ঝিনঝিয়াংঃ চীনের উইঘুর প্রশ্ন (৭ম পর্ব)
ঝিনঝিয়াংঃ চীনের উইঘুর প্রশ্ন
কাজাকিস্তানের দক্ষিণপূর্বে রয়েছে চীনের আধা-সায়ত্ত্বশাসিত প্রদেশ ঝিনঝিয়াং। ঝিনঝিয়াং-এর অধিকাংশ নাগরিক উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর। উইঘুর মুসলিমদের ভাষায় চীনা হান'দের থেকে আলাদা, অনেকটা তুর্কি ভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ঝিনঝিয়াং চীনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ যার সাথে প্রায় ৮ টি দেশের সীমান্ত যোগাযোগ রয়েছে: রাশিয়া, মংগোলিয়া, কাজাকিস্তান, কিরগিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারত।
ঝিনঝিয়াং প্রদেশ ঘিরে সব সময় সমস্যা রয়ে গেছে। উইঘুররা দুইবার ঝিনঝিয়াংকে ‘'ইস্ট তুর্কিস্তান’’ হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, প্রথমবার ১৯৩০ এর দশকে, দ্বিতীয়বার ১৯৪০ এর দশকে। উইঘুররা বিভিন্ন আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে গেছে।
যেমন: সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর ১৫ টি দেশের স্বাধীনতা যার মাঝে ৮ টিই তার পার্শ্ববর্তী, এবং তিব্বতের ফ্রি তিব্বত মুভমেন্ট থেকেও তারা অনুপ্রেরণা লাভ করে, এমনকি এখনো চীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার আন্দোলন জারি রয়েছে, এবং এর ফলে চীনা সরকারের কঠোর শাসনের অন্তর্ভুক্ত তারা হয়েছে এবং হচ্ছে।
২০০৯ সালে হান ও উইঘুরদের* মাঝে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে যাতে প্রায় দুইশো মানুষ নিহত হয়। নিহত পরবর্তী চীনা সরকার তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যথা: কঠোর হস্তে স্থানীয় বিক্ষোভ দমন করে; স্থানীয় নেতৃপর্যায়ে প্রচুর অর্থের যোগান দেয়; এবং তিব্বতে হান শ্রমিকদের অভিবাসন বজায় রাখে।
চীনের জন্য ঝিনঝিয়াং প্রদেশ ভূ-কৌশলগতভাবে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে সেখানে গড়ে ওঠা যেকোনো স্বাধীনতা আন্দোলনকে চীনা সরকার শক্ত হাতে দমন করতে পেছপা হয় না। ঝিনঝিয়াং শুধু চীনের কেন্দ্রভূমিকে ৮ টি দেশের থেকে সুরক্ষাই দেয়নি, ঝিনঝিয়াং চীনের তেল উৎপাদনের সর্ববৃহৎক্ষেত্র এবং চীনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার বড় বড় পরীক্ষাক্ষেত্রও এখানে রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের নেওয়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ইনিশিয়েটিভ: “ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড” প্রকল্পও এই ঝিনঝিয়াং প্রদেশকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। বস্তুত, এটি চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) অংশ। ঝিনঝিয়াং এই ইনিশিয়েটিভের ভূমিকেন্দ্রিক রুট যা প্রাচীন চীনের সিল্ক বাণিজ্য রুটের অংশ ছিল।
মূলত, এ প্রকল্পের মাধ্যমে চীন তার পুরাতন সিল্ক বাণিজ্য রুটকে আবারও জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, সেক্ষেত্রে চীন এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বৃহৎ অঞ্চল এই ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে সংযুক্ত হবে। এ ইনিশিয়েটিভের অধীনে চীন অনেক সমুদ্র তীরবর্তী দেশে সনুদ্র বন্দর তৈরি বা ইজারা নেওয়ার চেষ্টা করছে যাকে তারা স্ট্রিং অব পার্লস নামে ডাকে।
ঝিনঝিয়াং প্রদেশের নতুন নতুন শহর ও সিটিতে হান চীনাদের আধিক্য লক্ষ্যণীয়। এর অন্যতম কারণ এই নতুন শহরে চীনা সরকারের বিশাল বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে ঝিনঝিয়াং এর শিহহেজি (Shihezi) শহরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যা ঝিনঝিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমকি (Urumqi) থেকে প্রায় ৮৫ শতাংশ উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত।
এই শহরের ৬৫০,০০০ জনসংখ্যার মাঝে প্রায় ৬২০০০০ জন হান চাইনিজ। বর্তমানে ঝিনঝিয়াং এর জনসংখ্যার প্রায় ৪০* শতাংশ চীনা হান। এমনকি রাজধানী উরুমকির অধিকাংশ নাগরিকই হান চাইনিজ।
উইঘুরদের স্বাধীকার অর্জনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে জার্মানিতে ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস, এবং তুরস্কে পূর্ব তাজিকিস্তান স্বাধীনতা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে, উইঘুরদের বড় দুর্বলতা সেখানে তিব্বতের দালাইলামার মত বড় কোন নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। ফলে তাদের আন্দোলন একধরনের লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে।
একই সাথে চীনা সরকারও ঝিনঝিয়াং সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে যাতে ঐদেশগুলোর ভূখন্ডে উইঘুরদের স্বাধীকার আন্দোলনের চর্চা ও আন্দোলনের প্রয়োজনোয় সাহায্য ঐ রাষ্ট্রগুলো উইঘুরদের না দেয়।
এছাড়াও, বিশ্বের সামনে চীনা সরকার উইঘুর মুসলিমদের যারা স্বাধীন হতে আন্দোলন চালাচ্ছে তাদের ইসলামিক সন্ত্রাসী ও বিশৃঙ্খল গোষ্ঠী হিসেবে প্রচার করে যাচ্ছে। এমনকি চীন সরকার উইঘুরদের আল কায়েদা ও তাজিকিস্তানের কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অনুসারী হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।
তবে, আন্দোলন বিশ্লেষণ করলে একজন পর্যবেক্ষক সহজেই অনুধাবন করতে পারবে উইঘুরদের উগ্র বলে প্রচারের মূলে রয়েছে চীনের ঝিনঝিয়াং-এর স্বাধীকার আন্দোলন এবং ইসলাম সেখানে দ্বিতীয় সারিতে।
২০১৬ সালের প্রথম দিকে চীনা সরকার অফিসিয়ালি উইঘুরদের নিয়ে বিশ্বের সামনে তথ্য পেশ করে, সেখানে দেখানো হয় সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপের দরূন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের প্রবণতা ঝিনঝিয়াং এ দুর্বল হয়ে এসেছে। চীন এ লক্ষ্যে তুর্কি সরকারের সাথেও একত্রে কাজ করে।
তুর্কি সরকারও তুরস্কে অবৈধ উইঘুরদের গ্রেফতার শুরু করে, যেমন: ২০১৫ সালে প্রায় ৩২৪ জন উইঘুর তুর্কি আর্মির হাতে গ্রেফতার হন। ধারণা করা হয় তারা সিরিয়ায় অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে একত্রে যুদ্ধ করতে ঝিনঝিয়াং হতে সিরিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করতেছিলো।
তবে, উইঘুর নিয়ে বর্তমান বিশ্বে নানা সংবাদ প্রচার হচ্ছে। এর অন্যতম হল চীনা সরকার ঝিনঝিয়াং প্রদেশের নিরাপত্তার নামে উইঘুরদের একটা গ্রুপকে বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে রেখেছে যাকে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবাধিকার বিরোধী অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করছেন।
বস্তুত, চীন কোনভাবেই ঝিনঝিয়াং ও তিব্বতের স্বাধীনতাকে মেনে নিবে না, তাই এই অঞ্চলের স্বাধীকার আন্দোলন সমাপ্তির পথে। এই দুই অঞ্চল ভূ-কৌশলগত কারণে বৃহৎ শক্তিদের থেকে চীনের কেন্দ্রকে নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ এই দুই অঞ্চল বাফার অঞ্চল হিসেবে কাজ করছে।
এছাড়াও, অত্র অঞ্চলদ্বয়ের উদীয়মান বাজার সীমিত আকারে হলেও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষত, এ দুই প্রদেশে পর্যটন ব্যবসার অসীম সম্ভাবনা রয়েছে, চীন এজন্য এই দুই প্রদেশে বিবিধ অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিচালনা করছে।
তবে, এ দুই প্রদেশে চীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে, বিশেষত অত্র অঞ্চলে হান চীনা ও স্থানীয়দের মাঝে যে কোন ধরনের গৃহযুদ্ধ রোধ করতে; চীনে কমিউনিস্ট পার্টির দবদবা বজায় এবং চীনের সকল প্রদেশের মাঝে একতা বজায় রাখা।
ভাবানুবাদক:
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল বই:
Prisoners of Geography: Ten Maps That Explain Everything about the World.
লিখেছেন:
Tim Marshall,
A former foreign correspondent for Britain's Sky News Television
চীন পর্বঃ
রাশিয়া পর্বঃ
1. মেদভেদের দেশ রাশিয়া (Russia): সীমান্ত ঘেঁষা যুদ্ধের শঙ্কা (প্রথম পর্ব)
2. কি'ভেন রুশের (Kievan Rus) দেশ রাশিয়াঃ মস্কো থেকে সাইবেরিয়া (পর্ব ২)
3. উষ্ণ জলের দিকে রাশিয়ার যাত্রা (পর্ব ৩)
4. রাশিয়ার রাজনৈতিক অস্ত্রঃ জ্বালানী ও ইউরোপের শীত (চতুর্থ পর্ব)


No comments