একটি জাতিগোষ্ঠী যে প্রক্রিয়া গঠিত হয় (Ethnic Formation)
জাতিগোষ্ঠী গঠন প্রক্রিয়া:
জাতিগোষ্ঠী হওয়ার জন্য ছয়টি উপাদান বা বৈশিষ্ট্য যেমন আবশ্যক, তেমনি কোন গোষ্ঠিকে জাতিগোষ্ঠী হিসেবে আত্ম-প্রকাশ করার জন্য তাকে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়। ১৯৮৬ সালে Anthony D. Smith তার রচিত বিখ্যাত The Ethnic Origins of Nations গ্রন্থে একটি জাতিগোষ্ঠী কিভাবে গঠিত হবে তা নিয়ে আলোচনা করেন। স্মিথের ভাষায়, জাতিগোষ্ঠী তিনভাবে বা তিনটি উপলক্ষকে পুঁজি করে গড়ে উঠতে পারে। যথা: (১) স্থায়ীভাবে বসবাস (Sedentarization) ও স্মৃতিকাতরতা (Nostalgia), (২) প্রধান প্রধান ধর্ম (Organized religions), এবং (৩) আন্তঃরাষ্ট্রীয় কোন্দল (Inter-state Warfare)। এই তিনভাবের যেকোনো একভাবে, বা দুইভাবে, বা উভয়ভাবেই কোন জাতিগোষ্ঠী গড়ে উঠতে পারে।
১। Sedentarization and Nostalgia
Sedentarization এবং Nostalgia দুটি স্বতন্ত্র ধারণা। তবে এদের মাঝে যোগসূত্র রয়েছে।
ক। Sedentarization (স্থায়ীজীবন যাপন)
Sedentarization শব্দটির পারিভাষিক অর্থ যে প্রক্রিয়ায় কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস/ অবস্থান শুরু হয়। যাযাবর বা আধা-যাযাবর জীবনধারা থেকে স্থায়ী জীবনধারায় রূপান্তরকে জাতিগত ও জাতীয় পরিচয় গঠনের বৃহত্তর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা যায়। Sedentarization দ্বারা স্থায়ীভাবে বসবাসের একটি প্রক্রিয়াকে ইঙ্গিত করা হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্যভাবে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের অন্তর্ভুক্তিও লক্ষ্য করা যায়। এভাবে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রূপান্তর একটি গোষ্ঠির Sedentarization বা স্থায়ী জীবনযাপন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং পাশাপাশি উক্ত গোষ্ঠীর সম্মিলিত আইডেন্টিটি বা পরিচয়কেও প্রভাবিত করে । স্মিথের ভাষায়, জাতিগত ধারণা বিকাশের পূর্বে প্রাক-আধুনিক জাতিগত সম্প্রদায়গুলোর অনেকেই ছিলো যাযাবর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই যাযাবর গোষ্ঠীগুলো (Nomads) যখন স্থায়ী জীবনযাপন শুরু করে তখন তাদর সম্মিলিত পরিচয়েও পরিবর্তন আসে। এন্থনি ডী স্মিথ তাঁর গবেষণায় স্থায়ী বসবাসকে জাতিগোষ্ঠীর উত্থান ও সংহতির একটি মৌলিক ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে অহমীয়া আসামের কথা বলা যায়। Upper Assam বা উচ্চ আসামের অধিবাসী জাতিগতভাবে অসমীয়া বা অহমীয়া যারা একসময় বার্মার অন্তর্ভুক্ত ছিলো এবং জাতিগতভাবে থাই রেসের অন্তর্ভুক্ত। এই অসমীয়রা দীর্ঘদিন উচ্চ আসামের পাহাড়ে যাযাবরের জীবন যাপন করেছে। পরে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে আহোম সাম্রাজ্যের (১৩২০–১৮২৬) অধীনে। তবে যখন ব্রিটিশরা আসাম দখল করে আসামের স্থানীয় আইনের বিপরীতে বিভিন্ন ঔপনিবেশিক আইনের প্রচলন ঘটায় এবং Lower Assam বা নিম্ন আসামে অ-অসমীয়দের অভিবাসন ঘটায় তখন অসমীয়দের মাঝে নিজেদের ভাষা ও ভূখণ্ড কেন্দ্রিক জাতিগোষ্ঠীর চেতনা জাগ্রত হয়। এই জাতিগোষ্ঠীর চেতনাই পরবর্তীতে অসমীয়া জাতীয়তাবাদ বিকাশে সাহায্য করে। ফলে, বর্তমানে ভারতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বাহিরে অসমীয়া জাতীয়তাবাদও গভীরভাবে লক্ষণীয়।
Sedentarization বা স্থায়ীভাবে বসবাস, জাতিগত পরিচয়ের আঞ্চলিকরূপ প্রকাশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সাথে যাযাবর গোষ্ঠীগুলির আরও গভীর সংযোগ স্থাপন হয়। ফলে, আঞ্চলিক পরিচিতি জাতিগোষ্ঠী গঠন প্রক্রিয়ার ও জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়কে আরও দৃঢ় করার এক কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও, অত্র অঞ্চলের স্থানীয় সাংস্কৃতির প্রভাবে জাতিগোষ্ঠীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো নানাভাবে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়। ফলে, জাতিগোষ্ঠী আরও ম্যাচুউর হয়ে ওঠে যাতে সে নিজেকে আরও জটিল ও সক্ষম সামাজিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের বেদুইনদের কথা বলা যায় যারা হাজার বছর ধরে মরুর বুকে যাযাবর জীবনযাপন করেছেন। আধুনিকতার ছোয়ায় আরব বিশ্বেও নিত্যনতুন পরিবর্তন আসতে থাকে। ফলে, অধিকাংশ আরব স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। একইভাবে বেদুইনরাও ক্রমে তাদের যাযাবর জীবনযাপন ত্যাগ করে (যদিও এখনো ক্ষেত্রবিশেষ তারা বেদুইন প্রথা চর্চা করে), স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এহেন পরিবর্তনে বেদুইনদের জীবনধারায় ব্যপক পরিবর্তন সাধিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক কাঠামো, এবং সাংস্কৃতিক চর্চার রূপান্তর ইত্যাদি।
এছাড়াও, উদাহরণ হিসেবে গ্রেট মঙ্গোলিয়ানদের কথা বলা যেতে পারে যারা বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জলবায়ু পরিবর্তন, আঞ্চলিক আধুনিকায়ন, ভূরাজনীতি ও সম্পদের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি মঙ্গোলিয়ানদের ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবনের প্রভাব বিস্তার করে। ফলে অনেক যাযাবর মঙ্গোলিয়ান শহরে স্থানান্তরিত হয় বা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন শুরু করে করে।এরূপে তাদের ঐতিহ্যবাহী নানা সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক চর্চায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।
খ। স্মৃতিকাতরতা (Nostalgia)
স্মৃতিকাতরতা (Nostalgia) মানুষকে যেমন নিজের অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, সে অতীতের সাথে মানুষকে আরও গভীর আবেগে বাঁধতে চায়। জাতিগোষ্ঠী গঠনের ক্ষেত্রেও স্মৃতিকাতরতা জাতিগত পরিচয় রক্ষণাবেক্ষণ এবং জাতিগোষ্ঠীর উৎসের সাথে পুনর্মিলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন একটি জাতিগোষ্ঠী অন্য জায়গায় বসতি স্থাপন করে তখন তাদের অতীত ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পৌরাণিক কাহিনী, স্মৃতি এবং ভূখণ্ডের প্রতি মায়া ইত্যাদি স্মরণে তাদের মাঝে স্মৃতিকাতরতা নামক আবেগের জন্ম হয়ে থাকে। তারা মূলত তাদের অতীতকে স্মরণ করে, যে অতীত তাদের ভাষায় সবচেয়ে গৌরবময়, এবং যে অতীত তাদেরকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে তোলে অর্থাৎ জাতিগত গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা ইহুদী জাতির কথা বলতে পারি। ইহুদীদের নিকট জেরুজালেম সংলগ্ন ইস্রায়েলের অঞ্চল পবিত্র ভূমি (Sacred Land) বা তাদের ধর্মীয় বয়ান অনুসারে প্রতিশ্রুত ভূমি (Promised Land) হিসেবে বিবেচিত। ইহুদীদের হাজার বছরের বঞ্চনা ও অভিবাসনের ইতিহাস তাদের ঐ ধর্মীয় বয়ানের দিকে ধাবিত করেছে এবং তাদেরকে একত্র করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ইহুদীদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেমের প্রতি প্রবল স্মৃতিকাতরতা ও তাদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা ইহুদীদের একটি জাতিগোষ্ঠি হিসেবে গড়ে উঠতে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে ইসরায়েলে বসতি স্থাপনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আবার যদি পূর্বের উদাহরণের বেদুইন ও মঙ্গোলিয়ানদের কথা বলি যারা যাযাবর জীবন ত্যাগ করে শহুরে স্থায়ী জীবনযাপনকে গ্রহণ করেছে এবং তাদের অতীতের নানা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করেছে, তাদের মধ্যেও তাদের অতীত জীবনের স্মৃতিকাতরতা তাদের জাতিগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রকে আরও দৃঢ় করেছে।
উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায় স্থায়ীভাবে জীবন যাপন ও স্মৃতিকাতরতার মাঝে বেশ গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যাকে Anthony D. Smith আন্তঃসংযোগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। স্মিথের ভাষায়, সেডেন্টারাইজেশন হচ্ছে যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী নিবাসে রূপান্তরের একটি প্রক্রিয়া যা জাতিগত পরিচয়কে প্রভাবিত করে এবং নস্টালজিয়া হল সে প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটকে স্মরণ করা যা একটি গোষ্ঠীর সম্মিলিত স্মৃতি ও অনুভূতিকে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২। ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠী গঠন
ধর্মও জাতিগোষ্ঠী গঠনে সহায়তা করে থাকে। কেননা ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এবং পবিত্র প্রতীক ইত্যাদি একটি গোষ্ঠীকে একত্রিত করে থাকে। এছাড়া ধর্মীয় উপকথা (Myth), পবিত্র স্থান (Sacred Place), পবিত্র বাণী (Sacred Scripture), ধর্মীয় নেতৃত্ব (Religious Leadership) এবং প্রতীক (Symbol) জাতিগোষ্ঠির ঐতিহাসিক স্মৃতি এবং যৌথ পরিচয়ের অনুভূতিতে অবদান রাখে। উদাহরণ হিসেবে আমরা আবারও ইহুদী ধর্মের কথা বলতে পারি। ইহুদী গ্রন্থ তামলুক কেন্দ্রিক পৌরাণিক ইহুদী কাহিনী যেমন স্যামসান নামক বীরের সাথে স্থানীয় ফিলিস্তিন রাজার বিরোধের কাহিনী; বা দাউদ ও মুসা আঃ- এর অলৌকিক শক্তি নিয়ে নানা পৌরাণিক ইহুদী কাহিনী, ইহুদী ধর্মের প্রতীক—বিশেষত "মাগেন ডেভিড" (ডেভিডের তাবিজ)—ইসরায়েল রাষ্ট্রের পতাকায় ব্যবহার, জেরুজালেমকে ইহুদীদের পবিত্র স্থান ও প্রতিশ্রুত ভূমি বলে প্রচার, এবং নানা আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে (যেমনঃ পশ্চিম দেওয়ালে মাথা ঠোকা ) ইত্যাদিকে পুঁজি করে ইহুদী ধর্ম হাজার বছর ধরে ইহুদী জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় সংরক্ষণ করেছে। আবার, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এবং সামাজিক কাঠামো ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীকে পৃথক করেছে। ভারতীয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্ম তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বিকাশে প্রভাব বিস্তার করে। এক্ষেত্রে পবিত্র গ্রন্থ বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, দীপাবলি এবং হোলি উৎসব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আবার যদি খৃষ্টানদের কথা বলি, তাহলে আমরা কসোভোর কথা বলতে পারি বা আর্মেনিয়ার কথা বলতে পারি যাদের জাতিগোষ্ঠী পরিচয় বিনির্মাণে খৃষ্ট ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একইভাবে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য ও পরবর্তীতে পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর জাতিসত্তা বিকাশেও খৃষ্ট ধর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও, মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, তিব্বতীয়, থাই এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে জাতিগত পরিচয় গঠনে বৌদ্ধ ধর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে, ইসলাম ধর্ম আরব জাতিগত পরিচয়কে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। ইসলাম ধর্মের মৌলিক গ্রন্থ কুরআন ও হাদিস, হযরত মুহাম্মদ (স.) এর জীবনী এবং খিলাফতের ইতিহাস ইত্যাদি আরবদের মধ্যে পরিচয় গঠনে ও যৌথ অনুভূতি সৃষ্টিতে অবদান রাখে। এছাড়া আরবি ভাষা জাতিগত ও ধর্মীয় বন্ধনকে শক্তিশালী করেছে। উপরন্তু, হজ্জ যাত্রা ঐক্য ও সম্মিলিত পরিচয়ের শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে কাজ করে।
৩। আন্ত:রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ ও জাতিগোষ্ঠী গঠন
Anthony D. Smith জাতিগত পরিচয় গঠন ও দৃঢ় করণে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বা আন্তঃজাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার যুদ্ধের ভূমিকা উল্লেখ করেছেন। স্মিথের মতে, জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে সম্মিলিত পরিচয়ের দৃঢ় অনুভূতির বিকাশে যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়াটি বিভিন্নভাবে সংগঠিত হয়ে থাকে। যথা:
ক। বাহ্যিক হুমকি এবং অভ্যন্তরীণ সংহতি:
একটি রাষ্ট্র যদি বাহ্যিক হুমকির সম্মুখীন হয় তবে সেই রাষ্ট্রের জনগণের এবং যদি জাতিগোষ্ঠীর কথা বলি সে গোষ্ঠির সকল মানুষের মাঝে এক অভিন্ন লক্ষ্য হাসিলে দৃঢ় ঐক্যের অনুভূতি তৈরি হয়। এই ঐক্যের অনুভতি তাদের আরও সংঘবদ্ধ করে তোলে যা তাদের জাতিগোষ্ঠী বিকাশে অতি দরকারি। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষিত ও উপেক্ষিত হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তি পেতে এবং বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে [পরবর্তীতে এই উদাহরণটি আরও বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা হবে]।
খ। উৎপত্তি ও বীরত্বগাথা:
স্মিথ জাতিগত পরিচয় গঠনে পৌরাণিক কাহিনী এবং ঐতিহাসিক বর্ণনার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। পৌরাণিক কাহিনী জাতিগত পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্মিথের মতে, পৌরাণিক কাহিনী জাতির ঐতিহ্য এবং গৌরবময় অতীতের স্মৃতি বহন করে। এগুলি একটি জাতির ঐতিহাসিক ধারাকে সংরক্ষণ এবং বিকাশে সহায়তা করে। পৌরাণিক কাহিনীতে গৌরবময় এবং ঐতিহাসিক অর্জন অথবা সংগ্রামের গল্প থাকে, যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখে এবং তাদের উদ্দেশ্য ও আদর্শের প্রতি আস্থা জোগায়। স্মিথের মতে, একটি জাতিগোষ্ঠীর গঠন বা ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঐতিহাসিক স্মৃতি সংরক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এসব পৌরাণিক কাহিনীগুলি ভূমিকা পালন করে। এই পৌরাণিক কাহিণীতে জাতিগোষ্ঠীর সূচনা/ উৎস নিয়েও বহু কাহিনী এবং সে জাতিগোষ্ঠী গত হয়ে যাওয়া বহু বীরদের কাহিনীও লিপিবদ্ধ থাকে, যা সে জাতিগোষ্ঠীকে আরও আত্ম-বিশ্বাসী করে তোলে।
উদাহরণ হিসেবে বাঙালিদের উৎস বিশ্লেষণে বাঙালিকে একটি মিশ্র জাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ, আর্য, অনার্য, মঙ্গোলয়েড, দ্রাবির, অস্ট্রিক, আরব প্রভৃতি কত নানা জাতের মানুষের মিশ্রণে বাঙালি নৃগোষ্ঠি গড়ে উঠেছে তা প্রকাশ পায়। আর যদি বীরদের কথা বলতে হয় আমরা তিতুমিরের কথা বলতে পারি, যিনি ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন; আবার আরও পূর্বে আমরা পাল রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের কথা বলতে পারি যার দূরদর্শী ও সাহসী পদক্ষেপে প্রাচীন বাঙলা অঞ্চলের অরাজকতার ইতি ঘটেছিলো; আমরা বারো-ভুঁইয়াদের কথাও বলতে পারি কিভাবে তারা মোঘল শাসনের বিরোধিতা করে বাংলায় সায়ত্ত্বশাসন বজায় রেখেছিলো ইত্যাদি। এহেন বীরত্বগাথা বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করে।
গ। প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক কাঠামো :
যেমনটি দার্শনিক হেগেল বলেছিলেন যে সমাজকে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়। এই সমাজের ইতিহাস- এই সমাজের আধুনিকতার ইতিহাস হল দ্বন্দ্বের ইতিহাস। দ্বন্দ্বের ন্যায়, প্রতিটি যুদ্ধও প্রেক্ষাপটই শুধু পালটে দেয় না, যুদ্ধের প্রতিটি পক্ষকে আরও ম্যাচিউর করে। এই বয়ানটি জাতিগোষ্ঠী বিকাশেও সমানভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ, আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ একটি জাতিগোষ্ঠীকে আরও কেন্দ্রীভূত এবং সংগঠিত রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ ঘটানোর কথা বলে-সে হোক যুদ্ধে বিজিত বা পরাজিত। কারণ প্রতিটি যুদ্ধের পিছনে যে কারণগুলো থাকে, যেমনঃ সমন্বিত প্রতিরক্ষা, রাজনৈতিক মুক্তি, এবং সম্পদ সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি অর্জনে জাতিগোষ্ঠীকে নিজেকে আরও সংগঠিত, জটিল ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান গঠনের দিকে ধাবিত করে, যা জাতিগত পরিচয়কে আরও শক্তিশালী করে।
উদাহরণ হিসেবে কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর কথা বলা যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসী হিসেবে কুর্দিদের পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ ও ফরাসী ম্যান্ডেটের আদলে কুর্দিদের বাসস্থান পরিবর্তন হয়ে যায়। কুর্দিরা ইরাক, ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়া অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে, অত্র রাষ্ট্রের সাথে আদিবাসী কুর্দিদের যুদ্ধ ও সংঘাতের সূচনা ঘটে। বিশেষ করে, তুরস্ক ও ইরাকে কুর্দিরা নিজেদের জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়কে আরও শক্ত করতে তুরস্ক ও ইরাকের সরকারের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। প্রতিটি যুদ্ধ কুর্দিকে আরও বেশি সংগঠিত করছে এবং তার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও জটিল ও দক্ষ করে তুলেছে। এর অন্যতম উদাহরণ তুরস্কে কুর্দিদের পিকেকে নামক রাজনৈতিক দল এবং ইরাকের ইব্রিল অঞ্চলকে কুর্দিস্তান নামে ঘোষণা। অর্থাৎ, এরূপ যুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতিগোষ্ঠী নিজের পরিচয়কে ও নিজের সাংগঠনিক দক্ষতাকে আরও দৃঢ় করতে পারে।
ঘ। আঞ্চলিক সীমানা এবং পবিত্র স্থান :
দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধ আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ এবং নিরাপদ করার মাধ্যমে জাতিগত পরিচয়কে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। যুদ্ধের ফলে জনগণ তাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ভাষা নিয়ে আরও আবেগী হয়ে ওঠে এবং সেগুলো রক্ষায় নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সীমারেখা চিহ্নিত হয় তা একটি জাতিকে অন্যের থেকে আলাদা করে এবং এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রক্ষায় তাদের মাঝে সংগ্রামী মনোভাব গড়ে তোলে। এভাবে, যুদ্ধের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা একটি জাতিগোষ্ঠির নতুন ইতিহাস রচনা করে, যা জনগণের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। এছাড়া, আঞ্চলিকতা ও সে অঞ্চলে প্রাপ্ত সম্পদের নিয়ন্ত্রণও জাতিগত পরিচয়ের সাথে যুক্ত এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধে সে বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। এভাবে, দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধ কেবল আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ নয়, বরং জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে, যা পরবর্তী প্রজন্মে গর্ব ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে।
উদাহরণ হিসেবে যদি বাঙালিদের কথা বলি, মোগলদের সাথে বাঙালিদের দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ, ইংরেজদের সাথে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, পাকিস্তানিদের সাথে বাঙালিদের দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের কারণ ছিলো জাতিগোষ্ঠী হিসেবে নতুন সীমারেখা নির্ধারণ এবং অন্যদের থেকে বাঙালির স্বতন্ত্র পরিচয়কে রক্ষা। আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা ও সম্পদের উপর বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে এরূপ দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের সূচনা হয়েছিলো। সে দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের ফলে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর আত্ম-পরিচয় আরও দৃঢ় হয়েছে যা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে গর্ব ও আত্ম-বিশ্বাস সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, বর্তমানের ২৪ এর অভ্যুত্থানেও নতুন প্রজন্ম বাঙালির দ্বন্দ্ব, আন্দোলন ও যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে আত্মস্থ করেছে এবং ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে।
এভাবে বহিরাগত সংঘাত যে জাতিগত পরিচয় তৈরি এবং দৃঢ় করতে পারে Anthony D. Smith তা তার The Ethnic Origins of Nations গ্রন্থে উল্লেখ করেছে এবং বলেছেন আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ জাতিগোষ্ঠী গঠন প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
লিখেছেন
লামিয়া আফরিন
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


No comments