Feminism: তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক বিজ্ঞান
![]() |
| Feminism for Women Liberty |
বিংশ শতাব্দী নানা কারণে মানব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, এবং সে অধ্যায়ের অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা হলো Feminism বা নারীবাদের উত্থান। নারীদের ভোটার অধিকার নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে নারীবাদী চেতনার সূচনা ঘটে। ভোটার অধিকার নারীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং জনসম্পৃক্ততার পথ প্রশস্ত করে। ক্রমে নারীরা কর্মক্ষেত্রে অধিকহারে যোগদান করে এবং জনসম্পৃক্ত কর্মকান্ডেও নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি, বি্বিধ নাগরিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে নারীর সাথে রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক দৃঢ় হতে শুরু করে। এভাবে নারীরা সমাজ ও রাজনীতিতে একযোগে নিজেদের উপস্থিতি ও প্রভাব বিস্তার করে।
নারীরা রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নারী অধিকার সম্বলিত নী্তি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দীর্ঘ সময় ধরে Women’s liberation movements বা নারীমুক্তি আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। এই আন্দোলনে সকল বয়সের, সকল শ্রেণির এবং সকল বর্ণের নারীর উপস্থিতি ও প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য। নারীমুক্তি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিলো নারীর অধিকার নিশ্চিতকল্পে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কাঠামোয় বিদ্যমান সকল লিঙ্গভিত্তিক অসমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা, এবং প্রয়োজনে, নারী জোট গঠন করা যাতে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানঙ্ক রাজনীতিতে নারীর প্রবেশাধিকার সুগম হয়। এবাদেও, বিশ শতকের শেষভাগে নারীরা বিভিন্ন গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
রাজনৈ্তিক কর্মকাণ্ডে সমতাভিত্তিক অধিকারের লক্ষ্যে তাদের চলমান নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিলো জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও লিঙ্গভিত্তিক অসমতা দূর করা। এ লক্ষ্যে নারীবাদী জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) প্রবর্তন ও প্রসার ছিলো নারীবাদীদের খুব জরুরি ও জটিল এক কাজ। নারীবাদের সমর্থনে একাডেমিকরা প্রাথমিকভাবে ধী্রে হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করার প্রচেষ্টা চালান, এবং ক্রমে “Gender and Politics” একটি জ্ঞানক্ষেত্রে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন ধরণের Research Questions, Concepts, Theories এবং Methods (পদ্ধতি)-এর কারণে “Gender and Politics” নামক জ্ঞানক্ষেত্রের গবেষণাকার্য আরও বেশি উন্নত হয়েছে। বস্তুত, এসব গবেষণা ও তাত্ত্বিক বিকাশের পেছনে রয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে Feminist আন্দোলনের লম্বা প্রেক্ষাপট, এবং সমাজবিজ্ঞান ও বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটতে থাকা একের পর এক নতুন নতুন পরিবর্তন।
Feminism তত্ত্বের প্রেক্ষাপট
১৯০৬ সালে, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ড নারীদের ভোটার অধিকার ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার প্রদান করে। পরের বছরই, উনিশজন নারী ফিনল্যান্ডের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। নারীদের এরূপ রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ইতিহাস ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে পরিগনিত হয়। এভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ নারী ক্ষমতায়ন ও নারীর সর্বজনীন অধিকার অর্জনের স্বীকৃতি প্রদান করে। এই স্বীকৃতি পরবর্তীতে নারীদের gender equality (লিঙ্গসমতা) অর্জনের পথকে প্রশস্ত করে। উল্লেখ্য, নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো নারীদের ভোটের ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অধিকার অর্জন। এই আন্দোলন পরে একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপ নেয়, যেখানে গণবিক্ষোভ, সমাবেশ ও পদযাত্রা ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তী ধাপে, নারীরা রাজনৈতিক দলের কর্মী, বক্তা ও প্রার্থী হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালায়। যদিও সেই সময় নারীদের দলীয় কর্মী ও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া অনেকটাই প্রতীকী ছিল, তবুও এই প্রতীকায়ন আঠারো ও ঊনবিংশ শতকের নারীবাদী রাজনৈতিক দার্শনিক ও নারী অধিকারকর্মী, যেমন; Olympe de Gouge, Mary Wollstonecraft, এবং Harriet Taylor Mill-এর কল্পিত লিঙ্গভিত্তিক সমতার সমাজ নির্মাণের আংশিক বাস্তবায়ন ঘটায়। তবে, বিংশ শতাব্দীর সূচনাতেই সব দেশ নারীদের ভোটাধিকার দেয়নি। অনেক দেশেই নারীরা রাজনৈতিক অধিকার লাভ করে বিংশ শতকের মাঝামাঝিতে। যেমন: স্পেনে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃতি পায় ১৯৩১ সালে, ফ্রান্সে ১৯৪৪ সালে, ইতালিতে ১৯৪৬ সালে, ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৪৫ সালে, পেরুতে ১৯৫৫ সালে, সুইজারল্যান্ডে ১৯৭১ সালে, এবং কুয়েতে নারীদের ভোটাধিকার আইন পাস করে ২০০৫ সালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নারীর civic identity বা নাগরিক পরিচয়ের বিকাশ ও সামাজিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত। যুদ্ধকালীন সময়ে ইউরোপ ও আমেরিকার বিপুল সংখ্যক পুরুষ সামরিক বাহিনীতে নিয়োজিত থাকায় অস্ত্রশিল্প এবং অন্যান্য যুদ্ধ-সহায়ক খাতে জনবল সংকট দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের তাগিদে নারীদের ব্যাপক হারে কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। Patriotic act বা দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে যুদ্ধ-সম্পর্কিত শ্রমকে উপস্থাপন করা হলে নারীরা ঐতিহাসিকভাবে শ্রমবাজারে প্রবেশের এক নতুন সুযোগ লাভ করেন। পাশাপাশি, পূর্বে গৃহকর্মে নিয়োজিত অনেক বিবাহিত নারীও এই সময় কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হন। যদিও সে সময় অধিকাংশ কর্মক্ষম নারী এখনো গৃহে অবস্থান করতেন, তবুও যুদ্ধ-পরিস্থিতি নারীদের কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য এক নতুন সুযোগ ও সামাজিক স্বীকৃতি এনে দেয়। নারীদের এই ভূমিকা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের সঙ্গে তাদের নাগরিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে তোলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে অধিকাংশ কর্মজীবী নারী হয় গৃহে ফিরে যান, নয়তো তারা বাধ্য হন lower-paid positions বা নিম্নবেতনভিত্তিক পেশায় যুক্ত হতে। এর ফলে নারীর আর্থ-সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পায় এবং পুরুষ-নারী আয়ের বৈষম্য (wage gap) প্রকট হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপট বর্ণনায় ১৯৭৪ সালে Wilma Rule উল্লেখ করেন যে, “অনেক নারী স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন, কারণ সে সময় সমাজে ফ্রয়েডীয় মনোচিকিৎসা-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে এক নতুন ধরণের Familialism বা পরিবারকেন্দ্রিক আদর্শিক পরিবেশ গড়ে উঠে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কর্মজীবী নারীদেরকে মানসিকভাবে অসুস্থ বা বিকারগ্রস্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হতো।” এই আদর্শিক কাঠামো নারীর কর্মজীবনকে নেতিবাচক হিসেবে চিত্রিত করে এবং নারীদের গৃহকেন্দ্রিক কার্যক্রমক ও রক্ষণশীল আচারণকে অধিক উৎসাহিত করে।
ফলে, নারীরা মূলত কর্মক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হারান। তবে এর মানে এই নয় যে তাঁরা নাগরিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তার অন্যতম প্রমাণ এই দশকে নারীরা বিভিন্ন স্বেচ্ছাধীন সামাজিক সংগঠনিক কাজে ছিলেন যথেষ্ট সক্রিয় ও প্রাণবন্ত। বিশেষ করে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, শত-সহস্র গৃহস্থ নারী স্থানীয় নানা স্বেচ্ছাসেবী নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড প্রধানত ছিলো চার্চ ও দাক্ষিণ্য কেন্দ্রিক সেচ্ছাসেবী কাজ, গৃহস্থ দক্ষতা উন্নয়ন, নাগরিক সংযোগ বৃদ্ধি, শিক্ষা প্রভৃতি কেন্দ্রিক। অর্থাৎ, এসব সংগঠন মূলত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না এবং সরাসরি রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকারও দিত না। নারীরা মূলত স্বেচ্ছাসেবার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যুক্ত হতেন, ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও সামাজিক সেবায় অংশগ্রহণের করতেন।
১৯৬০-এর দশকে এসে নারীদের সামাজিক সংগঠনগুলোতে অংশগ্রহণ কমে যেতে থাকে। এই দশককে বলা হয় “গৃহিণীদের দশক (decade of housewives)”। এই দশকের পর হয় “নারীমুক্তির দশক (decade of women’s liberationists”)। এই সময় নারীদের মাঝে নতুন এক আর্থ-সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। চেতনার আলোকে অনেক নারী সংগঠন নিজেদের কার্যক্রমকে নতুনভাবে সাজায় যাকে তারা স্থানীয় নাগরিক সংগঠন (civic bodies) হিসেবে গণ্য করতেন, এই সংগঠনগুলো পেশাদার নারী নেতৃত্বের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর পক্ষে সুনির্দিষ্ট দাবিদাওয়া তুলে ধরার কথা বলেন। এই সময়টা ছিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের নতুন যুগ, যা নারীর সামাজিক পরিচিতিকে ব্যপকভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষত, নারীদের সাক্ষরতা বৃদ্ধি পায় যা তাদের সমাজিক সচেতনতা ও ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান অনুষংগ হিসেবে কাজ করে। একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত বিপ্লব, বিশ্বায়ন নির্ভর ভোগবাদী বাজার-ব্যবস্থার বিস্তার, গণযোগাযোগ মাধ্যমের দ্রুত প্রসার, এবং মধ্যবিত্ত জীবনধারা প্রভৃতি সমাজে নারীর ব্যক্তিগত জীবন ও নাগরিক জীবনে সামাজিকভাবে চাপানো পুরনো লিঙ্গভিত্তিক বৈষাম্যকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে।
এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, নাগরিকমুক্তি আন্দোলন এবং ছাত্রদের প্রতিবাদ নতুন রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দেয়। এই নতুন চেতনা নারীবাদের পূর্ববর্তী নারীমুক্তির চেতনাকে ভেঙ্গে (যাকে নারীবাদ তত্ত্বের ইতিহাসে (First Wave Feminism বলা হত), নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় (Second Wave Feminism)-এর শক্তি হয়ে ওঠে। এই রূপান্তরের পিছনে কতিপয় নারীবাদী লেখিকার ভূমিকা ছিলো অনস্বীকার্য, Betty Friedan, Simone de Beauvoir এবং Germaine Greer প্রমূখ ছিলেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাদের লেখনি ও বলনি প্রিন্ট ও ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে ক্রমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছতে শুরু করে, এবং এর মাধ্যমে নারীর ওপর সমাজে চলমান নিপীড়নের বিষয়টি জনপরিসরে আলোচিত হতে থাকে।
১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশে নারীদের কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে সম-মজুরির আইন এবং বৈষম্যবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন শুরু হয়। সরকারি রিপোর্টগুলোতে নারীর প্রতি প্রচলিত আইনি ও সামাজিক বৈষম্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয় এবং এসব বৈষম্যমূলক কাঠামোর সংস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়। এই সময় নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রভাবে ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য অঞ্চলের নারীরা রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করেন। তাঁরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নেন, স্থানীয় পর্যায়ে নারীমুক্তিমূলক সংগঠন গঠন করেন, এবং রাষ্ট্রীয় আইনসভা ও প্রশাসনের সামনে নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও পদযাত্রা চালিয়ে যান।
শ্রেণি, বর্ণ ও জাতিগত সীমারেখা অতিক্রম করে বৈষম্য বিলুপ্তির অভিন্ন লক্ষ্যে তাঁরা এক ধরনের নারী ঐক্য বা “sisterhood solidarity” গড়ে তোলেন। তবে এই ঐক্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি; বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যার ফলে ঐক্য ভেঙে পড়ে। তবুও নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল সামাজিক মনোভাবের আমূল পরিবর্তন। এই আন্দোলন নারীর ভূমিকা ও অবস্থান সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায় এবং দীর্ঘমেয়াদে জননীতি, সামাজিক রীতিনীতি এবং নারীদের আকাঙ্ক্ষার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। এটি শুধু নারীদের নয়, সে প্রজন্মের পুরুষের মনোভাবেও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়।
১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে পরিচালিত নারীমুক্তি আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিশ্বব্যাপী লিঙ্গ-সমতা (gender equality) বিষয়ক মানদণ্ডের বিস্তার ঘটে। এই বৈশ্বিক সচেতনতা ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক ছিল জাতিসংঘের Commission on the Status of Women, যা নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নারীবাদী আন্দোলনের গুরুত্বকে স্বীকৃতি জানিয়ে জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালকে “আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ” হিসেবে ঘোষণা করে, এবং একই বছর মেক্সিকো সিটিতে প্রথম World Conference on Women আয়োজন করে। এর ধারাবাহিকতায় আরও তিনটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কোপেনহেগেনে (১৯৮০), নাইরোবিতে (১৯৮৫), এবং বেইজিং-এ (১৯৯৫)।
নারী অধিকার নিশ্চিতকরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পদক্ষেপগুলোর একটি ছিল ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ গৃহীত CEDAW বা Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women। এটি নারীদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক "Bill of Rights বা অধিকারপত্র" হিসেবে বিবেচিত হয়, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনি ও নীতিগত প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে। ১৯৯৫ সালের বেইজিং সম্মেলনে গৃহীত Beijing Platform for Action ছিল নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মপরিকল্পনা। এর কয়েক বছর পর, ২০০০ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গ্রহণ করে ঐতিহাসিক রেজুলেশন ১৩২৫, যেখানে যুদ্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
২০০৯ সালে এই রেজোলুশন সম্প্রসারিত করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীকে যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা থেকে নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। এইসব আন্তর্জাতিক উদ্যোগ কেবলমাত্র নারী অধিকার ও নিরাপত্তাকেই সুনিশ্চিত করে না, বরং বিশ্বব্যাপী লিঙ্গ সমতার একটি আদর্শ কাঠামো গড়ে তোলার সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এসব নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি নারীদের সামাজিক মর্যাদা, অংশগ্রহণ ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানে Feminism: দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি
বিংশ শতাব্দীতে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি সত্ত্বেও, রাজনৈতিক বিজ্ঞানে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্তি একটি ধীর ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত ""Gender and Politics (লিঙ্গ ও রাজনীতি)" বিষয়ক গবেষণা খুব একটা বিকাশ লাভ করেনি। তবে ১৯৯০-এর দশকে এসে এটি রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ভেতরে একটি স্বতন্ত্র উপ-অনুশাখা (subfield) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে এই ক্ষেত্রটিকে ঘিরে রচিত হতে থাকে বিশেষায়িত গবেষণা জার্নাল, একাডেমিক ও পেশাগত নেটওয়ার্ক, গবেষণা প্রকল্প, নারীবিষয়ক ইনস্টিটিউট ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামসমূহ। যদিও বর্তমানে "Gender and Politics" একটি সুসংহত ও স্বীকৃত গবেষণা ক্ষেত্র হিসেবে গৃহীত, এটি আদতে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ জ্ঞানক্ষেত্র। কারণ, এখানে গবেষণার এজেন্ডা, পদ্ধতি এবং বিশ্লেষণ কাঠামো নানা রকম নারীবাদী তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত। উল্লেখযোগ্য নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. উদারবাদী নারীবাদ (Liberal Feminism)
২. চরমবাদী নারীবাদ (Radical Feminism)
৩. সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ (Socialist Feminism)
৪. উত্তর-গঠণবাদী নারীবাদ (Poststructuralist Feminism)
৫. উত্তর-উপনিবেশবাদী নারীবাদ (Postcolonial Feminism)
তবে এসব দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে পৃথক বা একে অপরের বিপরীত নয়। বাস্তবে, অনেক গবেষক একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিকে নিজেদের গবেষণার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনে অন্যান্য নারীবাদী চিন্তাধারা থেকেও মূল্যবান বিশ্লেষণ ও ধারণা গ্রহণ করেন। ফলে, "Gender and Politics" বিষয়ক গবেষণার মাঝে একধরণের আন্তঃসম্পর্কিত লক্ষ্য করা যায়।
১. উদারবাদী নারীবাদ (Liberal Feminism)
Liberal Feminism (উদারবাদী নারীবাদ) রাজনৈতিক বিজ্ঞানে নারীবাদী বিশ্লেষণের একটি প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এই ধারায় পরিচালিত "Gender and Politics" গবেষণার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলোঃ উদারবাদী রাষ্ট্রের (liberal state) কাঠামোগুলোকে সমস্যা হিসেবে না দেখে; বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে নারীদের এবং নারীদের প্রতিনিধিত্বের অভাবকে সমস্যা হিসেবে ধরা। তাই উদারবাদী নারীবাদে নারীবাদী রাজনীতির লক্ষ্য হলোঃ নারীদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা, অর্থাৎ রাজনীতিকে "নারীবান্ধব" (women-inclusive) করে তোলা। এটি একটি সংস্কারমূলক (reformist) এজেন্ডা, যা সমাজ বা রাষ্ট্র কাঠামোকে পরিবর্তনের চেয়ে অংশগ্রহণমূলক করার উপর বেশি জোর দেয়।
এই দৃষ্টিভঙ্গির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি মূলত রাষ্ট্র ও সরকার তথা পাবলিক স্পেস বা সরকারি বিষয়াবলিকে রাজনীতির প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে ধরে নেয়। এর ফলে ব্যক্তি বা পারিবারিক পরিসর, যা প্রাইভেট স্পেস হিসেবে বিবেচিত, তা গবেষণার আওতার বাইরে থেকে যায়। অর্থাৎ public-private বিভাজনকে এই গবেষণা যথাযথ বলে ধরে নেয়।
তৃতীয়ত, উদার নারীবাদ পজিটিভিস্ট (positivist) জ্ঞানতত্ত্ব ও পদ্ধতির উপর নির্ভরশীলম, যে জ্ঞানতত্ত্ব গবেষণার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ হতে হবে। এর ফলে গবেষণায় তথ্য ও মূল্যবোধের মধ্যে কঠোর সীমারেখা টানা হয় এবং পরিমাণগত (quantitative) পদ্ধতি ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই গবেষণা পদ্ধতি, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা, নারী ভোটারের অংশগ্রহণ ইত্যাদির পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নারীবাদকে বিশ্লেষণ করা হয়।
শেষত, এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তি এবং তার ক্ষমতাকে সমাজ পরিবর্তনের প্রধান উপাদান হিসেবে গণ্য করে। যেমন, সংসদে নারীর অনুপস্থিতি, নারীর নেতৃত্বে অভাব, অথবা নারীবাদী স্বার্থ-সংগঠনগুলোর কার্যক্রম ইত্যাদি গবেষণার মাধ্যমে নারীবাদের প্রকৃত বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করা যায়।
২. চরমবাদী নারীবাদ (Radical Feminism)
Radical Feminism (চরমবাদী নারীবাদ) রাজনৈতিক বিজ্ঞানে নারীবাদী গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রূপান্তরমুখী (transformative) দৃষ্টিভঙ্গি। এই ধারায় পরিচালিত “Gender and Politics” গবেষণার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: প্রথাগত public-private বিভাজনের উপর প্রশ্ন তোলা। Radical feminism-এর কেন্দ্রীয় দাবি হলো, সমাজে নারীরা শুধু রাষ্ট্রীয় বা পাবলিক কাঠামোতেই নয়, বরং ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক পরিসরেও পুরুষতান্ত্রিক (patriarchal) ক্ষমতার দ্বারা অব্যাহত নিপীড়নের শিকার। এই পুরুষ প্রধান আধিপত্য (male supremacy) নারীর শরীর, যৌনতা, প্রজনন, আবেগ ও স্নেহ-মমতার মতো ব্যক্তিগত দিকগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সমাজের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যা রাজনৈতিক সংগ্রামের বাইরে। ফলে নারীর মুক্তি নিশ্চিত করতে হলে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের কাঠামোয় নারীর অন্তর্ভুক্তি যথেষ্ট নয়; বরং ওই কাঠামোগুলোর ভেতরকার লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক বৈশিষ্ট্যকে আমূল পরিবর্তন (Radical Change) করতে হবে। এই কারণে Radical Feminism-এর অনুসারীরা Liberal Feminism-এর “সংখ্যাগত অন্তর্ভুক্তি” ভিত্তিক সংস্কারমূলক এজেন্ডা থেকে নিজেদের আলাদা করে। তারা নারীর অংশগ্রহণের পাশাপাশি কাঠামোগত রূপান্তরকেও গুরুত্ব দেন।
Radical Feminism মনে করে, নারীদের প্রতি বৈষম্য শুধু তাদের শরীর বা জৈবিক পরিচয়ের কারণে হয় না, বরং সমাজ যেভাবে "নারী" এবং "পুরুষ" পরিচয় তৈরি করে, সেই ব্যবস্থাটাই বৈষম্যমূলক। তাই তারা "sex" (জন্মসূত্রে লিঙ্গ) নয়, বরং "gender" (সমাজের তৈরি করা লিঙ্গভূমিকা) নিয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। এই নারীবাদী ভাবনার মূল বিষয় হলোঃ রাষ্ট্র, আইন, ধর্ম, শিক্ষা বা পরিবার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান কীভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে এবং নারীদের অধীনস্থ করে রাখে, তা বোঝা। Radical Feminism বলে, শুধু রাজনীতিতে বা সংসদে নারীদের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না; বরং যেসব নিয়ম-কানুন, ধারা বা চিন্তাধারা নারীদের পিছিয়ে রাখে, সেগুলোরই বড় পরিবর্তন দরকার। নারীদের প্রকৃত মুক্তি তখনই আসবে, যখন সমাজের এই পুরনো বৈষম্যমূলক কাঠামো ভেঙে দেওয়া হবে।
পদ্ধতিগতভাবে (methodologically), radical feminist গবেষকরা সাধারণত positivist গবেষণা পদ্ধতিকে প্রত্যাক্ষান করেন। যদিও এখনও পর্যন্ত নারীবাদী গবেষণার জন্য একক কোনো নির্দিষ্ট "feminist methodology" প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তারপরও তারা বিভিন্ন ধরনের গুণগত পদ্ধতি (qualitative methods) ব্যবহার করে থাকেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো discourse analysis (বক্তৃতা ও ভাষ্য বিশ্লেষণ), ethnographic methods (সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ), এবং case studies (ঘটনাভিত্তিক বিশ্লেষণ)। এসব পদ্ধতির মাধ্যমে তারা নারীর জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সমাজের লিঙ্গ-ক্ষমতা সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন।
৩. সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ (Socialist Feminism)
Socialist Feminism নারীবাদী তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা নারীর নিপীড়নের উৎস হিসেবে পুরুষতান্ত্রিকতা (patriarchy) এবং পুঁজিবাদ (capitalism) কাঠামোকে দায়ী করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলত নারীবাদ ও মার্কসবাদী বিশ্লেষণের সমন্বয়ে গঠিত। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা মনে করেন, কেবল লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নয়, বরং অর্থনৈতিক কাঠামো তথা পুঁজিবাদও নারীর ওপর বৈষম্য তৈরি করে। তারা বিশ্লেষণ করেন, কীভাবে পরিবার, সমাজ, শ্রমবাজার, রাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক উৎপাদনের ধরণসমূহ নারীকে অবমূল্যায়ন ও শোষণের শিকার করে তোলে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, পুঁজিবাদ নারীকে ‘অদৃশ্য শ্রমিক’ হিসেবে চিত্রায়িত করে, যিনি ঘরে কাজ করেন, সন্তান প্রতিপালন করেন, এবং সমাজের পুনর্উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, কিন্তু তার শ্রমকে কখনো অর্থনৈতিক মূল্য হিসেবে গণ্য করা হয় না। একইভাবে, সমাজ নারীর বাহিরের শ্রম (যেমন: শিক্ষকতা, নার্সিং, গার্মেন্টস) কম মজুরিতে গ্রহণ করে, কারণ নারীকে প্রথাগতভাবে ‘সহায়ক ভূমিকা’য় দেখানো হয়। ফলে নারীর শ্রম বাজারে প্রবেশ করলেও, সে থাকে পেশাগত ও আর্থিকভাবে দুর্বল অবস্থানে।
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা মনে করেন, নারীর প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী কাঠামো ভেঙে নতুন সামাজিক সম্পর্ক গড়ে না ওঠে। তারা শুধু রাজনৈতিক বা আইনি সমতা নয়, বরং অর্থনৈতিক অধিকার, সম্পদের ওপর নারীর নিয়ন্ত্রণ, যৌথ শ্রমের স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি এইসবকে নারীর ক্ষমতায়নের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে দেখেন। এই নারীবাদী ধারাটি পরিবর্তনের আহ্বান জানায় এবং নারীর জন্য একটি সাম্যবাদী ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের রূপরেখা উপস্থাপন করে। তাই সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ একটি রূপান্তরমুখী রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবেও বিবেচিত।
৪. উত্তর-গঠণবাদী নারীবাদ (Poststructuralist Feminism)
Poststructural Feminism হলো নারীবাদী তাত্ত্বিক ধারার একটি জটিল ও প্রভাবশালী অংশ, যা মূলত ভাষা, জ্ঞান এবং ক্ষমতার সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে লিঙ্গ ও রাজনীতির বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: এটি লিঙ্গ, প্রতিনিধিত্ব বা রাষ্ট্রের মতো মূল ধারণাগুলোকে কোনো স্থির বা স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা হিসেবে না দেখে, বরং discursive construction বা ভাষ্য ও অনুশীলনের মাধ্যমে গঠিত সামাজিক নির্মাণ হিসেবে দেখে।
অর্থাৎ, সমাজে ব্যবহৃত ভাষা, প্রতীক, ভাবনা ও সংস্কৃতি কীভাবে এই ধারণাগুলো গড়ে তোলে এবং স্থায়িত্ব দেয়, সেটিই এই নারীবাদী তত্ত্বের অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু। এই তত্ত্বে ক্ষমতাকে একটি সম্পর্কনির্ভর (relational) এবং পরিবর্তনশীল (fluid) বিষয় হিসেবে দেখা হয়। এখানে ক্ষমতা কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা নয়, বরং সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত গঠিত ও রূপান্তরিত হয়। ফলে, পুরুষতান্ত্রিকতার মতো কাঠামোগত বিশ্লেষণের বদলে পোস্টস্ট্রাকচারাল নারীবাদ দেখে কিভাবে প্রতিদিনের ভাষা ও প্রক্রিয়ায় লিঙ্গ-ভিত্তিক ক্ষমতা গড়ে ওঠে।
এই ধারার গবেষণা সাধারণত নিরপেক্ষ বা নির্দিষ্ট মূল্যবোধ নির্ভর নয়, বরং বোঝার চেষ্টা করে কিভাবে বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘নারীবান্ধব’ বা ‘পুরুষতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের ধারণাগুলো তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, একই রাষ্ট্রে বিভিন্ন অংশে নারীর অবস্থানের বৈচিত্র্য বোঝানো সম্ভব হয় যখন রাষ্ট্রকে একটি ভাষাগত নির্মাণ হিসেবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি সাম্প্রতিক Gender and Political Representation সম্পর্কিত গবেষণায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কারণ, এটি দেখায় কিভাবে ‘নারী প্রতিনিধি’, ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’, বা ‘লিঙ্গ সমতা’ ইত্যাদি ধারণা সমাজ-রাষ্ট্র-সংস্কৃতির মধ্যকার কথন ও অনুশীলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে এবং প্রশ্নের মুখে পড়ে।
৫. উত্তর-উপনিবেশবাদী নারীবাদ (Postcolonial Feminism)
পোস্টকলোনিয়াল নারীবাদ (Postcolonial Feminism) হলো একধরনের বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীবাদী গবেষণার বিদ্যমান ধারা, বিশেষত লিবারেল ও র্যাডিক্যাল নারীবাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological) ও অস্তিত্ববাদী (ontological) ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। এই নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দুটি মূল বিষয়ের উপর জোর দেয়।
প্রথমত, এটি যুক্তি দেয় যে নারীর প্রতি বৈষম্য কেবল পুরুষতন্ত্র (patriarchy)-এর ফল নয়; বরং ঔপনিবেশিকতা (colonialism) এই বৈষম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই দুটি শক্তির সম্মিলিত প্রভাবেই উপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশিক (Postcolonial) সমাজে নারীর ভূমিকা ও সামাজিক অবস্থান গঠিত হয়। Postcolonial নারীবাদ এই বিশ্বাসকে সমালোচনার চোখে দেখে যে, নারীদের অভিজ্ঞতা সর্বত্র এক ও অভিন্ন। ফলে, তারা পশ্চিমা নারীবাদীদের দ্বারা তৈরি “Third World women” নামে একটি একক ও একমাত্রিক পরিচয় নির্মাণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এই সমালোচনায় পশ্চিমা নারীর ক্ষমতায়নকে একটি আদর্শ মান হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধেও বক্তব্য উঠে আসে। দ্বিতীয়ত, Postcolonial নারীবাদ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে নিহিত বর্ণবাদ (racism)-কে চিহ্নিত করে এবং তা আজকের বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও কীভাবে টিকে আছে, তা বিশ্লেষণ করে। এই নারীবাদ গবেষণায় পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যকে ভেঙে দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের নারীদের নিজস্ব আন্দোলন, সংগ্রাম ও ক্ষমতায়নের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, Postcolonial নারীবাদ পুঁজিবাদের মতো নারী নিপীড়নের অভিন্ন জায়গাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি, নারীদের নিজস্ব সংস্কৃতি, অবস্থান ও অভিজ্ঞতার পার্থক্যকে সম্মান জানায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা পোস্টমডার্ন নারীবাদের সঙ্গে মিল রাখে, কারণ দুটো ধারাই ভাষ্য (discourse), বর্ণনা (narrative), এবং পরিচয়ের বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দিয়ে নারীদের বহুমাত্রিক নিপীড়নকে স্বরূপ জানতে তারা বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ, যৌনতা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির অন্তঃসম্পর্কিত (interconnected) জায়গাগুলো বিশ্লেষণ করে।
উপসংহার:
নারীবাদ (Feminism) একটি বহুমাত্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য হলো নারীদের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে সমতা, মর্যাদা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। এটি কেবল নারীর অধিকারের প্রশ্ন নয়, বরং তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে বিদ্যমান সব ধরনের অসমতা ও ক্ষমতার বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ ও বিকল্প চিন্তার ভিত্তি। নারীবাদের বিভিন্ন ধারা, যেমনঃ লিবারেল, র্যাডিকাল, সোশ্যালিস্ট, পোস্টস্ট্রাকচারাল, পোস্টকলোনিয়াল প্রভৃতি সবগুলোই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর অবস্থান ও অধিকার বিশ্লেষণ করেছে, এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের নানা রূপকে উন্মোচন করেছে।
আধুনিক সমাজে নারীবাদ শুধু নারীর নয়, বরং সকল প্রান্তিক ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকারের লড়াইয়ে এক অনন্য চেতনার ধারক। এটি জ্ঞান, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং উন্নয়ন চর্চায় নতুন প্রশ্ন তোলে এবং এক বিকল্প ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেয়। ফলে, সমতাভিত্তিক, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গঠনে নারীবাদ আজও প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়।
অনুবাদক:
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল লেখক:
Yvonne Galligan and Sara Clavero
Queen’s University Belfast Belfast, United Kingdom
মূল গ্রন্থ:
International Encyclopedia of Political Science


No comments