Header Ads

Header ADS

Postmodernism Theory: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন ব্যাখ্যা

 

Postmodern Art

Postmodernism প্রত্যয়টি গঠিত হয়েছে দুটি ভিন্ন শব্দের সংযোগে: Post এবং Modernism। শব্দতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে Post শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ Postum থেকে, যার অর্থ “পরবর্তী” (after) বা “উত্তর” (later)। অপরদিকে, Modernism শব্দটির উৎপত্তি লাতিন modernus শব্দ থেকে, যা আধুনিক বা বর্তমান সময়কে নির্দেশ করে (modernus → modernity)। সেই অনুযায়ী, শাব্দিকভাবে Postmodernism বলতে বোঝায় উত্তর-আধুনিকতাবাদ বা আধুনিকতার পরবর্তী ধাপ। এই পরিভাষাটি কেবল একটি দর্শন নয়, বরং এটি চিন্তাধারার অন্তর্নিহিত পরিবর্তনের লক্ষ্যে শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের দর্শন, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ নানা শাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়। 

Post-Structuralism (উত্তর-কাঠামোবাদ) ও Postmodernism (উত্তর-আধুনিকতাবাদ), এই দুটি তত্ত্বকে বলা যায় একই মুদ্রার দুই পিঠ। কারণ, উভয় দর্শনেরই সূচনা ও বিকাশ হয়েছে ফ্রান্সে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে। এই সময়টায় ফরাসি দার্শনিকরা সমাজ, রাজনীতি ও জ্ঞানের কাঠামোকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। তাঁদের অনেকেই মার্কসবাদ, অস্তিত্ববাদ (Existentialism), এবং ঘটনাবিজ্ঞান (Phenomenology) দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ফরাসি সমাজে এক ধরনের বোধ জাগিয়ে তোলে, বিশেষ করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা নিয়ে। পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ তখনও কৃষিনির্ভর ও তুলনামূলকভাবে অনুন্নত ছিল, কিন্তু ফ্রান্সসহ পশ্চিম ইউরোপে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের দ্রুত অগ্রগতি দেখা যায়। এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৬৮ সালের ছাত্র আন্দোলন ও শ্রমিকদের শিল্পাঞ্চলীয় বিক্ষোভ একটি টার্নিং পয়েন্ট বিবেচিত হয়, যা পূর্ব ইউরোপের সামাজিক পরিবর্তনের গতিকে অনেকটাই ত্বরান্বিত করে। 

এই আন্দোলনগুলোর পর ইউরোপজুড়ে গণসংস্কৃতি" (Mass Culture) ও "ভোক্তা/ ভোগবাদী সমাজ" (Consumer Society) নামে এক নতুন ধারার উত্থান ঘটে। বিশেষ করে ফ্রান্সে, Postmodernism তত্ত্বের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো উন্নত প্রযুক্তির প্রসার, গণমাধ্যমের প্রভাব, এবং নগরায়ণ কীভাবে মানুষের অভিজ্ঞতা ও সংস্কৃতিকে রূপান্তর করছে সেই প্রশ্নগুলো। প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে একধরনের সর্বব্যাপী গণসংস্কৃতি তৈরি হয় এবং এই সংস্কৃতি আবার কীভাবে একটি নতুন ভোগবাদী সমাজের ভিত্তি গড়ে তোলে, এগুলো ছিলো Postmodernism-এর মূল বিশ্লেষণ কাঠামো। এছাড়াও, তখনকার ফরাসি সমাজকে অনেক গবেষক “উত্তর-শিল্প সমাজ” (Post-industrial Society) হিসেবেও বর্ণনা করেছেন, যেখানে উৎপাদনের চেয়ে তথ্য, প্রযুক্তি ও ভোগ হয়ে উঠেছিলো নতুন শক্তি ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রধান চালিকা।

Postmodernism দ্বারা এমন একটি কালপর্বকে বুঝায় যা আধুনিকতার (Modernity) শুরু ও শেষ- এই দুটি সময়ের মাঝখানে অবস্থান করে। আধুনিকতার ধারাবাহিকতা ও তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ Postmodernism ধারনাটির অবতারণা ঘঠেছে। যদিও আধুনিকতাবাদ (Modernism) বলেছিলো, নিরপেক্ষ (Objective) ও বস্তগতভাবে (Materialist) সব কিছুকেই সে ব্যাক্ষা করতে পারবে, কিন্তু বিশ্ব ঘটনাবলিকে বস্তুগতভাবে বুঝতে ও নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করতে সে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটেই পোস্টমডার্নিজম তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পোস্টমডার্ন দৃষ্টিভঙ্গি হলঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক যেহেতু রাজনৈতিক কর্মের ফসল, সে রাজনৈতিক কর্ম ও কর্মকান্ড প্রধানত ভাষা (Language), ধারণা (Ideas), বিমূর্ত চিন্তা (Abstract Concept) এবং সামাজিক নিয়ম বা আদর্শ (Norm) ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত ও গঠিত হয়। Postmodernism এই প্রভাব ও গঠন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করে। 

Postmodernism দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা সমাজ ও সংস্কৃতিতে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলোকে ব্যাখ্যা করে। যেখানে Modernism ছিল একটি ঐতিহাসিক যুগ, যার বৈশিষ্ট্য ছিল কলকারখানার বিস্তার, যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন বৃদ্ধি, যুক্তিনির্ভরতা (Rationality), এবং ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) চিন্তা-ভাবনার সামাজিক আধিপত্য; সেখানে Postmodernism আগমন ঘটেছে Modernism-এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে। 

Postmodernism শব্দটি প্রয়োগ করা হয় এমন এক নতুন সময়ের সূচক হিসেবে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিন্নতর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নির্দেশ করে। এটি অতীত স্মৃতিকে ভুলে, নতুন সময়ের গুরুত্বের কথা বলে। সমাজের গুণগত রূপান্তর, সাংস্কৃতিক ও সংবেদনশীলতার পরিবর্তন, এবং উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির উত্থানের মধ্য দিয়ে এই নতুন প্রেক্ষাপটের সূচনা ঘটায়। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ব হিসেবে Modernism ও Postmodernism: 

১৮৯০ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময় পর্যন্ত, একটি ভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে বুঝাতে আধুনিকতাবাদ (Modernism) ধারনাটির অবতারণা ঘটে। এই সময়ের চিত্রকলা, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, নকশা, সাহিত্য ইত্যাদিতে কিছু নির্দিষ্ট ও ভিন্ন ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়, যেগুলো মিলে তৈরি হয় আধুনিকতার চেতনা। আধুনিকতাবাদ শুধু সাংস্কৃতিক কেন্দ্রিকই নয়, বরং রাজনৈতিক, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, যৌনতা এবং পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রেও এক নতুনত্বের এক রূপান্তরের ধারা হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, ইউরোপ, উপনিবেশিক শাসন ও সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এই রূপান্তর লক্ষ্য করা যায়। এই সময়কালে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে, কখনও ইতিবাচকভাবে, আবার কখনও নেতিবাচকভাবে। এর ফলে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। 

আধুনিকীকরণ (Modernization)-এর সূচনা হয়েছিলো শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে। এটি দ্বারা সাধারণত বোঝানো হত বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত রূপান্তর, যার ফলে বিশ্বব্যাপী বিমান, গাড়ি, যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং অন্যান্য আধুনিক যান্ত্রিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে অধিক-উৎপাদন (mass production) সম্ভব হয়েছিল। এই রূপান্তরের পেছনে আশা ছিল যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনমান উন্নত করবে, এবং সামগ্রিকভাবে সমাজকে আরও সহজ ও উন্নত করে তুলবে। কিন্তু বাস্তবে, এই পরিবর্তনের অনেক নেতিবাচক প্রভাব সমাজ ও বিশ্বের ওপর পড়তে শুরু করে, যা মানুষের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি সন্দেহ ও হতাশা সৃষ্টি করে। উত্তর-আধুনিকতাবাদ (Postmodernism) ছিল আধুনিকীকরণের এরূপ উন্নয়নমূলক পরিবর্তনের প্রতি একধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া। 

বিশেষ করে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যখন দেখা গেল যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণের বদলে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র, যেমনঃ পারমাণবিক বোমা, রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র ইত্যাদি উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন "বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মানবজীবন উন্নত হবে" এই ধারণা ধীরে ধীরে বিলীন হতে শুরু করলো। ফলে, মানুষের কাছে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও হতাশাব্যঞ্জক হয়ে উঠতে শুরু করলো। এই পরিস্থিতির ফলাফল হিসেবে পরবর্তী সময়ে Postmodernism -এর মতো সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা ঘটে, যা Modernism-এর মূল বিশ্বাস ও কাঠামোগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। 

ইউরোপে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব, যেমনঃ গণহত্যা, পারমাণবিক অস্ত্র, ও সামরিক দখলদারিত্ব ইত্যাদি সমাজকে আধুনিকতাবাদের ওপর প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। এর ফলস্বরূপ ইউরোপজুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ, গণআন্দোলন ও নাগরিক বিদ্রোহ। এ সময়ে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকা উপনিবেশগুলোতেও শুরু হয় উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম (Decolonization)। আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয়: শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন, নগরায়ন, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণশিক্ষা, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, পেশাগত বিশেষায়ন, সামাজিক গতিশীলতা, আমলাতান্ত্রিকতা এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। তবে এই "উন্নয়নমূলক" কাঠামোর মধ্যেই যখন ফ্যাসিবাদ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইহুদিদের গণহত্যা (হলোকস্ট), এবং বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি দেখা যায়, তখন মানুষের মধ্যে আধুনিকতাবাদের আদর্শকে ঘিরে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও হতাশা জন্ম নেয়। আধুনিকতা তার সাংস্কৃতিক মর্যাদা হারায় এবং মানুষ নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেঃ কিভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ধ্বংসাত্মক দিক থেকে মানবতাকে রক্ষা করা যায়। এই প্রেক্ষাপটে, পোস্টমডার্নিজম একটি দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আত্মপ্রকাশ করে। এটি একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রচলিত ব্যবস্থার বাহিরে এক pluralistic বিশ্বসংস্কৃতির কথা বলে, বিশেষ করে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যখন আন্তর্জাতিক রাজনীতি শক্তির প্রদর্শন ছিলো দুটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক জোট কেন্দ্রিক। 

পোস্টমডার্নিজম ফরাসি দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়, যারা ১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে ফ্রান্সে প্রভাব বিস্তারকারী অস্তিত্ববাদ (Existentialism) তত্ত্বের বিরোধিতা করেন। অস্তিত্ববাদ ব্যক্তির অস্তিত্ব, স্বাধীনতা এবং পছন্দের ওপর জোর দিলেও, পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদরা এসব ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারণারও সমালোচনা করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পোস্টমডার্নিজম প্রবেশ করে ১৯৮০ সালে। রিচার্ড অ্যাশলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নে উত্তর-আধুনিকতাবাদকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাঁর পাশাপাশি মাইকেল শ্যাপিরো, ডেভিড ক্যাম্পবেল, এবং জেমস ডার ডেরিয়ান প্রমুখ পোস্টমডার্নিজম তত্ত্বের প্রসারে বড় ভূমিকা রাখেন। এই বিখ্যাত তাত্ত্বিকেরা বলেন, প্রচলিত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ব আমাদের একধরণের চিন্তার কারবরত্ব (conceptual prison) ঘটিয়েছে। আধুনিকতাবাদ বিশ্বাস করত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন মানেই মানবজীবনের উন্নয়ন। কিন্তু পোস্টমডার্নিস্টরা এই বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তাদের মতে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে ভয়ংকর ধ্বংসের হাতিয়ারও তৈরি করতে পারে, যেমন পারমাণবিক বোমা, রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্র তা প্রমাণিত। এসব প্রযুক্তি নেতিবাচক ব্যবহার মানবজাতি, পরিবেশ এবং বিশ্বকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। 

Postmodernism তত্ত্বের আগমন ঘটে যখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বের গবেষণার ধরণ নিয়ে মহাবিতর্ক চলছে (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের Third Great Debate)। এই বিতর্কের সূচনা করেছিলেন পজিটিভিস্ট (Positivist) গবেষকরা, যারা যুক্তি দেন যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ অবশ্যই নিরপেক্ষ (Objective) এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করে হওয়া উচিত। তারা বিশ্বাস করতেন যে সামাজিক বিজ্ঞানেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে মানব ও সমাজের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তবে পোস্টমডার্ন তাত্ত্বিকরা, যাদের পোস্ট-পজিটিভিস্ট (Post-positivist) বলা হয়, এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তারা বলেন, “সব ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে কোনো নিরপেক্ষ বা চিরন্তন সত্য (Objective Truth) থাকে না।” যেমন ক্লাসিক্যাল লিবারাল (Classical Liberal) চিন্তাবিদ Immanuel Kant এবং নিউরিয়ালিস্ট (Neorealist) তাত্ত্বিক Kenneth Waltz যুক্তি দিয়েছিলেন, “এনলাইটেনমেন্ট” ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থার কার্যপ্রণালী বোঝা সম্ভব, এবং এই জ্ঞান মানব সভ্যতার উন্নয়ন সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। 

পোস্টমডার্নিস্টরা এই ধারণাকে ভুল ও একরকম বুদ্ধিভিত্তিক বিভ্রম (Intellectual Illusion) হিসেবে বিবেচনা করেন। তারা বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেমন মানব কল্যাণে অবদান রাখতে পারে, তেমনি তা ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ও  যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, যা মানবতা ও পরিবেশের জন্য ভয়ংকর হুমকি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে পোস্টমডার্নিস্টরা যুক্তি দেন যে, জ্ঞান ও সত্য কখনোই ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করে না। Steve Smith এর মতে:

“Power requires knowledge and all knowledge relies on and reinforces existing power relations.”

- অর্থাৎ, জ্ঞান ও ক্ষমতা পরস্পর সম্পর্কিত, এবং জ্ঞান অনেক সময়ই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে।

সুতরাং, পোস্টমডার্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তাত্ত্বিকরা প্রচলিত তত্ত্বসমূহের “সত্য” বা “জ্ঞান”- এর প্রকৃত অর্থ ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা খতিয়ে দেখেন এই ধারণাগুলো কীভাবে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এবং কীভাবে তা একপ্রকার নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়। 

Jean-François Lyotard তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Postmodern Condition এ বলেন, যে ব্যাক্ষাকে চূড়ান্ত ও সর্বজনীন সত্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, Postmodernism এমন সব ব্যাখ্যাকে "Meta-narratives" বলে চিহ্নিত করে। যেমনঃ এর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্বঃ Neorealism ও Neoliberalism। এই তত্ত্বদুটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নৈরাজ্যপূর্ণ (Anarchical) বলে, এবং এই বয়ানকে সত্য বলে দাবি করে থাকেন। তবে, পোস্টমডার্ন তাত্ত্বিকদের মতে, এই তত্ত্বদুটির ব্যাখ্যা ও দাবীগুলো যথেষ্ট ভিত্তিহীন ও সন্দেহের। কারণ, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কথিত Anarchical Structure এর পক্ষে নিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানসম্মত কোন প্রমাণ তারা উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি। 

Postmodern তাত্ত্বিকদের ভাষায়, প্রচলিত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বসমূহ (IR Theories), যেমন Realism, Liberalism, বা Marxism, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যাখ্যায় তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে, এসব তত্ত্ব অনেক সময়েই disorder বা বিশৃঙ্খল এবং inaccuracy বা অগ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যায় উপনীত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বের এই সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতিক্রিয়ায়, Postmodernism তত্ত্বটি একটি ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন, যার কেন্দ্রে রয়েছে Power-Knowledge Nexus। এটি একটি ধারণা যা Positivism সমর্থিত “Absolute Truth” বা চূড়ান্ত সত্য ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। অর্থাৎ, পোস্টমডার্ন তত্ত্ব বলে যে, জ্ঞান (knowledge) ও ক্ষমতা (power) একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত তা কখনোই নিরপেক্ষ হতে পারে না। 

James Der Derian এবং তার সমসাময়িক উত্তর-আধুনিকতাবাদী লেখকেরা বলেন যে, Postmodernism তত্ত্বটি আমাদেরকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্ব রাজনীতি বিশ্লেষণের জন্য বেশ কিছু বিকল্প পদ্ধতির (Alternative Methodologies) সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, যেমনঃ  

  • Genealogy (উৎসগত বিশ্লেষণ): ধারণাগুলোর ইতিহাস ও উৎপত্তি কোথা থেকে, কেন এবং কাদের স্বার্থে সৃষ্টি হলো তা উন্মোচন করা।
  • Textual Analysis (পাঠ বিশ্লেষণ): রাষ্ট্রীয় ভাষ্য, নীতিমালা, বা বয়ানকে বিশ্লেষণ করে দেখা—কী বলা হচ্ছে এবং কী গোপন রাখা হচ্ছে?
  • Narrative Inquiry (বয়ানমূলক অনুসন্ধান): রাজনীতি বা ইতিহাসে বলা গল্পগুলোর কাঠামো ও প্রভাব বিশ্লেষণ করা—কারা গল্প বলছে, আর কারা বাদ পড়ছে?
  • Discourse Analysis (ধারণাগত ভাষ্য বিশ্লেষণ): বিশেষ শব্দ বা ভাষার মাধ্যমে রাজনীতিতে কীভাবে ক্ষমতা বৈধতা পায় তা চিহ্নিত করা (যেমন: ‘War on Terror’, ‘Failed State’ ইত্যাদি)।
  • Deconstruction (বিনির্মাণ): একটি পাঠ বা তত্ত্বের মধ্যকার দ্বৈততা (binary opposition)—যেমন উন্নত/অনুন্নত, শক্তি/দুর্বলতা—উন্মোচন করে তাতে লুকানো শ্রেণিভিত্তিক ক্ষমতার সম্পর্ক দেখানো।
  • Double-reading (দ্বৈত পাঠ): প্রথমবার প্রচলিত অর্থে পাঠ করা, দ্বিতীয়বার তা বিশ্লেষণ করে ভিন্ন অর্থ ও সম্ভাবনা বের করা।

এই পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে পোস্টমডার্ন চিন্তাধারা প্রচলিত ও প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ব ও ধারণাগুলোর নির্মাণপ্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ ও চ্যালেঞ্জ করে। বিশেষভাবে, কোন ধারণা বা সত্যকে Deconstruction বা বিনির্মাণের মাধ্যমে পোস্টমডার্ন তাত্ত্বিকরা দেখান, কীভাবে ভাষা, বয়ান এবং পাঠ (text) গঠিত হয় ক্ষমতার স্বার্থে, এবং কীভাবে এই পাঠ বিশ্লেষণ করে তাতে লুকিয়ে থাকা নিপীড়নমূলক কাঠামো উন্মোচন করা যায়।

১৯৮০ সালের আগে International Relations Theory মূলত চারটি প্রধান ধারার দ্বারা প্রভাবিত ছিল: Realism, Liberalism, Marxism, এবং Constructivism। ১৯৫০-এর দশকের সমাজবিজ্ঞানীরা বেশিরভাগই positivist মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, যাদের মতে, বিশ্বের ঘটনাবলীকে বৈজ্ঞানিকভাবে, নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের সূচনা হয়, যাকে বলা হয় Positivism vs Post-Positivism Debate বা Third Debate। এই বিতর্কে postmodernism, feminism, critical theory, post-colonialism, এবং post-structuralism—সবগুলো তত্ত্বই positivist ধারণার বিরোধিতা করে। 

Richard Ashley বলেছেন, আমরা সাধারণভাবে মনে করি যে এই পৃথিবী, রাষ্ট্র, যুদ্ধ বা শান্তির মতো বিষয়গুলো বাস্তবে আগে থেকেই রয়েছে, আর তত্ত্ব বা থিওরি শুধু সেগুলো ব্যাখ্যা করে। কিন্তু পোস্টমডার্ন দৃষ্টিতে, আসলে ব্যাপারটা উল্টো। তত্ত্ব বা চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমেই এই "বাস্তবতা" গড়ে ওঠে। মানে, আমরা যে ভাষায় কথা বলি, যে ধারণা দিয়ে চিন্তা করি—তাই দিয়ে আমরা বাস্তব জগৎকে বুঝি, দেখি, এমনকি গঠনও করি। যেমন, যদি কোনো তত্ত্ব (Realism) বলে যে পৃথিবী নৈরাজ্যপূর্ণ (anarchical), তাহলে আমরা রাজনীতির ঘটনাগুলোকেও সেই চোখে দেখি। অথচ অন্য কোনো তত্ত্ব যদি বলে, পৃথিবী সহযোগিতার জায়গা (Liberalism), তখন আমরা সেটাও দেখতে পারি। তাই, "বাস্তবতা" একটাই নয়, বরং তত্ত্বের চোখ দিয়েই বাস্তবতা তৈরি হয়। 

Postmodernism কেবল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নয়, বরং পশ্চিমা সমাজ ও সংস্কৃতিতে একটি বৃহৎ চিন্তাপদ্ধতির পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। এটি architecture, art, education, law, literature, psychology, science, theatre, history, এবং theology প্রভৃতি ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করেছে। প্রচলিত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে Realism এবং Liberalism-কে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধারা হিসেবে দেখা হয়। Realism-এর মূল ধারণাগুলি হল: state, anarchy, sovereignty, এবং balance of power; অন্যদিকে Liberalism জোর দেয় democracy, peace, এবং interdependence-এর ওপর। পোস্টমডার্নিজম একটি ব্যাখ্যামূলক তত্ত্ব নয়, বরং এটি একটি approach বা দৃষ্টিভঙ্গি, যা বিদ্যমান তত্ত্বগুলোর “স্বাভাবিকীকরণ” (naturalization) প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে এবং খণ্ডন করে। এটি প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান (established knowledge/epistemology) ও ক্ষমতা কাঠামোর (power structures)  এর মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং বলে, জ্ঞান সবসময় কোনো না কোনো ক্ষমতার মাধ্যমে নির্মিত। 

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে Postmodernism-এর তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

  • Established knowledge/ epistemology বা প্রচলিত জ্ঞান বা সত্যের দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা;
  • একাডেমিক চর্চায় ভাষা (Language), পাঠ (Text) ও বয়ানের (Narrative) গুরুত্বকে তুলে ধরা; এবং
  • আধুনিকতা থেকে উত্তর-আধুনিকতার দিকে এক বুদ্ধিভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক যাত্রার পথকে সুগম করা।

১. Established knowledge/ epistemology বা প্রচলিত জ্ঞান ও সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা:

Postmodernism বিশ্বাস করে না যে পৃথিবীতে কোনো “একটি চূড়ান্ত সত্য” (absolute truth) আছে যা সবাই মেনে চলবে। বরং, তারা বলে প্রতিটি "সত্য" আসলে কারো না কারো ক্ষমতা ও স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে। যেমনঃ একটি রাষ্ট্র যখন নিজের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে অন্য রাষ্ট্রকে হুমকি মনে করে (Realism), তখন সেই "হুমকি" বাস্তব হুমকি নাও হতে পারে, এটি হতে পারে আক্রমনের এক অজুহাত। 

২. ভাষা (Language), পাঠ (Text) ও বয়ান (Narrative)-এর গুরুত্ব:

পোস্টমডার্ন চিন্তায় ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ভাষা বাস্তবতার নির্মাতা। অর্থাৎ, আমরা যেভাবে কোনো ঘটনা বা নীতিকে ব্যাখ্যা করি, সেটাই ধীরে ধীরে বাস্তবতায় রূপ নেয়। যেমনঃ “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ” (War on Terror) একটি রাজনৈতিক বয়ান বা narrative, যা ক্ষমতার স্বার্থে তৈরি এবং এর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক হস্তক্ষেপ বা নিপীড়ন ন্যায্যতা পায়।   

৩. আধুনিকতা থেকে উত্তর-আধুনিকতায় বুদ্ধিভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক স্থানান্তর:

এই তত্ত্ব আধুনিকতাবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মানবজীবন, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদিকে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দেয়। এটি বলে, আমরা কেবল উন্নয়ন, অগ্রগতি, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নিরাপত্তা দিয়েই সব ব্যাখ্যা করতে পারি না। পোস্টমডার্নিজম তাই এমন এক চিন্তার পথ খুলে দেয় যেখানে আমরা বিশ্ব রাজনীতিকে বহুমাত্রিক, সাংস্কৃতিক, ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভাষাগত কাঠামোর মধ্যে বুঝতে পারি।

পোস্টমডার্নিজম তত্ত্ব হিসেবে প্রচলিত তত্ত্বগুলোর তথাকথিত নিরপেক্ষ সত্য (objective truth) ধারণাকে অস্বীকার করে, কারণ, পোস্টমডার্নিজম তত্ত্বের ভাষায়, বাস্তবতা সম্পর্কে "সত্য" ও "জ্ঞান" আমাদের "উপলব্ধি (understanding)" এবং "উপস্থাপনার (representation)" উপর নির্ভর করে। Der Derian বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি শাস্ত্র হিসেবে পোস্টমডার্ন পন্থার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। মনে হয় যেন বৈশ্বিক পরিসর এমন একটি আয়না, যেখানে প্রচলিত তত্ত্বের দুর্বলতা (বিশেষ করে যেগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বড় আকারের meta-narrative দিয়ে বোঝায়) স্পষ্ট হয়ে ওঠে। Der Derian-এর মতে, মানুষের সম্পর্কের জটিলতা, দ্ব্যর্থতা ও অনিশ্চয়তা বৈশ্বিক পরিসরে আরও বড় করে প্রতিফলিত হয়, এবং সেটিই প্রমাণ করে যে, মাত্র একটি তত্ত্ব দিয়ে বিশ্ব রাজনীতির কার্যক্রম ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। 

পোস্টমডার্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্র (state) বিশ্লেষণের একক (unit of analysis), এবং তারা একমাত্র প্রাথমিক actor যাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আদেশ (command) দেওয়ার এবং “সংগঠিত সহিংসতা” (organized violence) প্রয়োগের বৈধ অধিকার রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে পোস্টমডার্ন চিন্তাধারা ‘ক্ষমতা’ (Power) ধারণাটিকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ ও সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করে। সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতার সম্পর্ক (Power Nexus) কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত (agent)-কে কীভাবে ভাবতে, বুঝতে ও আচরণ করতে প্রভাবিত করে, এবং এই আচরণের ফলে সেই বিদ্যমান ক্ষমতার কাঠামোতে কী ধরনের পরিবর্তন আসে—এগুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উত্তর-আধুনিকতাবাদ তত্ত্বের মূল আলোচ্যসূচি।

R.B.J. Walker বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে পোস্টমডার্নিজমকে সাহিত্যে, দর্শনে বা ভিজ্যুয়াল আর্টে এর প্রতিফলনের সাথে সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে দেখা জরুরি নয়। অর্থাৎ, এটি একটি স্বতন্ত্র বিশ্লেষণী কাঠামো হিসেবেও কাজ করে। তাঁর মতে, অন্যান্য আন্তর্জাতিক তত্ত্ব যেখানে রাষ্ট্রের আচরণ, সংঘাত বা সহযোগিতার সাধারণ ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ থাকে, সেখানে উত্তর-আধুনিকতাবাদ বরং মনোযোগ দেয় সীমান্ত, ভূখণ্ড এবং রাজনৈতিক সীমানা নির্ধারণের রাজনীতি নিয়ে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে, কীভাবে নিরাপত্তা ও সীমান্ত রক্ষা রাষ্ট্রের পরিচয়, জনগোষ্ঠী, শৃঙ্খলা এবং বৈশ্বিক রাজনীতির ধারণাকে গঠন করে, বা কীভাবে এই সীমানার লঙ্ঘন মানবতা, শান্তি এবং বৃহত্তর বিশ্ব রাজনীতির নতুন ধারণার জন্ম দেয়।

পোস্টমডার্ন তত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশের পেছনে একাধিক ঐতিহাসিক ও সামাজিক ঘটনা দায়ী। বিশেষ করে, ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে ছাত্র-শ্রমিকদের সামাজিক আন্দোলন, বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং দমনমূলক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জটিল প্রভাব প্রভৃতি পোস্টমডার্নিজমের তাত্ত্বিক ভিত্তিকে দৃঢ় করেছে। ফলে, এই তত্ত্ব বিদ্যমান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বগুলোর সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে এবং বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা ক্ষমতা, জ্ঞান এবং পরিচয়ের সম্পর্ককে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে।

Postmodernism Theory এর মূল ধারণাসমূহ (Main Assumptions)ঃ 

১. তাত্ত্বিক বন্দিত্ব (Conceptual Prisons) থেকে মুক্তির আহ্বান

পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদরা মনে করেন যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের প্রচলিত তত্ত্বগুলো আমাদের চিন্তাকে আটকে রাখে নির্দিষ্ট কিছু ধারণা বা কাঠামোর ভেতরে, যাকে বলা হয় “conceptual prisons”। এর অর্থ, আমরা যেভাবে বিশ্বকে দেখি বা বিশ্লেষণ করি, তা আসলে কিছু পুরনো ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তার মাধ্যমে তৈরি হওয়া কাঠামো। যদি উদাহরণ দিয়ে বলি, Realism তত্ত্বে বলা হয়—রাষ্ট্র (State) হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান ও একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ actor, এবং বিশ্বের কাঠামো নৈরাজ্যপূর্ণ (anarchical)। পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদেরা বলেন, এই ধারণা আসলে একটা “তাত্ত্বিক কারাগার বা বুদ্ধিভিত্তিক বন্দিত্ব”, যেখানে অন্যান্য actor যেমন: NGO, সামাজিক আন্দোলন, বহুজাতিক কোম্পানি, বা নারীবাদী গোষ্ঠীগুলোকে গুরুত্বই দেওয়া হয় না। 

২. Modernity এবং Enlightenment ধারণার সমালোচনা

পোস্টমডার্নিজম মনে করে, Modernity ধারণাটি মানুষকে বোঝায় যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ও যুক্তিবাদ (rationality) আমাদের পৃথিবীকে উন্নত ও স্থিতিশীল করে তুলবে। কিন্তু, ইতিহাস দেখায় যে এই উন্নয়নই বহু ধ্বংসের জন্ম দিয়েছে, যেমনঃ বিশ্বযুদ্ধ, উপনিবেশবাদ, ও পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার। যেমনঃ Immanuel Kant তার “Perpetual Peace” ধারণায় বলেছিলেন, গণতন্ত্র ও বাণিজ্য আন্তর্জাতিক শান্তিকে স্থায়ী করবে, এরই প্রেক্ষিতে এসেছিলো লিবারেলিজম তত্ত্বটি। আবার, Kenneth Waltz তার Neorealism তত্ত্বে বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় নৈরাজ্যকে ভালোভাবে বুঝতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করতে হবে। কিন্তু, উত্তর-আধুনিকতাবাদ তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা বলেন, লিবারেলিজম বা নিওরিয়ালিজম নামক তত্ত্বগুলো একধরনের অন্ধ বিশ্বাস, যা বাস্তবতার জটিলতা উপেক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, বুশ প্রশাসন ২০০৩ সালে ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে হামলা চালায়—যা Enlightenment চিন্তার আধুনিক প্রতিফলন—কিন্তু বাস্তবে তা শুধু ইরাকে নয়, বরং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা, ও ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনে। 

৩. কোনো বিষয়েই চূড়ান্ত সত্য নেই (No Objective Reality)

পোস্টমডার্নিজম তত্ত্ব মনে করে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো “একক সত্য” নেই। উপরন্তু, “সত্য” সবসময়ই ব্যাখ্যার ফল এবং ক্ষমতা ও অবস্থান অনুযায়ী ভিন্ন হয়। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র একে “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ” (War on Terror) বললেও, অনেক মুসলিম রাষ্ট্র বা নাগরিক এটিকে “ইসলামোফোবিক আগ্রাসন” হিসেবে দেখেছে। অন্যদিকে, NATO বলেছে তারা “মানবিক হস্তক্ষেপ” (humanitarian intervention) করছে কসোভোতে, কিন্তু সার্বিয়া এটিকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করে। এই উদাহরণগুলো দেখায়, “সত্য” একপাক্ষিক নয়, বরং তা বিভিন্ন actor-এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

৪. Grand Narrative-এর প্রত্যাখ্যান

পোস্টমডার্নিজম তত্ত্ব বলে, ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে একটি master narrative বা বড় গল্প দ্বারা চালিত হয়েছে, যেমন "পশ্চিমা সভ্যতা হচ্ছে উন্নত", বা "গণতন্ত্রই একমাত্র উত্তম শাসনব্যবস্থা"। আবার, Cold War-এর সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই নিজেদের মতাদর্শকে “গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ” হিসেবে উপস্থাপন করেঃ যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র মানেই মুক্তি; এবং সোভিয়েতের দৃষ্টিতে সমাজতন্ত্র মানেই শোষণমুক্ত বিশ্ব।পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদরা বলেন—এই দুই পক্ষেরই তত্ত্ব ছিল একধরনের ‘সত্যের দখলদারি’, যা অন্যান্য বিকল্প সত্যকে খণ্ডন করেছে। তারা মনে করেন, এখন সময় এসেছে ছোট ছোট গল্পের (petit narratives), যেখানে জাতিগোষ্ঠী, নারী, উপজাতি, অভিবাসী ইত্যাদি গোষ্ঠীর নিজস্ব অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

৫. ধর্ম ও মূল্যবোধের বিশ্লেষণ

ধর্ম, ভাষা ও মূল্যবোধ ইত্যাদি পোস্টমডার্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্ষমতা কাঠামোর অংশ। এগুলোকে নিরপেক্ষ বা সর্বজনীন বলে ধরা নেওয়া ঠিক নয়। যেমন: মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক আইডেন্টিটি বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অনেক সময় পশ্চিমা রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে “জঙ্গিবাদ” হিসেবে চিহ্নিত হয়।আবার পশ্চিমা মানবাধিকার বয়ান অনেক সময় মুসলিম বিশ্বের কাছে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের হাতিয়ার মনে হয়।উত্তর-আধুনিকতাবাদ তত্ত্বের চিন্তাবিদরা বলেন, এই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ভাষা মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক, যা আন্তর্জাতিক বয়ানের ভেতর একটি বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ লুকিয়ে রাখে। 

৬. তত্ত্বের বিনির্মাণ (Deconstruction of Theories):

Postmodernism-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি প্রচলিত তত্ত্বগুলোর গঠন ও ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং সেগুলোর "বিনির্মাণ" করে। পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদদের মতে, সমাজবিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বই নিরপেক্ষ (neutral) নয়। বরং প্রতিটি তত্ত্বই ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত ও পক্ষপাতদুষ্ট। তারা মনে করেন, তথাকথিত অভিজ্ঞতাভিত্তিক (empirical) তত্ত্বগুলোও একধরনের "মিথ" বা গল্প, যা ব্যক্তি বিশেষের দৃষ্টিভঙ্গি, মতামত এবং পূর্বধারণায় প্রভাবিত। তাই প্রতিটি তত্ত্বকেই বিশ্লেষণ ও পুনর্বিচার করতে হবে। যেমনঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের Neorealism তত্ত্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে মাত্র এককেন্দ্রিক (power-centric) দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে, যা বাস্তবতার বৈচিত্র্য ও জটিলতা উপেক্ষা করে। 


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে পোস্টমডার্নিজমের অবদান

ক. জ্ঞান ও ক্ষমতার অন্তর্নিহিত সম্পর্ক (Power-Knowledge Nexus):

Postmodernism-এর অন্যতম মৌলিক অবদান হলো, এটি প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে জোর দেয় যে "জ্ঞান" কখনোই ক্ষমতা থেকে স্বাধীন নয়। Michel Foucault-এর ভাষায়,

“Power produces knowledge, and knowledge reinforces existing power relations.”

অর্থাৎ, কোনো ‘অবজেক্টিভ ট্রুথ’ বা সার্বজনীন সত্য নেই—সত্য সবসময় একটি নির্দিষ্ট ক্ষমতা কাঠামোর পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয়। পোস্টমডার্ন তাত্ত্বিকরা দেখান, যেসব তত্ত্বকে আমরা নিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক বলে বিশ্বাস করি, সেগুলোর মধ্যেও ক্ষমতা, বৈষম্য ও রাজনীতির উপস্থিতি থাকে।

খ. Text বা পাঠ হিসেবে বিশ্বকে দেখা (World as a Text):

Postmodernism বিশ্বাস করে, বিশ্ব রাজনীতিকে একটি Text হিসেবে বিশ্লেষণ করা উচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বুঝতে কোনো একক, চূড়ান্ত ব্যাখ্যা নেই, বরং আছে বহু স্তরের, বহু দৃষ্টিকোণের ব্যাখ্যা। তাই, পোস্টমডার্নিস্টরা pluralism বা বহুবচনের ওপর গুরুত্ব দেন।

গ. বিকল্প বিশ্লেষণ পদ্ধতির প্রবর্তন:

Postmodern তাত্ত্বিকরা প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিপরীতে কিছু বিকল্প বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যেমন:

  • Deconstruction (ধারণার বিনির্মাণ):

Deconstruction এমন একটি বিশ্লেষণ পদ্ধতি, যার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, প্রচলিত তত্ত্ব ও ভাষা কাঠামো, যেগুলো নিজেদের “স্বাভাবিক” ও “সত্য” বলে উপস্থাপন করে—আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কৃত্রিম। পোস্টমডার্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যায়:

"There is no universal logic, only situated reasons; no absolute morality, only social preferences; no grand human progress, only diverse cultural stories."

  • Double Reading (দ্বৈত পাঠ বিশ্লেষণ):

এটি এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে কোনো পাঠ বা তত্ত্বকে একাধিকবার ও গভীরভাবে পড়া হয়, যাতে সেটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অস্পষ্টতা ও ক্ষমতানির্ভর বয়ান উদঘাটন করা যায়। Richard Ashley-এর মতে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে পোস্টমডার্নিস্টরা যেমন “international anarchy” বা “state sovereignty” এর মতো আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলধারার ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। 

উপসংহারঃ 

পোস্টমডার্নিজম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে, যা প্রচলিত তত্ত্বসমূহের ভিত্তি, ব্যাখ্যা ও “সত্য”-এর দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই তত্ত্ব বিশ্বাস করে যে, জ্ঞান ও সত্য কখনোই নিরপেক্ষ নয়; বরং সেগুলো সর্বদা নির্দিষ্ট ক্ষমতার কাঠামো দ্বারা গঠিত এবং নিয়ন্ত্রিত। পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করে দেখিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি কেবল শক্তির ভারসাম্য নয়, বরং ভাষা, বয়ান, সংস্কৃতি এবং সমাজের তৈরি একটি নির্মিত বাস্তবতা। তাদের মতে, কোনো চূড়ান্ত বা সর্বজনীন সত্য নেই—বরং রয়েছে বহু মতবাদ, ব্যাখ্যা এবং বয়ানের একটি জটিল নেটওয়ার্ক। 

তাই, আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বোঝার জন্য প্রথাগত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নয়, বরং প্রয়োজন বিকল্প পদ্ধতি, যেমন: Deconstruction, Double Reading, Narrative ও Discourse Analysis। অবশেষে, পোস্টমডার্নিজম আমাদের শেখায়, কীভাবে বিদ্যমান জ্ঞানের কাঠামোকে প্রশ্ন করা যায়, এবং কীভাবে “সত্য” বলে প্রচারিত ধারণার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতার খেলা উন্মোচন করা যায়। এটি একটি আত্ম-সমালোচনামূলক, বহুস্বরভিত্তিক ও বিশ্লেষণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি—যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি নতুন আলোতে দেখতে সহায়তা করে।



অনুবাদকঃ 
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


মূলঃ Postmodernism in International Relations

লেখকঃ Ali Usman Danwanzam, Yahaya Garba Saleh, Amon Rimamtanung Stephen


No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.