Header Ads

Header ADS

জাতীয়তাবাদ (Nationalism): আত্নপরিচয়ের এক নিগূঢ় অনুভূতি

জাতীয়তাবাদ: আত্নপরিচয়ের এক নিগূঢ় অনুভূতি




জাতীয়তাবাদ (Nationalism) মানব সভ্যতার একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রবণতা যা জাতি, রাষ্ট্র এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে গঠিত। জাতীয়তাবাদ কেবল একটি মতাদর্শ নয়, বরং এটি একটি অনুভূতি যা জনগণের ঐক্য, আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার ধারণাকে জোরদার কারে। জাতীয়তাবাদের মূল উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে- জাতি (Nation), জাতীয় চেতনা (National Consciousness), সার্বভৌমত্ব (Sovereignty), ভূখন্ড (Territory), রাষ্ট্র (State) ও সরকার (Government)। জাতীয়তাবাদ সাধারণত একাটি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি,ইতিহাস, ভূখন্ড ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।। এটি এমন একটি রাজনৈতিক আদর্শ, যেখানে জনগণ নিজেদের একই জাতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম করে। জাতির (Nation) পরিচয় মূলত ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভৌগোলিক সীমারেখার ভিত্তিতে গঠিত হয়। 

জাতীয়তাবাদের (Nationalism) বিকাশ 

জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকলেও এটি আধুনিক রূপ পায় ইউরোপের শিল্পবিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে। অর্থাৎ প্রাচীন যুগে মানুষ সাধারণত ধর্ম,ভাষা,গোত্র ও সাম্রাজ্যের ভিত্তিতে সংঘটিত হতো। উদাহরণস্বরূপঃ রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্য এবং চীন ও ভারতীয় সভ্যতাগুলো তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিতে এক ধরনের জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। মধ্যযুগে ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের অধীনে জাতীয়তাবাদ মূলত রাজাদের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠে।  

তবে, অতীতের বিদ্যমান কোন জাতীয়তাবাদের ধারণা আধুনিক জাতীয়তাবাদের মত এতটা প্রভাব তৈরি করতে পারেনি; আধুনিক জাতীয়তাবাদের মত একটি জাতির সার্বভৌমত্বের ধারণা তৈরি করতে পারেনি। বিশেষকরে ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ (১৭৭৬) ও ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) সময় এক আধুনিক জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। এই সময়ে “জনগণের শাসন,জাতীয় সংহতি এবং স্বাধীনতা”-এই ধারণাগুলো জনপ্রিয় হতে থাকে। উনবিংশ ও বিংশ শতকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। পাকিস্তান (১৯৪৭), ভারত (১৯৪৭), চীন (১৯৪৯), ইন্দোনেশিয়া (১৯৪৫), আলজেরিয়া (১৯৬২), বাংলাদেশ (১৯৭১) সহ অনেক দেশ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জন করে। 

জাতীয়তাবাদের (Nationalism) তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

জাতীয়তাবাদ, এই যে অনুভূতি, এই যে টান, এই যে চেতনা সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, সে গড়ে ওঠাকে পূর্ণরূপে বুঝার প্রয়োজনে কিছু সমাজবিজ্ঞানী জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন। নিচে সংক্ষেপে এরূপ কিছু তত্ত্বের মূলকথা উদাহরণ সমেত জেনে নেওয়া যাকঃ 

১। এলি কেদুরির জাতীয়তাবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ( Nationalism and Self-determination) 

এলি কেদুরি (Elie Kedourie) জাতীয়তাবাদকে একটি ইউরোপীয় ধারণা হিসেবে ব্যাক্ষা করেন। কেদুরির ভাষায়, জাতীয়তাবাদ ধারনার অবতারণা ঘটেছে উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে। তিনি বলেন মানবজাতি স্বভাবতই স্বতন্ত্র ও  পৃথক জাতিতে বিভক্ত হয়ে বসবাস করে। কেদুরির মতে, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি বা জাতিগত পরিচয়কে পুঁজি করে কোন জাতি নির্ধারণ করা যথেষ্ট নয়, বরং এসব উপাদান একসাথে মিশে একটি জাতির ধারণা গড়ে উঠতে পারে। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদকে কেদুরি ব্যাখ্যা করেছেন। যেখানে ভাষা, ধর্ম বা জাতিগত পরিচয় প্রধান বিষয় নয় বরং রাষ্ট্রীয় নীতি ও নাগরিকের রাজনৈতিক ইচ্ছা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন বা ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদ যদি কেবল ভাষা বা বর্ণের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হতো, তবে তা অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না। 

Kedourie ব্যাখ্যা করেছেন যে, জাতীয়তাবাদ দেশপ্রেম (Patriotism) ও বিদেশী-বিদ্বেষ ( Xenophobia) এক জিনিস নয়। দেশপ্রেম হলো নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা আর বিদেশী-বিদ্বেষ হলো অন্য জাতির প্রতি ঘৃণা। জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক মতবাদ, যা রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে, ভারতের  স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদ মানুষের ঐক্য সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু একই সময়ে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ দেশভাগের মত সংকট তৈরি করে।এছাড়া জাতীয়তাবাদ ও উপজাতীয়তা (Tribalism) এক নয়। উপজাতীয়তা সাধারণত ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিধান অনুসারে চলে যেখানে জাতীয়তাবাদ সহ-নিয়ন্ত্রণের (Self-determination) উপর ভিত্তি করে।

কেদুরি দেখান যে, জাতীয়তাবাদ ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারে। যেমন : জায়ানবাদের (Zionism) মাধ্যমে ইহুদি পরিচয়কে ধর্ম থেকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি আরও দেখিয়েছেন, জাতিরাষ্ট্র (Nation-state) ষোড়শ শতক থেকে গঠিত হয়নি বরং ইতিহাস পুনর্লিখন করা হয়েছে। যেমন: পাকিস্তানে ইসলামকে জাতীয়তাবাদের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় বা ফ্রান্সের ক্যাথলিক ধর্মকে ফরাসি পরিচয় এর সাথে সংযুক্ত করা হয়। তিনি বলেন, জাতিগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের (Self-determination) আকাঙ্ক্ষা জাতীয়তাবাদীর মূল ভিত্তি, তবে এটি সার্বজনীন সত্য নয়। যেমন অটোম্যান সাম্রাজ্য বড় রাষ্ট্র হলেও জাতীয় রাষ্ট্র ছিল না। ফ্রান্স রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যুদ্ধ রাজনীতি দক্ষতার কারণে জাতির অস্তিত্বের কারণে নয়। 

কেদুরি জাতীয়তাবাদ তত্ত্বের অন্যতম ধারক Ernest Renan এর মতবাদ তুলে ধরেন, যেখানে রেনান বলেন যে জাতি গঠনের মূল শর্ত হলো জনগণের ইচ্ছা,শুধু ভাষা বা বর্ণ নয়। উদাহরণ হিসেবে, Ahad Ha’am দেখিয়েছেন যে, ইহুদিদের জাতীয়তাবোধ কোন বাহ্যিক উপাদানের উপর নির্ভর করে না বরং তাদের অন্তরের অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল। একইভাবে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য বাংলাদেশ গঠিত হলেও ভাষা ছাড়া আরও অনেক ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণ এর ভিত্তি করে তুলেছিল।

খ। আর্নেস্ট গেলনারের জাতীয়তাবাদ এবং আধুনিকীকরণ (Nationalism and Modernization) 

Ernest Gellner মনে করেন, জাতীয়তাবাদ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শিল্পায়নের ফলাফল। তার মতে, আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য নাগরিকদের যে ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা তা হলো সাক্ষরতা বা শিক্ষার উপযোগিতা। গেলনার মনে করেন যে আধুনিক সমাজের মধ্যে, রাষ্ট্রের অধিকার ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম নির্বাহের জন্য নাগরিকদের একটি নির্দিষ্ট স্তরের শিক্ষার প্রয়োজন। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা ভাষার পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে শৈক্ষিক দক্ষতা এবং পরিচিতির মাধ্যমে একটি নতুন সংস্কৃতি গঠন করে।

গেলনারের তত্ত্ব অনুযায়ী, আধুনিক সমাজের জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হলো একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা, যা সমস্ত নাগরিকের মধ্যে একক ভাষা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ধারণা স্থাপন করে। এই শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন জনগণের মধ্যে একটি সাধারণ ভাষার ভিত্তিতে যোগাযোগ এবং সমন্বয় সাধন করে, যা জাতীয় একীকরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন জনগণ একটি শীর্ষ স্তরের শিক্ষার মাধ্যমে তাদের সমাজের নিয়ম এবং ভাষা বুঝতে সক্ষম হয়, তখন তারা নিজেদের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উঠতে পারে।

গেলনার আরও বলেছিলেন যে, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট ভাষার ব্যবহারকে উৎসাহিত করে এবং সে ভাষার সাথে সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক প্রভাবসমূহ প্রবাহিত হয়। এর ফলে, ব্যক্তিরা ঐ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে ওঠে এবং এটি একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তৈরি করতে সহায়ক হয়। তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন যে, আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যে আধুনিকীকরণের (Modernization) জন্য এটি একটি অপরিহার্য দিক যে রাষ্ট্রের মধ্যে নাগরিকরা একটি সাধারণ ভাষা ব্যবহার করে এবং সেই ভাষার মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। এতে ঐতিহ্যগত সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং নতুন এক আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।    

এছাড়া, গেলনার বলেন যে, জাতীয়তাবাদের উত্থান শুধুমাত্র ভাষা বা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির ফল নয়, জাতীয়তাবাদের উত্থান একটি বৃহত্তর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতেও ঘটে। সমাজে যখন বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য তৈরি হয় এবং জনগণ ঐতিহ্যগত প্রথা থেকে বের হয়ে আসে, তখন রাষ্ট্রের একীভূত ধারণা এবং জাতীয় সংহতির ধারণা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।গেলনারের তত্ত্ব আধুনিক রাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদের মধ্যে সম্পর্কের গভীর বিশ্লেষণ প্রদান করে, যেখানে শিক্ষা এবং ভাষার পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

গ। আর্নেস্ট গেলনারের জাতীয়তাবাদ ও উচ্চ সংস্কৃতি (Nationalism and High Culture) 

আর্নেস্ট গেলনারের মতে, জাতীয়তাবাদ (Nationalism) মূলত আধুনিকায়নের ফল এবং এটি শিল্পায়নের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তার মতে, জাতীয়তাবাদ কোনো প্রাকৃতিক বা ঈশ্বরপ্রদত্ত বিষয় নয়, বরং এটি একটি সমাজের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের মাধ্যমে গঠিত হয়। আগের কৃষিভিত্তিক সমাজগুলো ছিল স্থানীয় ও বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল, যেখানে বিভিন্ন ছোট ছোট গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে পরিচালিত হতো। কিন্তু আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে জাতীয়তাবাদ তখনই বিকশিত হয় যখন একটি অভিন্ন উচ্চ সংস্কৃতি (high culture) রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই উচ্চ সংস্কৃতি তৈরি হয় শিক্ষাব্যবস্থা, ভাষার মানকরণ, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে। 

গেলনার বলেন, আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা, ভাষার মানকরণ এবং সাংস্কৃতিক একীকরণ অপরিহার্য। এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের জনগণ একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয় লাভ করে, যা জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত শিক্ষা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে। ভারতীয় সমাজে ইংরেজি ভাষা, সাংবিধানিক শাসন, আধুনিক প্রশাসন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রবেশ করে, যা পরে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য গঠনে সহায়ক হয়। যদিও ভারতীয়রা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল, তারা ব্রিটিশ সংস্কৃতির কিছু উপাদান গ্রহণ করেছিল, যা আধুনিক ভারতের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একইভাবে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদ তখনই গড়ে ওঠে যখন শিক্ষার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে একটি অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

গেলনার বলেন যে জাতীয়তাবাদ আসলে পূর্ববর্তী স্থানীয় সংস্কৃতিগুলোর পরিবর্তিত রূপ। এটি লোকসংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে গঠিত হলেও, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি নতুন, শিক্ষা-নির্ভর, আধুনিক উচ্চ সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠার ফল। জাতীয়তাবাদ কেবল আবেগের বিষয় নয়; বরং এটি শিল্পায়ন এবং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কারণে গড়ে ওঠে, যেখানে শিক্ষা, ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐক্য রাজনীতির বৈধতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। 

ঘ। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের কল্পিত সম্প্রদায়  (“Nationalism and imagined Communities”) 

Benedict Anderson জাতীয়তাবাদকে "Imagined Community" হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে মানুষ নিজেদের একটি কল্পিত সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে কল্পনা করে। অর্থাৎ, একই জাতির সবাই একে অপরকে চিনতে না পারলেও তারা একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয়ে বিশ্বাসী হয়। তিনি দেখান যে মুদ্রণযন্ত্রের (Printing Press) আবিষ্কার এবং পুঁজিবাদ (Capitalism) এই জাতীয় চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

পূর্বে, ল্যাটিনের মতো ভাষাগুলোকেই জ্ঞানের একমাত্র উৎস হিসেবে ধরা হতো, রাজারা "ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট" বলে গণ্য হতেন, এবং মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে একই ধারণা প্রচলিত ছিল। তবে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও মুদ্রণযন্ত্রের প্রসারে স্থানীয় ভাষাগুলো (Local Languages/ Vernaculars/ Dialects) জনপ্রিয় হয়, ফলে মানুষের মাঝে একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয়ের জন্ম হয়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সে একসময় ব্রেটন (Breton), বার্গান্ডিয়ান (Burgundian) ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত ছিল, কিন্তু ছাপাখানার মাধ্যমে ফরাসি ভাষা প্রধান হয়ে ওঠে, যা ফরাসি জাতীয়তাবাদ গঠনে সহায়ক হয়।

বই বিক্রেতারা বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য ল্যাটিনের পরিবর্তে স্থানীয় ভাষায় বই প্রকাশ করতে শুরু করেন। যেমন, মার্টিন লুথার তার ৯৫টি থিসিস জার্মান ভাষায় লিখে সাধারণ জনগণের কাছে পৌছে দেন, যা জার্মান ভাষাকে শক্তিশালী করে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম দেয়। ইংল্যান্ডেও নরম্যান ফরাসির প্রভাব থাকলেও, পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষা আদালত ও প্রশাসনের ভাষা হয়ে ওঠে। 

মুদ্রণযন্ত্র ও জাতীয় চেতনার বিকাশঃ

১) মুদ্রণযন্ত্র মানুষকে একই ভাষায় এক সুতোয় গাঁথে যা তাদের মাঝে জাতীয় সংহতির জন্ম দেয়।
২) মুদ্রণযন্ত্র ভাষার স্থায়িত্ব এনে দেয়, ফলে মানুষের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চেতনা গড়ে ওঠে।
৩) মুদ্রণযন্ত্রের প্রভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ভাষা তৈরি হয়, যা জাতি গঠনে সহায়তা করে। 
৪) মুদ্রণযন্ত্র ও পুঁজিবাদের কারণে স্থানীয় ভাষাগুলোর বিকাশ ঘটে, যা জাতীয় পরিচয় ও জাতির গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ঙ। আন্থনি ডি স্মিথের দ্বৈত বৈধতার সংকট (Crisis of Dual Legitimation)  

কিছু বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষাবিদ-রাজনীতিবিদরা ধর্মের কিছু মৌলিক ধারণাকে সামাজিক অগ্রগতি এবং বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী শিক্ষা মাধ্যমে একত্রিত করার ব্যক্তিগত উপায় খুঁজে পেয়েছেন। তবুও, ধর্মীয় কর্তৃত্বের মাধ্যমে শাসিত সামাজিক কাঠামো অথবা বৈজ্ঞানিক রাষ্ট্রের 'যুক্তি-আইনি' কর্তৃত্বের মধ্যে মৌলিক পছন্দটি, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক স্তরে, মূলভাবেই রয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে, আরও বেশি মানুষ এই দুটি মৌলিক নীতির মধ্যে কোনো এক ধরনের পছন্দ বা সঙ্গতি স্থাপনের প্রয়োজন অনুভব করেছে এবং এর ফলে বিশ্বের মধ্যে দ্বৈততা সমস্যা উদ্ভূত হয়েছে।

Anthony D. Smith-এর The Crisis of Dual Legitimation তত্ত্ব অনুসারে, আধুনিক সমাজে ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। অনেকেই ধর্মীয় মূল্যবোধ ধরে রাখতে চায়, আবার কেউ কেউ বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে সমাজকে গড়ে তুলতে চায়। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তিনটি পথ দেখা যায়— 
১. নাব্য-ঐতিহ্যবাদ ( Neo-traditionalism)
২. আত্মীকরণবাদ (Assimilation)
৩.সংস্কারবাদ (Reformism)

প্রথমত, নব্য-ঐতিহ্যবাদ (Neo-traditionalism), যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ও সংগঠনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, কিন্তু ধর্মীয় মূলনীতিগুলো অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। উদাহরণ হিসেবে জামালউদ্দীন আল-আফগানির প্যান-ইসলামিক আন্দোলন বলা যায়, যেখানে তিনি মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে আধুনিক প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন। 
দ্বিতীয়ত, আত্মীকরণবাদ (Assimilation), যেখানে মানুষ সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক চিন্তাকে গ্রহণ করে এবং আধুনিক রাষ্ট্রের কাঠামোর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। উদাহরণ হিসেবে তুরস্কের মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ককে বলা যায়, যিনি ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কারের মাধ্যমে তুরস্ককে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করেছিলেন।
তৃতীয়ত, সংস্কারবাদ (Reformism), যেখানে ধর্ম ও আধুনিকতা একসঙ্গে মিলিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেওয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের কাজ উল্লেখ করা যায়, যিনি মুসলিমদের জন্য আধুনিক শিক্ষা চালু করলেও ইসলামের মৌলিক নীতিগুলো বজায় রেখেছিলেন।

এই তিনটি পথের যেকোনো একটিকে অনুসরণ করে সমাজে ধর্ম ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য আনা সম্ভব।

মূল্যায়ন 

জাতীয়তাবাদ একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণা যা একটি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূখন্ড এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এটি একটি ঐক্য, আত্মপরিচয় এবং স্বাধীনতার অনুভূতি জাগ্রত করে, যার মাধ্যমে জনগণ নিজেদের একই জাতির অংশ হিসেবে উপলব্ধি করে এবং নিজস্ব রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম করে।

এলি কেদুরি, এর্নেস্ট গেলনার এবং বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের মতো তাত্ত্বিকরা জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা দিয়েছেন। কেদুরি তার 'Nationalism and Self-determination' গ্রন্থে জাতীয়তাবাদকে ইউরোপীয় ধারণা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং দেখান যে ভাষা, ধর্ম বা সংস্কৃতির মাধ্যমে জাতি নির্ধারণ করা যথেষ্ট নয়, বরং এটি একটি গভীর রাজনৈতিক ধারণা যা রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। গেলনার বলেন যে, জাতীয়তাবাদ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শিল্পায়নের ফলাফল, যেখানে একটি অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ভাষার মাধ্যমে জাতির পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, অ্যান্ডারসন জাতীয়তাবাদকে "Imagined Community" হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে মানুষ নিজেদের একটি কল্পিত সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে দেখে এবং ঐক্যবদ্ধ হয়, এমনকি তারা একে অপরকে চিনতে না পারলেও। 

এছাড়া, জাতীয়তাবাদে কেবল একটি আবেগ নয়, এটি আধুনিক রাষ্ট্র, অর্থনীতি, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক একীকরণের ফল, যা জনগণের মধ্যে শক্তিশালী জাতীয় চেতনা তৈরি করে।




-লিখেছেন
জাকিয়া খাতুন 
৪র্থ বর্ষ, স্নাতক (সম্মান)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়



এই অধ্যায়ের অন্য লেখাগুলোঃ 







No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.