Critical Theory: স্ব-নিরীক্ষা ও সমাজ বিশ্লেষণের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
 |
| প্রফেসর Habermas শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলছেন |
পূর্বেই আলোচনা করেছি, ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকেরা যে ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের প্রবর্তনা ঘটান, সেখানে আমাদের চিন্তা-ভাবনা-গবেষণা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতিগত বিশ্লেষণের বিপরীতে নতুন একধরণের বিশ্লেষণ পদ্ধতির কথা বলা হয়। বিশেষ করে, সমাজ বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক তত্ত্ব উপস্থাপনে প্রচলিত যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব সে পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন এক পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ বা Methodology -এর সূচনা ঘটান।
ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকেরা কতিপয় উদ্দেশ্য সাধনে এরূপ নতুনত্বের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন বা চালিয়ে যাচ্ছেন। যথাঃ
(ক) স্ব-নিরীক্ষণ (self-reflexive)ঃ
সহজ করে বললে স্ব-নিরীক্ষণে একজন ব্যক্তি স্বীয় প্রতিবিম্বকে, অর্থাৎ, স্বীয় চিন্তা ও অবস্থানকে নিজেই মূল্যায়ন করে থাকেন। আবার, একাডেমিক আকারে যদি বলি, স্ব-নিরীক্ষণ বলতে এমন এক বোধ বা চেতনাকে বুঝায়, যেখানে কোন ব্যক্তি স্বীয় অন্তরীণ চিন্তা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, ও দৃষ্টিকোণকে নিজেই পূনঃমূল্যায়নের চেষ্টা করেন।ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের প্রধান লক্ষ্যই ব্যক্তির স্ব-নিরীক্ষণ চেতনাকে জাগ্রত করা।
এই স্ব-নিরীক্ষণ ব্যক্তিকে তার সামাজিক ও ঐতিহাসিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, যেখানে ব্যক্তি পুনঃমূল্যায়নের চেষ্টা করে কিভাবে তার চিন্তা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিকোনকে সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট গঠণ ও প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে, ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকেরা নতুন এক সমালোচনা ও বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যক্তির সামনে উপস্থাপন করেন, যা ব্যক্তির স্ব-নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াকে সক্রিয় ও ত্বরান্বিত করে।
(খ) আন্তঃবিভাগীয় বিশ্লেষণ (Interdisciplinary):
ব্যক্তিজীবনের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ বিশ্লেষণের নিমিত্তে জ্ঞানের নানা শাখার আগমন ও বিন্যাস ঘটেছে। পাঠ্যক্রম ও গবেষণার প্রয়োজনে এসব শাখা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে—কখনও ‘অনুষদ’ (Institute), কখনও ‘স্কুল’ (School), আবার কখনও ‘বিভাগ’ (Department/Discipline) হিসেবে। ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকেরা বলেন, ব্যক্তির জীবনকে ঘিরে যে জ্ঞানের শাখা গড়ে উঠেছে, সে শাখাগুলোর মাঝে অনেকক্ষেত্রে যোগসূত্র পাওয়া যায়। তবে, এই যোগসূত্র নির্ণয়ে চাই প্রচলিত ও সংকীর্ণ বিশ্লেষণ পদ্ধতির বিপরীতে এক নতুন আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা পদ্ধতি, যার সাহায্যে ব্যক্তি স্বীয়-নিরীক্ষণের প্রয়োজনে দর্শন, ইতিহাস, আইন, কলা প্রভৃতি জ্ঞানের শাখা থেকে সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভংগিকে পুনঃমূল্যায়নের সুযোগ পান।
(গ) বস্তুতান্ত্রিকতা (Materialist):
ব্যক্তির স্ব-নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া কেবল ভাববাদী বা বিমূর্ত ধারণার আলোকে গঠিত হয় না। ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের ভাষায়, ব্যক্তির চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে সমাজের জীবন্ত বাস্তবতা (Social Reality), যেমন: ক্ষমতার সম্পর্ক, শ্রেণিভিত্তিক কাঠামো, লিঙ্গভিত্তিক অভিজ্ঞতা, ও সামাজিক অবস্থান ইত্যাদির প্রভাব ও প্রতিধ্বনির মধ্য দিয়ে। ফলে, আন্তঃবিভাগীয় জ্ঞানের সমন্বয়ে ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকেরা নতুন যে বিশ্লেষণপদ্ধতির সুপারিশ করেন, সেখানে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি সামাজিক বাস্তবতা (Social Reality) ও বস্তুবাদী (Materialist) প্রেক্ষাপটকে অনিবার্যভাবে প্রাধান্য দিতে হবে। এই আন্তঃবিভাগীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতির উদ্দেশ্য হবেঃ ব্যক্তির স্ব-নিরীক্ষণ থেকে উৎসারিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে তাকে আরও গভীরতর ও বাস্তবনির্ভর বিশ্লেষণের দিকে নিয়ে যাওয়া।
(ঘ) মুক্ত (Emancipation):
আদতে, ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব প্রবর্তিত নতুন বিশ্লেষণ পদ্ধতির প্রধান লক্ষ্য হলোঃ ব্যক্তিকে স্ব-নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সামাজিক মুক্তির পথে এগিয়ে নেওয়া। ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের ভাষায়, এই মুক্তি (Emancipation) কেবল বাহ্যিক নিপীড়ন থেকেই স্বাধীনতা নয়, বরং এটি একটি জ্ঞানোত্তর ও আত্ম-সচেতনতামূলক রূপান্তর, যার মাধ্যমে ব্যক্তি তার অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতাকে নতুনভাবে অনুধাবন করতে শেখে, এবং সেই অনুধাবনের ভেতর দিয়ে ব্যক্তির মাঝে নতুন বিশ্লেষণধারা ও বোধ সৃষ্টি হয়। এই রূপান্তর-প্রক্রিয়াই ব্যক্তির সচেতনতা ও জ্ঞানগঠনে মুক্তির প্রকৃত তাৎপর্য প্রকাশ করে।
তবে, এই নতুন ধরনের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ (Methodological Analysis) উপস্থাপন ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকদের জন্য সহজ ছিল না, বিশেষ করে তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের কারণে। যথাঃ
(ক) কীভাবে তত্ত্ব এবং সামাজিক বাস্তবতার (Social Reality) মধ্যে সমন্বয় ও সম্পর্ক নির্ধারণ করা যায়?
(খ) এই সমন্বয়ের সাধনে ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের তাত্ত্বিকদের ভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে?
(গ) এবং, তাদের তাত্ত্বিক রচনার আদর্শগত ভিত্তি, বিষয়বস্তু এবং প্রায়োগিক পরিধি কেমন হওয়া উচিত?
যে মার্কসবাদকে ভিত্তি ধরে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকেরা Critical Theory প্রণয়নের চেষ্টা করেন, বিংশ শতকের সূচনায় নানা প্রেক্ষাপটে সেই চেতনা হোঁচট খায়। কার্ল মার্কস তার মার্কসবাদ তত্ত্বে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রেণি শোষণের প্রতিক্রিয়ায় একটি নতুন আর্থ-সামাজিক রূপান্তর ঘটবে। অর্থাৎ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণি, যাদের মার্কস "প্রলেতারিয়েত" বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, শোষক বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং একটি নতুন সমাজের সূচনা করবে। কিন্তু, বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের উত্থান, পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির একটি বড় অংশের পুঁজিবাদী উদারবাদী কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন, মার্কসের এই ভবিষ্যদ্বাণীকে ভুল প্রমাণিত করে। এর ফলে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকদের মধ্যে সামাজিক বাস্তবতা (social reality) এবং মার্কসবাদী তত্ত্বের প্রায়োগিক যথার্থতা নিয়ে সংশয় ও অস্পষ্টতা তৈরি হয়।
এরূপ সংশয় ও অস্পষ্টতা কাটিয়ে উঠতে, ফ্রাঙ্কফুট স্কুলের তাত্ত্বিকেরা নতুন এক গবেষণা বা বিশ্লেষণ পদ্ধতি উপস্থাপন করেন, যা প্রচলিত বিশ্লেষণ পদ্ধতি থেকে ভিন্ন ও সমন্বিত। এই বিশ্লেষণ পদ্ধতিটি প্রাথমিকভাবে পাঁচটি পর্যায় অনুসরণ করে কোন বিষয়কে ব্যাক্ষা করবে। যথাঃ
১। অন্তর্বর্তী সমালোচনা (Immanent Critique);
২। মূল্যনির্ভর ভিত্তি (Normative foundations);
৩। নির্মাণ, বিনির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ প্রক্রিয়া (Constructive, Deconstructive and Reconstructive Process);
৪। উন্মোচনমূলক সমালোচনা (disclosive critique); ও
৫। উৎসগত সমালোচনা (genealogical critique).
নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে পর্যায়গুলোর ব্যাক্ষা করা হল।
১। অন্তর্বর্তী সমালোচনা (Immanent Critique)ঃ
Critical Theory- এর তাত্ত্বিকগণ লক্ষ্য করেন যে, প্রচলিত বিশ্লেষণ পদ্ধতিগুলো সাধারণত কোনো ঘটনা বা তত্ত্বকে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কেবল তার অভ্যন্তরীণ (internal) অথবা বাহ্যিক (external) কারণ ও উপাদানের দিকে নজর দেয়। ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের তাত্ত্বিকদের ভাষায়, দ্বিমাত্রিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে কোনো জটিল সামাজিক বাস্তবতা বা চিন্তার কাঠামোর গভীরে প্রবেশ করা সম্ভব হয় না। এরই প্রেক্ষিতে তারা একটি তৃতীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি যুক্ত করার কথা বলেন, যা হলো "অন্তর্বর্তী সমালোচনা" (Immanent Critique)।
Immanent শব্দটি একটি বিশেষণ। এটি দ্বারা এমন এক গুণকে বুঝায় যা কোনো কিছুর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে উপস্থিত বা অন্তর্নিহিত থাকে। একইভাবে, Immanent Critique দ্বারা কোন ঘটনা, তত্ত্ব, আদর্শ, বয়ান বা পদ্ধতি প্রভৃতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা সমালোচনা ক্ষেত্রকে বুঝায়। অর্থাৎ, প্রশ্ন বা সমালোচনার ক্ষেত্র সর্বদাই নিহিত থাকে।ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকদের মতে, প্রচলিত বিশ্লেষণ পদ্ধতি দ্বারা প্রায়শই এই অন্তর্হিত সমালোচনার ক্ষেত্র উদ্ঘাটিত হয় না, বিশেষত যখন তা বাইরের মানদণ্ড দ্বারা চালিত হয়। কিন্তু যদি কোনো বিশ্লেষণ আন্তঃবিভাগীয়, স্ব-নিরীক্ষণধর্মী ও প্রতিফলনশীল হয়, তবে সেই বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কাঠামোর ভেতরকার দ্বন্দ্ব, অসম্পূর্ণতা ও পরিবর্তনের সম্ভাবনাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা অন্তর্বর্তী সমালোচনার প্রকৃত ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক ধারা হলো রিয়ালিজম (Realism) নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য—“আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নৈরাজ্যপূর্ণ, এবং এই প্রেক্ষাপটে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্বার্থপরভাবে ক্ষমতা অর্জনের দিকে ধাবিত হয়।” রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে যে ক্ষমতা প্রদর্শন করে, তা কখনও কখনও অন্য রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে, যাকে "নিরাপত্তা সঙ্কট বা (security dilemma)" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রিয়ালিস্ট তত্ত্বের বিভিন্ন শাখা, যেমন Classical Realism, Structural Realism, Offensive ও Defensive Realism, এই একই যুক্তিকে কেন্দ্র করে তাদের তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। বিংশ শতাব্দী থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত, "ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ" নীতি, বহু রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রীয় ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
অন্তর্বর্তী সমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা এই তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে যে, যদিও রিয়ালিস্ট তত্ত্ব আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় নৈরাজ্যের বাস্তবতা তুলে ধরে এবং নিজস্ব পন্থায় সে নৈরাজ্যের বিপরীতে ‘স্থিতিশীলতা’ নিশ্চিত করতে চায় (অর্থাৎ, শক্তি ভারসাম্যের মাধ্যমে)। কিন্তু নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করতে শক্তি ভারসাম্যেরও যে বিকল্প রয়েছে, অর্থাৎ, আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের নৈতিক কাঠামো, শান্তির নীতি, এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমেও যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় স্থিতি আনায়ন সম্ভব সে সম্ভাবনাকে রিয়ালিস্ট তত্ত্ব উপেক্ষা করে ।
অর্থাৎ, একদিকে তত্ত্বটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার কথা বলে, আবার অন্যদিকে সেই একই ব্যবস্থায় মানবকল্যাণ ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনের জন্য গৃহীত চর্চাকে অস্বীকার করে, এই দ্বৈততা থেকেই তত্ত্বটির অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি স্পষ্ট হয়। ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকেরা এই অসঙ্গতির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, রিয়ালিস্ট তত্ত্ব কার্যত এমন একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বৈধতা দেয়, যা বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষায় সুবিধাজনক। এইভাবে, রিয়ালিজম তত্ত্বটি নিজেকে নৈরাজ্য ও স্বার্থ-চালিত বাস্তবতার ব্যাখ্যাকারী হিসেবে উপস্থাপন করলেও, তার নিজস্ব নৈতিক অবস্থানের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব নিহিত রয়েছে তা অন্তর্বর্তী সমালোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২। মূল্যনির্ভর ভিত্তি (Normative foundations):
মূল্যনির্ভর ভিত্তি (Normative Foundations) বলতে বোঝায় সেই নৈতিক, দার্শনিক ও সামাজিক আদর্শ ও নীতিসমূহ, যা কোনো সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সাধারণত এই ভিত্তিগুলো গড়ে ওঠে ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও সামাজিক কল্যাণের মতো ধারণার উপর, যা নির্দেশ করে, কীভাবে সমাজ বা ব্যক্তির আচরণ হওয়া উচিত। ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের আলোকে, সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা বা বিশ্লেষণ কখনোই নিখাদভাবে বস্তুতান্ত্রিক (value-free) হতে পারে না, তা সবসময় ব্যক্তিতান্ত্রিক (Subjectivity) হয়।
সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গ ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে প্রভাবিত করে, যা ব্যক্তির বিশ্লেষণের মাঝে পক্ষপাত সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত, বিভিন্ন তত্ত্ব, মতবাদ বা বয়ানে প্রায় প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আদর্শিক আধিপত্য পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, হোর্কহাইমার ও অ্যাডর্নো বলেন, আধিপত্যশীল আদর্শ (ideologies) সমাজে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যা নিপীড়নকে বৈধতা দেয় এবং সাধারণ মানুষের মুক্তির পথ রুদ্ধ করে। এই প্রেক্ষাপটে, যখন ন্যায়বিচার বা স্বাধীনতার মতো মূল্যবোধ বিশ্লেষণের বিষয় হয়, তখন ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব প্রশ্ন তোলেঃ এই মূল্যবোধগুলো কি সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, নাকি শুধু ক্ষমতাশালী শ্রেণির সুবিধা নিশ্চিত করতেই গঠিত?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেও এই প্রশ্নগুলো বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। উদাহরণস্বরূপ, লিবারাল তত্ত্ব বলে যে, আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার মতো সার্বজনীন মূল্যবোধ দ্বারা রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালিত হওয়া উচিত। এই তত্ত্বের মূল্যনির্ভর ভিত্তি হল: ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, যা একটি আদর্শ বৈশ্বিক ব্যবস্থা রূপান্তরের নিমিত্তে রচিত। কিন্তু, ক্রিটিক্যাল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ব, বিশেষত ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, পোস্ট-কলোনিয়াল ও ফেমিনিস্ট তত্ত্বসমূহ, এই মূল্যবোধগুলোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক ‘সার্বজনীন’ মূল্যবোধগুলোর বাস্তব প্রয়োগ আদতে পশ্চিমা ক্ষমতার আধিপত্য টিকিয়ে রাখার উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
যেমন, কিছু রাষ্ট্র ‘মানবাধিকার’-এর অজুহাতে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে যাকে আজকের দুনিয়ায় Humanitarian Intervention বলে। এই ধরণের হস্তক্ষেপের পিছনে প্রধান সমালোচনা হল হস্তক্ষেপের আইনি বৈধতা হিসেবে যে মানবাধিকারের লঙ্গনের অভিযোগ আনা হয় তা অনেকক্ষেত্রে একপাক্ষিকভাবে নির্ধারিত হয়। এই সংকটের উত্তরণে হাবারমাস প্রস্তাব করেন যে, আন্তর্জাতিক মূল্যবোধগুলোকে গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে গঠন করা উচিত, যাতে তা সকল রাষ্ট্র ও জনগণের মতামত প্রতিফলিত করে এবং নিপীড়নমূলক কাঠামো ভেঙে ন্যায়ভিত্তিক একটি বৈশ্বিক সমাজ গঠনে সহায়ক হয়।
সুতরাং, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যেই তত্ত্বই হোক না কেন, যখন তা ন্যায়বিচারের নামে কিছু মূল্যবোধ প্রচার করে, তখন ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব অনিবার্যভাবে জিজ্ঞেস করে—এই ন্যায়ের সংজ্ঞা কে নির্ধারণ করছে, কার স্বার্থে করছে, এবং তা কি সত্যিই সকলের জন্য সমানভাবে কার্যকর? এই প্রশ্ন তোলার মাধ্যমেই মূল্যনির্ভর ভিত্তিকে কেবল আদর্শিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও ক্ষমতাবিশ্লেষণমূলক একটি উপাদান হিসেবে পুনর্বিবেচনার সুযোগ তৈরি হয়।
৩। নির্মাণ, বিনির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ প্রক্রিয়া (Constructive, Deconstructive and Reconstructive Process)ঃ
নির্মাণ, বিনির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ প্রক্রিয়া হলো ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব প্রবর্তিত বিশ্লেষণ কাঠামোর তৃতীয় ধাপ, যেখানে সমাজ, তত্ত্ব কিংবা আদর্শিক বয়ানসমূহকে একদিকে যেমন বিনির্মাণ (deconstruction) করা হয়, অন্যদিকে তেমনি নতুন করে নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ (construction/reconstruction) করার কথাও বলা হয়। এই প্রক্রিয়াগুলোর মূল উদ্দেশ্যঃ প্রচলিত ধারণা, নীতি কিংবা আদর্শের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অসঙ্গতি, পক্ষপাত ও নিপীড়নমূলক উপাদান উন্মোচন করা, এবং সেই জায়গায় একটি ন্যায়ভিত্তিক (justice), অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) ও মুক্তিকামী (emancipatory) কাঠামো গড়ে তোলা।
এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ বিনির্মাণ (Deconstruction)—যার মাধ্যমে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা আদর্শিক বয়ান বিশ্লেষণ করে দেখা হয়, সেটি কীভাবে ক্ষমতার স্বার্থে গঠিত হয়েছে, কী ধরনের নৈতিক যুক্তি ও মূল্যবোধ সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে, এবং কাদের কণ্ঠস্বর বা অভিজ্ঞতা সেখানে বাদ পড়েছে। এই ধাপে প্রচলিত বাস্তবতার ‘স্বাভাবিকতা’কে প্রশ্নবিদ্ধ করে করা হয়, এবং যে আদর্শিক কাঠামো সমাজে প্রতিষ্ঠিত যে বয়ান সমাজে প্রচলিত, তা আসলে কার পক্ষে বা কার পক্ষ থেকে, এবং কার বিরুদ্ধে কাজ করে।
এরপর আসে নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ (Construction and Reconstruction) ধাপ, যেখানে বিকল্প চিন্তার জগৎ নির্মাণ করা হয়। এই পর্যায়ে নতুন বিশ্লেষণ পদ্ধতির সাহায্যে বিদ্যমান তত্ত্ব, নীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পরিবর্তে এমন একটি কিছু প্রস্তাব করা হয়, যা মানবমর্যাদা, অংশগ্রহণ, গণতন্ত্র, সাম্য ও সংহতি প্রভৃতির ভিত্তিতে গঠিত। এই ধাপটি কেবল সমালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সৃজনশীল ও সমাধানমুখী চিন্তা গঠনেও সাহায্যে করে। ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব মনে করে, সমাজ পরিবর্তনের জন্য শুধু তাত্ত্বিক/ অন্তর্নিহিত সমালোচনা যথেষ্ট নয়; বরং সাথে প্রয়োজন নতুন ধারণা, নতুন কাঠামো এবং ন্যায়ের বিকল্প উপস্থাপন, যা বিদ্যমান নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক কাঠামোকে অতিক্রম করতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ আবারও যদি আন্তর্জাতিক মানবিক হস্তক্ষেপ (Humanitarian Intervention) ধারণাটির কথা বলি, তাহলে দেখা যাবেঃ ‘মানবাধিকারের নামে হস্তক্ষেপ’ একটি নৈতিক নীতিরূপে উপস্থাপিত হলেও, পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার প্রায়ই হাতিয়া হিসেবে এই ধারণাকে কাজে লাগায়। বিনির্মাণের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, এই হস্তক্ষেপমূলক নীতির অন্তরে ক্ষমতা, সামরিক আধিপত্য এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যের উপাদান নিহিত রয়েছে।
এরপর, পুনঃনির্মাণের ধাপে প্রশ্ন তোলা হয়: এই নীতিকে কি এমনভাবে পুনর্গঠন করা যায় না, যেখানে স্থানীয় জনগণের অভিজ্ঞতা, সম্মতি এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়? একটি বিকল্প কাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে মানবিক হস্তক্ষেপ এমন একটি রূপ নিতে পারে, যা সমতাভিত্তিক রাজনৈতিক ন্যায়ের অংশ হয়ে ওঠে—যেখানে মানবাধিকার শুধু আদর্শ নয়, বরং নির্বিচার ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং অংশগ্রহণমূলক ন্যায়ের এক প্রকাশ।
৪। উন্মোচনমূলক সমালোচনা (disclosive critique)ঃ
উন্মোচনমূলক সমালোচনা (Disclosive Critique) ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের বিশ্লেষণ কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যার মূল লক্ষ্য হলো—কোনো তত্ত্ব, ভাষা, নীতি, বা সামাজিক বাস্তবতার গভীরে লুকিয়ে থাকা অর্থ, পক্ষপাত ও ক্ষমতার সম্পর্ককে উন্মোচন করা। সমাজে অনেক ধারণা, শব্দ বা নীতিকে এতটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত হিসেবে উপস্থাপন করা হয় যে আমরা সেগুলোর পেছনের আদর্শিক কাঠামো বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আর প্রশ্ন করি না। এই সমালোচনার কাজ হলো সেই ‘স্বাভাবিক’ ও ‘অবধারিত’ বলে ধরা বিশ্বাসগুলোকেই বিশ্লেষণ করে দেখা, সেগুলো কীভাবে গড়ে উঠেছে, কারা তা তৈরি করেছে, এবং কার স্বার্থে তা কাজ করছে। বিশেষ করে মিশেল ফুকো, হাইডেগার, ও ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকেরা বলেন, জ্ঞান, বয়ান, বিশ্লেষণ বা দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই নিরপেক্ষ নয়; বরং তা সমাজের ক্ষমতাকাঠামো দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন, 'উন্নয়ন', 'সার্বভৌমত্ব', বা 'মানবিক হস্তক্ষেপ'—এই শব্দগুলো শুনতে নিরপেক্ষ বা মানবিক মনে হলেও, উন্মোচনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, এসব ধারণার মধ্যেই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, অর্থনৈতিক আধিপত্য ও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব লুকিয়ে থাকে। তাই এই সমালোচনার উদ্দেশ্য হলো—আমাদের জ্ঞানের কাঠামো ও নীতিগত ধারণাগুলোকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখানো, যাতে আমরা বিদ্যমান বাস্তবতার একমাত্রিকতা ভেঙে দিয়ে আরও ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চিন্তার দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
৫। উৎসগত সমালোচনা (genealogical critique)ঃ
উৎসগত সমালোচনা (Genealogical Critique) হলো ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের বিশ্লেষণ কাঠামোর পঞ্চম ও চূড়ান্ত ধাপ, যার মাধ্যমে কোনো ধারণা, নীতি, জ্ঞান বা সামাজিক প্রথার ইতিহাস, উত্পত্তি ও বিকাশের পেছনে থাকা ক্ষমতা, সংঘাত ও আদর্শিক প্রক্রিয়াগুলো উন্মোচন করা হয়। এটি মূলত প্রশ্ন তোলে—আমরা যেসব কিছুকে ‘স্বাভাবিক’, ‘সত্য’ বা ‘বৈধ’ বলে মেনে নিই, সেগুলোর ভিত্তি আদতে কী? এই সমালোচনার মূল প্রেরণা এসেছে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (Michel Foucault)-র কাজ থেকে, বিশেষ করে তাঁর “Discipline and Punish” এবং “The History of Sexuality” বইয়ের আলোকে। ফুকো দেখান, সত্য ও জ্ঞানের ধারণাগুলো কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার ফল নয়, বরং ক্ষমতার এক বিশেষ কাঠামো ও ইতিহাসের মধ্য দিয়ে গঠিত।
ফুকোর মতে, ঐতিহাসিকভাবে আমরা যেসব ধারণা—যেমন ‘পাগলামি’, ‘অপরাধ’, ‘যৌনতা’, বা ‘নিয়ন্ত্রণ’—কে নিরপেক্ষ বা প্রাকৃতিক বলে ভাবি, সেগুলো আসলে বিশেষ সময় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবেই গঠিত হয়েছে। তাঁর দৃষ্টিতে, ইতিহাস কোনো সরলরৈখিক ‘উন্নয়নের’ কাহিনি নয়, বরং তা ক্ষমতা, প্রতিরোধ, ও জ্ঞান উৎপাদনের নানা স্তর ও সংঘাতে গঠিত একটি জটিল প্রক্রিয়া। উৎসগত সমালোচনা এই জটিলতাকেই উন্মোচন করে, এবং দেখায়—কীভাবে একটি নির্দিষ্ট তত্ত্ব বা আদর্শিক কাঠামো প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, এবং সেই প্রভাব বজায় রাখতে নির্দিষ্ট ভাষা, প্রতিষ্ঠান ও শাস্তিমূলক কৌশল ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণস্বরূপ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘সার্বভৌমত্ব’ বা ‘আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা’—এই ধরনের ধারণাগুলোর ইতিহাস যদি উৎসগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তাহলে বোঝা যাবে যে এই ধারণাগুলো কেবল আইনত কিংবা প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হয়নি; বরং ঐতিহাসিক উপনিবেশবাদ, সামরিক আধিপত্য, এবং ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে এগুলো বৈশ্বিক আদর্শে রূপ পেয়েছে।
ফুকোর ভাষায়, উৎসগত বিশ্লেষণ মূলত “যেখানে আমরা সত্য খুঁজি, সেখানে ইতিহাস খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা”। অর্থাৎ, কোনো আদর্শ বা জ্ঞানকে বর্তমান সময় থেকে টেনে বের করে তার জন্ম-পরিস্থিতি, রূপান্তর ও রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করা। এই দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করতে পারি—কোনো ধারণা চিরকালীন বা নিরপেক্ষ নয়, বরং প্রতিটি ধারণা ঐতিহাসিকভাবে গঠিত, ক্ষমতাবানদের স্বার্থে পরিচালিত এবং তাই প্রশ্নযোগ্য। সুতরাং, উৎসগত সমালোচনা আমাদের চিন্তাকে শুধু বর্তমান বাস্তবতায় আটকে না রেখে, তার গভীরে থাকা ইতিহাস ও ক্ষমতার স্তরগুলো অন্বেষণের দিকে ধাবিত করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে “মানবাধিকার” (Human Rights) ধারণাটি একটি সর্বজনীন ও নৈতিক মূল্যবোধ হিসেবে উপস্থাপিত হয়, যা বিশ্বজুড়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবমর্যাদা রক্ষার কথা বলে। কিন্তু উৎসগত সমালোচনার মাধ্যমে যদি এই ধারণার ইতিহাস ও বিকাশকে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যায় যে, মানবাধিকার ধারণাটি একদিকে যেমন ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট যুগের উদ্ভব, অন্যদিকে তা উপনিবেশিক ক্ষমতার ছায়ায় এবং পশ্চিমা রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাবে গঠিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের Universal Declaration of Human Rights প্রণয়ন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে, যেখানে ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের মানবিক ভাবমূর্তি পুনর্গঠনের চেষ্টা করছিল।
কিন্তু এই ঘোষণার পেছনে অনেক উপনিবেশিত জনগণের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বাদ পড়েছিল। অনেক গবেষক যেমন ফুকো, এডওয়ার্ড সাঈদ বা আনুয়া চক্রবর্তী দেখিয়েছেন, এই ধরণের মানবাধিকার বয়ান প্রায়ই পশ্চিমা হস্তক্ষেপ বা “হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশন”-এর নৈতিক অজুহাতে পরিণত হয়, যা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একধরনের নব্য-ঔপনিবেশিকতা তৈরি করেছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসগত সমালোচনা প্রশ্ন তোলে: মানবাধিকার ধারণাটি কে তৈরি করেছে? এর পিছনে কী ধরনের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কাজ করেছে? এবং, এটি কাদের অভিজ্ঞতা উপেক্ষা করে ‘সার্বজনীন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে?
এই প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, মানবাধিকারের মতো একটি ইতিবাচক ধারণাও ইতিহাস, ক্ষমতা ও আদর্শিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে গঠিত, এবং তার সার্বজনীনতা একটিমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না। অতএব, উৎসগত সমালোচনার কাজ হলো এই ইতিহাস ও ক্ষমতার স্তরগুলো উন্মোচন করা, যাতে আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারি।
উপসংহার:
Critical Theory মূলত একটি মুক্তিকামী ও প্রশ্ননির্ভর বিশ্লেষণ পদ্ধতি, যা সমাজ, রাষ্ট্র, জ্ঞান ও নীতিকে নিরপেক্ষ ও স্বাভাবিক ধরে নেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এই তত্ত্বের মূল শক্তি হলো এর স্ব-নিরীক্ষণ, ক্ষমতার অন্তর্নিহিত সম্পর্ক উন্মোচন, এবং প্রাতিষ্ঠানিক বয়ান ও বাস্তবতার গঠনপ্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের চিন্তাবিদেরা দেখিয়েছেন, সামাজিক কাঠামো ও নীতিনির্ধারণ সবসময়ই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ ও আদর্শিক অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই সমাজ বিশ্লেষণে শুধু ঘটনা বা ফলাফল নয়, বরং পেছনের নৈতিক, আদর্শিক ও ক্ষমতাগত ভিত্তিগুলোকেও মূল্যায়ন করা জরুরি।
Critical Theory আমাদের শেখায়ঃ প্রতিটি জ্ঞান, নীতি বা আদর্শকে ইতিহাস, সমাজ এবং ক্ষমতার নিরিখে ব্যাক্ষা করতে হবে; নিরপেক্ষতা বা ‘সত্য’ বলে সমাজবিজ্ঞানে কিছু নেই, যদি না আমরা বুঝি সেই সত্য কে বলছে, কোন কাঠামোর মধ্যে থেকে বলছে, এবং কার অভিজ্ঞতা সেখানে অন্তর্ভুক্ত বা বর্জিত। এই তত্ত্ব শুধু সমাজের অন্তর্হিতিত প্রশ্নগুলোকেই তুলে ধরে না, বরং ন্যায় ও মুক্তির পথে নতুন পরিবর্তনের সম্ভাবনাও ফুটিয়ে তোলে। এটি শুধু একটি তত্ত্বই চর্চা নয়; বরং বিকল্প চিন্তা ও প্রশ্ন করার এক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ পদ্ধতি।
অনুবাদকঃ
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল প্রবন্ধঃ
Crtitical Theory (Frankfurt School)
Published by Stanford Encyclopedia of Philosophy
মূল লেখকঃ
Robin Celikates, Jeffrey Flynn
No comments