Header Ads

Header ADS

ইতিহাসের আলোয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (পর্বঃ ১)

ইতিহাসের আলোয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

History of International Relations

একাডেমিক পাঠ্যক্রম হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের (International Relations) সূচনা বেশী পুরাতন নয়। মাত্র এক শতাব্দী পূর্বেই পাঠ্যক্রম হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক যাত্রা শুরু করে। তবে, একাডেমিক পাঠ্যক্রমের বাহিরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসকেও মূল্যায়ণ করতে হবে যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রয়োগ ছিলো লক্ষণীয়, এবং কিছুক্ষেত্রে সে প্রয়োগের ইতিহাস লিপিবদ্ধও হয়েছে।

এই নিবন্ধে আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সে ঐতিহাসিক যাত্রাকে সংক্ষিপ্তভাবে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। পাশাপাশি এই দীর্ঘ যাত্রায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোন কোন বিষয়কে অধিক প্রাধান্য দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি একাডেমিক পাঠ্যক্রম হিসেবে যাত্রার প্রয়োজনে কিভাবে এবং কেনি সে বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করেছে তাও উল্লেখের চেষ্টা করবো।  

১. দার্শনিক যাত্রা 
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (International Relations) অধ্যায়ণের সূচনা কবে নাগাদ হয়েছে? এর নানাবিদ ব্যাক্ষা থাকলেও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাক্ষাটি দিয়েছে এডওয়ার্ড হ্যালেট কার (Edward Hallett Carr/ E. H. Carr), যিনি ই এইচ কার নামে বেশী পরিচিত। তিনি বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে ইউরোপীয় বিশ্বে যুদ্ধকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা সংস্কৃতির অবসানকল্পে ১৯৩০’র দশকের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়ণের সূচনা ঘটে। তবে, ই এইচ কারের বক্তব্যটি একাডেমিক যাত্রার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হলেও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়ণের যে গভীর ঐতিহাসিক দিক রয়েছে তা নির্দিষ্ট করে না।     

১.ক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু কী? 
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলকথা যুদ্ধ ও শান্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। শুধু কোন একটি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক/ বৈদেশিক সম্পর্ক যুদ্ধ ও শান্তি বিবেচনায় পরিচালিত হয় না, বরং অনেক রাষ্ট্রের সমন্বয়ে যে আন্তর্জাতিক সিস্টেম গড়ে উঠেছে সেখানেও যুদ্ধ ও শান্তি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মৌলিক দুই বিষয়। ফলে, যুদ্ধ ও শান্তিকে ভিত্তি করে যদি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস রচনার চেষ্টা করা হয় তবে প্রাচীন থেকে বর্তমান অবধি নানা প্রুধার লেখনিতে যুদ্ধ ও শান্তি সম্পর্কিত নানা কথা, নানা চিত্র, নানা ব্যাক্ষা আমাদের সম্মুখে প্রতীয়মান হয়। 

উদাহরণ স্বরূপ, পাশ্চাত্য়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে প্রাচীন গ্রিসের আন্তঃনগররাষ্ট্রের ভিতরকার যুদ্ধ ও শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আনুমানিক ৫৫০ খৃঃপূর্বে লেখা গ্রীক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের বিখ্যাত গ্রন্থ দ্যা পেলোপনেসিয়া ওয়ার, এবং প্রাচ্যের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস ও কূটকৌশল নিয়ে আনুমানিক ৩০০ খৃঃপূর্বের লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং আনুমানিক ৪৫০ খৃঃপূর্বে লেখা সান ঝু’র দ্যা আর্ট অব ওয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস অনুধাবনের একক অনবদ্য উপকরণ।

তবে, মধ্যযুগে বৃহৎ সাম্রাজ্যের অধীনে আন্তঃরাষ্ট্র/ আন্তঃনগরাষ্ট্র/ আন্তঃস্বাধীন জনপদের মধ্যকার সম্পর্কের এক ধরণের ইতিঘটে। এ সময়কার প্রখ্যাত অনেক লেখক যেমন ক্যাসিওডোরাস (Cassiodorus), প্রোসিপিয়াস (Procopius), আল-শায়বানি (Al-Shaybani), প্রমুখ প্রখ্যাত ঐতিহাসিকদের লেখনিতে যুদ্ধ ও কূটনীতির দিক গুরুত্ব পেলেও, আন্তঃসাম্রাজ্যের সম্পর্কের প্রকৃতি তাদের লেখনিতে অনুপস্থিত ছিলো। সাম্রাজ্যযুগের সমাপ্তিতে পুনরায় আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক মাথাচাড়া দিয়ে দেখা দিলো। 

এর সূচনা ঘটেছিলো আধুনিক ইতালিতে (ফ্লোরেন্সে) এবং ক্ল্যাসিকাল গ্রীক ঐতিহাসিক থুসিডাইডের লেখনি (দ্যা পেলোপনেসিয়া ওয়ার) আবিষ্কারের মাধ্যমে। অর্থাৎ, নতুন করে গড়ে ওঠা সার্বভৌম রাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনের জন্য পুনরায় যুদ্ধ ও শান্তি কেন্দ্রিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক পরিচালন নীতিকে অনুসরণে গুরুত্ব দেওয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে যদি ইতালির ফ্লোরেন্স রাষ্ট্রের কথা যদি বলি, সেখানে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি এবং ফ্রান্সিসকো গুইচ্চিয়ারদিনি (Francisco Guicciardini) আন্তঃরাষ্ট্রী সম্পর্ক পরিচালনার সাপেক্ষে রাষ্ট্রের শক্তি অর্জন ও দক্ষ লিডারশীপের উপর গুরুত্বারোপ করেন, যা ম্যাকিয়াভেলির বিখ্যাত গ্রন্থ দ্যা প্রিন্স- এ ফুটে উঠেছে।  

রেনেসাঁ যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে (International Relations) নতুননত্ব আসে। রেনেসাঁর কল্যাণে ব্যক্তি স্বাধীনতা দর্শন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দর্শনকেও প্রভাবিত করে। রেনেসাঁ যুগের লেখনিতে সামাজিক ন্যায়বিচার, আদর্শবাদ, লিডারশীপ কোয়ালিটি ইত্যাদি মূখ্য হয়ে ওঠে। এই যুগের লেখনিতে, গোটা মধ্যযুগে চার্চ ও রাজার সমন্বয়ে (বোঝাপড়া বা লেনদেনের ভিত্তিতে) ইউরোপের যে রাজনৈতিক কাঠামোর বিস্তার ঘটেছিলো তা ভেঙে ব্যক্তি স্বাধীনতা কেন্দ্রিক ও সেকুল্যার আদর্শের ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বন্দবস্তের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।  

১.খ সার্বভৌমত্ব, চুক্তি ও স্থায়ী শান্তি
রেনেসাঁর শেষ পর্যায়ে নতুন ধারণা হিসেবে সার্বভৌমত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ বোদা’র (Jean Bodin) হাতে সার্বভৌমত্বের ধারণাটির আত্মপ্রকাশ। তার মতে, সার্বভৌমত্ব একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক ব্যাপারে সর্বোচ্চ ও অবিসংবাদিত ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। পরবর্তীতে, আন্তর্জাতিক আইনের জনক, ডাচ বিচারক হুগো গ্রোসিয়াস (Hugo Grotius) জ্যাঁ বোদা’র সার্বভৌমত্ব ধারণাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোরূপে বিশ্লেষণ করেন। 

গ্রোসিয়াস তার বিখ্যাত De Jure Belli ac Pacis (The Law of War and Peace, 1625) গ্রন্থে মানুষের সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের আকাঙ্ক্ষা এবং সেক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আইনের ভূমিকার আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ব্যাক্ষা করেন। তার মতে, সার্বভৌমত্বের উন্মেষ ঘটেছে প্রাকৃতিক আইন এবং সামাজিক সম্পর্কের সমন্বয়ে।  তিনি প্রাকৃতিক আইন ও ধর্মীয় আইন ভিত্তিক সমাজবদ্ধ রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, সমাজে/ রাষ্ট্রে যুদ্ধ ও শান্তির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নৈতিক নীতিমালা থাকা উচিত। যেমন তিনি তার বিখ্যাত Mare Liberum (The Free Sea), ১৬০৯ গ্রন্থে সমুদ্রযাত্রার স্বাধীনতা কথা বলেন। অর্থাৎ, যুদ্ধ ও সংঘাতের প্রেক্ষাপটেও যেন অবাধ সমুদ্রযাত্রা নীতিকে সকল সাম্রাজ্য অনুসরণ করে।  এছাড়াও, ১৬০৪ সালে রচিত De Jure Praedae (On the Law of Prize and Booty) গ্রন্থে গ্রোসিয়াস যুদ্ধের ক্ষেত্রে নৈতিক প্রথা অনুসরণের গুরুত্ব দেন, বিশেষত যুদ্ধে ধ্বংস বা লুণ্ঠিত সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা করেন। 

তবে, গ্রোসিয়াসের এহেন ব্যাক্ষার সাথে রেনেসাঁ যুগের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক থমাস হবস দ্বিমত পোষণ করেন। হবসের ভাষায়, মানুষ স্বভাবতই যৌক্তিক বা রেশোনাল জীব এবং সে কারণে মানুষ নিজের স্বার্থ রক্ষাকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ফলে, মানুষ এমন এক শক্তিশালী বা দানবিক সমাজ ব্যবস্থা তৈরির প্রচেষ্টা চালায় যে দানব সমাজ (যাকে হবস তার বিখ্যাত গ্রন্থ Leviathan-এ লেভিয়াথান নাম দিয়েছেন) নৈরাজ্যে ভরা প্রাকৃতিক আইনের বিপরীতে একটি নিরাপদ, শৃঙ্খলিত ও গ্রহণযোগ্য আইনের সূচনা করবে যা তার স্বার্থকে রক্ষা করবে। সার্বভৌমত্বই হল রাষ্ট্রের সেই দানবিক রূপ এবং হবসের মতে রাষ্ট্রের/ সমাজের  টিকে থাকার প্রয়োজনে সার্বভৌমত্ব আবশ্যিক। কিন্তু, আবার এই সার্বভৌমত্বই আন্তর্জাতিক সিস্টেমকে নৈরাজ্যপূর্ণ করে তোলে, কারণ সিস্টেমের প্রতিটি সমাজই সার্বভৌম, এবং সেকারণে প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় মশগুল থাকে, যা সামগ্রিক সিস্টেমে নৈরাজ্য বা Anarchy সৃষ্টি করে।     

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে সার্বভৌমত্ব ধারণার ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা, যেমনঃ ক্যাপিটালিজমের উদ্ভব, ঔপনিবেশিক বিস্তার, এবং সামরিক প্রযুক্তির উন্নতি প্রভৃতির সমন্বয়ে আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটতে থাকে। পূর্ববর্তী শক্তিশালী সাম্রাজ্য সার্বভৌমত্বের ধারণায় আরও ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার নতুন করে শুরু হয়। নতুন রাষ্ট্রের ধরণ ও ব্যবহার বিশ্লেষণের লক্ষ্যে নতুন নতুন কনসেপ্ট ও তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে যার মধ্যে সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব উল্লেখযোগ্য। জঁ-জ্যাক রুশো, থমাস হবস ও জন লক উভয়ের লেখনিতে প্রাকৃতিক আইনের প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক চুক্তি গুরুত্ব পায়। এক্ষেত্রে ইংলিশ গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষিতে হবসের সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব, সপ্তদশ শতকের বিপ্লবের প্রেক্ষিতে জন লকের সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব, এবং অষ্টাদশ শতকের ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে রুশোর সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে।  

আধুনিক সময়ে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের (International Relations) প্রেক্ষাপট সংক্রান্ত কনসেপ্ট ও তত্ত্বের বিকাশে হবস ও লকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সার্বভৌমত্বের বা সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে প্রাকৃতিক আইনের বিপরীতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে হবস ও লকের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো। একইভাবে, প্রতিটি রাষ্ট্র সার্বভৌম হওয়ায় রাষ্ট্রের সমন্বয়ে যে আন্তর্জাতিক সিস্টেম তৈরি হবে সেখানে যে প্রাকৃতিক আইন তৈরি হবে বা নৈরাজ্য দেখা দিবে, অর্থাৎ, প্রতিটি রাষ্ট্র যেহেতু সার্বভৌম ফলে সে অন্য রাষ্ট্রের কথায় নিজের আইনের পরিবর্তন ঘটাবে না; আবার অন্যকেও সে তার আইন পরিবর্তনের কথা বলবে না; প্রত্যেকেই নিজের যৌক্তিক দিকটি দেখবে এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করবে। অত্র প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোন নীতিতে পরিচালিত হবে তা নিয়েও হবস ও লকের মতানৈক্য বিদ্যমান ছিলো।

হবসের ভাষায়, এহেন নৈরাজ্যকর আন্তর্জাতিক সিস্টেমে প্রতিষ্টি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার নিজেদের স্বার্থকে রক্ষা করবে। হবসের একই মতাদর্শ পরবর্তীতে তার অন্যান্য অনুসারীরা যেমন ডাচ দার্শনিক বেনেডিক্ট ডে স্পিনোযা (Benedict de Spinoza) অনুসরণ করেন। যেমনঃ স্পিনোযা বলেন হবসের দেওয়া সমাধানই শ্রেয়, অর্থাৎ, নৈরাজ্যকর সিস্টেমে প্রতিটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মাঝে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক হবে সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে; রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার ভিত্তিতে; রাষ্ট্রের কঠোর শক্তি প্রদর্শনের ভিত্তিতে। তবে, পরবর্তী দার্শনিকদের মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান ওলফ (Christian Wolff) এবং এমেরিক ভাতেল (Emeric Vatell) হবসের তুলনায় লকের দেওয়া সমাধাকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। অর্থাৎ, জন লকের ভাষায়, নৈরাজ্যপূর্ণ সিস্টেম বিবেচনায় আন্তঃরাষ্ট্রীয় (আন্তঃরাষ্ট্রীয়কে আন্তর্জাতিকও বলা যায়) সম্পর্ক পরিচালনায় রাষ্ট্রকে শান্তিপূর্ণ পন্থা অনুসরণ করতে হবে, মানব কল্যাণকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে, এবং উভয়ের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কমন জায়গা চিহ্নিত করে উভয়ের স্বার্থ আদায়ের উদ্দেশ্য সহযোগিতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। বস্তুত, হবস ও লকের এহেন ভিন্নধর্মী মতাদর্শ পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রথম দুই তত্ত্বঃ রিয়েলিজম ও লিবারেলিজম বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।   

হবস ও লকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চিন্তায় নতুনত্ব আসে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বা এনলাইটেনমেন্ট যুগে। এই যুগে সংঘাত ও সহযোগিতাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংঘাত ও সহযোগিতা কেন্দ্রিক অষ্টাদশ শতকে শক্তি ভারসাম্য (Balance of Power) ও স্থায়ী শান্তি (Perpetual Peace) নামক দুইটি রাজনৈতিক দর্শনের আবির্ভাব ঘটে। রাজনৈতিক শক্তি ভারসাম্য ধারণাটির প্রয়োগ অতি প্রাচীনকাল হতে চলে এসেছে। তবে, অতীতে শক্তি ভারসাম্য দিয়ে বুঝাতো একটি রাষ্ট্রের অন্যকে দমনের সক্ষমতাকে যাকে ইংরেজিতে বলে Containment এবং পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুজনের মাঝে সমান শক্তিশালী হওয়া যাকে ইংরেজিতে বলে Counterpoise ।  তবে, শক্তি ভারসাম্যের আধুনিক সংস্করণের সূচনা ঘটে ফরাসী চতুর্দশ লুইয়ের সময়ে। 

তৎকালীন লেখক ফ্রান্সিওস ফেনেলন (Francois Fenelon) বলেন চতুর্দশ লুইয়ের সময়ে, যুদ্ধ ও কূটনীতির প্রেক্ষাপটে নিজদের স্বার্থ রক্ষায় গোটা ইউরোপ শক্তি ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করতে শুরু করে, যার অন্যতম উদাহরণ ইউরোপীয় শক্তিদের আতরেচ চুক্তি (Treaty of Utrecht) স্বাক্ষর। এই চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্য ছিলো ইউরোপীয় সিস্টেমকে একটি স্থায়ী ও ভারসাম্যপূর্ণ সিস্টেমে রূপান্তর করা। যেখানে পূর্বতন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো সার্বভৌমত্বের আদলে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপ নিবে, এবং তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় একটি স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে শক্তি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হবে। বস্তুত, এই চুক্তির আদলে ইউরোপ কেন্দ্রিক নতুন এক (স্থিতিশীল) বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমসাময়িক প্রভাবশালী লেখক উইলিয়াম রবার্টসনের ভাষায়, শক্তি ভারসাম্য কেন্দ্রিক নতুন ইউরোপীয় সিস্টেম প্রতিষ্ঠা ইউরোপের সকল রাষ্ট্রের জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল। কারণ, শক্তি ভারসাম্য ধারণাটি ইউরোপকে সাম্রাজ্যবাদী চেতনাকে পাশ কাটিয়ে একাধিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের মেশালে একটি স্থিতিশীল ইউরোপীয় সিস্টেম প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। এভাবে, Balance of Power ধারণাটি আধুনিক ইউরোপীয় ব্যবস্থায় নতুনত্ব নিয়ে আসে।   

শক্তি ভারসাম্যের ন্যায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ইতিহাসও অনেক পুরাতন। শান্তি প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের প্রধান উদাহরণ ধর্ম ও ধর্মীয় গ্রন্থ এবং ধর্মীয় পন্ডিতদের লেখনি। যেমনঃ সেইন্ট থমাস অগাস্টাইন, সেইন্ট একিউনাস, দান্তে এবং এরাসমাস প্রমুখকে ইউরোপের ইতিহাসে শান্তি প্রতিষ্ঠার দূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ধর্মীয় আদলে শান্তি প্রতিষ্ঠার ইতি ঘটে আধুনিক সেকুল্যার ইউরোপে। এনলাইটেনমেন্ট যুগে, সেকুল্যার ইউরোপ ব্যক্তি স্বাধীনতাকে কেন্দ্রে রেখে নতুনভাবে শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে উদ্যোগী হয়। অর্থাৎ, রাজনৈতিক স্বার্থকেন্দ্রিক যে ইউরোপীয় সিস্টেম গড়ে উঠেছে তাকে বদলে ব্যক্তি স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মুক্ত বাণিজ্য, কল্যাণমূলক রাজনৈতিক কাঠামো প্রভৃতিকে প্রাধান্য দেয় এমন একটি সিস্টেম প্রতিষ্ঠায় সকল সার্বভৌম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো কাজ করবে। তৎকালীন লেখকদের যারা ইউরোপে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক পরিচালনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে ইউরোপীয় সিস্টেমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে গেছেন, ডুক ডে সাল্লিকে (Duc de Sully) এবং আবে দে সেইন্ট পিয়েরেকে (Abbe de St. Pierre) তাদের অগ্রজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।        

ফলে, এনলাইটেনমেন্ট যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস অনেকাংশে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক পরিচালনের ইতিহাস। এ যুগের প্রধান প্রধান দার্শনিকরা শান্তি ও বিশ্বজনীন আদর্শের (Cosmopolitanism) পক্ষে ছিলেন। তাদের দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্রে ছিলোঃ মানুষেরা স্বভাবতই যৌক্তিক এবং শান্তিপ্রিয়, এবং তারা এমন একটি সমাজের কল্পনা করে যেখানে এমন এক রাজনৈতিক কাঠামো ও লিডারশীপ থাকবে যারা শান্তি প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিবে। সংঘাত ও যুদ্ধের সূচনা তখনই ঘটবে যখন রাজনৈতিক কাঠামো ও লিডারশীপ তাদের মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ, শান্তি প্রতিষ্ঠা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেবে। এনলাইটেনমেন্ট যুগের এহেন দার্শনিক চিন্তার উপরে শক্ত ভিত গড়ে তোলেন জার্মান দার্শনিক ইম্যানুয়েল ক্যান্ট। কান্টের লেখা প্রবন্ধ Perpetual Peace: A Philosophical Sketch (1795) স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা রূপরেখা প্রদান করে, যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পাঠ্যক্রমের অন্যতম তত্ত্ব লিবারেলিজমের প্রধান দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়। 



ভাবানুবাদঃ

বদিরুজ্জামান 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 



মূল বইঃ

International Encyclopedia of Political Science

মূল লেখকঃ

Torbjorn L. Knutsen

Norwegian University of Science and Technology (NTNU)

Trondheim, Norway




প্রথম পর্ব: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস

https://irstudycornerbangla.blogspot.com/2025/01/history%20of%20international%20relations%20in%20bangla%20part%20I.html?m=1


দ্বিতীয় পর্বঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস (যুদ্ধ ও শান্তি)

https://irstudycornerbangla.blogspot.com/2025/01/international%20relations%20history%20in%20bangla.html


তৃতীয় পর্বঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রতিষ্ঠা

https://irstudycornerbangla.blogspot.com/2025/01/Origin%20of%20IR%20Department%20in%20Bangla.html



No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.