Header Ads

Header ADS

ইতিহাসের আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কঃ বিভাগ প্রতিষ্ঠা (পর্ব ৩)

ইতিহাসের আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কঃ বিভাগ প্রতিষ্ঠা (পর্ব ৩) 

Aberystwyth University


প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর

আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ঘিরে যে বিতর্কের সূচনা হয়েছিলো এবং যে বিতর্কের উৎস ছিলো ইতিহাসের অনেক গভীরে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সে বিতর্ক ক্রমে পাঠ্যক্রমে রূপান্তার হওয়া শুরু করে। এই রূপান্তরের হাওয়া যেন হঠাৎ করেই বইতে শুরু করে, যেমনটি রাজা ফার্দিনান্দের হত্যার প্রেক্ষিতে প্রথম মহাযুদ্ধের আবির্ভাব ঘটেছিলো। যুদ্ধের গতিপথ যত এগোতে থাকে যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক রূপ তত নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সালে, একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ইউরোপীয় শিল্পোন্নত শক্তিগুলোর ছোড়া আগ্নেয়াস্ত্রের গোলায় ইউরোপের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি সত্য যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় লক্ষাধিক ইউরোপীয় যুবক নিহত হত।  

এই অকল্পনীয় ধ্বংসলীলা, নিষ্ঠুরতা ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধান ও বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তোলে। কিভাবে এই অনর্থক যুদ্ধের কবলে এত প্রাণহানী ঘটছে? কিভাবে এই ধ্বংসলীলার ইতি ঘটানো সম্ভব? আগত সময়ে যেন এহেন দুর্যোগ আর ফিরে না আসে সেক্ষেত্রে কী কী করণীয়? প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে বিশেষজ্ঞ দল গবেষণা শুরু করেন। অতঃপর এহেন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়োজনে ইউরোপের ভূমিতে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (International Relations- IR) শিরোনামে নতুন পাঠ্যক্রমের সূচনা হয়। 

উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলঃ ইউরোপে চলে আসা যুদ্ধ নির্ভর সাংস্কৃতির পরিবর্তন কিভাবে ঘটানো যায় তা ইতিপূর্বে অনেক ঐতিহাসিক, আইনবিদ, এবং যুদ্ধবিরোধী এক্টিভিস্টদের মুভমেন্টের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে (IR) পাঠ্যক্রম হিসেবে উন্নীত করতে দুইটি দলের ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদের প্রথম দলটির সদস্য ছিলো তৎকালীন কতিপয় ধনাঢ্য শিল্পপতি যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই ইউরোপীয় যুদ্ধের কারণ অনুসন্ধান ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রচুর পরিমাণের অর্থ গবেষণাখাতে প্রদান করতেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আলফ্রেড নোবেল, এন্ড্রু কারনেজি (Andrew Carnegie) এবং রিচার্ড গারটোন (Richard Garton)।

দ্বিতীয় দলটির অধিকাংশ সদস্য ছিলেন রাজনীতিবিদ যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ব্রিটেনের জেমস ব্রাইচ (James Bryce) এবং ফিলিপ নোবেল বেকার (Philip Noel Baker), এবং আমেরিকান অধ্যাপক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি উইড্রো উইলসন। প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলার অভিজ্ঞতা সরকারি আমলা, কূটনীতিক, রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাদের উপদেষ্টা প্রমূখদের যুদ্ধ ও শান্তির ব্যাপারে গভীরভাবে জানতে আগ্রহী করে তোলে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যেভাবে পালটে দেয়

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR) অধ্যায়নের সূচনা হয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। প্রধানত দুইটি কারণ খুঁজে দেখতেঃ কোন কোন কারণে যুদ্ধের সূচনা ঘটে? এবং কোন কোন শর্ত পূরণের দরুন যুদ্ধের সম্ভাবনায় স্থায়ীভাবে ইতিটানা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ অনুসন্ধানে যেসকল বিখ্যাত স্কলার আত্মনিয়োগ করেছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ লয়েজ ডিকেনসন (G. Lowes Dickinson) তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য। 

ডিকেনসনের ভাষায় যুদ্ধের তাৎক্ষনিক কারণ হিসেবে জার্মানির সামরিক নীতিকে দায়ী করা হলেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিলো আরও গভীর ও জটিল একটি কারণে। তার ভাষায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় রাজনৈতিক সিস্টেম সম্পূর্ণরূপে ছিলো আইনশূন্য (Lawlessness) অথবা নৈরাজ্যপূর্ণ (Anarchy)। এই গভীর কারণটিকে ডিকেনসন ১৯১৬ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত The European Anarchy গ্রন্থে সবিস্তারে বিশ্লেষণ করেন। 

কিভাবে নৈরাজ্যের পরিবর্তে শান্তি আনয়ন করা যায়; শৃঙ্খলা আনয়ন করা যায় ইত্যাদি চিন্তা ডিকেনসনের মত অন্য অনেক লেখক ও এক্টিভিস্টদের নানা প্রস্তাবনায় উঠে আসে। তাদেরই একজন ছিলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ ইরবিং ফিশার (Irving Fisher), যিনি একাডেমিয়ায় নতুন কনসেপ্ট হিসেবে শান্তিপুঞ্জের (League of Peace) ধারণাটি উপস্থাপন করেন। তবে এই ধারায় সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রবক্তা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারি আমলা ও লেখক লিওনার্দ উল্ফ (Leonard Woolf)।

১৯১৬ সালে উল্ফের রচিত গ্রন্থ International Government কূটনীতিক, আমলা এবং রাষ্ট্রপ্রধান যেমন রবার্ট চেচিল (Robert Cecil), জ্যান স্মুতস (Jan Smuts) এবং এমনকি উইড্রো উইলসনকে ব্যপকভাবে প্রভাবিত করে। ফলে, ১৯১৯ সালে উইড্রো উইলসন যখন প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে (Paris Peace Conference) যোগদান করেন, তিনি যুদ্ধ সমাধানের একমাত্র স্থায়ী পন্থা হিসেবে লিওনার্দ উল্ফ প্রবর্তিত জাতিপুঞ্জের (League of Nations) ধারণাকে সকল সদস্যের সামনে পেশ করেন।           

উল্ফের জাতিপুঞ্জের ধারণা উইড্রো উইলসন প্রবর্তিত চৌদ্দ দফাতেও স্থান করে নেয় যা পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নতুন করে সাঁজাতে শুরু করে। প্যারিস সম্মেলনে উইলসনের বক্তব্য রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রথাগত রাষ্ট্র পরিচালনা নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে। যুদ্ধের সমাপ্তিতে উইলসনের জাতিপুঞ্জ ধারণা সাধারণের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জাতিপুঞ্জ ধারণার সূচনা পাশাপাশি আরও একটি কাজ করে, অর্থাৎ, কিভাবে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমাতে জাতিপুঞ্জ সাহায্য করতে পারে, কিভাবে রাষ্ট্রপ্রধানরা নতুনভাবে তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালন নীতির পুনঃবিন্যাস ঘটাবে প্রভৃতি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে (IR) একটি পাঠ্যক্রম হিসেবে আরও গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করে। 

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে উইলসন ইউরোপীয় বিজেতা রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতে উইলসন উল্ফের ধারণাকে আরও বিস্তারিতভাবে তাদের সামনে উপস্থাপন করেন, এবং এই ধারণাকে কেন আমেরিকা সমর্থন দেয় সে বিষয়টিও ব্যাক্ষা করেন। রাষ্ট্রপ্রধানদের পাশাপাশি নানা শ্রেণির গবেষক, আইনবিদ ও এক্টিভিস্টও উইলসনের নতুন ভিশনের সাথে পরিচিতি হন। সকলে ঐক্যমতে পৌছেন যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষণা ও পাঠ্যক্রম পরিচালিত করতে হবে। 

এরই ফলশ্রুতিতে, ব্রিটিশ ধনাঢ্য শিল্পপতি ডেভিড ড্যাভিসের (David Davies) অর্থায়নে যুক্তরাজ্যের ওয়েলস রাজ্যের আবেরিস্তিউথে (Aberystwyth) অবস্থিত ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯১৯ সালে বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভাগ যাত্রা করে। এক বছর বাদেই, অর্থাৎ, ১৯২০ সালে আমেরিকা ও বৃটেনে সমন্বিতভাবে আন্তর্জাতিক এফেয়ার্স ইন্সটিটিউট (Institute of International Affairs) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিস্ক এন্ড পলিটিক্যাল সাইন্স (The London School of Economics and Political Science- LSE) বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামক একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খোলা হয়। একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমন্ড এ ওয়ালস স্কুল অব ফরেন সার্ভিসের (Edmund A. Walsh School of Foreign Serviceঅধীনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR) বিভাগ খোলা হয়।  

এছাড়াও, ১৯২৪ সালে সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২৮ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR) বিভাগ চালু হয়। তবে, প্রাথমিকভাবে ব্রিটেন ও আমেরিকায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চালু হওয়ায় অনেকেই ধারণা করেছিলো পাঠ্যক্রমটি হয়তো শুধু ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোর একটি নিজস্ব পাঠ্যক্রম হবে। কিন্তু তা হয়নি, এর অন্যতম কারণ  যুদ্ধের থাবা থেকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গভীর জ্ঞান প্রতিটি রাষ্ট্রেরই প্রয়োজন ছিলো। যেমনঃ ১৯২৭ সালে সুইজারল্যান্ডে Geneva’s Graduate Institute of International Studies নামে স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

এভাবে,  যুদ্ধের বিপরীতে চিরস্থায়ী শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে পাঠ্যক্রম হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে। পাঠ্যক্রমের অধ্যায়নের কেন্দ্রে ছিলো ইম্যানুয়েল ক্যান্টের বিখ্যাত Perpetual Peace: A Philosophical Sketch গ্রন্থটি। ধারণা করা হতো এই গ্রন্থের সাহায্যে উদারবাদী আদর্শ, গণতন্ত্র, মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং সমন্বিত নিরাপত্তার আলোকে যুদ্ধাংদেহী ইউরোপীয় সংস্কৃতির পরিবর্তন সম্ভব হবে। সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে Ernest Satow, David P Heatley, S.H. Allen, P. Potter ছিলেন উল্লেখযোগ্য যারা যুদ্ধের কারণ এবং কিভাবে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব ইত্যাদি নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতেন।  

তাদের লেখনিতে উঠে আসতে থাকলো রাষ্ট্রপ্রধানের অযৌক্তিক ও নেতিবাচক মনোভাবের ফলেই যুদ্ধের সূচনা হয়, এবং সে যুদ্ধের সমাপ্তি সম্ভব যদি রাষ্ট্র যৌক্তিক সিদ্বান্ত নেয়, এবং কূটনীতির সাহায্যে সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করে যায়। তবে,  আদর্শ, আইন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার লক্ষ পূরণের উদ্দেশ্যে সে কূটনীতি পরিচালিত হতে হবে। তবেই যুদ্ধের বিপরীতে শান্তি ও নিরাপত্তা স্থায়ী হবে। 



ভাবানুবাদঃ

বদিরুজ্জামান 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 



মূল বইঃ

International Encyclopedia of Political Science

মূল লেখকঃ

Torbjorn L. Knutsen

Norwegian University of Science and Technology (NTNU)

Trondheim, Norway






প্রথম পর্ব: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস

https://irstudycornerbangla.blogspot.com/2025/01/history%20of%20international%20relations%20in%20bangla%20part%20I.html?m=1


দ্বিতীয় পর্বঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস (যুদ্ধ ও শান্তি)

https://irstudycornerbangla.blogspot.com/2025/01/international%20relations%20history%20in%20bangla.html


তৃতীয় পর্বঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রতিষ্ঠা

https://irstudycornerbangla.blogspot.com/2025/01/Origin%20of%20IR%20Department%20in%20Bangla.html






No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.