Critical Theory বিকাশে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল তাত্ত্বিকদের ভূমিকা
Critical Theory বিকাশে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল তাত্ত্বিকদের ভূমিকা
Critical Theory দ্বারা একগুচ্ছ তত্ত্বের বিন্যাসকে বুঝানো হয়। এই তত্ত্বের উদ্দেশ্য সমাজে বিবদমান নানা সঙ্কট/ সংঘাত (Conflicts), বিতর্ক (Controversy), ও প্রতিক্রিয়াকে (Tendency) প্রশ্ন/ সমালোচনা করা, যাতে আদর্শের ভিত্তিতে (Normativity) সামাজিক রূপান্তর সহজ হয়। মার্কসবাদী দর্শনে প্রভাবিত পশ্চিম ইউরোপের একদল দার্শনিক ও তাত্ত্বিকের কাজের ফসল হিসেবে Critical Theory-এর অবতারণা ঘটে। এই দার্শনিক ও তাত্ত্বিকদের কাজগুলোকে একত্রে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল অব থট (Frankfurt School of Thought) হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
১৯৩০-এর দশকে, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে Institution of Social Research (ISR) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যাত্রা করে। এই প্রতিষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের মাঝে সমন্বয় করা, এবং সত্য অনুসন্ধান ও পূর্ণ মুক্তির লক্ষ্যে আন্তঃবিভাগীয় গবেষণাকে (Inter-disciplinary Research) ত্বরান্বিত করা।
Frankfurt School of Thought যাদের চিন্তা, লেখনি ও বলনিতে সমৃদ্ধ হয়েছিলো মাক্স হোর্কেইমার (Max Horkheimer), থিওডর আদোর্নো (Theodor Adorno), হারবার্ট মারকিউজ (Harbert Marcuse), ওয়াল্টার বেঞ্জামিন (Walter Benjamin) প্রমূখ ছিলেন তন্মধ্যে প্রভাবশালী। তাদেরকে Frankfurt School of Thought-এর প্রথম প্রজন্মের তাত্ত্বিকের মর্যাদা দেওয়া হয়। অন্যদিকে, জারগেন হ্যাবারমাস (Jurgen Habermas) ছিলেন Frankfurt School of Thought-এর দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রভাবশালী চিন্তক ও মার্কসবাদী দার্শনিক।
বৃহৎ পড়িসরে বলতে গেলে, Critical Theory-তে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবিধ মুভমেন্টেরও সমন্বয় ঘটেছে। যেমনঃ Feminism Theory, Critical Race Theory, Queer Theory, এবং Post-Colonial Theory। তবে, কিছুক্ষেত্রে Critical Theory-এর প্রবক্তাদের লেখনিতে মনঃসমীক্ষা (Psycho-Analysis) এবং উত্তর-গঠনবাদের (Post-Structuralism) প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে মিশেল ফুঁকো (Michel Foucault) ও জ্যাক দারিদা'র (Jaques Darrida) উত্তর-আধুনিকতাবাদী (Post-Modernism) লেখনির বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে।
Frankfurt School of Thought-এর সূচনাঃ
মজার বিষয় হল, Frankfurt School বলতে আদতে কিন্তু কোন স্কুল নেই। বস্তুত, এই 'স্কুল' বলতে সামাজিক ও দার্শনিক পড়িসরে বিক্ষিপ্তভাবে বিরাজিত বিবিধ চিন্তার সমন্বয়কে বুঝায়। এই সমন্বয় ঘটে নানা চিন্তকের দার্শনিক বিতর্কের মধ্য দিয়ে। এ বিতর্কের প্রধান লক্ষ্য ছিলোঃ মুক্তির পথে- সত্যের সন্ধানে সচেষ্ট হওয়া।
এই বিতর্কের মাঝে যেগুলো প্রায়শই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠতোঃ
ক। কোন কিছুর প্রতি অসম্মত হওয়ার ক্ষেত্রে বা সমালোচনার ক্ষেত্রে কোন একটি পদ্ধতি (Methodology) অনুসরণ প্রয়োজনীয়;
খ। ইতিপূর্বের প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত বয়ান, গ্রন্থ, ইতিহাসের বর্ণনা ইত্যাদিকে কিভাবে ও কোন পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা দরকার?
গ। অতীতে যা গেছে তা কী ভালো, অগ্রনী না কি কানাগলিতে হারিয়ে যাওয়ার মত ভ্রান্ত?
ঘ। চলতি সামাজিক সঙ্কট এবং অন্য দার্শনিক ক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত সঙ্কট সমাধানে কী উপায় অবলম্বন প্রয়োজন? ইত্যাদি।
যাহোক, এই লেখায় আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল অব থটের বিবর্তন সম্পর্কে জানবো, এবং কিভাবে এই স্কুল Critical Theory-কে সমৃদ্ধ করেছে তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো।
ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের প্রথম প্রজন্মের দার্শনিক ও লেখকদের প্রথম প্রধান কাজ ছিলো মুক্তিলাভ ও সত্যের সন্ধানে দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন জ্ঞানের শাখার মাঝে সমন্বয়ের চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে প্রথম প্রজন্মের দার্শনিক ও চিন্তকদের প্রধান অবদান ছিলো দর্শন ও সামাজ বিজ্ঞানের নানা জ্ঞানের শাখা বিশ্লেষণে একটি নতুন ধরণের মেথড বা গবেষণা প্রণালী উপস্থাপন করা।
প্রথম প্রজন্মের তাত্ত্বিকেরা মার্কসবাদ অধ্যয়নে গভীর মনোনিবেশ করেন। তারা সিগমুন্ড ফ্রয়েড, ম্যাক্স ওয়েভার এবং ফ্রেড্রিখ নিটশের মত প্রভাবশালী লেখকদের চিন্তার সাথে মার্কসবাদকে মিলিয়ে দেখতে শুরু করেন যাতে মার্কসবাদকে পুনর্মূল্যায়ন ও সময়োপযোগী করা যায়। এই দুই শ্রেণীর চিন্তার মেশালে তারা সমালোচনার নতুন এক মডেল উপস্থাপন করেন যা আদতে র্যাডিকাল এবং সামাজিক বাস্তবতা (Social Reality) থেকে উদ্ভূত।
এই মডেলের সাহায্যে তারা বহু বিষয়কে পরখ করে দেখতে চাইছিলেন। যেমনঃ তারা একনায়কতন্ত্রকে শুধু একটি রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে না দেখে, এটিকে তারা একক পারিবারিক কাঠামোর ভিত্তিতেও ব্যাক্ষা করেন; এটিকে তারা বদ্ধমূল মানসিক ধারনার আলোকেও ব্যাক্ষা করেন। এছাড়াও, এই মডেলের সাহায্যে ফ্রাঙ্কফুট স্কুলের তাত্ত্বিকেরা পুঁজিবাদের বহুবিদ চরিত্র নিয়ে আলোচনা করেন। পুঁজিবাদ কিভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মনোজাগতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে- এবং পুঁজিবাদ কীরূপে আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে সে ব্যাক্ষাও দেয়।
১৯২৩ সালে, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে Institute of Social Research (ISR) নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩১ সালে, ম্যাক্স হোর্কেইমার এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের পর তিনি তার প্রাথমিক বক্তব্যে বলেন, এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে কিছু মৌলিক কার্যে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি প্রাথিমিক পর্যায়ে দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় আনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেন এবং আন্তঃবিভাগীয় গবেষণার সূচনা ঘটান।
এক্ষেত্রে হোর্কেইমার মনোবিজ্ঞান, রাজনীতির অর্থনীতি (Political Economy), এবং সংস্কৃতি অধ্যায়নকে প্রাধান্য দেন। তিনি বলেন যে আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা 'সামাজিক দর্শন' (Social Philosophy) বিকাশে সাহায্যে করবে। তিনি আরও বলেন যে এই 'সামাজিক দর্শন' আমাদের 'সামাজিক বাস্তবতা (Social Reality)' অনুধাবনেও সহায়ক হবে। এভাবে, সমাজের সামগ্রিক চিত্র আমাদের সম্মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠবে- যাকে তিনি "Social Totality" বলেছেন।
Social Totality সমাজকে একটি সম্পূর্ণ, জটিল ও আন্তঃসম্পর্কিত ব্যবস্থা হিসাবে বোঝার চেষ্টা করে, যেখানে অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও আদর্শবাদ একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সামগ্রিক সামাজিক অনুধাবন ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের মূলমন্ত্র হয়েছে, যা মার্কসবাদেরও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিলো।
ম্যাক্স হোর্কেইমার বাদেও ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের প্রথম প্রজন্মের অন্যতম প্রভাবশালী তাত্ত্বিকদের মধ্যে থিওডর আদোর্নো, হারবার্ট মার্কিউজ, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, ফ্রেড্রিখ পলক, লিও লোইন্থাল প্রমূখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। এই প্রথম প্রজন্মের অধিকাংশ তাত্ত্বিক ছিলেন জাতিতে জার্মান এবং ধর্মে ইহুদী। ফলে, জার্মানে যখন হিটলারের প্রণীত জাতীয় সমাজতন্ত্র (নাৎসিবাদ) চুড়ান্ত রূপ লাভ করে, এই প্রথম প্রজন্মের তাত্ত্বিকেরা অনেকেই জার্মান ত্যাগ করেন, অন্যদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ এ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে তাদের কতেক জার্মানে ফিরে আসেন।
উল্লেখ্য, যুদ্ধের প্রাক্কালেই জার্মানে Institute of Social Research (ISR) নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিকে হিটলার বন্ধ করে দেন। হোর্কেইমার জার্মান থেকে সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নেন, এবং সেখান থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমান। ১৯৩৪ সালে হোর্কেইমার আমেরিকার প্রসিদ্ধ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে Institute of Social Research (ISR) নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, এবং পলক, মার্কিউজ, লোইন্থাল এবং পরবর্তীতে আদোর্নো হোর্কেইমারের সাথে যোগ দেন।
Frankfurt School-এর তাত্ত্বিকেরা যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেনঃ
Frankfurt School-এর প্রথম প্রজন্মের দার্শনিক ও তাত্ত্বিকেরা- তাদের পূর্বের ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের প্রবক্তাদের কাজ দ্বারা দারূণভাবে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হন। বিশেষ করে, উনবিংশ শতকে জার্মান দর্শনের সবচেয়ে দার্শনিক হেগেলের বামপন্থার (Leftism) দিকে তারা ঝুঁকে পড়েন। হেগেলের বামপন্থা দর্শনের অনুসারীরা নিজেদের প্রগতিশীল বলে পরিচয় দিতেন।
তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষঙ্গকে সমালোচনার আলোকে ব্যাক্ষা করতেন, বিশেষ করে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যকার সম্পর্ককে প্রচলিত ভাববাদী ধারায় না দেখে ভিন্নভাবে ব্যাক্ষা করতেন। এই দলের নিকট কার্ল মার্কসের মার্কসবাদ ছিলো সবচেয়ে বড় প্রভাবক। মার্কসের বস্তুতান্ত্রিক বিশ্লেষণ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ব্যাক্ষ্যায় যে প্রচলিত জ্ঞানের ধারা রয়েছে তাদের চ্যালেঞ্জ করে এবং নতুন আঙ্গিকে বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা চালায়।
১৮৪১ সালে, হোর্কেইমার, পলক এবং আদোর্নো প্রতিষ্ঠানটিকে নিউইয়র্ক থেকে লস এঞ্জেলসে স্থানান্তারিত করেন। যুদ্ধ সমাপ্তের পর তারা পুনরায় জার্মানিতে ইন্সটিটিউট পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, এবং হোর্কেইমার ও আদোর্নো পর্যায় ক্রমে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তাদের স্থাপিত ভিত্তিকে, পরবর্তীতে, ফ্রাঙ্কফুর্টের স্কুলের দ্বিতীয় প্রজন্মের তাত্ত্বিকেরা ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই প্রজন্মের তাত্ত্বিকদের মধ্যে জারগেইন হ্যাবারমাস, আলফ্রেড স্কিমিদ, আল্বার্ট ওয়ালমার প্রমূখ ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী।
এই নতুন আঙ্গিকে বিশ্লেষণের নিমিত্তে মার্কস রাজনীতির অর্থনীতি (Political Economy) প্রচলন ঘটায়। এই রাজনীতির অর্থনীতি, সামাজিক রূপান্তরে (Social Transformation) পুঁজিবাদের চরিত্রকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে। এভাবে কার্ল মার্কস ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের একটি স্টান্ডার্ড দাঁড় করান যা পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকদের হাতে আরও শাণিত হয়েছে।
মার্কস যখন লেখনী শুরু করেন, অর্থাৎ, ১৯৪০-এর দশকে তখন আধুনিক পুঁজিবাদ কেবল যাত্রা শুরু করেছে। তথাপি, এই পুঁজিবাদের আদলে জার্মানিতে যে আধুনিকতার জন্ম ঘটতে যাচ্ছে সেখানে- অর্থাৎ, আধুনিক জার্মানের সামাজিক বিন্যাসে মার্কস সঙ্কট দেখতে পান, মার্কসের ভাষায় যার সমাপ্তি ঘটবে বিপ্লবী শক্তির উত্থানে।
১৯৩০-এর দশকে যখন মার্কসের অনুসারী ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকেরা ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব নিয়ে লেখনিতে আত্মনিবেশ করেছেন, ততক্ষণে জার্মান ইউরোপের সবচেয়ে আধুনিক শিল্পন্নোত ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। এই তাত্ত্বিকেরা সামাজিক রূপান্তরের সংকল্প করেছিলেন, কিন্তু, সেক্ষেত্রে তারা প্রথমে মার্কসের ব্যাক্ষাকেই সমালোচনা শুরু করেন।
মার্কস পুঁজিবাদের যে পর্যায়বৃত্ত ব্যাক্ষা করেছেন, অর্থাৎ, সাম্যবাদী সামাজিক রূপান্তরে পুঁজিবাদী সমাজের (জার্মান) শ্রেণীবৈষাম্য শ্রমিকদের বিপ্লবী করে তুলবে, ফ্রাঙ্কফুট স্কুলের তাত্ত্বিকেরা বলেন, এরূপ সঙ্কট শ্রমিক অসন্তোষের বদলে তাদের মাঝে ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে। কারণ শ্রমিকরা মনে করেন এই পপুলিস্ট ফ্যাসিবাদই তাদের বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এভাবেই সমাজতন্ত্রের নাম দিয়ে ইতালি ও জার্মানে ফ্যাসিবাদ ও নাতসিবাদের বিস্তার ঘটে।
ফ্রাঙ্কফুট স্কুলের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা। তারা বলতেন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক রূপও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়। তবে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গকে বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদের তাত্ত্বিকেরা যেভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক স্বরূপ গঠনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যাক্ষা করেন, সে বয়ানকে ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা চিরন্তর ধরে নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। উপরন্তু, মনস্তত্ত্বে সামাজিক ও সংস্কৃতির প্রভাব বিশ্লেষণে ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষাকে (Psycho-Analysis) প্রাসঙ্গিক মনে করেন।
কট্টর মার্কসবাদের (Orthodox Marxism) বিপরীতে গিয়ে তারা সামাজিক ও ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক নানা পরিবর্তনকে ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষার আলোকে বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা চালায়। তারা বলেন, আধুনিক পরিবার কাঠামো সমাজে বিদ্যমান/ চলমান সাংস্কৃতির মহাশক্তির (Superstructure) এর আদলে প্রভাবিত হয়। মার্কসের ভাষায় বস্তুতান্ত্রিকতা সামাজিক সাংস্কৃতিক মহাকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে, এবং পর্যায়ক্রমে তা গণসংস্কৃতিতে (Mass Culture) রূপ নেয়।
ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকরা ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষা তত্ত্বের আলোকে ম্যাক্স ওয়েবারের সামাজিক তত্ত্বকেও ব্যাক্ষার চেষ্টা করেন- যার উদ্দেশ্য ছিলো তৎকালীন সমাজকে বিশ্লেষণে ওয়াভার যে বর্ণনা দিয়েছে তাকে পরীক্ষা করা। এক্ষেত্রে, ওয়েভারের Rationalization তত্ত্বকে খুঁটিয়ে দেখতে চেয়েছেন ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা। এই তত্ত্বে ওয়েভার বলেন, সমাজের নানা সঙ্কট সমাধানে সমাজে আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিতে হবে যা একটি যৌক্তিক ও কার্যকর উপায়।
হোর্কেইমার এবং আদোর্নো- এর বিখ্যাত গ্রন্থ "Critique of Instrumental Reason (1947)", এবং হ্যাবারমাসের Communicative Action তত্ত্বের ক্ষেত্রে ওয়েবারের Theory of Rationalization গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
১৯২৩ সালে জর্জ লুকাসের Reification and Consciousness of the Proletariat শীর্ষক রচনা মার্কস ও ওয়েবারের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরিতে কাজ করে- যা ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা লুফে নেয়। এখানে লুকাস মার্কসের 'পণ্য' ধারণাকে বিশ্লেষণ করেছেন। অর্থাৎ, কিভাবে পণ্যের ধারণা সামগ্রিকভাবে সামাজিক রূপান্তর ঘটিয়েছে (ভোগবাদী সমাজ), এবং তিনি একই সাথে ওয়েবারের Rationalization প্রক্রিয়াকে সামাজিক রূপান্তরের প্রধান জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে দেখিয়েছেন।
অর্থাৎ, পণ্যের আমলাতন্ত্র জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই পণ্যের যথার্থতাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে যাকে লুকাস 'Reification' নামে ডেকেছেন। লুকাস দেখান এভাবেই আমলাতন্ত্র পুঁজিবাদী বয়ানকে (পণ্য কেন্দ্রিক ভোগবাদী সমাজ) সচেতনভাবে সমাজে বিস্তার ঘটিয়েছে, এবং নাগরিকদের নিকট তাকে যৌক্তিক করে তুলেছে।
ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকেরা ক্লাসিক্যাল জার্মান দর্শন দ্বারা অনেক বেশিই প্রভাবিত ছিলেন। এই তালিকায় ইমানুয়েল কান্ট থেকে শুরু করে জার্মান আদর্শবাদীরা এমনকি ফ্রেডরিখ নিটশে পর্যন্ত ছিলো। স্কুলের তাত্ত্বিকদের কাছে কান্টের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক রচনা কারণ এখানে কান্ট নাগরিকদের মুক্তভাবে ও জনসম্মুখে যুক্তিবাদী হওয়ার কথা বলেছেন।
অর্থাৎ, কান্টের ভাষায় চিরমুক্তি (Emancipation) লাভে প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে যুক্তির (Reason) চর্চা করা প্রয়োজন। ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা এই মতামতের ভিত্তিতে Reason-এর ভিত্তিতে তাদের আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা পরিচালনা শুরু করেছিলেন। তবে, কান্টের এরূপ বয়ানের বিপরীতে মার্কস ও হেগেল বলেন, এই Reason সর্বদা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বস্তুতান্ত্রিক অনুষঙ্গের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে, Reason-কে মুক্ত করার সুযোগ কম- কারণ তা পক্ষপাতগ্রস্থ (Biased)।
ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের দার্শনিকরা প্রায়শই তাদের কাজের রেফারেন্স হিসেবে হেগেলের বিভিন্ন দার্শনিক উক্তি ও দার্শনিক পয়েন্ট ব্যবহার করেছেন। মারকিউজ, আদোর্নো, বেনহাবিব, হোনেথ প্রমুখ হেগেলের গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন: কখনো স্বল্প আকারে বা কখনো বৃহৎ পরিসরে। মানুষের যে ব্যক্তিসত্তা (intersubjectivity) রয়েছে এবং এই ব্যক্তিসত্তা মানুষের স্বাধীনচেতা জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ- এই কথাগুলো প্রথমে হেনেথ ক্রিটিক্যাল তত্ত্বে যুক্ত এবং তিনি এই ধারণা লাভ করেন হেগেলের Theory of Recognition থেকে। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের অন্যতম তাত্ত্বিক Rahel Jaeggi ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব বিকাশে হেগেলের অন্তর্নিহিত ব্যাক্ষাকে (Immanent Critique) সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। রাহেল বলেন, সমাজকে প্রগতিশীল করতে যে সামাজিক রূপান্তরের প্রয়োজন সেক্ষেত্রে শেখার কোন বিকল্প নেই।
ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকদের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো অযৌক্তিকতাকে বিশ্লেষণ করা। এই বিশ্লেষণের প্রয়োজনে তারা অন্তর্নিহিত ব্যাক্ষাকে (Immanent Critique) কে একইভাবে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। তবে, উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হল অযৌক্তিকতা (Irrationality) বিশ্লেষণে এই অন্তর্নিহিত ব্যাক্ষাকে (Immanent Critique) তারা শুধু কান্ট ও হেগেলের দৃষ্টিতেই দেখতে চান নি, বরং তাদের বাহিরেও ফ্রয়েড ও নিটশের মত প্রভাবশালী যুক্তিবাদী তাত্ত্বিকদের মতাদর্শকেও এই স্কুলের তাত্ত্বিকেরা গ্রহণ করেন।
আধুনিক বুর্জুয়া সংস্কৃতি এবং মানুষের পক্ষপাতমূলক (Subjective) বিশ্লেষণের নেতিবাচকতা নিয়ে নিটশে যে বক্তব্য প্রদান করেন, ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের লেখকগণ, বিশেষত এই স্কুলের প্রথম প্রজন্মের তাত্ত্বিকেরা তাকে যথার্থ মনে করেন। নিটশের লেখনিতে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলো ম্যাক্স হোর্কেইমার, বিশেষ করে নিটশের Dialectic of Enlightenment নামক বিখ্যাত গ্রন্থের দ্বারা যে নিটশে যুক্তির সূচনা ও বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেন। হোর্কেইমারের পর নিটশের লেখনিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হন Menke, বিশেষ করে নিটশে আধুনিক সমতার ধারণাকে যেভাবে সমালোচনা করেন, Menke তাকে ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে মূল্যায়ন করেন।
এভাবেই, ফ্রাঙ্কফূর্ট স্কুলের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের তাত্ত্বিকদের লেখনি ও চিন্তা মার্কস, হেগেল, কান্ট, নিটশে, ফ্রয়েড প্রমূখ মহাদার্শনিকের মতাদর্শ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। তাদের তত্ত্বকথার মূল লক্ষ্য ছিলো সত্য ও মুক্তির লক্ষ্যে যুক্তি নির্ভর ও পদ্ধতিগত অনুসন্ধান। এবং এভাবেই Frankfurt School of Though- এর হাত ধরে Critical Theory-এর বিকাশ ঘটেছে।
অনুবাদকঃ
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল প্রবন্ধঃ
Crtitical Theory (Frankfurt School)
Published by Stanford Encyclopedia of Philosophy
মূল লেখকঃ
Robin Celikates, Jeffrey Flynn


No comments