Header Ads

Header ADS

রাশিয়ার "Near Abroad" নীতি ও পুতিনের ইতিহাস পাঠ (পঞ্চম পর্ব)

রাশিয়ার "Near Abroad" নীতি ও পুতিনের ইতিহাস পাঠ (পঞ্চম পর্ব)  

Russian Near Abroad Policy


ক্রাইমিয়া দখলের পর রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শিল্পোন্নত শহর লুহান্সক ও দোনেস্কের রুশপন্থিদের পুতিন উস্কে দেয় যাতে তারাও ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলন রাশিয়াকে সুযোগ লরে দিনেপার নদী পাড়ি দিয়ে কিয়েভে প্রবেশ করতে। তবে, ইউক্রেনীয়রা সে ঝুকি নিতে চায় নি। তাহলে, রাশিয়া ইউক্রেনের জ্বালানি সরবারাহের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। ফলে, ইউক্রেন থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাট যে জ্বালানি সরবারাহ পেতো তা কমে যাবে, এবং এ ঘটনা ইউক্রেনের জন্য ন্যাটো বা ইইউতে যোগদান করার পথকে সংকীর্ণ করে তুলবে। তবে, তখন সম্ভব না হলেও, বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ইউক্রেনীয় রুশপন্থিদের সাহায্যে রাশিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর খোরাসান, দোনেস্ক ও লুহান্সক দখল করে নেয়। 


নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় রাশিয়া কতটা সামরিকভাবে শক্তিশালী ও প্রস্তুত, ক্রাইমিয়া অধিগ্রহণ তারই বড় প্রমাণ, এবং ২০২২ সালের ইউক্রেন যুদ্ধ সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। ক্রাইমিয়া দখল বিশ্ববাসীকে বুঝতে শেখায় “Near Abroad” রাশিয়ার জন্য কতটা রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে। পাশাপাশি বহি:বিশ্বের কাছে এ এক বার্তা যে রাশিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি যেকোনো হুমকি রাশিয়া শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। বস্তুত, ক্রাইমিয়া রাশিয়ার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ শহর। ক্রাইমিয়া হয়ে কৃষ্ণ সাগর ও আযোভ সাগর দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সহজ হবে। 


ক্রাইমিয়া অধিগ্রহণ কিন্তু বাল্টিক ও বলকান অঞ্চলের প্রতি রাশিয়ার ক্ষুদা মেটেনি। তবে রাশিয়া বাল্টিকে সংঘাতে জড়াতে চায় না, তাই জর্জিয়ায় তার সৈন্য সমাবেশ বজায় রেখেছে। ইউক্রেনের পাশাপাশি রাশিয়া জর্জিয়ার অভ্যন্তরেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবে। ২০২২ সালে দেখা গেছে ইউক্রেনে যতটা না রাশিয়ার পরিকল্পনা মাফিক পরিবর্তন এসেছে, জর্জিয়া সে তুলনায় চুপ ও রাশিয়ার প্রভাবের মধ্যে সময় অতিক্রান্ত করছে। 


২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আদতে এটি ছিলো ন্যাটোর প্রতি রাশিয়ার এক সতর্কবার্তা যেন সে রাশিয়ার সীমানার কাছাকাছি না এগোয়। ন্যাটোও ২০১৪ সালের ন্যাটো সামিটে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে বলে, “ ন্যাটো দূরপ্রাচ্যে যাবে, তার বেশি না।” কিন্তু পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে থাকে যখন ন্যাটোর কিছু বিমান বাল্টিক আকাশ সীমায় উড়তে থাকে। পোলান্ড জোটবদ্ধ সামরিক মহড়ার নাম করে ন্যাটোকে এহেন বিমান ঊড্ডয়নের অনুমতি দেয়। এছাড়াও, আমেরিকা এই মহড়ার মাধ্যমে ন্যাটোর সমরাস্ত্র রাশিয়ার যতটা সম্ভব কাছাকাছি নেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। একই সাথে ন্যাটো, বাল্টিক দেশ: এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোলান্ড ও জর্জিয়ার প্রতিরক্ষা ও বিদেশমন্ত্রির সাথে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যায়। 


এই সময় কিছু বিশ্লেষকের বিশ্লেষণ আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। তারা বলেন রাফায়েল জেড বিমান যতই বাল্টিক আকাশ সীমায় উড়ে বেড়ালেও রাশিয়ার রাডারে তা ধরা পড়বে না। তবে, এ বিশ্লেষণ শুধু কূটনীতিক বাক্য বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ন্যাটোও যে প্রস্তুত হচ্ছে রাশিয়ার বিপরীতে তা প্রকাশ পায়। বস্তুত, বাল্টিক দেশের দৃষ্টিতে এ প্রস্তুতি প্রকাশ আবশ্যিক হয়ে উঠেছিলো, কারণ প্রতিবেশি কোন একটি দেশে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে চুপ করে থাকা মানা নিজেকেও সহজ শিকারে পরিণত করা। তবে, পূর্বতন ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামো ও সে কাঠামো ঘিরে আমেরিকার প্রণীত বৈদেশিক নীতিকে পরিমার্জনের প্রয়োজন মার্কিনীরা অনুভব করেন, এবং সে মাফিক নতুন নীতি উপস্থাপন করেন, যদিও তা ইউরোপীয় দেশগুলোকে আকর্ষিত করতে পারে নি, যার প্রধান কারণ নিরাপত্তা বাজেট। 


বাল্টিক দেশ: এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়াকে নিয়ে ন্যাটোর দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার। যেহেতু এ তিন দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়েছে, সেক্ষেত্রে এদের রক্ষায়ও ন্যাটো সনদের পঞ্চম অনুচ্ছেদ অনুসরণ করা হবে, “ন্যাটোভুক্ত কোন দেশকে সামরিক ভাবে আঘাত করার অর্থ ন্যাটোভুক্ত সকল দেশকে আঘাত করা।” ফলে তাদের রক্ষায় ন্যাটো এগিয়ে আসবে। এই অনুচ্ছেদকে পুজি করে ৯/১১ এ যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে ন্যাটোও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়। 


প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একজন ইতিহাসের শিক্ষার্থী। ইতিহাস থেকে সে শিখেছে, বিশেষ করে সোভিয়েত ইতিহাস থেকে, যেখানে সোভিয়েত নিজের পরিধি শুধু বাড়িয়েই গিয়েছে এবং জোরপূর্বক অন্যকে নিজের পরিধিতে যুক্ত করেছে। পুতিন এমন ভুল করতে নারাজ। পুতিন বুঝেন বাল্টিক দেশগুলোকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ হল ন্যাটোকে রাশিয়ার আরও নিকটে নিয়ে আসা। বিপরীতে ২০১৬ সালের শুরু থেকে, রাশিয়া নিজেই তাদেরকে সিগন্যাল দিতে শুরু করে। রাশিয়া রাশিয়ার সামরিক স্ট্রাটেজি পত্রে নানান পরিবর্তন আনেন, যা ২০১৫ সালের পরিবর্তনের তুলনায় অনেক বেশি। এই পত্রে সর্বপ্রথম রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার এক বহিরাগত হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে। 


রাশিয়ার দরকার নেই বিভিন্ন সমরাস্ত্র বাল্টিক অঞ্চলকে কব্জা করার বা ঐ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার। কিন্তু কখনো যদি তা দরকার পরে তাহলে তাহলে সে কব্জা বা প্রভাব বিস্তারের পক্ষে রাশিয়ানদের পুতিন বিভিন্ন যুক্তি দিতে পারবে যে রুশ সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ সেখানে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এস্তোনিয়া ও লাটভিয়ার প্রতি চারজনের একজন রুশ নৃগোষ্ঠীর, এবং লিথুনিয়ার প্রায় ৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী নৃগোষ্ঠীগতভাবে রুশ। এস্তোনিয়ায় রুশ ভাষাভাষীরা দীর্ঘদিন যাবত অভিযোগ করে আসছে এস্তোনিয়ার রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে (যেমন নাগরিকত্ব) তারা এস্তোনিয়ানদের কাছে বৈষম্যের শিকার হন। এর মানে এই নয় যে রুশ ভাষাভাষী এস্তোনিয়ানরা চায় রাশিয়ার অংশ হতে, উপরন্তু রাশিয়া তাদেরকে কাজে লাগিয়ে এই দেশগুলোয় তার প্রভুত্ব বজায় রাখতে পারে।


বাল্টিক অঞ্চলের রুশ ভাষাভাষীরা আদতেই সে দেশে জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিতে যে সকল রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে, তারা সে দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়াও, এ শীতপ্রধান দেশগুলোর জ্বালানির চাহিদার সিংহভাগই মেলে রাশিয়া থেকে, ফলে তাদের উষ্ণায়নকেও রাশিয়া রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। যাহোক, রাশিয়া বাল্টিক অঞ্চলে তার প্রভাব বজায় রেখে যাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বাল্টিক দেশের প্রতিরক্ষাকে সবচেয়ে ভঙ্গুর করে তুলেছে। এখন এ তিনিটি দেশ বাল্টিক সাগর, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব হয়ে রাশিয়াকে ইউরাল পর্বত পর্যন্ত ঢেকে রাখে, অর্থাৎ এই অঞ্চল জুরে বাল্টিক দেশগুলো রাশিয়া ও ন্যাটোর মাঝে বাফার হিসেবে কাজ করছে। 

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত মলদোভা রাষ্ট্রটি উভয় পাশেই জটিলতা সৃষ্টি করে। রাশিয়া যদি মলদোভায় আক্রমণ চালাতে চায় তাকে ইউক্রেনের মাঝ দিয়ে অগ্রসর হয়ে দ্নিপার নদী পাড় হতে হবে; সেখান থেকেও অন্য এক রাষ্ট্রের সীমারেখা পেড়িয়ে মলদোভায় পৌঁছাতে হবে। তবুও রাশিয়া এহেন আক্রমণ চালাতে পারব, সেক্ষেত্রে ইউক্রেনের ওডিশা অঞ্চল পর্যন্ত প্রথমে রাশিয়ার দখলে আনতে হবে (বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ রাশিয়াকে এমনই সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে)। তবে মলদোভা যেহেতু এখনো ন্যাটো সদস্য নয়, তাই মলদোভায় রাশিয়ার আক্রমণের প্রেক্ষিতে রাশিয়া ও  ন্যাটোর মাঝে সংঘাত বা যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা কম। তবে সেক্ষেত্রে পশ্চিমাদের কঠিন অবরোধের শিকার রাশিয়াকে হতে হবে। ফলে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মাঝে সম্পর্কের চিড় আরও গভীর হতে পারে। যদিও, বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার উপর চরম অবরোধ আরোপ করে পশ্চিমারা, যদিও ইউরোপের কিছু রাশিয়ার জ্বালানি নির্ভর দেশের অবরোধ আরোপ নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।


তবে রাশিয়া কেন মলদোভাকে চায়? কারণ, মলদোভা সীমানার পাহাড়গুলো কারপাথ (Carpath) পর্বত দক্ষিণ-পশ্চিমে বক্রভাবে ট্রান্সেলভেনিয়া পর্বতচূড়ায় গিয়ে মিশেছে। আবার, কারপাথের দক্ষিণ-পূর্বে সমভূমি চলে গেছে একেবারে কৃষ্ণসাগরের তীর অব্দি। যেহেতু রাশিয়া নিজের নিরাপত্তার অজুহাতে পোলান্ডের উত্তর ইউরোপীয় সমভূমিকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়, সেক্ষেত্রে কৃষ্ণসাগর ঘেঁষা সমভূমি, যাকে পূর্বে বাসারাবিয়া (Bessarabia) নামে ডাকা হত, তার উপর রাশিয়াকে আগেই নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর প্রচেষ্টার পর এই অঞ্চলে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন কালে। তবে, সোভিয়েত পতনের পর সে সুযোগটিও হারিয়ে যায়। পুতিনের ভবিষ্যৎ চিন্তায় যে এই অঞ্চল নেই তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, এবং বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সে পথে রাশিয়াকে এগিয়ে রাখছে। 


ভাবানুবাদক:

বদিরুজ্জামান 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 


মূল বই: 

Prisoners of Geography: Ten Maps That Explain Everything about the World.


লিখেছেন:

Tim Marshall,

A former foreign correspondent for Britain's Sky News Television





No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.