চীনের প্রতিরক্ষাঃ গোবি মরু থেকে চীনের মহাপ্রাচীর (দ্বিতীয় পর্ব)
চীনের প্রতিরক্ষাঃ গোবি মরু থেকে চীনের মহাপ্রাচীর (দ্বিতীয় পর্ব)
![]() |
| The Great Wall of China |
উত্তর চীনে দক্ষিণের মত এত প্রাণের স্পন্দন নেই। উত্তর চীনের ভূপ্রকৃতি রুক্ষ পাহাড় ও মরুভূমিতে আবদ্ধ। চীনের গোবি মরুভূমি যা গিয়ে মিশেছে মংগোলিয়ার সীমান্তে। পশ্চিম চীন পাহাড়ের সারিতে ঘেরা। পশ্চিমের তিব্বতীয় মালভূমি গিয়ে ঠেকেছে হিমালয়ের পর্বতশ্রেণীতে। আর চীনের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব গিয়ে মিশেছে দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব চীন সাগরে।
চীনা ভূখণ্ডের প্রাণকেন্দ্র অর্থাৎ উত্তর চীনা সমভূমি যা ইংয়াজি ও ইয়েলো নদীর ধারাবাহিক পলিমাটিতে গড়ে উঠেছে, চীনের সবচেয়ে উর্বর ভূমি। ধান ও সয়াবিন চাষের আদর্শ আবহাওয়া এ ভূমির প্রধান সহায়ক। বছরে দুইবার ধান ও সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয় এ ভুখন্ডে। ফলে, এ অঞ্চলে চীনের জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। প্রায় ১৫০০ খৃষ্টপূর্বে, উত্তর চীনা সমভূমিতে ছোট ছোট অনেক শহর গড়ে উঠেছিলো যারা নিজেদের মাঝে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকতো, এভাবেই একসময় চীনের আদি বংশ- শাং বংশের (Shang Dynasty) উদ্ভব। এখানেই চীনা সভ্যতার রূপকার হান'-দের উদ্ভব, এবং তারা উত্তর চীনা সমভূমিকে চীনের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বাফার অঞ্চল হিসেবে ব্যবহার করতেন।
বর্তমানে ‘হান'’রা চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী, চীনের প্রায় ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী হান', এবং তারাই চীনের রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা মান্দারিন, কান্টোনিজ (Cantonese) ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাগত ক্ষেত্রে পৃথক হলেও, নৃগোষ্ঠীক বিচারে ও চীনা হার্টল্যান্ড বা উত্তর চীনা সমভূমি রক্ষার প্রশ্নে তারা এক ও অভিন্ন। যদিও মান্দারিন (পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে) ভাষার সূচনা উত্তর চীনে, তবুও ক্রমে এটি চীনের প্রভাবশালী ভাষায় পরিণত হয়। এটি চীনের অফিসিয়াল ভাষা, চীনা সরকারি দপ্তর, টেলিভিশন প্রোগ্রাম ও শিক্ষাক্রম প্রভৃতি ক্ষেত্রে মান্দারিন ভাষা ব্যবহৃত হয়। মান্দারিনের লিখিত রূপ ক্যান্টন ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মত হলেও, কথন হিসেবে মান্দারিন এ ভাষাগুলোর থেকে আলাদা ।
![]() |
| Gobi Desert |
উত্তর চীনা সমভূমি বা চীনের হার্টল্যান্ড বা কেন্দ্রীয় ভূমিটি চীনের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৃগোষ্ঠিক, এবং সর্বোপরি চীনের কৃষি জাত শিল্পের গ্রাভিটি বা কেন্দ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ভূখণ্ডটি আয়তনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক, তবে প্রায় ১ বিলিয়ন চীনা নাগরিকদের বসবাস এ ভূখন্ডে। কারণ, চীনের সবচেয়ে বসবাস উপযোগী আবহাওয়া রয়েছে এখানে; চীনের কৃষি ভিত্তিক সমাজের সর্বাধিক উর্বর ভূমি রয়েছে এখানে, এবং ঐতিহাসিকভাবে হান'েরা নিজেদের অন্য জাতিগোষ্ঠীর থেকে বিশেষত পাহাড়ি যুদ্ধবাজ গোষ্ঠী এবং মংগলদের থেকে বাচতে গোটা চীনের এ ভূখণ্ডকে সবচেয়ে নিরাপদ ও উপযোগি মনে করেছিলো।
টিকে থাকার মূলমন্ত্র হিসেবে চীন আইভান দ্যা টেরিবলের প্রণীত রুশ আক্রমণাত্মক নীতিকে অনুসরণ করে। শুধু টিকে থাকাই নয়, এই নীতি রুশ সাম্রাজ্যকে যেভাবে শক্তিশালী করেছিলো, চীনা বিভিন্ন সাম্রাজ্যও সে নীতির সুফল পেয়েছে? প্রথমেই উল্লেখ করেছি উত্তর চীনা সমভূমির চারিপাশে পর্বত ও নদী দ্বারা ঘেরা। ফলে হান'রা এই প্রাকৃতিক সীমারেখাকে কাজে লাগাতে চায়, এবং সীমান্ত রক্ষা ও আরও পাহাড়ি সীমানা দখলের মাধ্যমে নিজেদের সুরক্ষিত করতে চেয়েছে হান'রা। প্রায় হাজার বছর ধরে তিব্বতকে অধিগ্রহণের যে চেষ্টা হান'রা চালিয়ে এসেছে সেক্ষেত্রে সফল হয়েছে মাত্র সাত দশক আগে।
চীনের মহান' দার্শনিক কনফুসিয়াসের (৫৫১-৪৭৯ খৃঃ পূর্ব) সময় থেকে চীনাদের মাঝে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বা আইডেন্টিটি তৈরির প্রতি আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। তখন দুইটি ক্ষেত্রে চীনা ভূখন্ডের নাগরিকদের চিহ্নিত করা হয়: চীনা সভ্যতার ধারক ও বাহক হান'েরা, এবং এর বাহিরের সকলেই পাহাড়ি ও বর্বর শ্রেণীভুক্ত। তৎকালীন প্রায় ৬০ মিলিয়ন চীনা অধিবাসী ছিলো হান', যারা নিজেদের চীনা ভূখণ্ডের বৈধ ও সভ্য অধিবাসী বলে দাবী করতো।
২০০ খৃষ্টপূর্ব পরবর্তীতে চীন সামনের দিকে এগিয়েছে, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। গন্তব্য ছিলো তিব্বতের আরও দক্ষিণপূর্বে যাওয়া, সেন্ট্রাল এশিয়ার তৃণভূমিতে পৌঁছাতে চেয়েছে, আরও দক্ষিণের দক্ষিণ চীন সাগরের তীরে গিয়ে পৌছায়। ২২১-২০৭ খৃঃ পূর্বে চীনা ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী সাম্রাজ্য “চিন সাম্রাজ্য (Qin Dynasty) পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি: চীনের মহা প্রাচীর তৈরি করে। মহা প্রাচীরের পরবর্তী চীনা ইতিহাস, চীনের আধুনিকায়নের ইতিহাস। আজকে চীনের সীমানা আমরা দেখছি তার অধিকাংশই নির্ধারিত হয়েছিলো দুই-হাজার বছর পূর্বে, চিন সাম্রাজ্যের অধীনে।
ভাবানুবাদক:
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল বই:
Prisoners of Geography: Ten Maps That Explain Everything about the World.
লিখেছেন:
Tim Marshall,
A former foreign correspondent for Britain's Sky News Television
1. মেদভেদের দেশ রাশিয়া (Russia): সীমান্ত ঘেঁষা যুদ্ধের শঙ্কা (প্রথম পর্ব)
2. কি'ভেন রুশের (Kievan Rus) দেশ রাশিয়াঃ মস্কো থেকে সাইবেরিয়া (পর্ব ২)
3. উষ্ণ জলের দিকে রাশিয়ার যাত্রা (পর্ব ৩)
4. রাশিয়ার রাজনৈতিক অস্ত্রঃ জ্বালানী ও ইউরোপের শীত (চতুর্থ পর্ব)
5. রাশিয়ার "Near Abroad" নীতি ও পুতিনের ইতিহাস পাঠ (পঞ্চম পর্ব)
6. রাশিয়ার জ্বালানী ও রুশ ভাষী ইউরোপিয়ান (শেষ পর্ব)



No comments