চীন: জীবন্ত সভ্যতা ও ড্রাগনের ভূমি (প্রথম পর্ব)
চীন: জীবন্ত সভ্যতা ও ড্রাগনের ভূমি (প্রথম পর্ব)
![]() |
| Chinese Flag with Dragon Ai Make |
চীন রাষ্ট্রের আড়ালে এক সভ্যতা- বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লুসিয়ান পাই (Lucian Pye)
অক্টোবর, ২০০৬, হাজার ফুট আয়াতনের যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-সুপার ক্যারিয়ারের হাজার ফুট আয়তনের ইউএসএস কিট্টি হ'ক (USS Kitty Hawk) উত্তর চীন সাগরের বুক চিড়ে দক্ষিণ জাপান ও তাইওয়ান প্রণালীর মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল। হঠাৎ, কাউকে কোনরূপ সতর্ক বার্তা ছাড়াই এক চীনা সাবমেরিন কিট্টি হ'কের পথ আগলে দাড়াল (ভেসে উঠল)। কিট্টি হ'কের সাথে ছিলো এক ডজন যুদ্ধজাহাজ, ক্যারিয়ার ভরা বিধ্বংসী যুদ্ধবিমান, আর নীল জলের তলায় শক্তিশালী সাবমেরিন। সে তুলনায় চীনা সাবমেরিনটি ছিলো দুর্বল সং ক্লাস সাবমেরিন, যা চলতো ডিজেল চালিত ইলেক্ট্রিক পাওয়ারে। তবুও, চীনা সং ক্লাস সাবমেরিনটি ছিলো চীনা শক্তির প্রতীক।
এত আধুনিক প্রযুক্তি থাকার পরও কোন ধরণের সিগনাল ছাড়া কিভাবে এবং কোথা থেকে চীনা সাবমেরিনের আবির্ভাব ঘটলো সে কথা ভেবে আমেরিকানরা একইসাথে আশ্চর্য ও রাগন্বিত হচ্ছিলেন। এছাড়াও, তাদের মনে হয়েছিলো চীনা সাবমেরিন হয়তো কোন সংঘাত বাঁধাতে চাচ্ছে বা কিট্টি হ'কের টর্পেডোর রেঞ্জের কাছাকাছি পৌছে আমেরিকানদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। তারা চীনা নৌবাহিনীর এহেন আচারণের নিন্দা জানালেন, বস্তুত তারা কঠোর ভাষায় সমালোচনা জানালেন। তাদের নিন্দা ও সমালোচনার জবাবে চীনের পক্ষ থেকে বলা হল, “ ওহ, কি একটা অবস্থা (Coincidence)! আমরা হঠাৎ করেই তোমাদের যুদ্ধ মহড়ার মাঝেই উপস্থিত হলাম! ভেসে উঠলাম তাও আমাদের সীমার অনেক দূরে! দু:খিত, আমাদের ধারণা ছিলো তা।”
![]() |
| USS Kitty Hawk and Chinese Submarine |
অনেকে এ ঘটনাকে আধুনিক সময়ের ‘গানবোট ডিপ্লোম্যাসি’’ হিসেবে উল্লেখ করেন। গানবোট ডিপ্লোম্যাসির সূচনা হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে, অর্থাৎ দুর্বল ভূখন্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে কোন শক্তিশালী নাবিককে যুদ্ধজাহাজ নিয়ে পাঠানো হতো। তবে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে গানবোট ডিপ্লোম্যাসির সবচেয়ে বড় উদাহরণ উনবিংশ শতকের জাপানের বিপরীতে আমেরিকার স্যার আর্থারের নৌশক্তি ব্যবহারে জাপানের সামুদ্রিক বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
একবিংশ শতকে এসে চীনও সে একই কৌশল (গানবোট ডিপ্লোম্যাসি) অনুসরণ করছে, বিশেষত তাইওয়ান প্রণালী ও পূর্ব চীন ও জাপান সাগরে। চীনের পক্ষ থেকে দেওয়া বার্তাটি পরিষ্কার, “আমরা এখন সামুদ্রিক শক্তি, এখন আমাদের সময়, এবং এটা আমাদেরই সাগর।” চীনের চার হাজার বছরের ইতিহাসে চীনের সামুদ্রিক অভিযাত্রা ও শক্তিমত্তার বহু কাহিনীই লিপিবদ্ধ আছে। তবে, চীনের বিশ্বব্যাপী পদচারণ চীনকে বিভিন্ন অঞ্চলে তার বন্দর ও নৌশালা তৈরিতে সাহায্য করেছে, এবং এখন চীন সমুদ্র চলাচলের পথ বা রুট আপনাদের খুব কাছেই আছে।
এর আগে চীন কখনো বৃহৎ নৌশক্তি ছিলো না। এর কারণও ছিলো। চীনের বিশাল ভূখন্ড, বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের সাথে চীনের সীমারেখা, আঞ্চলিক কিছু অঞ্চলে সীমিত পরিসরে সামুদ্রিক বাণিজ্য প্রভৃতি চীনকে কখনো বৃহৎ নৌশক্তি গঠনে মনোযোগী করেনি। তবে, সমুদ্র অভিযাত্রায় চীনা নাবিকদের আরব নাবিকদের ন্যায় সুনাম ছিলো, বিশেষত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে। তবে, চীনা নাবিকদের তুলনায় চীনা নৌবাহিনীর প্রভাব শুধু চীনের উপকূলেই সীমিত ছিলো, নাবিকদের মত এই দুই মহাসাগরে নিজেদের উপস্থিতি বাড়ানোর কোন আগ্রহ চীনা সাম্রাজ্য ও পরবর্তীতে মাও সেতুং-এর চীনে দেখা যায়নি।
চীনা শাসকেরা সবসময় রাশিয়ার মত ভূখণ্ডের বা ভূমির দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন, এবং কিভাবে আরও আরও অঞ্চল দখলে নেওয়া যায়, কিভাবে আরও মানুষকে চীনা সাম্রাজ্যের অধীনে আনা যায় সে প্রচেষ্টাই চালিয়েছেন।
![]() |
| Yellow and Yangtze River |
ইয়েলো নদীর অববাহিকায় বন্যা হরহামেশাই হয়, দুকূল ছাপিয়ে যায় যায় ঘোলা ইয়েলোর জলে। দুপারের জীবনকে থামিয়ে দেয়, জনপদকে ধ্বংসের মূখে ঠেলে দেয়। ইয়েলোর এহেন নিষ্ঠুর আচরণে চীনা ইতিহাসে ইয়েলোকে ‘'হান'দের চাবুক (Scourge of the Son of Hans)”, আবার অনেকে, ইয়েলোকে “চীনের দু:খ” নামে ডাকে। উপরুন্তু, এ নদীর তীর ঘেঁষেই ১৯৫০ পরবর্তীতে চীনের শিল্পায়নের বিকাশ ঘটে, যা চলমান ছিলো পরবর্তী তিন দশক পর্যন্ত।
শিল্প-কলকারখানার দুষিত বর্জ্য-পদার্থ ইয়েলোর জলকে বিষাক্ত করে তুলেছে। এ বর্জ্যই গিয়ে মিশছে সাগরে। তবে, সময়ে সময়ে ইয়েলোর দূষণের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়ে যায় যে বর্জ্য সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। তা সত্বেও, মিশরীয় সভ্যতার লীলাভূমি যেমন নীলনদ, চীনা সভ্যতার উন্মেষভূমিও ইয়েল নদী। এ নদী তীরেই চীনারা প্রথমে কৃষিকাজ শুরু করে, লেখার প্রয়োজনীয় কাগজ ও কলমও আবিস্কার করে। ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশ চীনকে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর, শক্তিশালী থেকে মহা শক্তিশালীতে পরিণত করে।
ভাবানুবাদক:
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল বই:
Prisoners of Geography: Ten Maps That Explain Everything about the World.
লিখেছেন:
Tim Marshall,
A former foreign correspondent for Britain's Sky News Television
1. মেদভেদের দেশ রাশিয়া (Russia): সীমান্ত ঘেঁষা যুদ্ধের শঙ্কা (প্রথম পর্ব)
2. কি'ভেন রুশের (Kievan Rus) দেশ রাশিয়াঃ মস্কো থেকে সাইবেরিয়া (পর্ব ২)
3. উষ্ণ জলের দিকে রাশিয়ার যাত্রা (পর্ব ৩)
4. রাশিয়ার রাজনৈতিক অস্ত্রঃ জ্বালানী ও ইউরোপের শীত (চতুর্থ পর্ব)
5. রাশিয়ার "Near Abroad" নীতি ও পুতিনের ইতিহাস পাঠ (পঞ্চম পর্ব)
6. রাশিয়ার জ্বালানী ও রুশ ভাষী ইউরোপিয়ান (শেষ পর্ব)




No comments