Header Ads

Header ADS

নব্য-মার্কসবাদ (Neo-Marxism): আইডিয়া ও সংস্কৃতির আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

 নব্য-মার্কসবাদ (Neo-Marxism): আদর্শ ও সংস্কৃতির আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক 

Neo-Marxism

Neo-Marxism বা নব্য-মার্কসবাদ আদতে কিছু তত্ত্বের এক সমন্বিত রূপ। এই তত্ত্বগুলোর মূল ভিত্তি কার্ল মার্কসের বিখ্যাত মার্কসবাদ তত্ত্ব (Theory of Marxism)। তবে, নব্য-মার্কসবাদের গঠন, আলোচ্যসূচি, ও বিশ্লেষণ পদ্ধতি কার্ল মার্কসের মার্কসবাদ তত্ত্বের থেকে অনেকটা ভিন্ন। যেখানে মার্কসবাদে প্রাথমিকভাবে শ্রেণী সংগ্রাম (Class Struggle), ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism), এবং পুঁজিবাদের বিষাক্ত রূপকে গভীর থেকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করে, নব্য মার্কসবাদ সেখানে নিজের তাত্ত্বিক দৃষ্টি, নিজেদের বিশ্লেষণ ইত্যাদিকে বিশ্ব রাজনীতি মূখী করেছে। নব্য-মার্কসবাদ বিশ্ব-রাজনীতিকে নানাদিক বিবেচনায় বিশ্লেষণ করে, যা বিশ্ব-রাজনীতিকে ব্যাক্ষা করার প্রথাগত তত্ত্বগুলোকেও চ্যালেঞ্জ করে।  

মার্কসবাদ ও নব্য-মার্কসবাদের মাঝে প্রধান পার্থক্যটি হল মার্কসবাদ যেখানে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক মুক্তিকে মূখ্য করে দেখেছে, নব্য-মার্কসবাদ এই অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সংস্কৃতি ও আইডিয়ার ভূমিকাকে অতি গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করে। নব্য-মার্কসবাদীদের ভাষায়, আইডিয়া, বিশ্বাস, চিন্তা, এবং সাংস্কৃতিক নানা অনুষঙ্গ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কিভাবে পরিচালিত হবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়। তারা বলে, বিশ্বের বৃহৎ শক্তি বা শক্তিধর জোট আন্তর্জাতিক সিস্টেমে কৃত্রিমভাবে অসমতা তৈরি করে রাখে যাতে সিস্টেমের তুলনামূলক দুর্বল রাষ্ট্রের থেকে তারা মুনাফা অর্জন করতে পারে। 

নব্য-মার্কসবাদ তত্ত্বের অন্যতম প্রুধা এন্থনিও গ্রামসি (Antonio Gramsci) বলেন, বৃহৎ শক্তি বা জোট এরূপ অসমতা তৈরি করতে পারে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বদলৌতে যাকে তিনি সাংস্কৃতিক ক্ষমতা (Cultural Hegemony) বলেছেন। গ্রামসির মতে, বৃহৎ শক্তিরা তাদের সংস্কৃতি ও আইডিয়াকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অন্যান্যদের উপর প্রভুত্ব বজায় রাখে। উদাহরণ হিসেবে আমেরিকার কথা বলা যেতে পারে।  আমেরিকার পপ সংস্কৃতি এবং উদারবাদী আদর্শ আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অন্যান্যদের উপর যুক্তরাষ্ট্র চাপিয়ে দিতে চায়।  যেমন দিয়েছে লাতিন আমেরিকায়, যেমন দিয়েছে পূর্ব এশিয়ায় এবং ইউরোপে, যাতে এ অঞ্চলের দেশগুলো সামগ্রিকভাবে আমেরিকার প্রভুত্ব স্বীকার করে নেয়।  

নব্য-মার্কসবাদ তত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো, এই তত্ত্ব বিশ্ব রাজনীতির বিভিন্ন পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করে, এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে নির্ভশীলতা রয়েছে তাকেও গুরুত্ব দেয়। এই তত্ত্বে বলা হয় আমরা যে উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মাঝে সম্পর্ক দেখতে পাই তা আদতে একটি স্থায়ী নির্ভরশীলতা (Perpetuate Dependency) ও শোষণের (Exploitation) সম্পর্ক। নব্য-মার্কসবাদ তত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অর্থাৎ নির্ভরশীল তত্ত্ব (Dependency Theory) অনুসারে, শক্তিশালী দেশের সাথে আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছে এক জটিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক যা আদতে শক্তিধরের প্রতি সিস্টেমের অন্যান্যদের নির্ভরশীলতার ফলে তৈরি হয়েছে। 

এই নির্ভরশীল তত্ত্বের সাহায্যে নব্য মার্কসবাদ তত্ত্ব আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের উপস্থিতি ও প্রভাবকে চিহ্নিত করে। এছাড়াও, কিভাবে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় কৃত্রিমরূপে স্থায়ী ভিত্তিতে অসমতা সৃষ্টি করে এবং সে অসমতা থেকে সমতায় ফিরতে তাদের নিজস্ব স্বার্থপন্থী অর্থনৈতিক মডেল প্রদান করে তা নব্য-মার্কসবাদ বিশ্লেষণের চেষ্টা করে। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে আবশ্যিকভাবে পাঠককে বিশ্বব্যবস্থায় পুঁজিবাদের ভূমিকাকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।

যেভাবে নব্য-মার্কসবাদ ধারনাটির আগমন

নব্য-মার্কসবাদ (Neo-Marxism) আদর্শ ও সংস্কৃতির আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দর্শনের আগমন ঘটেছে গত শতকে, অর্থাৎ বিংশ শতকের প্রথমার্ধে। কার্ল মার্কসের মার্কসবাদ তত্ত্বের সমালোচনাস্বরূপ নতুন যুগের সমাজতন্ত্রপন্থীদের হাত ধরে নব্য-মার্কসবাদী চিন্তার সূত্রপাত ঘটে। এই নতুন যুগের সমাজতন্ত্রপন্থীদের অনেকেই Frankfurt School of Thought সংঘের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই সংঘের সবচেয়ে বড় অবদান হল সমালোচনা তত্ত্ব (Critical Theory) উপস্থাপন যা কাঠামোগত বিশ্লেষণ ও সমালোচনার মাধ্যমে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পরিবর্তন আনতে চায়। 

নব্য-মার্কসবাদের মতোই সমালোচনা তত্ত্বও কার্ল মার্কসের মার্কসবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল, তবে এটি সংস্কৃতি, রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক কাঠামো বিশ্লেষণে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে। নব্য-মার্কসবাদের প্রধান প্রধান চিন্তক ছিলেন হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট জর্জি লুকাস (György Lukács), ইতালিয়ান কমিউনিস্ট এন্তোনিও গ্রামসি (Antonio Gramsci), জার্মান সমালোচনা তাত্ত্বিক ম্যাক্স হোরকেইমার (Max Horkheimer) , থিওডর আদোরনো (Theodor Adorno), হারবার্ট মারকিউহজ (Herbert Marcuse) এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী এঞ্জেলা দেবিস (Angela Davis)।

কার্ল মার্কসের মার্কসবাদ তত্ত্বের থেকে নব্য-মার্কসবাদ তত্ত্ব (Neo-Marxism) কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছে। নব্য-মার্কসবাদ তত্ত্বের সাথে কার্ল মার্কসের মার্কসবাদ তত্ত্বের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল মার্কসবাদের তত্ত্বের অন্যতম ভিত্তিঃ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism) তত্ত্বকে অস্বীকার করা। এই অস্বীকারের প্রবণতা শুরু হয় ১৯২০ এর দশকে যখন কিছু কমিউনিস্ট কার্ল মার্কসের বস্তুবাদী বিশ্লেষণের বাহিরে গিয়ে সাংস্কৃতিক উপাদানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সিস্টেমকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করে। এই পথের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক ছিলেন এন্থনি গ্রামসি, যিনি তার সাংস্কৃতিক মহাশক্তি (Cultural Hegemony) তত্ত্বের দ্বারা আন্তর্জাতিক পরিক্রমাকে সাংস্কৃতিক ছাঁচে বিশ্লেষণ করার কথা বলেন। 

গ্রামসির এই তত্ত্বের প্রভাবে নব্য-মার্কসবাদ তত্ত্ব একাডেমিক মহলে সাংস্কৃতিক মার্কসবাদ (Cultural Marxism) হিসেবেও পরিচিতি পায়। যদিও কার্ল মার্কসের মার্কসবাদের ন্যায় নব্য-মার্কসবাদের প্রধান গবেষণাক্ষেত্র ছিলো বুর্জুয়া শ্রেণী নির্ণয় ও তাদের আচরণ বিশ্লেষণ; তবে নব্য-মার্কসবাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে পড়ে বুর্জুয়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, অর্থাৎ বুর্জুয়ারা জীবনযাপন ও ভোগবাদে যে সংস্কৃতি অনুসরণ করে সে সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পরিক্রমায় ছড়িয়ে দেয় যাতে পরিক্রমার অন্য সদস্য দেশগুলোও এরূপ বুর্জুয়া সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, এবং এভাবেই আন্তর্জাতিক সিস্টেমকে পুঁজিবাদ কব্জা করে রাখে। নব্য-মার্কসবাদের এরূপ বিশ্লেষণের সাথে মার্কসের মার্কসবাদের পার্থক্য হলোঃ মার্কসবাদ যেখানে পুঁজিবাদী সমাজ বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যকে প্রধান্য দিয়েছেন, নব্য-মার্কসবাদীরা আন্তর্জাতিক সিস্টেমকে বিশ্লেষণে সেখানে পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক প্রভাবকে প্রাধান্য দিয়েছেন।  

কতিপয় পণ্ডিতদের ধারণা, মার্কসের মার্কসবাদ তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে নব্য-মার্কসবাদ (Neo-Marxism)  তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। এই সীমাবদ্ধতার অন্যতম হল মার্কসের বিখ্যাত গ্রন্থ কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে দাবীঃ আগত সময়ে পুঁজিবাদের বিকাশে যখন নতুন ঘরনার শিল্পোন্নত সমাজের আবির্ভাব ঘটবে তখন শ্রমিক শ্রেণীর মাঝে শ্রেণী চেতনা (Class Consciousness)-এর উন্মেষ ঘটবে, এবং সে উন্মেষের হাত ধরেই শ্রমিক বিপ্লব (Proletariat Revolution) সংগঠিত হবে, এবং এই বিপ্লবের হাত ধরেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো কমিউনিজমের পথে এগিয়ে যাবে। কিন্তু, প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেখানে কৃষিপ্রধান রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে শ্রমিক ও কৃষকের বলশেভিক বিপ্লবের হাত ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে সমসাময়িক বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মান, নেদারল্যান্ড এবং আমেরিকার মতো প্রধান শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোয় এরূপ প্রলেতারিয়েত বিপ্লবগুলি ঘটেনি। 

জর্জি লুকাচ (György Lukács) নেতৃত্বে হাঙ্গেরিতে সংঘটিত কমিউনিস্ট বিপ্লব কিছুদিনের জন্য সফল হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই সে বিপ্লব বেহাত হয়ে যায়। ফলে, ১৯২০’র দশকে কমিউনিস্টদের মাঝে মার্কসবাদের এই ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে ডায়লগের সূচনা হয়ঃ  মার্কস কী ঠিক বলেছিলেন? না মার্কসের সমীকরণে ভুল ছিলো? আসল কারণটি কী? ডায়লগে তারা উক্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন। অবশেষে, তাদের কতিপয় কমিউনিস্ট পণ্ডিত সিদ্বান্তে উপনীতি হন যে শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বিপ্লব বেহাত হওয়ার প্রধান কারণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক মহাশক্তি (Cultural Hegemony)। তারা বলেন যে এই সাংস্কৃতিক মহাশক্তি বুর্জোয়া শ্রেণীর দাপট বজায় রাখে এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে প্রয়োজনীয় শ্রেণী চেতনা গড়ে উঠতে বাধা দেয়, যার ফলে মার্কসের বক্তব্য মাফিক বিপ্লবী প্রলেতারিয়াতে পরিণত হতে পারে না। 

Cultural Hegemony ধারণাটি বিকাশে সবচেয়ে অগ্রণী ছিলেন হাঙ্গেরীয় মার্কসবাদী দার্শনিক জর্জি লুকাচ (György Lukács) ও ইতালীয় মার্কসবাদী দার্শনিক এন্তোনিও গ্রামসি (Antonio Gramsci)। তাদের সাথে অল্প-বিস্তর যুক্ত ছিলেন ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের অন্যতম প্রধান পণ্ডিত জার্মান দার্শনিক ম্যাক্স হর্কহেইমার (Max Horkheimer), যিনি ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন  [ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব অধ্যায়ে আমরা  ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব বিকাশে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিতভাবে জানবো]। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো কার্ল মার্কসের "বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র" (Wissenschaftlicher Sozialismus) কে পরিমার্জিত এবং উন্নত করা। এ লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে হারবার্ট মারকিউজ তার বিখ্যাত Eros and Civilization গ্রন্থটি রচনা করেন। 

এই গ্রন্থে মার্কিউজ দেখানোর চেষ্টা করেন কিভাবে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের শ্রমিক শ্রেণীকে নানা প্রোপ্যাগান্ডা ও মিথ্যা আশায় দমিয়ে রাখে, যাকে নব্য-মার্কসবাদীরা মার্কসের মিথ্যা চেতনা (false consciousness) মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। যদিও মতবাদটি এসেছিলো মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখনি থেকে, কিন্তু মতবাদটিকে নব্য-মার্কসবাদীরা পূর্ণতা দেন। কিভাবে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সিস্টেমকে পুঁজিবাদের চেতনার আলোকে সাজানো হয় এবং কিভাবে পুঁজিবাদীরা নানা প্রোপ্যাগান্ডা ও মিথ্যা বয়ানের মাধ্যমে সে সিস্টেমকে শ্রমিকদের কাছে গ্রহণীয় করে তোলে নব্য- মার্কসবাদীরা এই মতবাদের আলোকে সহজভাষায় সে মিথ্যা চেতনা সম্পর্কে মানুষের মাঝে সমালোচনামূলক সচেতনতা (critical consciousness) তৈরিতে কাজ করে যান।  

একদিক থেকে, নব্য-মার্কসবাদ তত্ত্বের মূল কথা হলো আধুনিক শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা একটি ভোগবাদী সাংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, এবং এই ভোগবাদী সংস্কৃতিকে টেঁকসই করতে পুঁজিবাদীরা বিজ্ঞাপন, প্রোপ্যাগান্ডা, মিশ্র অর্থনীতি এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদী পপ কালচার প্রচার ও প্রসারে ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেয়। এই নিয়ামকগুলো রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সিস্টেমের সদস্যদের সঠিক চেতনা জাগ্রত হতে দেয় না। অর্থাৎ, তারা যে ভোগবাদে অভ্যস্ত হওয়ার দরুন পুঁজিবাদীদেরকে শোষণের ক্ষেত্র তৈরি দিচ্ছে এই সমালোচনামূলক চেতনা ভোগবাদী পুঁজিবাদী সিস্টেমে জাগ্রত হয় না। 

এই সচেতনতা জাগ্রত না হওয়া কী দোষের? বস্তুত ভোগবাদী সিস্টেমের প্রতি মানুষের মিথ্যা চেতনা বা মিথ্যা সন্তুষ্টি মার্কসবাদের ক্ষেত্রে  একটি সমস্যা, কারণ এটি মানুষের বিপ্লবী ইচ্ছাকে দুর্বল করে দেয় এবং বিদ্যমান সমাজে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা রয়েছে তাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে। ফলে, নব্য-মার্কসবাদীদের লক্ষ্য হল এই মিথ্যা চেতনাকে ভেঙে দেওয়া এবং মানুষকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা অবহিত করা এবং মানুষের আসল স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করা, যাতে তারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণের বিরুদ্ধে নিজেদের সংগঠিত করতে পারে। 

নব্য-মার্কসবাদ (Neo-Marxism) তত্ত্বের মূল আইডিয়াগুলো

নব্য- মার্কসবাদ (Neo-Marxism) তত্ত্ব মোটাদাগে তিনটি আইডিয়ার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। যথাঃ 

ক. আদর্শ ও সংস্কৃতি (Ideology and Culture): 

নব্য-মার্কসবাদীদের বিশ্বাস প্রতিটি প্রভাবশালী আদর্শ বা দর্শন এবং সাংস্কৃতিক উপাদান বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পারিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করে থাকে। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাধর দেশগুলো অত্র আদর্শ বা দর্শন এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের সাহায্যে সিস্টেমের অন্যান্য দেশকে প্রভাবিত করে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। সে বিবেচনায়, নব্য-মার্কসবাদ তত্ত্বের অন্যতম উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কে দর্শন ও সংস্কৃতির ভূমিকাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা। ফলে, এই তত্ত্বের সাহায্যে আমরা আন্তর্জাতিক সিস্টেমে দর্শন ও সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে জানতে পারবো, এবং একই সাথে কিভাবে ক্ষমতাধরেরা উক্ত প্রভাব বজায় রেখে আন্তর্জাতিক সিস্টেমে শক্তি ও অর্থনৈতিক অসমতা পুষে রাখে তাও বুঝতে পারবো।  

খ. সাংস্কৃতিক ক্ষমতা (Cultural Hegemony): 

ইতালীয় মার্কসবাদী এন্তোনিও গ্রামসি (Antonio Gramsci) আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সাংস্কৃতিক মহাশক্তি (Cultural Hegemony) ধারণাটি প্রবর্তন করেন। এই ধারণা অনুসারে, আন্তর্জাতিক সিস্টেমের শক্তিশালী দেশ বা গোষ্ঠী সংস্কৃতি (Culture), আইডিয়া (Ideas) এবং মূল্যবোধকে (Values) হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সিস্টেমের অন্য দেশের উপর আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রভাবশালী শক্তি তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও আদর্শকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রচার করতে পারে, যার ফলে অন্যান্য জাতিগুলো সেই মূল্যবোধ ও আদর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। গ্রহণ করতে বাধ্য এজন্য যে তারা ঐ প্রভাবশালী দেশের উপর নানাভাবে নির্ভরশীল। এর ফলে, স্থানীয় সংস্কৃতি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রভাবশালী শক্তির আধিপত্য আরও দৃঢ় হয়। সাংস্কৃতিক হেজেমনির বিশ্লেষণের মাধ্যমে, নব্য-মার্কসবাদীরা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার সম্পর্ক ও প্রভাবের প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেন।

গ. নির্ভরশীল তত্ত্ব (Dependency Theory): 

নব্য-মার্কসবাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো নির্ভরতাশীলতা তত্ত্ব (Dependency Theory), যা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উপর কেন্দ্রীভূত। নব্য-মার্কসবাদীরা মনে করেন যে এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে প্রায়ই নির্ভরশীলতার একটি কাঠামো বিদ্যমান থাকে, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শোষণের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর সম্পদ ও ক্ষমতা বজায় রাখে। এই শোষণ বিভিন্ন উপায়ে ঘটতে পারে, যেমন অন্যায্য বাণিজ্য চুক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদের নিষ্কাশন, অথবা সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরশীলতা। নির্ভরতা তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে গ্লোবাল সিস্টেম এমনভাবে গঠিত, যা শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষায় কম উন্নত দেশগুলোকে শোষণের সুযোগ করে দেয়। 

উপসংহার

মার্কসবাদ তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা প্রশমনে বিংশ শতকে নব্য- মার্কসবাদ (Neo-Marxism) তত্ত্বের আগমন। তত্ত্বটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতন্ত্র ধারণা উপস্থাপন করে, যেমন আদর্শ ও সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক হেজেমনি এবং নির্ভরতা তত্ত্ব। এসব ধারণা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা গ্লোবাল সিস্টেমে বিদ্যমান ক্ষমতার সম্পর্ক ও বৈষম্য সম্পর্কে গভীর ধারণা পেতে পারি। এটি আমাদের বর্তমান বিশ্বের জটিল চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ ও সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে সহায়তা করে, যেখানে জাতিগুলো পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। 



-

বদিরুজ্জামান

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়



        

 


No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.