(পর্ব ২) ইতিহাসের আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কঃ শান্তি ও শক্তি ভারসাম্য
শান্তি ও শক্তির আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস
Balance of Power তত্ত্ব ও Perpetual Peace দর্শন আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নতুনত্ব নিয়ে আসে। এই নতুনত্ব আশার সঞ্চার ঘটায়। শক্তি ভারসাম্য ও চিরস্থায়ী শান্তিকে ঘিরে যে কনসেপ্টগুলির আগমন ঘটেছে উনবিংশ শতক নাগাদ সৈনিক, রাষ্ট্রপ্রধান, দার্শনিক, এবং বিভিন্ন ফিল্ডের, বিশেষ করে ইতিহাস, অর্থনীতি, ভূগোল এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা সেই কনসেপ্টগুলোকে প্রয়োগ করতে শুরু করেন। এক্ষেত্রে দু’টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পাঠ্যক্রমে রূপান্তর হওয়ার ক্ষেত্র তৈরিতে সাহায্য করেছে। যথাঃ
প্রথমতঃ ১৬৪৮ সালের Treaty of Westphalia -এর স্বাক্ষরের ফলে ইউরোপে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সূচনা হয়। এই সার্বভৌম রাষ্ট্র আয়তন, জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অখন্ডতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিবেচনায় একে অন্যের চেয়ে আলাদা। এই রাষ্ট্রের সমন্বয়ে ইউরোপীয় রাজনৈতিক সিস্টেম গঠিত হয়। উনবিংশ শতকে জার্মান ঐতিহাসিক লিওপল্ড ভন রানকে (Leopold von Ranke) ইউরোপীয়দের সামনে “Great Powers” নামক একটি কনসেপ্ট উপস্থাপন করেন। রানকের “Great Powers” ধারণাটি ইউরোপের কতিপয় ঔপনিবেশ রাষ্ট্রঃ ব্রিটেন, ফ্রান্স, ডাচ, ইতালি, জার্মান, অস্ট্রো-হাংগেরি প্রভৃতি কেন্দ্রিক ইউরোপীয় সিস্টেমের মূলে আঘাত করে এবং অন্যান্য স্থানীয় ইউরোপীয় রাষ্ট্রকেও ইউরোপীয় সিস্টেমের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।
দ্বিতীয়তঃ যদিও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তবে এনলাইটেনমেন্ট পরবর্তী যুগের লেখকেরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বর্তমান ইতিহাসকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন। এই গুরুত্বের প্রধান কারণ ছিলো সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আধুনিক রাষ্ট্রের সূচনা। এর পূর্বে নগররাষ্ট্র, গোত্র, সাম্রাজ্য, সামান্তবাদ, জনপদ প্রভৃতি থাকলেও সার্বভৌমত্বের ধারণা সেখানে ছিলো না। এই সার্বভৌমত্বের কারণে আধুনিক রাষ্ট্র পূর্ববর্তী রাজনৈতিক শাসন কাঠামো থেকে স্বতন্ত্র। এই সার্বভৌম রাষ্ট্রই পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান কর্মক হিসেবে আবির্ভূত হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন ইতিহাসের সূচনা লগ্ন হিসেবে ধরা হয় পঞ্চদশ শতককে। সেই ধারা বর্তমানে চলমান। তবে, শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসের সূচনা ও বিকাশ ভূমি ছিলো ইউরোপ। ফলে, ইউরোপের ইতিহাসই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে আরও পশ্চিমের, অর্থাৎ আমেরিকান বয়ানও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে যুক্ত হয়, এবং বর্তমানে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
রাষ্ট্র কেন্দ্রিক যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস রচনা শুরু হয় সেখানে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জন লিলি ও এডওয়ার্ড ফ্রিম্যানের বিখ্যাত Contemporary History গ্রন্থটি বেশ প্রভাব বিস্তার করে। জার্মান ঐতিহাসিক হেনরিখ ভন ত্রিতস্ক (Heinrich von Treitschke) আন্তর্জাতিক সম্পর্কে রাষ্ট্রের প্রকৃতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। ত্রিতস্ক বলেন সমসাময়িক ঐতিহাসিকেরা আন্তর্জাতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামককে গুরুত্ব দিতেন। যথাঃ (১) ব্রিটিশ প্রবর্তিত মুক্ত বাণিজ্য কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস, এবং (২) দার্শনিক হবস ও ম্যাকিয়াভেলি প্রবর্তিত সার্বভৌমত্ব ধারণার ভিত্তিতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও যুদ্ধকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস।
উনবিংশ শতকের শেষ পর্যায়ে ভূগোলবিদেরা (Geographers) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস রচনায় একটি নতুন দিক হিসেবে ভূগোলকে (Geography) সংযুক্ত করেন। ভৌগোলিক প্রয়োজনে, অর্থাৎ, সম্পদের অপ্রতুলতা ও স্থানের সঙ্কট নিরসনও যে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনের অন্যতম কারণ ভূগোলবিদেরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস রচনায় সেদিকটিকে গুরুত্ব দিতে বলেন। এই ভূগোলবিদদের অন্যতম ছিলেন ফ্রেডরিখ রাসেল (Friedrich Ratzel) এবং জোহান রুডোলফ কেজেলিন (Johan Rudolf Kjellen)। পরবর্তীতে, কেজেলিন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস রচনার নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে ভূ-রাজনীতি (Geopolitics) ধারনাটি উপস্থাপন করেন।
ভূগোলবিদদের ন্যায়, অর্থনীতিবিদেরাও ক্রমে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস রচনায় যুক্ত হতে থাকেন এবং তাদের দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস রচনায় আবশ্যিকভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। ফরাসি লেখকদের লেখনিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস রচনা শুরু হয় যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৮৭৪ সালে রচিত অর্থনীতিবিদ (Paul Leroy Beaulieu) পল লেরোয় বিউলিউ-এর Of Colonization Among Modern Nations নামক প্রভাবশালী গ্রন্থটি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস রচনার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে অর্থনীতির পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞানকেও প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। এক্ষেত্রে জ্যাক নোভিচো (Jacques Novicow) অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৮৮৬ সালে নোভিচো তার বিখ্যাত la politique internationale (International Politics) গ্রন্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সমাজবিজ্ঞানের একটি কনসেপ্ট বা টার্ম হিসেবে বর্ণনা করেন। এছাড়াও, সমসাময়িক বিখ্যাত ম্যগাজিন, যেমনঃ The North American Review, The Review of Reviews, Review of the Two Worlds, Political Science Quarterly, American Political Science Review প্রভৃতিতে নতুন কনসেপ্ট হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও বিস্তারিত আকারে বিশ্লেষণ করা হয় যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস ও তত্ত্বকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
তবে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন ইতিহাসকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে আন্তর্জাতিক আইন। সার্বজনীন (Cosmopolitan) বিশ্বব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, মানব কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রভৃতির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে নতুন আঙ্গিকে সংজ্ঞায়িত করে। নানা আইনবিদদের লেখনি, চুক্তি, বিচারিক রায় ও বিভিন্ন প্রথার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক আইন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিবিধি পরিচালনায় নতুন আইনি রূপরেখা প্রদান করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রখ্যাত কিছু আইনবিদ আন্তর্জাতিক আইনকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনায় আবশ্যিক এক অনুষঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করতে শুরু করেন, এবং কাজের সুবিধার্থে তারা নিজেদের মাঝে একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করেন।
এই প্লাটফর্ম থেকে la Revue de droit international et de droit comparé (RDI; Journal of International and Comparative Law) শিরোনামে একটি জার্নাল প্রকাশিত হতে শুরু করে। পাশাপাশি এই আইনবিদরা বেলজিয়ান শহর গেন্টে (Ghent) আন্তর্জাতিক আইন অনুষদ (Institute of International Law) স্থাপন করেন। সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব ও কাঙ্ক্ষিত এটিই ছিলো তাদের আন্তর্জাতিক আইন সংক্রান্ত লেখনি ও বলনির প্রধান আলোচ্য বিষয়। এছাড়াও, সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের নিমিত্তে যে এক বা একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রয়োজন তাও তাদের লেখনির প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিলো। তাদের ভাষায়, সংঘাতে বা বিরোধ নিরসনে এহেন সংস্থা নিরপেক্ষভাবে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই আইনবিদদের অন্যতম ছিলেন স্কটিশ বংশোদ্ভত জেমস লোরিমার (James Lorimer)। ১৮৭১ সালে RDI জার্নালে “Final Problem in International Law” শিরোনামে লোরিমারের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে লোরিমার বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। তবে, যেহেতু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অংশ নেওয়া প্রতিটি রাষ্ট্রই সার্বভৌম, সেহেতু এই সার্বভৌমত্বের দরুন তারা শুধু নিজেদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ নিয়ে চিন্তিত এবং অন্য কোন রাষ্ট্রের নির্দেশনায় তারা পরিচালিত হয় না। ফলে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনের ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থার অভাব অনুভূত হয়। তবে, বিষয়টি এমন নয় যে কেন্দ্রীয় সরকার হলেই রাষ্ট্র সে সরকারের নিয়ন্ত্রণকে মেনে নেবে। কারণ, রাষ্ট্র যেহেতু সার্বভৌম তাই সে তার সরকার বাদে অন্যকোন শক্তির নিয়ন্ত্রণকে স্বীকার করবে না। লোরিমারের ভাষায়, এই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভাষায় নৈরাজ্য বা Anarchy বলে উল্লেখ করা হলেও আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায়, এহেন পরিস্থিতিকে Lawlessness বা আইনগত শূন্যতা বলে উল্লেখ করা হয়।
লোরিমার বলেন, বিশৃঙ্খল (Orderless) অবস্থায় নৈরাজ্য (Anarchy) বিরাজ করে, যদিও নৈরাজ্য/ বিশৃঙ্খল (Orderless) এবং আইনগত শূন্যতা (Lawlessness) একই অবস্থা নয়। কারণ, নৈরাজ্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলার (Orderless) পরিবর্তে শৃঙ্খলা (Order) আনয়নে দুইটি নিয়ামককে বা কৌশল বা নীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যথাঃ (১) শক্তি ভারসাম্য নীতি (Principle of Balance of Power), এবং (২) অর্থনৈতিক পরস্পর নির্ভরশীল নীতি (Principle of Economic Interdependence) । আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যখন এই নীতিদ্বয়ের মাধ্যমে পূর্ণরূপে শৃঙ্খলা আনয়ন সম্ভব হলো না, তখন প্রয়োজনের তাগিদে তৃতীয় নিয়ামক হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিক্রমায় কেন্দ্রিয় শাসনব্যবস্থা (Central Legislative/ Central Govt.) কনসেপ্টটি আবির্ভূত হল।
এই কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কনসেপ্টটির মূল উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সিস্টেমে যে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, আইনের প্রয়োগে তার সমাধান সম্ভব। এই সম্ভাবনার পালে হাওয়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিমা উদারবাদী দেশগুলো এবং নানা আইনবিদ আন্তর্জাতিক আইনকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্ত করার পক্ষে সহমত জ্ঞাপন করেন। ফলে, ইউরোপে যুদ্ধের বিরুদ্ধে নতুন এক মুভমেন্টের সূচনা ঘটে, এবং মুভমেন্টের প্রেক্ষিতে যুদ্ধ বিরোধী কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থারও আবির্ভাব ঘটে। ক্রমে অধিক সংখ্যক ইউরোপীয় যারা যুদ্ধ বিরোধী মুভমেন্টের অংশ ছিলো তারা এই আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সমর্থন জানাতে তার দেশকে চাপ দিতে থাকে। ফলে, ১৮৮৯ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (Inter-Parliamentary Union) যাত্রা শুরু করে।
এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো আন্তঃ পার্লামেন্টারি আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করা। এই সংস্থার কাজের প্রভাবে ১৮৯৯ সালে নেদারল্যান্ডের রাজধানী হেগে আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন (International Peace Conference) আয়োজিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পাশাপাশি প্রায় ৪০০ টি শান্তিকামী সংস্থার সদস্যগণও অংশ গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের পথ ধরে পরবর্তীতে নেদারল্যান্ডের রাজধানী হেগে আন্তর্জাতিক আদালতের পূর্বসূরী স্থায়ী সালিশি নিষ্পত্তি আদালত (Permanent Court of Arbitration - PCA) স্থাপিত হয়।
তবে, আন্তর্জাতিক আইন ও তার কল্যাণে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থার আশাব্যঞ্জক পরিবেশ উনবিংশ শতকের শেষের দিকে দ্রুতই কেটে যায়। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন ধারণা হিসেবে বাস্তববাদী রাজনীতি বা Realpolitik-এর আবির্ভাব ঘটে। জার্মান ঐতিহাসিক (Heinrich von Treitschke) হেনরিখ ভন ত্রিতস্ক Realpolitik-এর আদলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস বিশ্লেষণ শুরু করেন। তিনি রাজনীতিকে শক্তির আলোকে ব্যাক্ষা দেন, এবং বলেন রাষ্ট্র শুধু রাজনৈতিক (শক্তি) প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই তার রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে পারে যা একদিকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অন্যদিকে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ে সহায়ক হয়।
আমেরিকান ঐতিহাসিক ও কূটনীতিক পল রেইন্সখ (Paul Reinsch) ১৯০০ সালে রচিত তার World Politics গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে ১৮৭১ সালের প্রুশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে ত্রিতস্কের রাজনৈতিক চিন্তায় এহেন পরিবর্তন এসেছিলো। পূর্বে ত্রিতস্ক যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনায় সার্বভৌমকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন, যুদ্ধের পরে তিনি তার মত পালটে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনায় রাষ্ট্রকে শক্তি প্রদর্শন ও শক্তি প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার কথা বলে গেছেন। প্রুশিয়ার যুদ্ধ শুধু ত্রিতস্ককেই নয়, সমগ্র ইউরোপের শক্তি কাঠামোকে প্রভাবিত করে, কারণ এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অটো ভন বিসমার্কের নেতৃত্বে প্রুশিয়ান প্রদেশগুলো একত্র হয়ে জার্মান রাষ্ট্র গঠন করে। ফলে, রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইউরোপীয় ব্যবস্থায় নতুন অংশীদার হিসেবে জার্মানির আত্ম-প্রকাশ ঘটে যার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে জার্মান জাতীয়তাবাদ এবং বিসমার্কের অধীনে অভাবনীয় জার্মান অর্থনৈতিক বিকাশ। এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিসমার্ককে একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে সহায়তা প্রদান করে যা তৎকালীন ফ্রান্স, বৃটেন, রুশ ও অস্ট্রো-হাংগেরিয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ক্রমেই চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।
এভাবেই নতুন শতকের (বিংশ শতাব্দী) শুরু হয় ডারউইনের সামাজিক তত্ত্বের আলোকে: শক্তিমানরাই টিকে থাকবে। এই শক্তিমান হওয়ার অন্যতম ফায়দা ছিলো উপনিবেশ স্থাপনে সক্ষমতা অর্জন। নতুন জার্মানির সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি জার্মানিকেও সাম্রাজ্যবাদী হতে অনুপ্রাণিত করে। রেইন্সখের লেখা World Politics গ্রন্থটি তখন সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থে রূপ নেয়। রেইন্সখের ভাষায়, প্রুশিয়া যুদ্ধ নতুন করে যুদ্ধ ও শান্তি শীর্ষক বিতর্কের সূচনা ঘটায়। এক পক্ষ শক্তিমান হতে নতুন নতুন সমরাস্ত্র তৈরির প্রতি জোর দিতে থাকে, অন্যদিকে যুদ্ধের প্রভাব কতটা মারাত্মক হয়ে থাকে, বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর উদারবাদী পক্ষের বর্ণনা ও প্রচারণায় তা ফুটে ওঠে।
ভূগোল, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান সকলেই যুদ্ধ, শান্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে তাদের একাডেমিক গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে লিবারেলিজম তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা (Norman Amgell) নরমান এঞ্জেলের ১৯১০ সালে লেখা গ্রেট ইলিউশন (Great Illusion) গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই গ্রন্থে নরমান উদারবাদী দর্শনের আদলে শিল্প-যুগে অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থাকে কিভাবে যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্ত করে তা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন এত ক্ষতি করেও যে লাভের আশায় রাষ্ট্রগুলো যে যুদ্ধ বা সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তা পূরণ হয় না, অর্থাৎ, যুদ্ধ কখনো জয়ী হতে পারে না। তাই এই আধুনিক যুগে যেখানে অস্ত্রের ধ্বংস করার ক্ষমতা এতটাই বেশি এবং একই সাথে শিল্পযুগের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরস্পর এতটাই জড়িত যে যেকোন যুদ্ধে প্রতিটি রাষ্ট্রই আঘাতপ্রাপ্ত হবে।
ভাবানুবাদঃ
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল বইঃ
International Encyclopedia of Political Science
মূল লেখকঃ
Torbjorn L. Knutsen
Norwegian University of Science and Technology (NTNU)
Trondheim, Norway
প্রথম পর্ব: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস
https://irstudycornerbangla.blogspot.com/2025/01/history%20of%20international%20relations%20in%20bangla%20part%20I.html?m=1
দ্বিতীয় পর্বঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস (যুদ্ধ ও শান্তি)
https://irstudycornerbangla.blogspot.com/2025/01/international%20relations%20history%20in%20bangla.html
তৃতীয় পর্বঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রতিষ্ঠা
https://irstudycornerbangla.blogspot.com/2025/01/Origin%20of%20IR%20Department%20in%20Bangla.html


No comments