনীতিতে প্রথম এশিয়ার দেশ হিসেবে জাপান আন্তর্জাতিক ক্ষমতার বন্টনে নিজের জায়গা করে নেয়।
আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমনঃ আধুনিক জার্মানির কারিগর অটো ভন বিসমার্ক ফ্রান্সকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে আলাদা করে দিতে চেয়েছিল। কারণ যে আধুনিকায়নের পদক্ষেপ বিসমার্ক গ্রহণ করেন তা ফ্রান্সের আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য ছিলো নেতিবাচক, এবং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া ও ফ্রান্সের সাথে জার্মানির সংকট ছিলো। বিসমার্ক বুঝেছিলো যদি সে ফ্রান্সকে আলাদা করে ফেলতে চায় তাহলে ফ্রান্স হয়তো রাশিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে নতুন বলয় তৈরি করবে, এক্ষেত্রে দুই ফ্রন্ট থেকেই জার্মানি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকবে। তাই সে নিজে রাশিয়ার সাথে নতুন চুক্তি করে, এবং পরবর্তীতে অস্ট্রো-হাংগেরিয়ান সাম্রাজ্যও সেই চুক্তিতে যুক্ত হয়। ফ্রান্সও নিজেকে আলাদা ভাবতে থাকে, এবং বাধ্য হয় চির শত্রু ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে।
একইভাবে, স্নায়ুযুদ্ধকালে পিংপং কূটনীতির কথাও বলা যায়। হেনরি কিসিঞ্জার সোভিয়েতের অন্যতম সহযোগি মাও সেতুং-এর চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীতা অনুভব করেন। কারণ, চিরায়ত রাজনীতিক কৌশল হিসেবে তৎকালে যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েতকে দমিয়ে রাখতে চীনকে আমেরিকার কাছে টানাটা খুব জরুরি ছিলো, একই সময় সোভিয়েত-চীনের মাঝেও একধরণের টানাপোড়ন চলছিলো। কিসিঞ্জার সেই সুযোগটি নিয়েছিলেন যা Realpolitik বাস্তবতার এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এই উদাহরণগুলি বলে দেয়, Realpolitik কোন রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও বৈদেশিক নীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। চলমান বা আসন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যে ব্যবহারিক নীতিকে অনুসরণ করা হয় তাই Realpolitik বা বাস্তববাদী রাজনীতি। অর্থাৎ, প্রয়োজনে নিজের শত্রুর সাথে হাত মেলাতে হবে বা প্রয়োজনে অন্যকে শত্রুতে রূপান্তর করতে হবে বা প্রয়োজনে শক্তি ভারসাম্যকে রাষ্ট্রের স্বার্থ লাভ বা নিরাপত্তা অর্জনের প্রধান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এভাবে Realpolitik কাজ করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রিয়েলিজম তত্ত্বের মতই Realpolitik রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রাষ্ট্র পরিচালনার স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল সাজায়। ম্যাকিয়াভেলির ভাষায় বৈদেশিক নীতির সফলতা অনেকাংশে রাষ্ট্রে বা সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ স্থিতি, শক্তিমত্তা ও মঙ্গলকামনার উপর নির্ভর করে। তবে এই মঙ্গলকামনার কোন আদর্শিক বিষয় নয়, বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিকে ধরে রাখার ইচ্ছাই ম্যাকিয়াভেলির মঙ্গলকামনা। তৎকালীন অনেক রাষ্ট্রপ্রধানই এই দিকটিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলো। উদাহরণ হিসেবে আবারও অটো ভন বিসমার্কের কথা বলা যায়। বিসমার্ক চেয়েছিলেন প্রুশিয়াকে ইউরোপের অন্যতম ক্ষমতাধর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এজন্য প্রথমেই বিসমার্ক প্রুশিয়া সহ অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রদেশগুলোকে একত্র করে আধুনিক জার্মানের পত্তন ঘটান। যখন অভ্যন্তরীণভাবে জার্মানি একত্র হয়ে আধুনিকতার দিকে যাত্রা করে, তখন বিসমার্ক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জার্মানির স্থান শক্তিশালী করতে বৃহৎ সামরিক বাহিনী গঠন করে। ফলে বিংশ শতকের প্রথম দিকেই বিসমার্ক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, এবং জার্মানি তখন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অন্যতম ক্ষমতাধর অংশীদার রাষ্ট্র।
তবে, অনেক বিশেষজ্ঞ, বিশেষত সফল কূটনীতিক ও রাষ্ট্রপ্রধান আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বাস্তববাদী বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ দিকটিকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন না। তারা বলেন, প্রায়োগিক রাজনীতি সম্পর্কে দক্ষতাই রাষ্ট্রকে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনার বাহিরেও তার বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিতে পারে, এমনকি অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থ বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ দিককে অবহেলাও করা যায়। এধরণের বয়ানের সবচেয়ে বড় বক্তা আমেরিকার প্রখ্যাত কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার। স্নায়ুযুদ্ধে আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জড়ানো, বিশেষত ভিয়েতনাম যুদ্ধকে প্রলম্বিত করা এবং চীনকে আমেরিকার কাছে আনার বিষয়ে কিসিঞ্জার Realpolitik-কে অনুসরণ করেন। বিশেষ করে যদি পিংপং ডিপ্লোম্যাসির কথা বলি, চীন তখন সোভিয়েতের সবচেয়ে কাছের মিত্র রাষ্ট্র এবং চীনের পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সাথে আমেরিকার মিত্রতা। ফলে চীনকে কাছে রাখতে পারলে সোভিয়েতকে দুর্বল করা যাবে এবং পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকান উপস্থিতিকে নিরাপদ রাখা যাবে। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এধরণে চাপ ছিলো না, পক্ষান্তরে বিরোধীতা ছিল। কিন্তু অভিজ্ঞ কিসিঞ্জার, অভ্যন্তরীণ সেই চাপগুলোকে অবজ্ঞা করে যখন ১৯৭০’র দশকে সোভিয়েতের সাথে চীনের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তখন চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র তার ও তার মিত্রের সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে। এটি কিসিঞ্জারের প্রায়োগিক রাজনীতি বিবেচনা প্রসূত ডিপ্লোম্যাসির ফল।
Realpolitik- জাতীয় স্বার্থকে যেকোন উপায়ে, যেকোন আদর্শ ও যেকোন মূল্যবোধের উপর একদম প্রথমে রাখতে চায়, সে অনুযায়ী বাস্তববাদী রাজনৈতিক কৌশলের কথা বলে। Realpolitik বিশারদদের ভাষায় অনেকক্ষেত্রে বাস্তববাদী নীতি অনৈতিক ও নীতিবহির্ভূতও হতে পারে। তবে, Realpolitik কিছুক্ষেত্রে এথিকস বা নৈতিকতার বিষয়কেও গুরুত্ব দেয়, তবে প্রেক্ষাপট ভিন্নতায়। ম্যাকিয়াভেলির ভাষায় যে নৈতিক ও আদর্শিক ভিতের উপর মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে ও পরিচালিত হয়, সে নৈতিক ও আদর্শিক বিষয়গুলো রাষ্ট্রপরিচালনায় ব্যবহৃত হয় না। কারণ রাষ্ট্রকে স্বার্থের কথা ভাবতে হয়, এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় কোনরূপ আদর্শের বশীভূত না হয়ে সে স্বার্থে আদায়ে বাস্তববাদী রাজনৈতিক কৌশলকে কাজে লাগাতে হয়।
উদাহরণ হিসেবে রাশিয়ার ক্রাইমিয়া দখল ও বর্তমানে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অন্য দেশের কোন অঞ্চল দখল বে-আইনি সত্ত্বেও রাশিয়া তার জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত নিরাপত্তার অজুহাতে ক্রাইমিয়া দখল করেছে, এবং ২০২২ সালে ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঞ্চল দখলে নিয়েছে যা ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। একইভাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভার্সাই চুক্তির কথা বলা যেতে পারে যেখানে পরাজিত জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলকে বিজেতারা নিজেদের ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করে। এখানে আদর্শিক বিবেচনায় ফ্রান্স বা ব্রিটেন বসে থাকেনি, পরাজিত রাষ্ট্রকে চুক্তিতে অংশ নিতে দিতে চায়নি, তাদের কথা শোনা তো দূরের। ফলে, ফ্রান্স ও ব্রিটেন জার্মানি ও অটোম্যানদের বিরাট ভূখন্ডের মালিক হয়ে যায় যা তাদের বাস্তববাদী রাজনৈতিক কৌশলের ফসল। তবে, এই কৌশল যে সবসময় সফল হবে তা নয়। অনেক ইতিহাসবিদ যেমন ক্লাসিক্যাল রিয়ালিস্ট ইএইচ কার বলেন দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালের সংকট এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ভার্সাই চুক্তির বৈষাম্যমূলক রাজনৈতিক কূটচাল।
Realpolitik-এর দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি চলমান বা আসন্ন পরিস্থিতির নিরিখে প্রণীত হতে হবে এবং নীতি বাস্তবায়নে প্রেক্ষাপটের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সকল কিছুই চলে আসবে, অর্থাৎ, রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোন দেশ কিভাবে, কোন প্রেক্ষিতে বা স্বার্থে রাষ্ট্রটির সাথে আচারণ করবে, এবং সেই আচারণ রাষ্ট্রটির আচারণে বা নীতি প্রণয়নে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, বা রাষ্ট্রের স্বার্থ বা নিরাপত্তা নিশ্চিতে সে আচারণের ধরণ কেমন হতে পারে ইত্যাদি রাজনৈতিক বাস্তবতাকে রাষ্ট্রকে বিবেচনা করতে হবে, এবং সে অনুযায়ী জাতীয় ও বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও নির্বাহ করতে হবে। তবে, Realpolitik- আন্তর্জাতিক আইনের দিককে গুরুত্ব দেয় না, কারণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের স্বার্থ আদায়ে রাষ্ট্রকে কখনো আইনের বাহিরে যেতে হবে।
যেমনঃ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমাগত সামরিক উপস্থিতি এবং এ সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টি ও অন্য রাষ্ট্রের সমুদ্রসীমায় থাকা কিছু দ্বীপকে চীনের নিজের দাবি করা আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। তবুও, চীন তার আঞ্চলিক স্বার্থ বিবেচনায় দক্ষিণ চীন সাগরে তার সামরিক ও আধিপত্যবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। এটি শুধু যে ক্ষুদ্র দেশ, যেমন ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে চীনের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি করছে তা নয়। চীনের এহেন উত্থান এই অঞ্চলের তৎপর ক্ষমতাধর দেশ যেমনঃ জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত প্রভৃতির রাজনৈতিক স্বার্থের জন্যও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। ফলে, এ দেশগুলো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নয়া রাজনৈতিক বাস্তবতার (Realpolitik) নিরিখে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি, QUAD, AUKUS ইত্যাদি সামরিক জোটের অবতারণা করছে। আবার, বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র দেশগুলোও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নয়া রাজনৈতিক বাস্তবতা (Realpolitik) অনুসারে তাদের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও পরিচালনার উদ্যোগ নিতে বাধ্য হচ্ছে, যার অন্যতম বড় উদাহরণ বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক।
যারা Realpolitik- এর প্রবক্তা বা কট্টর অনুসারী তারা নিজেদের রিয়েলিজম তত্ত্বের অনুসারী বলেও দাবী করে; তারা যেকোনো আদর্শিক বা উদারবাদী ভাবাবেগের অনুসারী না হয়ে প্রথাগত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে প্রাধান্য দেয়। এমন একপেশী আচারণে অনেকে তাদের অবিশ্বাস করে বা নীতিবহির্ভূত কর্মক হিসেবে গণ্য করে। উদাহরণ হিসেবে চীনের তাইওয়ানের কথা বলা যায়। চীন তাইওয়ানকে নিজের ভূখন্ড হিসেবে দাবী করে, কিন্তু তাইওয়ান নিজেকে স্বাধীন হিসেবে প্রচার করে। এমনকি স্নায়ুযুদ্ধকালে চীনের সাথে পশ্চিমের সম্পর্ক যতদিন স্বাভাবিক হয়নি, তখন তাইওয়ানকে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। চীনের বিপরীতে তাইওয়ানকে ঘিরে পশ্চিমা দুনিয়ায় এক ধরনের মুভমেন্ট রয়েছে, এবং অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষে, এবং তাইওয়ানের প্রতি চীনের আচারণকে নীতিবহির্ভূত ও বে-আইনি মনে করে। কিন্তু, তাইওয়ানের ব্যাপারে চীন প্রথাগত রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার করে আসছে, যেখানে যেকোনো মূল্যেই হোক তাইওয়ানকে চীনের ভূখন্ডের অন্তর্ভুক্ত করতে প্রস্তুত।
ম্যাকিয়াভেলির লেখায় Realpolitik এর দুটি ধরণ পাওয়া যায়, যেমনঃ ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রপ্রধানের উদ্দেশ্যে বলেন, “শান্তির সময়ে সহজ পন্থা অনুসরণ করনা, বরং নিজেকে আরও ধারালো করে নাও যাতে কঠিন সময়ের সুযোগ দ্রুত আদায় করে নিতে পারো- (Never take things easy in times of peace, but rather use the latter assiduously, in order to be able to reap the profit in times of adversity). ” ম্যাকিয়াভেলির ভাষায়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে যাতে ভবিষ্যতের যেকোন আক্রমনকে প্রতিহত করা যায়, যাতে কঠিন সময়ে জটিল সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তার ভাষায় রাজনৈতিক পরিক্রমায় রাষ্ট্রের স্বার্থমূখী যে সুযোগটি আসবে, প্রায়োগিক রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার করে সুযোগ লুফে নিতে হবে, এক্ষেত্রে লক্ষ পূরণে যেকোন উপায় রাষ্ট্র নিতে পারে (যদিও স্বার্থ আদায়ে শক্তি ব্যবহারের এই বৈধতা নিয়ে অনেক বিতর্ক চালু রয়েছে)। যেমনঃ ইরানের মধ্যপ্রাচ্যে যে আঞ্চলিক স্বার্থ রয়েছে তা অর্জনে ইরান এক্সিস অব রেসিস্টান্ট নামে তার সামরিক বিস্তার মধ্যপ্রাচ্যজুরে বৃদ্ধি করেছে। সম্প্রতি ইসরায়েলের সাথে ইরানের সংকটে এই এক্সিস ইরানকে সাহায্য করছে বিশেষত হিজবুল্লাহ এবং হুতি। হুতি লোহিত সাগরে ইসরায়েলি জাহাজ প্রবেশে বাঁধা সৃষ্টি করছে যা ইরান ও হুতি উভয়েরই আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করছে। তবে, হুতির এহেন আচারণ আন্তর্জাতিক সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্যকে চরমভাবে ব্যহত করছে।
সমসাময়িক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে Realpolitik শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে অনেকক্ষেত্রে Realpolitik ভিত্তিক বৈদেশিক নীতি কেন প্রণীত ও নির্বাহ হবে তার ব্যাক্ষায় Realpolitik এর অনুসারীরা বলেন বৈদেশিক নীতি সবসময় স্বার্থ-কেন্দ্রিক হতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রিয়েলিজম ঘরনার তাত্ত্বিকেরা শক্তিভিত্তিক-রাজনীতিকে (Power Politics) সবসময় নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছেন। বিশেষত, নিও-রিয়েলিজম তত্ত্বের প্রবক্তা কেনেথ ওয়ালজ এবং জন মেয়ারশেইমার শক্তিভিত্তিক/বাস্তব রাজনীতিকে সবসময় বিশৃঙ্খল বা নৈরাজ্যপূর্ণ (Anarchic) আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখিয়েছেন, যদিও তারা তাদের লেখনিতে Realpolitik কথাটির উল্লেখ করেন নি।
Realpolitik ধারণাটির সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলঃ এ ধারণায় যা বলা হয় এবং সে অনুযায়ী যা প্রেস্ক্রিপশন দেওয়া হয় উভয়ের মাঝে বিরোধীতা থেকে যায়। ম্যাকিয়াভেলি ফ্লোরেন্সের রাজাকে যে আসন্ন চ্যালেঞ্জের ব্যপারে সচেতন করতে তার প্রিন্স গ্রন্থটি লিখেছিলেন, সে চ্যালেঞ্জগুলো শুধু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত হয় না, পাশাপাশি নতুন কিছু পরিবর্তনের সুচনা ঘটায়। যেমনঃ রেনেসা পরবর্তী ইতালিকে যেকোন বৈদেশিক আগ্রাসন বা আক্রমণ থেকে রক্ষা এবং ফ্লোরেন্সবাসীর মাঝে একতা সৃষ্টি।
তবে, কোথায় গিয়ে কোন এনালাইসিস বা বিশ্লেষণ শেষ হবে, এবং কোথা থেকে উপদেশ শুরু হবে তা নির্ধারণ করা জরুরি। যেমনঃ রিয়েলিজম তত্ত্বের অনুসারীদের মত Realpolitik-এর প্রবক্তারা বলেন, Realpolitik আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যকর (Anarchic) প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা প্রতিযোগিতার প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট করে তোলে। তবে, যদি এভাবে বলা হয়, রাষ্ট্র প্রধানদের চিন্তার সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয় বা প্রভাবিত হয় সেক্ষেত্রে Realpolitik-এর আলোচনা ও বর্ণনা সত্যিই কাজের। এক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলির ভাষায় ফ্লোরেন্সের রাজার আচারণ হবে শক্তিভিত্তিক রাজনৈতিক আদলে গড়া, এবং এ বাস্তববাদীতা রাজাকে নিজের মত করে এক ধরনের জগৎ তৈরির সুযোগ করে দিবে যাকে সে আন্তর্জাতিক জীবনের অংশ মনে করে, এবং সে জীবন তার ব্যক্তিজীবন নয়, তার রাষ্ট্রের/ সাম্রাজ্য/ প্রদেশের জীবন।
ভাবানুবাদঃ
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল লেখাঃ Realpolitik
মূল লেখকঃ Dr. Adam R.C. Humphereys


No comments