Header Ads

Header ADS

রাশিয়ার রাজনৈতিক অস্ত্রঃ জ্বালানী ও ইউরোপের শীত (চতুর্থ পর্ব)

Russian Energy Supply to Europe

সেভাস্তিপোল রাশিয়ার একমাত্র কার্যকরী উষ্ণ পানির সমুদ্র বন্দর। এর পূর্বে কৃষ্ণ সাগর হয়ে রাশিয়া ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের সুবিধা পেতো। কিন্তু ১৯৩৬ সালে তুরস্কের সাথে পশ্চিমের মন্ট্রিক্স চুক্তি স্বাক্ষরের পর রাশিয়া সে সুযোগ হারিয়ে ফেলে। এই চুক্তির বদলে পরবর্তীতে তুরস্ক ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে, এবং বসফরাস প্রণালীর উপর তুরস্কের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রাশিয়ার বাণিজ্য জাহাজকে তুরস্ক ট্রানজিটের সুবিধা দেয়, তবে তা সীমিত আকারে।

এমনকি বসফরাস প্রণালী পাড় হওয়ার পরও ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করতে রাশিয়াকে এজিয়ান সাগর পাড়ি দিতে হয়, এবং তারপর জিব্রাল্টার প্রণালী হয়ে অবশেষে আটলান্টিক মহাসাগরের রাশিয়ার বাণিজ্য জাহাজ প্রবেশ করে। আবার যদি ভারত মহাসাগরে রাশিয়ার বাণিজ্য জাহাজ প্রবেশ করতে হয় তাকে এই লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগর হয়ে সুয়েজ খাল হয়ে বাব এল মান্দেব দিয়ে রাশিয়ার জাহাজ ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে। 

রাশিয়া সিরিয়া গৃহযুদ্ধের মোর ঘুরিয়ে দিলেও রাশিয়ার খুব সীমিত সং্খ্যক জাহাজ ভূমধ্যসাগরের সমুদ্র বন্দর তারতুসে (Tartus) রয়েছে। নৌবন্দরটি আয়াতনে ছোট, এবং তার অস্ত্রের যোগানও। 

রাশিয়ার অন্যতম ভূ-কৌশলগত দুর্বলতা হল বাল্টিক সাগর। যেকোনো যুদ্ধে রাশিয়ার নৌ বহর বাল্টিক সাগরের বাহিরে বের হতে পারবে না। এর অন্যতম একটি কারণ স্কাগরেক প্রণালী (Skagerrak Strait), যার সাহায্যে বাল্টিক সাগর উত্তর সাগরের সাথে যুক্ত হয়েছে। এই সরু প্রণালীটি ন্যাটোর সদস্য ডেনমার্ক ও নরওয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যদিও বা কোন যুদ্ধজাহাজ প্রণালী থেকে বের হয়ও তাকে দীর্ঘ গুইক (GUIK) অঞ্চল অর্থাৎ উত্তর সাগরের গ্রীনল্যান্ড, আইসল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের বিরাট শূন্যস্থান পার হয়ে তাকে আটলান্টিকে পৌঁছাতে হবে। 

রাশিয়া ক্রাইমিয়া দখল করে নিজের অংশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েই কিন্তু বসে থাকেনি। রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে শক্ত রাশিয়ান নৌবহর তৈরি করে, এবং বাল্টিক সাগর ঘেষে রাশিয়ার ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড নোভরোসিস্কে নতুন রাশিয়ার নৌশালা তৈরি শুরু করলো যা রাশিয়াকে বাল্টিক অঞ্চলে কৌশলগত সাহায্য প্রদান করবে। এখানে পুতিন প্রায় ৮০ টি নতুন যুদ্ধজাহাজ ও কতগুলো সাবমেরিন চালু করলো। তবে, কৃষ্ণসাগরে যেকোনো যুদ্ধের জন্য নতুন নৌ বহরও তুলনায় অনেক কম ছিলো। ফলে, পুতিন রাশিয়ার জন্য নতুন নৌ ডকট্রিন চালু করলো যেখানে ন্যাটোকে রাশিয়ার প্রধান শত্রু হিসেবে দেখানো হলো।

এই ডক্ট্রিনের আদলে ন্যাটোকে রাশিয়া একটি হুশিয়ার প্রদান করলো যে রাশিয়ার সীমান্তে কোন ধরনের সামরিক/ নৌ উপস্থিতিকে রাশিয়া মেনে নিবে না। তবে, রাশিয়ার এহেন উৎকন্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে আসে নি, উপরন্তু, ন্যাটোর সাহায্যে রোমানিয়ার নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে কৃষ্ণসাগরে ন্যাটোর উপস্থিতিকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে, এবং পাশাপাশি তুরস্কের সাথে সমঝোতা করছে যাতে বসফরাস দিয়ে সীমিত আকারে শুধু রাশিয়ার বাণিজ্যিক জাহাজই যাতায়াতের সুযোগ পায়, কোন সামরিক নয়। 

সোভিয়েত রিপাবলিক অব ইউক্রেনের অংশ হওয়ারও প্রায় দুই শতাব্দী আগে ক্রাইমিয়া রাশিয়ার অংশ ছিলো। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট খ্রুসচেফ ক্রাইমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ করেছিলেন এটা ভেনে যে সোভিয়েত ও সোভিয়েতের অংশগুলো স্থায়ীভাবে থাকবে। বর্তমানে ক্রাইমিয়া সোভিয়েতের অংশও নয়, এবং এমনকি রাশিয়াপন্থি নয়। পুতিন আন্দাজ করতে পেরেছিলেন ক্রাইমিয়ায় কতটা পরিবর্তন এসেছে। পশ্চিমা কূটনীতিকরা কি সে পরিবর্তনটি ধরতে পারেন নি? যদি না পারেন তবে তার কূটনীতির প্রথম অধ্যায়ের উপর তাদের গভীর জ্ঞান নেই। বস্তুত, যখন অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন আসে, বৃহৎ ক্ষমতাধরেরা স্বাভাবিকভাবে সেক্ষেত্রে শক্তি প্রদর্শন করে। যদি পশ্চিমা কূটনীতিকরা সচেতন হতেন, তবে ইউক্রেনের এই গুরুত্বপূর্ণ শহর ক্রাইমিয়া রাশিয়ার মাঝে বিলীন হয়ে যায় না।  

পশ্চিমা মিডিয়া গোটা বিশ্বে প্রচার করতে লাগলো একনায়কতন্ত্র ও অগণতান্ত্রিক রাশিয়ার প্রভাব থেকে বের হয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাতিঘর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে ইউক্রেন যাত্রা করতে প্রস্তুত। যখন এই বয়ানটি প্রচার করা হচ্ছিলো তখন পশ্চিমা মিডিয়া হয়তো এক সত্য ভূলতে বসেছিল যে একবিংশ শতকে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেলো, কোন স্থানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা এক শতকেও সম্ভব নয়, আর রাশিয়া এতো গণতান্ত্রিক আইন কানুনের থোড়াই কেয়ার করে। 

ইয়ানিকোভিচের পর আলেক্সান্ডার তুরছিনোভ ইউক্রেনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তিনি ক্ষমতার আসনে বসেই কিছু ভুল/ রাশিয়া বিরোধী বক্তব্য ও নীতি গ্রহণ শুরু করে যার মধ্যে অন্যতম রুশ ভাষাকে ইউক্রেনের কিছু প্রদেশের দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে যে দীর্ঘদিনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তা রহিত করা। উল্লেখ ঐ প্রদেশের অধিবাসীদের একটি বড় অংশের মাতৃভাষা রুশ এবং তারা রাশিয়াপন্থি মনোভাব পোষণ করতেন, এর মধ্যে ক্রাইমিয়া অন্যতম। ফলে, উক্ত অঞ্চল ব্যাপী জন অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, এবং সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়। পুতিন এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। তিনি প্রচার করতে শুরু করেন ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষীদের রক্ষা করা রাশিয়ার পবিত্র দায়িত্ব।

এই দ্বায়িত্বের বিষয়টি রাশিয়া অনেক আগে থেকেই ভেবে আসছে, বিশেষত সোভিয়েত জামানায়। সোভিয়েত অঞ্চলে রুশ ভাষাভাষীদের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত একটি আইনও করে রাশিয়া। ফলে ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষীদের রক্ষার অজুহাত পুতিন ভালোভাবেই প্রচার করতে থাকে। পাশাপাশি রুশ ভাষাভাষীদের রাশিয়ার নাগরিকত্ব দেওয়ার আইনও রাশিয়া করে যেখানে কোন রুশ ভাষাভাষী ব্যক্তির দাদা যদি রাশিয়ার অধিবাসী হন, তাহলে সেও রাশিয়ার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। আর যদি ইউক্রেনের সাথে সংঘাত বেধে যায়, তবে এই রুশ ভাষী ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ার পাসপোর্ট নিয়ে অন্য দেশে যাবে, ফলে সংঘাতে এক ধাপ এগিয়ে থাকবে রাশিয়া। 

ক্রাইমিয়ার মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬০ শতাংশ নৃগোষ্ঠীগত ভাবে রাশিয়ান। ফলে ক্রাইমিয়া রাশিয়ার জন্য খুব সহজ টার্গেট হবে বলে পুতিন ভাবতেন। ধারণা মাফিক পুতিন ইউক্রেনীয় সরকার বিরোধী দলকে বিভিন্নভাবে প্রনোদনা দেওয়া শুরু করে যাতে এই আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ানো যায়। যখন সংঘর্ষ তীব্র হয়ে ওঠে, পুতিন সরকার বিরোধীদের সমর্থনে রাশিয়ার সৈন্যদের ক্রাইমিয়ায় প্রবেশ করার অনুমতি দেন, এবং ক্রাইমিয়ার সমুদ্র বন্দরের নৌশালা তৈরি করেন। ইউক্রেনের সৈন্যের পক্ষে এক সাথে দুই ফ্রন্টে অর্থাৎ রাশিয়ান সৈন্য ও সরকার বিরোধী সংগ্রামীদের সাথে যুদ্ধে জড়ানো সম্ভব ছিলো না, তাই তারা ক্রাইমিয়া থেকে দ্রুত ইউক্রেনীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ক্রাইমিয়া পুনরায় ডি ফ্যাক্টোভাবে রাশিয়ার অংশ হয়ে যায়। 

আপনি বলতেই পারেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতায় হস্তক্ষেপ করা উচিত হয় নি, কারণ তার আরও অনেক উপায় ছিলো। কিন্তু সত্য বলতে কী রাশিয়াকে ইশ্বর যে ভৌগোলিক অবস্থানে রেখেছে, সে বিবেচনায় পুতিনের হাতে আর কোন অপশনই ছিলো না। যে অঞ্চল দিয়ে রাশিয়ার বেশিরভাগ বাণিজ্য হয়, যে অঞ্চলের সমুদ্রবন্দর রাশিয়ার একমাত্র উপযোগী উষ্ণ পানির খোলা সমুদ্রের প্রবেশের পথ, সে গুরুত্বপূর্ণ ক্রাইমিয়া হারানোর বা সে অঞ্চল দখল অধিগ্রহণের সুযোগ পুতিন কোনভাবেই ছাড় দিতে পারেন না। এটা বাস্তববাদী যৌক্তিক রাজনীতির একটি সরল সত্য। 

রাশিয়ার কাছে ইউক্রেন আয়তনে বেলজিয়াম সমপরিমাণ ভূখণ্ড হারালেও পশ্চিমা কোন মোড়ল ইউক্রেনকে ক্রাইমিয়া পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। ইউক্রেন ও তার প্রতিবেশী দেশগুলো একটা কথা খুব ভালো করেই বুঝেছিলো যে যতক্ষণ না তারা ন্যাটোতে যোগদান করছে, রাশিয়া তাদের উপরে চড়ে বেড়াবে, এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্যে আসবে না। তবে, পুতিনের জন্য তার সীমান্তবর্তী দেশে ন্যাটোর উপস্থিতি রাশিয়ার অস্তিত্ব সংকট তৈরি করে। পশ্চিম চাইলেই ক্রাইমিয়া ইস্যুকে অগ্রাহ্য দেখাতেই পারে, কিন্তু রাশিয়া নয়। 

রাশিয়ার ক্রাইমিয়া দখলের প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার উপর সীমিত আকারে অবরোধ জারি করে। সীমিত আকারে অবরোধ দেওয়ারও একটা মজার কারণ রয়েছে। তাহল ফ্রান্স ও জার্মানির মত কিছু দেশের সস্তামূল্যে  জ্বালানির সবচেয়ে বড় সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন পূর্ব থেকে পশ্চিমে গিয়েছে, এবং সেপথে সব দেশই সে সস্তা জ্বালানির সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হল পাইপলাইন চালু বন্ধের চাবি কিন্তু রাশিয়ার কাছে। 

পুতিনের বড় অস্ত্র দুইটি: জ্বালানিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার, এবং এই কাজটাকে পড়ে রুশ নৃগোষ্ঠী বা রুশ ভাষাভাষীদের রক্ষণাবেক্ষণের অজুহাতে বৈধ করা। ২০১৪ সালের এক বক্তব্যে পুতিন ‘Novorossiya’ নবরোশিয়া বা নতুন রাশিয়া ধারণাটি দেন। নবরোশিয়া দিয়ে পুতিন দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেনকে বুঝিয়েছে যে অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া অটোম্যানদের থেকে দখলে নিয়েছিলো। তখন রুশ সাম্রাজ্যের মুকুট ছিলো রাণী ক্যাথেরিন দ্যা গ্রেট। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে রাণী ক্যাথেরিন রুশ ভাষাভাষীদের এই অঞ্চলে বসবাসের জন্য প্রেরণ করেন, এবং তাদের মাতৃভাষা হিসেবে রুশ ভাষাকে চর্চার তাগিদ দেন। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন নভরোশিয়াকে ইউক্রেন নামে নামকরণ করে। 

কিন্তু সোভিয়েত এ কাজটি কেন করেছিলো? প্রশ্নটি তোলেন পুতিন। পরে তিনি বলেন,”প্রভু, আপনি তাদের (ইউক্রেনীয়দের) বিচার করতে দিন।” পুতিনের দীর্ঘ বক্তব্যে তিনি ইউক্রেনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল যেমন: খারকিভ, লুহানস্ক, ডোনেস্ক, খেরসোন, মাইকোলাইভ, এবং ওডেশার কথাও বলেন। তিনি বলেন, “ইউক্রেন গঠনে রাশিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বিভিন্ন কারণে ইউক্রেনে বিলিন হয়ে যায়। কিন্তু রুশ ভাষাভাষীরা আজও টিকে আছে। রাশিয়ার প্রতি তাদের ভালোবাসা এখনো তাজা।” 



ভাবানুবাদক:

বদিরুজ্জামান 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 


মূল বই: 

Prisoners of Geography: Ten Maps That Explain Everything about the World.


লিখেছেন:

Tim Marshall,

A former foreign correspondent for Britain's Sky News Television




No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.