১৯৬০ এর দশকে যখন স্নায়ুযুদ্ধ নতুন ধাপে পা দেয়, স্নায়ুযুদ্ধ সংক্রান্ত রাজনৈতিক আলাপচারিতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে। এর পূর্বে, অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নেই আফ্রিকা ও এশিয়ায় ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো সায়ত্ত্বশাসনের দাবী জানাতে থাকে। ইউরোপীয় ঔপনিবশিকেরা সেই দাবীকে অগ্রাহ্য করে এবং আন্দোলনকারীদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, তখন অনন্যোপায়ে আন্দোলনকারীরা স্বাধীকার আন্দোলনের নামে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। তারা ফরাসি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও কিছুক্ষেত্রে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী (Premier) নিকিতা খ্রুশচেভ (Nikita Khrushchev) এরূপ সশস্ত্র সংঘাতকে পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার এক মহা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। ফলাফলরূপে, সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে সমর্থন করে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতে থাকে।
সোভিয়েতের এরূপ পদক্ষেপকে যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহের চোখে দেখে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা ছিলো সোভিয়েতের এরূপ সমর্থন ও সাহায্যে সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ এবং স্বাধীনতাকামীরা কমিউনিজমের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিবে যা সোভিয়েতকে ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত দিক বিবেচনায় এগিয়ে রাখবে। ফলে, সোভিয়েতের এরূপ বিস্তার রোধে যুক্তরাষ্ট্র নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে যার মধ্যে ডমিনো তত্ত্ব ছিলো অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রও এরূপ স্বাধীকার আন্দোলনে তার সামরিক সাহায্য প্রদান শুরু করে, এবং আমেরিকান রাষ্ট্রপ্রধান ও বিশেষজ্ঞরা সোভিয়েত বিস্তার রোধে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।
তবে, সোভিয়েত বিস্তার রোধে আমেরিকার সরকার ও স্ক্লারদের একটি সংকটে পড়তে হয়। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইউরোপ থেকে বিশ্বক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সরে যায়, আমেরিকা তখন বিশ্বক্ষমতার হাল নতুন ধারক হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবে, নতুন ধারক হিসেবে বিশ্বক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজের অবস্থান টেঁকসই করতে ইউরোপ যেন আর ক্ষমতার কেন্দ্রে না আসতে পারে তা নিশ্চিত করতে হয়।
ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিদের আরও দুর্বল করতে আমেরিকা তাদের উপনিবেশদের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দেওয়া শুরু করে। কিন্তু, সোভিয়েত ইউনিয়নও যখন সামরিকভাবে স্বাধীকার আন্দোলনে সাহায্য প্রদান শুরু করে তখন আমেরিকার জন্য বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে, কারণ ততক্ষণে সোভিয়েতের সাথে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
সোভিয়েকে কোণঠাসা করার যে পলিসি যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করে তা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির পক্ষে নিয়ে যায়। ফলে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর স্বাধীনতার পক্ষে যখন সোভিয়েত সাহায্য করছে সে প্রেক্ষাপটে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে নীতি গ্রহণ করাকে তৃতীয় বিশ্বের সেই স্বাধীনতাকামী দেশগুলো ভালোভাবে নেয়নি। এখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রেক্ষাপটে সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা যাবে।
তবে, স্নায়ুযুদ্ধকালে ইন্দো-চীন অঞ্চলে ফরাসি উপনিবেশভুক্ত দেশগুলোর স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন না করে, বিপরীতে ফরাসিদের পক্ষ গ্রহণ করায় যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বাজেভাবে সমালোচিত হয়েছে। এমনকি, ১৯৫৪ সালে ফরাসি সরকার ইন্দো-চীন অঞ্চল ছেড়ে গেলেও, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে রয়ে যায়, এবং তার ফলে রক্তক্ষয়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধ সারা পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের মহাশক্তি বা হেজমন মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের তীব্রতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পালটে দেয়, এবং যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধনীতি নিয়ে নানা সমালোচনা তৈরি থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ভিয়েতনাম নিয়ে মহা বিতর্কের সূচনা হয়ঃ কেন যুক্তরাষ্ট্র উপনিবেশ অঞ্চলের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও উন্নয়নে সহযোগিতা করছে না? কেন যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি যুদ্ধে জড়াচ্ছে? কোন ধরণের জাতীয় স্বার্থ এরূপ যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র লাভ করবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম যুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকেণ, এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের এরূপ আচারণের কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অসম পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে দায়ী করেন, এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নব্য-সাম্রাজ্যবাদী (Neo-Imperialist) রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দেন। এই দলের কতিপয় অধ্যাপক যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী আচরণ ব্যাক্ষায় কার্ল মার্কসের মিথ্যা চেতনা (False Consciousness) কনসেপ্টের সাহায্য নেন।
মার্কসবাদের মিথ্যা চেতনা (False Consciousness) অনুযায়ী সমাজের কিছু শ্রেণী, বিশেষত শ্রমিক শ্রেণী, তাদের প্রকৃত স্বার্থবিরোধী এমন মতবাদ, মূল্যবোধ বা চিন্তাকে সমর্থন করে যা শাসক শ্রেণীর (বুর্জোয়া বা পুঁজিপতির) স্বার্থে আদায়কে সহজ করে দেয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণি এরূপ বয়ান তৈরি করে। মার্কসবাদে শ্রমিক শ্রেণীর শোষণ এবং শাসক শ্রেণীর ক্ষমতা বজায় রাখার উপায় ব্যাখ্যা করতে উক্ত কনসেপ্টটি ব্যবহৃত হয়।
এই কনসেপ্ট অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদ নির্ভর সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবকে প্রতিষ্ঠিত করতে এরূপ মিথ্যা চেতনা প্রচার করে এবং সেগুলোকে সার্বজনীন সত্য হিসেবে বর্ণনা করে চলে। শুধু অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীরাই নন, এরূপ বক্তব্য আসতে থাকে অ-পশ্চিমীয় বিভিন্ন প্রখ্যাত নেতৃবৃন্দ থেকে, যাদের মধ্যে চীনের মাও সেতুং, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো, বিপ্লবী চে গুয়েভারা, এবং ভিয়েতনামের হো চি মিন উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রেডিক্যাল (Radical) ঘরনার স্ক্লাররা এই মহান লিডারদের চিন্তা ও দর্শন দ্বারা দারুনভাবে প্রভাবিত হন।
কুইন্সি ওয়াইট প্রদত্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পাঠের উপযোগী তিনটি দর্শনের (বিপ্লববাদ- Revolutionism, যুক্তিবাদ- Rationalism ও বাস্তবাদ- Realism) ভিতর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নে রিয়েলিজম ও যুক্তিবাদ প্রভাব বিস্তার করে এবং বিপ্লববাদ দর্শন হিসেবে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছিলো। ফলে, স্নায়ুযুদ্ধের মাঝামাঝিতে উক্ত রেডিক্যাল ঘরনার স্কলার ও নেতৃবৃন্দের পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বয়ানের সাহায্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পাঠে নতুনত্ব আনয়নের চেষ্টা করা হয়, যার প্রধান কারণ ছিলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নে রিয়েলিজম ও যুক্তিবাদের পাশাপাশি বিপ্লববাদের প্রাধান্য বৃদ্ধি।
১৯৭০ এর দশকে ওয়াইট প্রদত্ত অত্র তিনটি দর্শনকে (বিপ্লববাদ- Revolutionism, যুক্তিবাদ- Rationalism ও বাস্তবাদ- Realism) আরও শক্ত ভিতে দাঁড় করান থমাস কুন (Thomas Kuhn)। তিনি “থ্রি প্যারাডিম (Three Paradigm)” নাম দিয়ে ওয়াইটের দর্শন তিনটিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করলেন। ওয়াইটের ব্যাক্ষাকে গ্রহণ করে থমাস কুন বললেন এই “থ্রি প্যারাডিম”- আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে সাহায্য করবে, কারণ এই তিনটি দর্শনের অন্তদর্শন (Ontology) একে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র বা আলাদা।
প্রথাগত শক্তি (Traditional Power) কনসেপ্টকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নে বিপ্লববাদী দর্শনের ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। প্রথাগত শক্তি (Traditional Power) কনসেপ্টের সংজ্ঞায়নে কিছু নির্দিষ্ট সম্পদের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেমনঃ সমরাস্ত্র, আর্থিক সম্পদ, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি। কিন্তু, বিপ্লববাদ ইউরোপ কেন্দ্রিক এরূপ সংজ্ঞায়নকে চ্যালেঞ্জ করে, এবং তৃতীয় বিশ্বকে পুঁজি করে নতুনভাবে শক্তি কনসেপ্টকে সংজ্ঞায়নের কথা বলে। এক্ষেত্রে বিপ্লববাদ উপনিবেশবাদ ও সংঘাত (কিভাবে ঔপনিবেশিক শাসন সংঘাতের জন্ম দেয়), এবং সম্পদ ও যুদ্ধ (কিভাবে সম্পদের অসম বণ্টন যুদ্ধকে উস্কে দেয়) ইত্যাদির আলোকে নতুন আঙ্গিকে শক্তি কনসেপ্টটির সংজ্ঞায়নের চেষ্টা চালায়।
বিপ্লববাদী তাত্ত্বিকদের ভাষায়, শক্তিকে সামাজিক সম্পর্কের আলোকেও সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। অর্থাৎ, সামাজিক কাঠামো বা সিস্টেমে একটি রাষ্ট্রের অবস্থান কোথায় সে অনুসারে সে রাষ্ট্রের শক্তিকে নির্দিষ্ট করা যায়, এবং শক্তি যত বেশি হবে রাষ্ট্রটি সে সিস্টেমের বিভিন্ন আইন-কানুন প্রণয়নে তত সক্ষম হবে। বিপ্লববাদীদের ভাষায়, অর্থনৈতিক শোষণের উদ্দেশ্যে উপনিবেশ স্থাপনের ফলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক পরিক্রমায় সর্বময় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
ফলে, আন্তর্জাতিক পরিক্রমায় অন্য যে রাষ্ট্রগুলো রয়েছে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী এমন একটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরি করতে চায় যা পরিচালিত হয় আন্তর্জাতিক অর্থনীতি কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সিস্টেমের আদলে। অর্থাৎ, বিপ্লববাদীদের ভাষায়, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নির্ভর একটি সিস্টেম তৈরি করে এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নির্ভর প্রতিটি রাষ্ট্রকে সে সিস্টেম অনুসরণে বাধ্য করে। ফলে, বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রকেই উক্ত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পুনরায় শোষিত হতে থাকে এবং তারা আরও দুর্বল ও সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একাডেমিক দুনিয়ায় এরূপ চক্রকে নব্য-উপনিবেশবাদ (Neocolonialism) বলা হয়, যার প্রধান উদাহরণ আফ্রিকা মহাদেশ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়ণ ও অনুধাবনে বিপ্লববাদ আরও বড় একটি পরিবর্তন আনেঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে তারা আন্তর্জাতিক সিস্টেম থেকে থেকে বিশ্লেষণের কথা বলে (Systemic level of analysis)। অর্থাৎ, রিয়েলিজমে যেখানে রাষ্ট্র কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কথা বলে, এবং যুক্তিবাদে যেমন ব্যক্তি কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কথা বলে, বিপ্লববাদ সেখানে বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনুধাবনে পাঠককে অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সিস্টেম লেভেল থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে।
এক্ষেত্রে, বিপ্লববাদের প্রধান টার্গেট ছিলো পুঁজিবাদ। তাই তারা বলতঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বুঝতে হলে আন্তর্জাতিক সিস্টেম যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে অর্থাৎ, পুঁজিবাদ, সেই পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে বুঝতে হবে। এহেন চিন্তাকে আরও শাণিত করতে বিপ্লববাদীরা সাম্রাজ্যবাদ (Theory of Imperialism) নামে নতুন এক তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। উল্লেখ্য, এই বিপ্লববাদীদের অনেকে নব্য-মার্কসবাদী (Neo-Marxist) বলেও সম্বোধন করেন, এবং পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন তত্ত্ব হিসেবে নব্য-মার্কসবাদ (Neo-Marxism) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
নব্য-মার্কসবাদীদের অন্যতম ছিলেন আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক (Andre Gunder Frank)। সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বের আলোকে ফ্রাংক আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে দুইটি ভাগে বিভক্ত করেন। তিনি বলেন এই দুইটি ভাগের একদম কেন্দ্রে বা প্রথম সারিতে (Core) রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র, দরিদ্রপীড়িত নির্ভরশীল রাষ্ট্র রয়েছে দ্বিতীয় সারিতে (Periphery)। তবে, ইম্যানুয়েল ওয়ালারেস্টান (Immanuel Wallerstein) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন তত্ত্ব হিসেবে নব্য-মার্কসবাদকে (Neo-Marxism) পরিচিত করান।
১৯৭৪ সালে রচিত ওয়ালারেস্টানের বিখ্যাত Modern World System গ্রন্থটিতে তিনি বিগত ৫০০ বছরের বিশ্ব ইতিহাসকে গভীর থেকে বিশ্লেষণ করেন, এবং তিনি বলেন এই দীর্ঘ ইতিহাসে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালিত হত ক্ষমতাধরদের সাথে (যারা ছিলো সম্পদশালী এবং তাদের অবস্থান ছিলো বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে- Core) দুর্বল ও নির্ভরশীল রাষ্ট্রের (যারা বিশ্ব রাজনীতির একদম প্রান্তে- Periphery অবস্থান করতো)। ওয়ালারস্টানের গ্রন্থটি স্নায়ুযুদ্ধকালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নের এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করে, যেখানে আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতি কিভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে পরিচালিত করেছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
শুধু বিপ্লববাদী লেখকেরাই নয়, নব্য-রিয়েলিজম তত্ত্বের অনুসারীরাও বলতে শুরু করেন যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়ণ ও অনুধাবনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সিস্টেম থেকে বিশ্লেষণ (Systemic level of analysis) করতে হবে। নব্য রিয়েলিজম তত্ত্বের অনুসারীদের মধ্যে কেনেথ ওয়ালজ (Kenneth Waltz) ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী। ওয়ালজ বলেন আন্তঃরাষ্ট্রীয়/ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সবসময় বৃহৎ শক্তির গড়ে তোলা রাজনৈতিক সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত হয়।
অর্থাৎ, বৃহৎ শক্তিরা নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনেঃ নিরাপত্তা বা জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে সিস্টেম গড়ে তোলে, এবং অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও একইভাবে নিজের স্বার্থ, নিরাপত্তা ও টিকে থাকার প্রশ্নে অত্র সিস্টেমকে অনুসরণ করে। ফলে, সিস্টেমের একদম কেন্দ্রে যে পরিবর্তন ঘটে তার প্রভাব ঐ সিস্টেমের সাথে যুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কে গিয়ে পড়ে। একদম মাকড়সার জালের মতঃ কেন্দ্রে স্পন্দন সমগ্র জালকেই স্পন্দিত করে।
১৯৭৯ সালে ওয়ালজ রচিত Theory of International Politics গ্রন্থে ওয়ালজ এই সিস্টেমের প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। উক্ত গ্রন্থে ওয়ালজ পুরাতন শক্তি ভারসাম্য তত্ত্বকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন, এবং তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিশ্ব-অর্থনীতিকেও (সমষ্টিক অর্থনীতি) গুরুত্ব দেন। ওয়ালজের এরূপ সিস্টেম তত্ত্ব তৎকালীন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ রবার্ট গিলপিনকেও (Robert Gilpin) আকৃষ্ট করে।
ওয়ালজের বক্তব্যকে সমর্থনে ১৯৮১ সালে গিলপিন War and Change গ্রন্থটি রচনা করেন। অত্র গ্রন্থে গিলপিন দাবী করেন যে বৃহৎ শক্তিরা সবসময় নিজেদের তৈরি করা আইনে আন্তর্জাতিক সিস্টেমে সাঁজাতে চায়, এবং তাদের এরূপ আইন প্রণয়নের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়। পরবর্তীতে, গিলপিন আরও একধাপ এগিয়ে যান, তিনি বলেন, ইতিহাস বিশ্লেষণে যে মহাশক্তিধরদের (হেজমন) পাওয়া যাবে তাদের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাদের উত্থান ও পতন ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপট হতে পারে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বা মহামারী বা আরও বড় কোন আঘাত।
উদাহরণ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েতের কথা বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে যেখানে ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও জাপানের দবদবা ছিলো যার মধ্যে ব্রিটেন ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাধর বা হেজমন (Hegemon)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা ব্রিটেনের হেজমন স্ট্যাটাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে আমেরিকাকে নতুন হেজমনের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। আবার যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে যায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সোভিয়েতও নতুন হেজমন হিসেবে আবির্ভূত হয়।
কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনে সোভিয়েতের হেজমন স্ট্যাটাসও লুপ্ত হয়, শুধু যুক্তরাষ্ট্র একক হেজমন হিসেবে রয়ে যায়। বর্তমানে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি চীনকে আগামী হেজমনের তালিকায় প্রথমে রাখছে। রবার্ট গিলপিনের হেজমন তত্ত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে জর্জ মোডেলস্কি (George Modelski) এবং উইলিয়াম থম্পসন (William Thompson) হেজমন চক্র তত্ত্ব (Theory of Hegemonic Cycle) বা হেজমন স্তর তত্ত্ব (Theory of Hegemonic Waves) প্রণয়ন করেন, যেখানে তারা চক্রের সাহায্যে দেখান কিভাবে এবং কোন প্রেক্ষাপটে হেজমন শক্তির উত্থান পথন হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নে ও অনুধাবনে আমাদের সিস্টেম থেকে বিশ্লেষণ শুরু করতে হবে, এই যে বয়ান বিপ্লববাদী তাত্ত্বিকেরা দাঁড় করিয়েছিলেন, ওয়ালজ ও গিলপিনের মত রিয়েলিস্টরা সেই বয়ানকে গ্রহণ করেন এবং সিস্টেম বিশ্লেষণের জন্য রিয়েলিজম তত্ত্বকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন যাকে নব্য-রিয়েলিজম বলা হয়। রিয়েলিস্টরা যখন সিস্টেম বয়ানকে গ্রহণ করেন, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী লিবারেলিস্টরা চুপ করে বসে থাকতে চাননি।
তারাও সিস্টেম বিশ্লেষণ পূর্বক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নকে গুরুত্বের কথা বলতে শুরু করেন, কিন্তু নিজস্ব আঙ্গিকে। এই নব্য-উদারবাদীদের অগ্রনায়ক ছিলেন রবার্ট কোহেন (Robert Keohane)। তিনি রবার্ট গিলপিন ও ওয়ালজের সমর্থিত নব্য-বাস্তববাদের বিকল্প একটি তত্ত্ব সামনে নিয়ে আসেন যাকে নব্য-উদারবাদ বা নিও-লিবারেলিজম বলে।
কোহেন বলেন, রবার্ট গিলপিনের যেমনটি বলেছেনঃ মহা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে হেজমন বা মহাশক্তির পতন ঘটে এবং সে পতনে পুরাতন বিশ্ব ব্যবস্থার ইতি ঘটে ও নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, আদতে বিষয়টি এমন নাও হতে পারে। কোহেন তার বিখ্যাত After Hegemony গ্রন্থে দাবী করেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার নেতৃত্বে যে বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, আমেরিকার যদি পতন ঘটে এবং নতুন হেজমনের আগমন ঘটে তবুও আমেরিকা প্রণীত ব্যবস্থায় সেভাবে পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে না।
কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকা প্রণীত বিশ্বব্যবস্থা পূর্বের যেকোনো ব্যবস্থার তুলনায় গোটা বিশ্বের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী হেজমন হিসেবে যে চীনের কথা বলা হচ্ছে, সে চীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো প্রভৃতি বিবেচনায় পশ্চিমাদের থেকে বিপরীত হলেও, চীনের উত্থান হয়েছে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বদলৌতে, এবং এই উত্থানকে ধরে রাখতে আমেরিকা প্রণীত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে চীনের অনুসরণ করতে হবে।
ফলে, যদিও হলিউড সাইন্স ফিকশন মুভিতে দেখানো হয় পৃথিবীর যাবতীয় দুর্যোগ আমেরিকাই সমাধা করতে পারে, এবং আমেরিকার অনুপস্থিতে এক নৈরাজ্যপূর্ণ সময় তৈরি হবে, বিষয়টি কোহেনের গ্রন্থ অনুসারে তেমন হবে না। অর্থাৎ, আমেরিকা হেজমন হিসেবে পতন হওয়া মানেই কোন যুদ্ধ ও সংঘাতের উত্থান নয়, সব স্বাভাবিক নিয়মেই চলবে।
এভাবেই, ১৯৮০ নাগাদ বিপ্লববাদ, বাস্তববাদ ও যুক্তিবাদ প্রধান তিনটি ধারা হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নে প্রাধান্য বিস্তার করে। বিপ্লববাদীরা (Revolutionist) যারা নব্য-মার্কসবাদকে (Neo-Marxism) অনুসরণ করেন তারা পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার সমালোচনা করাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করেন; বাস্তববাদীরা (Realist) যারা নব্য-বাস্তবাদকে (Neo-Realism) অনুসরণ করে্ন তারা বৃহৎ শক্তির নেতৃত্ত্বে কিভাবে আন্তর্জাতিক সিস্টেম গড়ে ওঠে এবং এই সিস্টেমের সাথে যুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্র কিভাবে এবং কেন এই সিস্টেমের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজেদের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করেন তা ব্যাক্ষা করাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পাঠের মূল হিসেবে গ্রহণ সুপারিশ করেন; এবং যুক্তিবাদীরা (Rationalism) যারা নব্য-উদারতাবাদকে (Neo-Liberalist) অনুসরণ করেন তারা বলেন সিস্টেমের অংশ প্রতিটি রাষ্ট্র কেন ও কি পন্থায় রেশনাল বা যৌক্তিক সিদ্বান্ত গ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সিস্টেমে যে নৈরাজ্য বিদ্যমান তাকে আইনি কাঠামোয় আবদ্ধ করতে পারে তা খুঁজে দেখাই হওয়া উচিৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নের মূল লক্ষ্য।
এই তিনটি দার্শনিক ধারা তাদের নিজ নিজ মূল তত্ত্বকে/ মূল দর্শনকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। অর্থাৎ, মার্কসবাদ দর্শন নব্য-মার্কসবাদ তত্ত্ব গড়ে ওঠার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে; আবার, মরগেন্থু প্রদত্ত রিয়েলিজম তত্ত্বকে নতুনভাবে সাজিয়ে নিও-রিয়েলিজম তত্ত্বের যাত্রা হয়; আবার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উদারবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে লিবারেলিজম তত্ত্বের যাত্রা হয়েছিলো; সকলের নিকট যে উদারতাবাদ রেশনাল বা যৌক্তিক মনে হয়েছিলো সেখানে বেশ কিছু পরিবর্তন এনে নব্য-উদারবাদ তত্ত্বের আগমন ঘটে যা প্রাতিষ্ঠানিক নিও-লিবারেলিজম নামেও পরিচিত।
তবে, তাদের মূল তত্ত্বগুলো যেমন রিয়েলিজমের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, উদারতাবাদের ক্ষেত্রে ব্যক্তি, ও মার্কসবাদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শ্রেণীকাঠামো, প্রভৃতিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের কেন্দ্রে রেখেছিলো, নতুন এই তত্ত্ব তিনটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়ণ ও অনুধাবনে সিস্টেম থেকে বিশ্লেষণ (Systemic level analysis) শুরু করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়।
No comments