Header Ads

Header ADS

যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে Containment Policy: প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ

 যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে Containment Policy: প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ

Containment Policy

Containment শব্দটি ইংরেজি ভাষার একটি বিশেষ্য (noun), যার বাংলা পারিভাষিক অর্থ হলো আটকে রাখা, সীমাবদ্ধ করা, বেষ্টনী তৈরি বা নিয়ন্ত্রণে রাখা। উৎসগতভাবে শব্দটি লাতিন ভাষা থেকে উদ্ভূত। এর মূল লাতিন রূপ “continere”, যার অর্থ থামিয়ে রাখা বা বাধা দেওয়া। এই “continere” শব্দটি দুটি অংশে বিভক্ত— “com-” অর্থাৎ একত্রে এবং “tenere”, অর্থাৎ ধরে রাখা। এই লাতিন শব্দটি ধীরে ধীরে ইংরেজি ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে ক্রিয়া “contain” এবং বিশেষ্য “containment” রূপে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। আধুনিক ইংরেজিতে containment শব্দটি এমন একটি প্রক্রিয়া বা কৌশলকে নির্দেশ করে, যার মাধ্যমে কোনো ঘটনা, শক্তি বা প্রভাবকে বিস্তার বা সম্প্রসারণ থেকে সীমাবদ্ধ করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষণে containment শব্দটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এটি বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে স্নায়ুযুদ্ধ (Cold War) পর্বে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শিক ও ভূ-রাজনৈতিক সম্প্রসারণ ঠেকানোর জন্য একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল হিসেবে “Containment Policy” গ্রহণ করে। পরবর্তীতে, এই নীতি বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও কৌশলগত ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

Containment Policy এর ইতিহাসঃ 

মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ. কেনান (George F. Kennan) প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে "Containment" বা "নিয়ন্ত্রণ" নীতির ধারণা উপস্থাপন করেন। ১৯৪৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি দীর্ঘ টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন, যা পরে "Long Telegram" নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে "Foreign Affairs" ম্যাগাজিনে "X" ছদ্মনামে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি এই ধারণাকে আরও সুসংগঠিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। স্নায়ুযুদ্ধকালীন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণবাদী কৌশলের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদানের উদ্দেশ্যেই এই Containment নীতির প্রস্তাব দেওয়া হয়। কেনানের মতে, সোভিয়েত আদর্শিক ও ভূরাজনৈতিক সম্প্রসারণকে সামরিক সংঘাত নয়, বরং কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিরোধের মাধ্যমে ঠেকানোই হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশল। এই নীতিই পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধকালীন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাত ও জোট গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। 

স্নায়ুযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি ছিল মূলত দ্বিমেরুকেন্দ্রিক (Bipolar World Order)। একদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী পশ্চিমা জোট এবং অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক জোট। এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে একটি সুসংহত কৌশলগত কাঠামোর মধ্যে পরিচালনার লক্ষ্যে মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ. কেনান “কন্টেইনমেন্ট” তত্ত্ব উত্থাপন করেন। যদিও নিরপেক্ষ আন্দোলন (Non-Aligned Movement, NAM) এই দ্বিমেরু কাঠামোর বাইরে একটি বিকল্প রাজনৈতিক অবস্থান গঠনের চেষ্টা করে, বাস্তবতায় তারা ছিল তুলনামূলকভাবে প্রান্তিক এবং প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকায় নিয়োজিত। ফলস্বরূপ, কন্টেইনমেন্ট নীতির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত সম্প্রসারণ রোধ, এবং এটি NAM-ভিত্তিক রাষ্ট্রসমূহকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়নি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যখন দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা (Bipolar World Order) ভেঙে পড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন একমেরুকেন্দ্রিক (Unipolar World Order) ব্যবস্থার উত্থান ঘটে, তখন কন্টেইনমেন্ট তত্ত্বের কার্যকারিতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বহু বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন যে, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সাথে সাথে এই তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতাও হ্রাস পাবে। কিন্তু, এই ধারণা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিশেষত,  অধীনে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে কন্টেইনমেন্ট নীতি অনুসারে সাজাতে শুরু করে। তবে এবারে সোভিয়েত বা কোন রাষ্ট্র নয়, এবারে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নতুন ধরনের বৈশ্বিক হুমকিকে, যেমনঃ “সন্ত্রাসবাদ,” “দুষ্কৃতিকারী রাষ্ট্র” (rogue states), এবং “অজ্ঞাত সত্তা” (ambiguous entities)—কে টার্গেট করে পুনরায় কন্টেইনমেন্ট নীতিকে ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই তত্ত্বের কার্যকারিতা, সীমাবদ্ধতা ও নৈতিকতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা ও তাত্ত্বিক বিতর্ক শুরু হয়।

Containment ধারণাটি স্নায়ুযুদ্ধকালীন মার্কিন বৈদেশিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের প্রশাসন (১৯৪৫–১৯৫৩) এই ধারণাকে একটি রাষ্ট্রীয় নীতি (doctrine) এবং বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডের ন্যায়সংগত যুক্তি (rationale for external action) হিসেবে গ্রহণ করে। ট্রুম্যানের পরবর্তী রাষ্ট্রপতিরাও, বিশেষ করে লিন্ডন বি. জনসন (১৯৬৩–১৯৬৯), এই নীতি বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এটি ছিল একটি প্রতিরক্ষামূলক ও প্রতিরোধমূলক কৌশল, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে নিজস্ব আদর্শিক প্রভাব ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালায়। যেমন: এই ধারণার প্রস্তাবক মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ. কেনান ইফরেন ম্যাগাজিন পত্রিকায় তাঁর বিখ্যাত “X” প্রবন্ধে লিখেছিলেন:   

“The main element of any United States policy toward the Soviet Union must be that of a long-term, patient but firm and vigilant containment of Russian expansive tendencies.”

— X (Kennan), Foreign Affairs, 1947

এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে এফ. কেনান দীর্ঘমেয়াদে একটি কঠোর, সতর্ক ও কার্যকরী প্রতিরোধ নীতির পক্ষে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র কন্টেইনমেন্ট নীতি বাস্তবায়নে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত সম্প্রসারণ ও কমিউনিস্ট মতাদর্শ বিস্তার রোধ করা। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণ নীতির প্রধান ক্ষেত্র ছিলো ইউরোপ ও এশিয়া। উদাহরণ হিসেবে মার্শাল প্ল্যান, ন্যাটো (NATO), CENTO, SEATO, Domino Policy   ইত্যাদি গঠনের মতো উদ্যোগের প্রসঙ্গ টানা যায়। 

এখানে কতিপয় উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যা যুক্তরাষ্ট্রকে Containment নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে মনোযোগী করেছে। যথা: 

১. গ্রিসে “কমিউনিস্ট বিস্তার” প্রতিরোধে সহায়তা (১৯৪৭): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে গ্রিসে একটি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়—যেখানে একদিকে ছিল রাজতন্ত্রপন্থী সরকার এবং অন্যদিকে ছিল কমিউনিস্ট বিদ্রোহীরা। যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করছিল, গ্রিস যদি কমিউনিস্টদের হাতে চলে যায়, তাহলে তুরস্ক ও অন্যান্য দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশেও এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে (যেটিকে বলা হয় Domino Theory)।ফলে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে গ্রিসের সরকারকে সহায়তা করে কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ করে। এটিই ছিল কন্টেইনমেন্ট নীতির প্রথম বড় বাস্তব প্রয়োগ। 

২. মার্শাল প্ল্যান (১৯৪৮): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই দুর্বলতা কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন বাড়াতে পারত, বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র চালু করে মার্শাল প্ল্যান—যার মাধ্যমে প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়া হয় ইউরোপের ১৬টি দেশকে। এর উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে সোভিয়েত প্রভাব প্রতিরোধ করা। Marshal Plan কে কন্টেইনমেন্ট নীতির একটি অর্থনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

৩. ট্রুম্যান ডকট্রিন ঘোষণা (১২ মার্চ ১৯৪৭): তার এক বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বলেন:“আমরা সহায়তা করব সেই সব মুক্ত মানুষদের, যারা সশস্ত্র সংখ্যালঘু বা বাইরের চাপের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা করছে।” এটি ট্রুম্যান ডকট্রিন নামে পরিচিত। মূলত এটি ছিল কন্টেইনমেন্ট নীতির নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—যেকোনো স্থানে কমিউনিস্ট হুমকি প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে।

৪. NATO গঠন (১৯৪৯): North Atlantic Treaty Organization (NATO) গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এটি ছিল একটি সামরিক জোট, যেখানে একটি সদস্য রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে বাকিরা একযোগে প্রতিক্রিয়া জানাবে। NATO ছিল কন্টেইনমেন্ট নীতির সাংগঠনিক এবং প্রতিরক্ষামূলক রূপ।

৫. কোরিয়া যুদ্ধ (১৯৫০–৫৩)ঃ কোরিয়া যুদ্ধ ছিল কন্টেইনমেন্ট নীতির সামরিক প্রয়োগের অন্যতম প্রধান উদাহরণ। উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট সরকার দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রমণ চালালে, জাতিসংঘের অনুমোদনে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিজমকে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করতে বাধা দেয়, যা ছিল কন্টেইনমেন্ট নীতির লক্ষ্য।

৬. ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৫৫–১৯৭৫)ঃ এই যুদ্ধের মূল পটভূমি ছিল—উত্তর ভিয়েতনামে সোভিয়েত-সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকার এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকার। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত, যদি ভিয়েতনাম কমিউনিজমের হাতে পড়ে, তাহলে অন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোও একই পথে যাবে (Domino Theory)। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর পরাজিত হয়, কিন্তু এটি ছিল কন্টেইনমেন্ট নীতির সবচেয়ে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল প্রয়োগ।

এইভাবে কন্টেইনমেন্ট নীতিমালা যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে দীর্ঘ সময় ধরে প্রভাবিত করেছে। 

কন্টেইনমেন্ট নীতির অবসান ও পুনরাবির্ভাব: উত্তরণ থেকে রিগ্যান পর্যন্ত

১৯৬০-এর দশকের শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক উন্নতির দিকে যায়। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আন্তর্জাতিক উত্তেজনা হ্রাসে উদ্যোগ নেন, যার পরিচিতি হয় "détente" নামে। এই নীতির মাধ্যমে তারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও কূটনৈতিক সংলাপকে গুরুত্ব দেন। ফলে, ঐ সময়টায় কন্টেইনমেন্ট নীতির কার্যকারিতা অনেকটাই কমে আসে।

তবে এর আগেই, "Rollback" নামে একটি আরো আগ্রাসী নীতির কথা উঠেছিল, যার প্রবক্তা ছিলেন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেস। তিনি কেবল সোভিয়েত সম্প্রসারণকে ঠেকানোতে সন্তুষ্ট ছিলেন না, বরং সরাসরি পূর্ব ইউরোপ থেকে সোভিয়েত প্রভাব "নির্মূল" করে সেখানে "মুক্তি" আনার কথা বলেছিলেন। এই বিকল্প কৌশল ও শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের মধ্যেও কন্টেইনমেন্ট নীতি পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। বরং ১৯৮০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তা আবার নতুন রূপে ফিরিয়ে আনেন।

রিগ্যান প্রশাসনের সময় কন্টেইনমেন্ট নীতিকে আরও বিস্তৃত ও আক্রমণাত্মকভাবে ব্যবহার করা হয়। তার উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমগুলো ছিল—

  • আআফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, কম্বোডিয়া ও নিকারাগুয়ায় সোভিয়েত সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত গেরিলাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা প্রদান।
  • পশ্চিম ইউরোপে মার্কিন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের মাধ্যমে সোভিয়েত সামরিক শক্তিকে চাপে রাখা ও ভারসাম্যহীন করার প্রয়াস।
  • স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ (SDI): এটি ছিল একটি উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা, যা মহাকাশ ও মাটিতে থেকে শত্রু ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্ষম সিস্টেম গড়ে তোলার কথা বলে। এর কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় বাধ্য করে ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়।

এইভাবে রিগ্যান কেবল কন্টেইনমেন্ট নীতিকে পুনর্জীবিতই করেননি, বরং একে নতুন মাত্রা ও নতুন অভিমুখ দিয়েছিলেন। রিগ্যান সরাসরি সোভিয়েত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানান- কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত সবদিক দিয়ে। 

কন্টেইনমেন্ট নীতির শক্তি ও দীর্ঘস্থায়ীতার পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের প্রভাব 

যুক্তরাষ্ট্রের কন্টেইনমেন্ট নীতি দীর্ঘ সময় ধরে বৈদেশিক নীতি হিসেবে কার্যকর থাকতে পেরেছে, কারণ এর পেছনে একসাথে অভ্যন্তরীণ (Domestic) এবং আন্তর্জাতিক (External) নানা উপাদান কাজ করেছিল।

১৯৪০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান প্রশাসনের সময়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। এই অর্থনৈতিক ও সামরিক ভিত্তি কন্টেইনমেন্ট নীতিকে বাস্তবায়নের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিকভাবে সবল রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের নানা অঞ্চলে সামরিক সহায়তা, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পেরেছিল। 

১৯৫৩ সালে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের মৃত্যু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আনে। পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার সামরিক ভারসাম্য রক্ষার বদলে বরং সরকারি ব্যয় হ্রাস, অর্থনৈতিক সহায়তা কমানো এবং ব্যয়বহুল সামরিক মোতায়েন সীমিত করার নীতিতে মনোযোগ দেন। অর্থাৎ, তিনি কন্টেইনমেন্ট নীতিকে সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে নয়, অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।

১৯৮৯–১৯৯১ সালের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে ধারণা করা হয়েছিল যে কন্টেইনমেন্ট নীতির প্রয়োজনীয়তা আর থাকবে না। বিশ্লেষকদের আশা ছিল একটি "সাহসী নতুন বিশ্ব" গড়ে উঠবে, যেখানে শান্তি ও সহযোগিতা প্রাধান্য পাবে এবং কন্টেইনমেন্টের মতো ব্যয়বহুল প্রতিরক্ষা কৌশল অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্ন। 

বার্লিন প্রাচীর ভাঙার দুই দশক পরও বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ৭০০টির বেশি সামরিক ঘাঁটি সক্রিয় রয়েছে এবং ১৫০টিরও বেশি দেশে প্রায় ৩,৭০,০০০ মার্কিন সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। এই তথ্য প্রমাণ করে, স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হলেও যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিজেদের বৈদেশিক স্বার্থ বিবেচনায় এখনো নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।

বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র প্রায়শই "নতুন শত্রু", "সমতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী (Peer Competitor)" এবং "আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ" এর মতো নতুন হুমকির কথা বলে। ফলে, যদিও কন্টেইনমেন্ট নীতির পুরনো কাঠামো বদলে গেছে, কিন্তু তার মূল চেতনা এখনো অনেক ক্ষেত্রে টিকে আছে—নতুন আকারে, নতুন ব্যাখ্যায়। 


Post-Bipolar বিশ্বে কন্টেইনমেন্ট নীতি

যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে “containment” বা নিয়ন্ত্রণ নীতির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এর “আত্মা” এখনো বিরাজমান। বিশেষ করে তিন ধরনের নতুন হুমকিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এই নীতির রূপান্তরিত প্রয়োগ চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন: 

১. Rogue States (দুষ্কৃতিকারী রাষ্ট্র):

১৯৯১ সালের গলফ যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে “দুষ্কৃতিকারী রাষ্ট্র” হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার বিরুদ্ধে একটি কঠোর কন্টেইনমেন্ট নীতি গ্রহণ করে। এই নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে সীমিত করা, যাতে সে আরও কোনো দেশে বা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য আঞ্চলিক হুমকি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে না পারে। 

কন্টেইনমেন্ট নীতির আওতায় ইরাকে যা করা হয়:

  • ইরাকের উপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে তার অর্থনীতি দুর্বল করা হয়, যাতে দেশের সামরিক ও প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা সীমিত হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরাকে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীর অভাব দেখা দেয়, যা দেশটির সাধারণ জনগণের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
  • ইরাকের কাছ থেকে নিষিদ্ধ অস্ত্র সরানোর জন্য জাতিসংঘ একটি পরিদর্শক দল পাঠায়, যারা ইরাকের বিভিন্ন সামরিক ও বিজ্ঞান কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে। এই পরিদর্শন মূলত নিশ্চিত করার জন্য যে ইরাক কোন ধ্বংসাত্মক অবৈধ অস্ত্র যেমন, পরমাণু, বায়োলজিক্যাল বা রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করছে না। 
  • যুক্তরাষ্ট্র পারস্য উপসাগরের নিরাপত্তা রক্ষায়, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ জলপথে মার্কিন বাণিজ্য ও সামরিক গতি অবাধ রাখতে তার সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। 
  • আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইরাককে একাকী করে ফেলা হয়, যাতে তার প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো তার সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে দেয়। এতে ইরাকের রাজনৈতিক প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস পায় এবং তার উপর আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। 

২. Peer Competitors (সমতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী):

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চীনের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন ধরনের কন্টেইনমেন্ট নীতি গ্রহণ করে। যদিও সরকারিভাবে এটি স্পষ্টভাবে কন্টেইনমেন্ট হিসেবে স্বীকৃত নয়, তবুও সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, মিত্র রাষ্ট্রদের প্রতি সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি বজায় রেখেছে। বিশেষ করে তাইওয়ানের নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট সংকেত প্রদান করেছে।

জন মিয়ারশেইমার, একজন বিশিষ্ট রিয়ালিস্ট তাত্ত্বিক, যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলকে তিনি শক্তির ভারসাম্য (Balance of Power) রক্ষার প্রয়াস হিসেবে দেখেন। তার “Offensive Realism” তত্ত্ব অনুযায়ী, বড় রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে এবং সে সূত্র অনুযায়ী চীনের উত্থানকেও যুক্তরাষ্ট্র বাধাগ্রস্ত করতে চায়। মিয়ারশেইমারের মতে, এই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্ব রাজনীতিতে সংঘাতের সম্ভাবনাও বাড়িয়ে তুলবে, কারণ আগত সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। সার্বিকভাবে, বর্তমান বিশ্বে চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে একটি আধুনিক রিয়ালিস্ট কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যেখানে কন্টেইনমেন্ট নীতি পুরনো হলেও তার চেতনা আজও বিদ্যমান।

৩. Ambiguous Threats (অস্পষ্ট হুমকি):

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি নতুন ধরনের কন্টেইনমেন্ট কৌশল যোগ হয়, যা ‘অস্পষ্ট হুমকি’ বা “Ambiguous Threats” নামে পরিচিত। এই কৌশল মূলত রাষ্ট্র নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উগ্রবাদী গোষ্ঠী, এমনকি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উগ্রবাদী প্রথার বিবেচনায় গ্রহণ করা হয়।। ৯/১১ এর প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র এই নতুন প্রকার হুমকির বিরুদ্ধে তার মিত্র দেশগুলোকে টেনে এনে ‘War on Terror’ বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে শুরু করে। এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসবাদে জড়িত বা সংশ্লিষ্ট যে কোনো গোষ্ঠী বা নেটওয়ার্ককে দুর্বল করা, যা একদিকে যেমন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে টার্গেট করতো, অন্যদিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উগ্রবাদী প্রথাগুলোকেও সন্দেহের চোখে দেখে তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতো। 

যুদ্ধের মূল ক্ষেত্র ছিল মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন ইরাক, আফগানিস্তান, উপসাগরীয় দেশগুলো, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু অংশ। এই প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে, সন্ত্রাসীদের আর্থিক ও সামাজিক নেটওয়ার্ক ধ্বংসে ব্যাপক অভিযান চালায়, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা চালায় এবং আন্ত:সীমান্ত (cross-border) চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার রোধে কাজ করে। 

এই কৌশলটি পূর্বের কন্টেইনমেন্ট নীতির থেকে ভিন্ন, কারণ এতে শত্রু নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্র নয়, বরং অস্পষ্ট ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক এবং তাদের সম্ভাব্য সহযোগী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এর ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নীতিতে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আসে, যা আধুনিক যুগের বৈশ্বিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জকে আরও জটিল করে তুলেছে। 

উপসংহার:
কন্টেইনমেন্ট নীতি স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি প্রধান কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, যা সোভিয়েত সম্প্রসারণ রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই নীতির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার কমে গিয়েছিল, তবুও নতুন বৈশ্বিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ যেমন দুষ্কৃতিকারী রাষ্ট্র (Rogue States), সমতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী (Peer Competitors), এবং অস্পষ্ট হুমকি (Ambiguous Threats) মোকাবেলায় কন্টেইনমেন্টের ধারণা আজও প্রাসঙ্গিক। একে বিশেষজ্ঞরা Neo-Containment Policy-ও বলে থাকেন। এর পরিবর্তিত রূপ যুক্তরাষ্ট্রকে বহুমাত্রিক হুমকির বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। ফলে বলা যায়, কন্টেইনমেন্ট নীতি যদিও যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে বদলেছে, তার মূল চেতনা এবং প্রভাব আজও বিশ্ব রাজনীতিতে গভীরভাবে বিরাজমান। 



অনুবাদক: 
বদিরুজ্জামান 
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 


মূল লেখক: 
Frédéric Charillon 
Université d’Auvergne–Clermont Ferrand 1 Paris, France


মূল গ্রন্থ: 
International Encyclopedia of Political Science 

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.