Header Ads

Header ADS

সামুদ্রিক বিভাজন (Maritime Boundaries): কতটুকু আমার কতটুকু সবার

 সামুদ্রিক বিভাজনঃ কতটুকু আমার কতটুকু সবার 

Maritime Boundary Map in Medieval 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই সামুদ্রিক সীমারেখা নির্ধারণ প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটে। সমুদ্র উপকূলে প্রাপ্ত জ্বালানি সম্পদের প্রাচুর্য ততকালীন রাষ্ট্রদের নিজ নিজ সমুদ্রিক সীমারেখা নির্ণয়ে প্রলুব্ধ করে তোলে৷ ১৯৫০ সাল নাগাদ দেখা যায় বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলের সামুদ্রিক সীমারেখা নির্ধারণ সম্পন্ন হয়ে যায়। যা ক্রমেই বেড়ে চলে, এমনকি ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোও সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলের সুযোগ পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। 

তবে, স্থল সীমানা চিহ্নিত করা নিয়ে যেমন সংঘাত ও সংকটের জন্ম হয়েছে বিংশ শতকে, সামুদ্রিক সীমারেখা নির্ধারণ নিয়েও এখন অব্দি সংকট বিরাজ করছে। মজার বিষয় হলো, রাষ্ট্রগুলো শুধু নিজেদের সীমানা নির্ধারণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, উপরন্তু সকলের জন্য একটা নির্দিষ্ট লাইনও তৈরি করেছে যার বাহিরে কোন রাষ্ট্রই আইনত নিজের সীমানা বৃদ্ধি করতে পারবে না। 

তবে, তার পরেও সংকট রয়ে গেলো সমুদ্রের মহীসোপান অঞ্চলের সীমানা কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা চিহ্নিত করে, এবং অর্থনৈতিক সামুদ্রিক অঞ্চলে অন্যদেশের প্রবেশের নিয়ম কেমন হবে ইত্যাদি নিয়ে। মহীসোপান অঞ্চল সংক্রান্ত সংকট ও বিরোধ নিরসনে Commission on the Limits of the Continental Shelf (CLCS) গঠিত হয়। যদিও এই কমিশনের কাজ কিছুটা জটিল ও ব্যয় সাপেক্ষ, তবে বিরোধ নিরসনে কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। 

অত্র নিবন্ধে আমরা জানার চেষ্টা করবো সমুদ্রের বিভিন্ন সীমারেখা নিয়ে, এবং সে সীমারেখা সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কিছু আইন নিয়ে। এছাড়াও, সমুদ্রের সীমানা কিভাবে নির্ধারিত হবে এবং কতটুকু পর্যন্ত সে সীমানা নির্ধারণ করা যাবে তাও জানবো। 

সমুদ্র আইন, ১৯৮২:

বিংশ শতকের অন্যতম একটি প্রভাবশালী চুক্তি ছিলো UNCLOS বা  সমুদ্র আইন সংক্রান্ত কনভেনশন । সমুদ্র আইনের মাধ্যমে সমুদ্র সংলগ্ন দেশগুলো নিজেদের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে খানিকটা ছাড় দিতে সম্মত হয়। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৩ সাল অবদি নানা বিচার বিশ্লেষণ শেষে প্রায় ৩২০ অনুচ্ছেদের আনক্লজকে সকলের সামনে উপস্থাপন করা হয়। জ্যামাইকায় ১৯৮২ সালে, প্রায় ১১৯ টি দেশ সমুদ্র সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তবে, স্বাক্ষরেরও এক যুগ পরে, অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে যখন ৬০ টি দেশ চুক্তিকে র‍্যাটিফাই বা অনুমোদন দান করে তখন থেকে UNCLOS তার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। বিংশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হলেও আনক্লজ কিন্তু নিখাঁদ নয়, কিছু অস্পষ্টতা এই চুক্তিতে রয়েছে গিয়েছে। তবে, আনক্লজ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে, অর্থাৎ সামুদ্রিক সীমারেখা নির্ধারণ করেছে। 

রাজনৈতিক সমুদ্র সীমা কতটুকু হবে?

UNCLOS-এর তৃতীয় অনুচ্ছেদে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে প্রতিটি সমুদ্র সংলগ্ন দেশ উপকূল হতে ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল= ১.৮৫২ কিলোমিটার) পর্যন্ত জলসীমাকে তার রাজনৈতিক সীমা হিসেবে গ্রহণ করবে। শুধু বাণিজ্যিক প্রয়োজনেই রাষ্ট্র-ক, রাষ্ট্র-খ এর সমুদ্রসীমা ব্যবহারের সুযোগ পাবে। যেকোনো ধরণের সামরিক প্রয়োজনে রাষ্ট্র-ক এই সীমারেখা ব্যবহার করতে পারবে না, কারণ ১২ নটিক্যাল মাইল রাষ্ট্র-খ এর ভৌগোলিক অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। 

শুধু সমুদ্রসীমা-ই নয়, ১২ নটিক্যাল মাইল অব্দি আকাশসীমাও রাষ্ট্র-খ এর সার্বভৌমত্বের অংশ হবে, এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যের মত রাষ্ট্র-ক যদি রাষ্ট্র-খ এর আকাশ সীমা ব্যবহার করতে চায় তখন তাকে রাষ্ট্র-খ এর অনুমতি গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় রাষ্ট্র-খ নিজের আকাশসীমাকে নিরাপদে রাখতে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। প্রথমে রাজনৈতিক সমুদ্র সীমায় ইউরোপীয় যুদ্ধজাহাজের অনুপ্রবেশ প্রায়শই ঘটতো। ফলে তৃতীয় বিশ্বের উপকূলীয় দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থেই রাজনৈতিক সীমানায় যেকোনো ধরণের সামরিক নৌবহর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, তবে, রাষ্ট্র-খ যদি চায় তাহলে রাষ্ট্র-ক তার নৌ-বহর রাষ্ট্র-খ এর রাজনৈতিক সীমানায় প্রবেশ করাতে পারে। 

অতীতে যখন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকেরা বিভিন্ন উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করে তখন সামুদ্রিক যাত্রাকে নিরাপদ করতে তারা "Cannon Shot Rule" বা "Three-Mile Limit" নীতি অনুসরণ করতো। এই নীতি অনুসারে প্রতিটি উপকূলীয় উপনিবেশ এবং পরবর্তীতে স্বাধীন উপকূলীয় দেশের জন্য তিন নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমাকে তাদের রাজনৈতিক সীমা হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে থাকে এবং সমুদ্রতলের খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা উপকূলীয় দেশকে তিন নটিক্যাল মাইলে সন্তুষ্ট রাখতে পারেনি। তখন একেক রাষ্ট্র একেক আয়তনের জলসীমাকে নিজেদের রাজনৈতিক সমুদ্রসীমা হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু করে। নিচে এরূপ একটি তালিকা দেওয়া হলঃ

রাজনৈতিক সমুদ্রসীমা হিসেবে ঘোষণা করে
(নটিক্যাল মাইল)

দেশের সংখ্যা 

৩ নটিক্যাল মাইল 

১৮

"

"

১২ "

৮৪

১৫ "

২০ "

৩০ "

৩৫ "

৫০ "

৭০ "

১০০ "

১৫০ "

২০০ "

১৩


তালিকা থেকে প্রতীয়মান হয় তৎকালে অধিকাংশ উপকূলীয় দেশ ১২ নটিক্যাল মাইল জলসীমাকে তাদের রাজনৈতিক সীমা হিসেবে বিবেচনা করছে এবং বৃহৎ শক্তিগুলো স্বভাবতই ২০০ নটিক্যাল মাইল অবদি জলসীমাকে নিজেদের সমুদ্রসীমা হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। ফলে, চুক্তি প্রণয়নের সময় সামষ্টিক রূপ বিবেচনায় ১২ নটিক্যাল মাইলকে উপকূলীয় দেশের জলসীমা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। 

সামুদ্রিক সংলগ্ন অঞ্চল কী?
 
সামুদ্রিক সংলগ্ন অঞ্চল(Contiguous Zone) হলো একটি সামুদ্রিক জলসীমা যা রাজনৈতিক জলসীমা (Territorial Sea) এর পর, কিন্তু একক অধিকারভুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল (Exclusive Economic Zone, EEZ) এর পূর্বে অবস্থিত। জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সনদ (UNCLOS) অনুযায়ী, সামুদ্রিক সংলগ্ন অঞ্চল একটি দেশকে তার রাজনৈতিক জলসীমার বাইরে অবস্থিত হলেও সমুদ্রের ওই অংশে উপকূলীয় রাষ্ট্র সীমিত আকারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকার পায়। সাধারণত, এটি দেশের উপকূল থেকে ২৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, তবে এটি নির্দিষ্ট নিয়ম ও শর্ত অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে। সামুদ্রিক সংলগ্ন অঞ্চল তৈরির মূল উদ্দেশ্য হল: ১. স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা বজায় রাখা – উপকূলী দেশটি এখানে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিভিন্ন ঝুঁকি, যেমন অবৈধ অভিবাসন, শুল্ক চুরির বিরুদ্ধে নজরদারি এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রভৃতি থেকে তার ভৌগোলিক অখন্ডতাকে রক্ষা করতে পারে অর্জন করতে পারে ; ২. পরিবেশ সুরক্ষা – সমুদ্রের দূষণ রোধে এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে। 

প্রণালী ব্যবহারের নিয়ম কী? 

আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা ব্যবহারের প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক জলসীমা বিতর্ক আরও ঘোলাটে হতে শুরু করে। অতীতে রাজনৈতিক জলসীমা হিসেবে ৩ নটিক্যাল মাইলকে গ্রহণ করা হয়েছিলো। তখন প্রণালী বা সরু জলপথ একের অধিক উপকূলীয় দেশের অধীনে পড়তো। কিন্তু রাজনৈতিক সীমানাকে যখন ৩ থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয় তখন অনেকগুলো প্রণালী ও সরু জলপথ কিছু কিছু দেশের একক অধিকারে চলে আসে, ফলে নতুন সঙ্কটের সূচনা ঘটে। কারণ গোটা দুনিয়ায় প্রায় ১৫০-২০০ টির মত সামুদ্রিক প্রণালী রয়েছে যা ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এবং অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালিত হয়। 

এছাড়াও, এই প্রণালীগুলোর অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্গত হওয়ায় বৃহৎ দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রশ্নের মূখে পড়ে। এই সঙ্কট নিরসনে সামুদ্রিক প্রণালী ও সরু জলপথের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের অধিকার প্রদান করে। এই অধিকারটি UNCLOS-এর ৩৮ নং অনুচ্ছেদ: “Transit Passage” অনুসারে আইনি রূপ লাভ করে। এই অনুচ্ছেদের আদলে উপকূলীয় দেশকে প্রণালী দিয়ে আন্তর্জাতিক জাহাজ পরিচালনের (শুধু সামরিক জাহাজ বাদে) বাঁধা দেওয়া থেকে বিরত রাখে, এমনকি যদি এটি তার রাজনৈতিক জলসীমার অন্তর্গত হয়। অর্থাৎ, প্রণালীর প্রশ্নে উপকূলীয় দেশকে তার সার্বভৌমত্বকে কিছুটা ছাড় দিতে হবে।      

এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোনঃ 

UNCLOS চুক্তির আদলে উপকূল হতে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত জলসীমাকে প্রতিটি সমুদ্র সংলগ্ন দেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন বা EEZ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে উপকূলীয় দেশের রাজনৈতিক জলসীমা এবং অনেকক্ষেত্রে মহীসোপান অঞ্চলও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন নির্ধারণ গত শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, বিশেষত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সামুদ্রিক দেশের জন্য। এই জোন তৈরির মাধ্যমে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক জলসীমাকে রাজনৈতিক সীমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে এবং দুই-তৃতীয়াংশ জলসীমাকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের বাহিরে রাখা হয়েছে যাতে উক্ত জলসীমা মানব কল্যাণের উপযোগী হতে পারে। 

পরিসংখ্যান অনুসারে আমাদের মৎস্য চাহিদার প্রায় নব্বই শতাংশ এবং জ্বালানী চাহিদার প্রায় ৯৫ শতাংশের যোগান সমুদ্রের ২০০ নটিক্যালের মাঝেই পাওয়া যায়।  উপকূলীয় রাষ্ট্র এই জোনের মাঝে একক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, অর্থাৎ এই অঞ্চলে অন্য কোন দেশ নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। পাশাপাশি এই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক জীব ও অজীব সম্পদের উপর উক্ত দেশের একক অধিকার নিশ্চিত হবে, অর্থাৎ, অন্য কোন দেশে ঐ অঞ্চলের প্রাপ্ত সম্পদের উপর তার দাবি উপস্থাপন করতে পারবে না। এছাড়াও, অত্র অঞ্চলের যাবতীয় গবেষণা পরিচালনের অধিকারও উক্ত দেশের একক অধিকারে থাকবে পাশাপাশি অত্র অঞ্চলের পরিবেশ সংরক্ষণের দিকটিও রাষ্ট্রের উপর বর্তাবে। 

দুইটি প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন ধারনার উন্মেষ ঘটে। যথাঃ উপকূলীয় সার্বভৌমত্ব এবং প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা। প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা, বিশেষত মৎস্য সম্পদ আহরণের প্রয়োজনে বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন আয়তনের জলসীমাকে নিজেদের ইকোনোমিক জোন হিসেবে নির্ধারণ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অত্র অঞ্চলের আয়তন প্রায় ৩০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। রাজনৈতিক সমুদ্রসীমা নিয়ে পূর্বে ৩ নটিক্যাল মাইলের একটি প্রথা চালু থাকলেও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের প্রয়োজনে এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন নিয়ে কোন প্রথা বা আন্তর্জাতিক ঐক্যমত ছিলো না। ফলে, সামুদ্রিক সীমারেখা নির্ধারণকে ঘিরে বিরোধের জন্ম হয়। EEZ গঠনের অন্যতম একটি কারণ ছিলো মহীসোপান প্রশ্নের সমাধান করা। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, অনেকগুলো সামুদ্রিক দেশ মহীসোপান অঞ্চলের সমুদ্রতলে সম্ভাব্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের অধিকার দাবি করে। এর অন্যতম কারণ তখন অধিকাংশ উপকূলীয় দেশ তাদের মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ অঞ্চল হিসেবে মহীসোপান অঞ্চলকে নির্ধারণ করতো। ১৯৪৫ সালের ট্রুম্যান ডিকলারেশনের মাধ্যমে তৎকালীন মহাশক্তিধর দেশ আমেরিকাই প্রথমে মহীসোপান অঞ্চলের সমুদ্রতল সম্পদ আহরণের সূচনা করেন, ফলে স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য দেশও একটি বৈধতা পেয়ে যায়। 

কিন্তু এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক অঞ্চল আইনের অধীনে মহীসোপান অঞ্চলের সমুদ্রতলে যেকোন ধরণের খননকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়, তবে অত্র অঞ্চলে মৎস্য আহরণে কোন বাঁধা দেওয়া হয়নি। এর অন্যতম কারণ ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরের সমুদ্র আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার অন্তর্ভুক্ত এবং প্রথাগত সামুদ্রিক আইন ও আনক্লজ অনুসারে আন্তর্জাতিক সমূদ্রসীমায় বা গভীর সমুদ্রের সমুদ্রতল কোন একক দেশের অধিকারভুক্ত নয়, বরং তা আন্তর্জাতিক বা বৈশ্বিক সম্পদের অন্তর্ভুক্ত। 

মহীসোপান অঞ্চল কিভাবে নির্ধারিত হবে?

ইংরেজি শব্দ Continental Shelf-এর বাংলা প্রতিশব্দ মহীসোপান অঞ্চল। যে পয়েন্ট থেকে সমুদ্রসীমা নির্ণয় করা হয়, তাকে "বেসলাইন" বলা হয়, আর মহীসোপান (continental shelf) হলো সেই অঞ্চলের সমুদ্রতল, যা মূলভূমির (landmass) কাছাকাছি থাকে এবং যেখানে সমুদ্রের গভীরতা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। মহীসোপান হলো সমুদ্রের সেই অংশ যা উপকূলের কাছাকাছি বিস্তৃত থাকে এবং এর গভীরতা সাধারণত ২০০ মিটার বা তার নিচে থাকে। এটি সমুদ্রতলের একটি শাখা, যা উপকূল থেকে শুরু হয় এবং সমুদ্রের গভীরতর অংশে চলে যায়। মহীসোপান যখন গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যায়, তখন তা মহীঢালে পরিণত হয়। মহীঢাল একটি খাঁজযুক্ত, অধিক তীক্ষ্ণ ঢালবিশিষ্ট এলাকা, যেখানে সমুদ্রের গভীরতা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। 

এটি মহীসোপানের পরবর্তী অংশ, যেখানে সমুদ্রের গভীরতা ২০০ মিটার থেকে শুরু হয়ে অনেক বেশি গভীরে চলে যায়। মহীসোপান (continental shelf) এবং মহীঢাল (continental slope)-এর পরের অংশটি হলো মহীভূমি (Continental Rise)। মহীভূমি হল মহীঢাল এবং গভীর সমুদ্রের (oceanic basin) মধ্যে থাকা একটি এলাকা, যেখানে সমুদ্রতল অপেক্ষাকৃত সমতল এবং গভীরতা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এটি মূলত সমুদ্রতলের একটি সমতল অঞ্চল, যেখানে সমুদ্রের গভীরতা তুলনামূলকভাবে কম থাকে এবং অঞ্চলটি গভীর সমুদ্রের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে। এই তিনটি অঞ্চল (মহীসোপান, মহীঢাল, মহীভূমি) একসঙ্গে কন্টিনেন্টাল মার্জিন (Continental Margin) নামে পরিচিতযা অগভীর সমুদ্রতল থেকে শুরু করে গভীর সমুদ্রের অংশের সাথে মিশে যায়। 

তবে মহীসোপান অঞ্চলের সর্বোচ্চসীমা কতটুকু হবে তা নিয়ে এখন অবধি আন্তর্জাতিক ঐক্যমত গৃহীত হয়নি। ১৯৫৮ সালের জাতিসংঘের মহীসোপান চুক্তির প্রথম অনুচ্ছেদের আদলে সমুদ্রের গভীরতা ২০০ মিটারের ভিত্তিতে মহীসোপান অঞ্চল নির্ধারণের একধরনের আইনি প্রচেষ্টা চালানো হয়। তবে, ১৯৫০ এর দশকের সামুদ্রিক প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে ২০০ মিটার গভীর সমুদ্রতলকে মহীসোপান অঞ্চল হিসেবে সকলে মেনে নিলেও, বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে যখন উপকূলীয় রাষ্ট্রের সমুদ্রের আরও গভীরে গিয়ে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে তখন মহীসোপান অঞ্চল চুক্তির ধারাকে নিয়ে বিরোধিতা ও মতানৈক্য তৈরি হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উতকর্ষের দরুন উপকূলীয় দেশ, বিশেষত দক্ষিণ আমেরিকার সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলো আরও গভীরের অঞ্চলকে নিজেদের মহীসোপান অঞ্চল বলে দাবী করছে। 

এরূপ বিরোধের মীমাংসায় আনক্লজের ৭৬ (৪) নং অনুচ্ছেদে পরিষ্কার করে বলা হয় যে ভৌগোলিকভাবে যে দেশগুলোর সমুদ্রতল একধরণের সমতল ও অগভীর এবং তার বিস্তৃতি মহীঢালে (continental slope) পরিণত হওয়ার পর্যন্ত ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি সে উপকূলীয় দেশ প্রায় ৩৫০ নটিক্যাল মাইল অবধি মহীসোপান অঞ্চলের অধিকারী হবে। তবে এক্ষেত্রে ২০০ থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে উপকূলীয় দেশটি শুধু মৎস্য আহরণ করতে পারবে, এবং  অত্র অঞ্চলের সমুদ্রতলে যেকোন ধরণের খনন কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল পরিষদের (International Seabed Authority) অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে এবং অত্র অঞ্চল থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের সাহায্যে যে মুনাফা উপকূলীয় দেশটি অর্জন করবে তার একটি অংশ আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল পরিষদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। 

তবে, যদি উপকূলীয় রাষ্ট্রের মহীসোপান অঞ্চল ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের পূর্বেই মহীঢালে পরিণত হয়, তখন আনক্লজ অনুসারে উপকূলীয় দেশটি দুটি কাজ করতে পারেঃ যেখান থেকে মহীঢালে রূপান্তর হচ্ছে ঐ অঞ্চলকে চিহ্নিত করতে পারে, অথবা মহীসোপান অঞ্চল নিয়ে কাজ করা কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে মহীসোপান হিসেবে একটা সীমারেখাকে গ্রহণ করতে পারে। এই সীমারেখা নির্ধারণটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সীমারেখাই উপকূলীয় রাষ্ট্রের জাতীয় সার্বভৌম ও ভৌগোলিক অধিকারের থেকে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমাকে চিহ্নিত করে যাকে সার্বজনীন মানব সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 

আন্তর্জাতিক জলসীমা কোথা থেকে শুরু হয়? 

আন্তর্জাতিক জলসীমা বা গভীর সমুদ্র বা খোলা সমুদ্র (High Sea / Deep Sea / International Water) একটি আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক জলসীমা যা কোনো একক দেশের ভৌগোলিক জলসীমার অন্তর্ভুক্ত নয়। আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সনদ (UNCLOS), অনুযায়ী, কোন উপকূলীয় দেশের ভৌগোলিক জলসীমা, অর্থাৎ রাজনৈতিক জলসীমা (Territorial Sea), একক অধিকারভুক্ত অর্থনৈতিক জলসীমা (Exclusive Economic Zone, EEZ), বা সংলগ্ন সামুদ্রিক অঞ্চল (Contiguous Zone) যেখানে এসে শেষ হয়, আন্তর্জাতিক জলসীমা সেখান থেকে শুরু হয়। অর্থাৎ, সাধারণত ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের পরের খোলা সমুদ্রই আন্তর্জাতিক জলসীমার অন্তর্ভুক্ত। 

আন্তর্জাতিক জলসীমাকে গভীর সমুদ্র বা খোলা সমুদ্র হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক জলসীমায় উপর কোন একক দেশের সার্বভৌমত্ব বা রাজনৈতিক অধিকার নেই। তবে, এটি পুরো বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত, যেখানে কোনো রাষ্ট্র চাইলে নৌ চলাচল, মাছ ধরা বা গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে তাকে UNCLOS-এর বিধি-বিধান অনুসারণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোন দেশের একক কর্তৃত্ব নেই, কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন সমন্বিতভাবে জলদস্যুতা, পরিবেশ দূষণ, বা অবৈধ কার্যকলাপ প্রভৃতি অপরাধের বিরুদ্ধে  সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এইসব কার্যক্রমের উপর নজরদারি এবং আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আন্তর্জাতিক জলসীমা সমস্ত দেশের জন্য একটি সাধারণ সম্পদ (Common Heritage of Mankind), ফলে, এর সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও বিশ্ব সম্প্রদায়ের। 

উপসংহারঃ 

বিংশ শতকের দ্বিতীয় ধাপে রাজনৈতিক প্রয়োজনে সামুদ্রিক সীমা নির্ধারিত হতে শুরু করে। এই ধারাকে আইনের আওতায় আনতে ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের অধীনে সমুদ্র আইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা তার একযুগ বাদে ১৯৯৪ সালে গিয়ে বলবত হয়। বিংশ শতকের অন্যতম শক্তিশালী চুক্তি ছিলো আনক্লজ যা সামুদ্রিক সীমারেখা সংক্রান্ত উপকূলীয় দেশের আচারণের উপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করে। সামুদ্রিক সীমারেখা নিয়ে বিরোধ মীমাংসায় চুক্তির অনুচ্ছেদগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বৃহৎ শক্তির ক্ষেত্রে কিছুটা অসঙ্গতি প্রতীয়মান হলেও উন্নয়নশীল উপকূলীয় দেশগুলোর মধ্যকার সামুদ্রিক সীমারেখা বিরোধ মীমাংসায় আনক্লজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

তবে, কিছু অস্পষ্টতা এখনো রয়ে গেছে, বিশেষ করে মহীসোপান অঞ্চলকে ঘিরে। তবে, রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় বৃহৎ শক্তি অনেকক্ষেত্রে এই চুক্তির আইনকে ভঙ্গ করে, যেমন দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামুদ্রিক সীমারেখা নির্ধারণ অত্র অঞ্চলের অন্যান্য সমুদ্রিক দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে, তবে সেক্ষেত্রে এই দেশগুলো আনক্লজের আইনি কাঠামোকে সামনে রেখেই চীনের এহেন দাবীকে আইনগতভাবে অবৈধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফলে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিবিধি অনুসরণে ও অনুধাবনে সামুদ্রিক সীমারেখা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা আমাদের একান্ত কাম্য।  




লেখক

বদিরুজ্জামান 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

   






      









No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.