Header Ads

Header ADS

Security Dilemma: যে সংকটে নিরাপত্তা কমে

 
Security Dilemma

Security Dilemma বা নিরাপত্তা সংকট আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম এক মৌলিক ধারণা, যা ব্যাখ্যা করে কেন রাষ্ট্র একে অপরকে সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং কিভাবে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টা (Defensive Action) শেষ পর্যন্ত পারস্পরিক অবিশ্বাস (Mistrust) ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে (Competition) উসকে দেয়। এই ধারণা থেকে বোঝা যায়, একটি রাষ্ট্র যখন স্বীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তখন সেই পদক্ষেপ প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে প্রতিভাত হয়। ফলে তারা (প্রতিবেশী বা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী) নিজেরাও প্রতিরক্ষামূলক (Defensive) বা আক্রমণাত্মক (Offensive) প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

এটি একটি চক্রের মতন যা মূলত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নৈরাজ্যিক (Anarchic) রূপের কারণে সৃষ্টি হয়, যেখানে কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার বা রাজা নেই যা আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যপূর্ণ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলোর জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। এই অনিরাপত্তামূলক পরিবেশে একটি রাষ্ট্র আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে চায় এবং প্রতিরোধ বা প্রতিঘাতের সামর্থ অর্জনের মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্র-ক সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। এক্ষেত্রে, এক রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা অপর রাষ্ট্রের জন্য আক্রমণাত্মক বলে বিবেচিত হয়, এবং এর ফলেই শুরু হয় স্বার্থ-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।

উদাহরণস্বরূপ, যদি রাষ্ট্র-ক নিজ নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে (Defensive) সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করে বা অস্ত্রের আধুনিকায়ন ঘটায়, রাষ্ট্র-খ এই পদক্ষেপকে আক্রমণাত্মক (Offensive) প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। তখন রাষ্ট্র-খ নিজেও প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যেমন নতুন সামরিক জোটে প্রবেশ, অস্ত্র সংগ্রহ বা প্রতিরক্ষা চুক্তি। এভাবে যদি রাষ্ট্র-খ এর সামরিক শক্তি রাষ্ট্র-ক কে ছাড়িয়ে যায়, তখন রাষ্ট্র-ক আবার নতুন করে নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে। এই দোদুল্যমান নিরাপত্তাহীনতা ও প্রতিক্রিয়ার দরুন রাষ্ট্র-ক ও রাষ্ট্র-খ একে অপরকে হুমকি বিবেচনা করে, যা উভয়ের মাঝে এক Security Dilemma বা নিরাপত্তা সংকট তৈরি করে।

এই সংকট তাদের সামনে স্পষ্ট করে যে এক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও তার প্রতিক্রিয়ায় অন্য রাষ্ট্রের নতুন করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি আদতে উভয়ের ক্ষেত্রেই নিরাপত্তা হ্রাসের বা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যতদিন না উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য (Balance of Power) অর্জিত হয় বা পারস্পরিক আস্থা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা পায়, এই চক্র ততদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতি অনিশ্চিত, প্রতিযোগিতামূলক ও সংঘাতপ্রবণ থাকে।

নিরাপত্তা সংকটের বৈশিষ্ট্য

নিরাপত্তা সংকট বলতে যে পরিস্থিতিকে বুঝায় সেখানে মোটাদাগে চারটি বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয়। যথা: 

১. অনভিপ্রেত হুমকি (Unintended Threat): নিরাপত্তা সংকটে প্রধান সমস্যা হলোঃ একটি রাষ্ট্র যদি নিজের নিরাপত্তা বাড়াতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে বা অস্ত্র মোতায়েন করে, তার এই পদক্ষেপকে অন্য রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা নয়, বরং সম্ভাব্য আক্রমণ হিসেবে দেখে। ফলে, একটি রাষ্ট্রের আত্মরক্ষামূলক (Defensive) ব্যবস্থা অন্য রাষ্ট্রের কাছে আক্রমণাত্মক (Offensive) মনোভাবের প্রতিফলন মনে হয়, যদিও প্রথম রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক। যেমনঃ ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও সংরক্ষণ শুরু করে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এটিকে তার নিরপত্তা ঝুকি ও প্রতিদ্বন্দ্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রও পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে, যার ফল ছিল পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা (Arms Race)।

২. উদ্দেশ্য ও আচরণের অনিশ্চয়তা (Uncertainty of Intentions): আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সত্যিকারের অভিপ্রায় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে না। রাষ্ট্রের মধ্যে আস্থা ও স্বচ্ছতা না থাকায় অন্য পক্ষের সামরিক পদক্ষেপকে হুমকি মনে হয়। এই অনিশ্চয়তা থেকেই সন্দেহ, ভয় এবং অবিশ্বাস জন্ম নেয়, যা সরাসরি নিরাপত্তা সংকটের জন্ম দেয়। যেমনঃ উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। উত্তর কোরিয়া দাবি করে তার পারমাণবিক কর্মসূচিত মূলত প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহীত, কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র তা আগ্রাসন হিসেবে দেখে । ফলে তারা নিজেরাও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অস্ত্র সংগ্রহ ও সামরিক চুক্তি জোরদার করে।

৩. কর্ম-প্রতিক্রিয়ার চক্র (Action-Reaction Cycle): নিরাপত্তা সংকটে একটি রাষ্ট্র যখন সামরিক প্রস্তুতি নেয়, তখন অপর রাষ্ট্রও আত্মরক্ষার নামে একই ধরনের বা আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই প্রতিযোগিতা বন্ধ না হয়ে একের পর এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যাকে Action-Reaction Cycle বলা হয়। এটি অনেক সময় অস্ত্র প্রতিযোগিতা বা সামরিক উত্তেজনায় রূপ নেয়। ভারত যখন তার মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় উন্নয়ন ঘটায় বা অস্ত্র কিনে, তখন পাকিস্তান এটিকে নিজের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে এবং সে-ও পাল্টা পারমাণবিক বা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। এভাবে একটি দেশ আত্মরক্ষার জন্য যা করে, তা অপর পক্ষের প্রতিক্রিয়া ডেকে আনে এবং এই কর্ম-প্রতিক্রিয়ার চক্র চলতেই থাকে।

৪. নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি (Escalation of Insecurity): নিরাপত্তা সংকটের সবচেয়ে বড় পরিণতি হলো প্রতিটি রাষ্ট্র নিজেকে নিরাপদ করতে গিয়ে এতটাই অস্ত্র সজ্জিত হয়ে পড়ে যে, এক পর্যায়ে সবাই আরও অনিরাপদ হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, নিরাপত্তা অর্জনের চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত উল্টোভাবে নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তোলে, এটিকে অনেক গবেষকেরা মজা করে বলেন হুমকির ভারসাম্য (Balance of Terror)। যেমনঃ ন্যাটোর সম্প্রসারণ রাশিয়ার কাছে প্রতিরক্ষা নয়, বরং ঘিরে ফেলার (encirclement) কৌশল মনে হয়েছিল। ফলস্বরূপ, রাশিয়া ইউক্রেনকে পশ্চিমা জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে বাধা দিতে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে এবং ২০২২ সালে পূর্ণমাত্রায় সামরিক যুদ্ধ শুরু করে। এতে ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

ঐতিহাসিক ও দার্শনিক পটভূমি (Historical and Philosophical Context)

গ্রীক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডিস তাঁর অমর গ্রন্থ The History of the Peloponnesian War–এ এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে যুদ্ধের বিশ্লেষণ করেন। এখানে “Melian Dialogue” অংশটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির “শক্তির নৈতিকতা” (Realpolitik) ও “নিরাপত্তা সংকট” বোঝার এক সূচনাবিন্দু। এখানে এথেন্স, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র, মেলোস নামক দুর্বল দ্বীপ-রাষ্ট্রকে বলে:

"The strong do what they can, and the weak suffer what they must."

মেলোস নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু এথেন্স এই নিরপেক্ষতাকেই হুমকি মনে করে, এবং শেষ পর্যন্ত তাদের দমন করে।

নিরাপত্তা সংকটের দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে আমরা দেখতে পাই, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আধিপত্যের প্রয়াস অন্য রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মেলোসের নিরপেক্ষতা ছিল এথেন্সের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য, আর এথেন্সের আগ্রাসন ছিল স্পার্টার জন্য নিরাপত্তা হুমকি। ফলে এই দ্বৈরথ শেষ পর্যন্ত পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়, যা ছিল এক ধরণের নিরাপত্তা প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত ফলাফল।


সতেরো শতকের দার্শনিক টমাস হবস তাঁর বই Leviathan–এ “State of Nature” ধারণা দেন, যেখানে তিনি বলেন:

“The life of man [is] solitary, poor, nasty, brutish, and short.”

State of Nature দ্বারা এমন এক সমাজিক প্রেক্ষাপটকে বুঝায় যেখানে কেউ-ই নিরাপদ নয়, কারণ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার মত কোন শক্তিশালী বা উচ্চতর কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে, প্রাকৃতিক পরিবেশে সবাই নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকে। নিরাপত্তা সংকটের দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি অনেকটা হবসের state of nature-এর মতোই। এখানে কোনো সর্বোচ্চ সরকার বা কর্তৃপক্ষ নেই, প্রতিটি রাষ্ট্র নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য। কিন্তু, এক রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অন্য রাষ্ট্রের কাছে আগ্রাসী হুমকি হিসেবে প্রতিভাত হয়। ফলে, অবিশ্বাস ও প্রতিযোগিতার এই চক্রই নিরাপত্তা সংকটের উৎস।

ষোড়শ শতাব্দীর ইতালীয় চিন্তাবিদ ম্যাকিয়াভেলি তাঁর বই The Prince–এ বাস্তববাদী কূটনীতি ও নেতৃত্বের ধারণা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, একজন প্রিন্স বা রাজনেতার মধ্যে থাকতে হবে Virtù – ব্যক্তিগত শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও দৃঢ় সংকল্প, এবং Fortuna – ভাগ্য বা অনিশ্চয়তা, যা নারীসুলভ, এবং যাকে জয় করতে হয় পুরুষালি গুণাবলীর মাধ্যমে। নিরাপত্তা সংকটের দৃষ্টিকোণ থেকে ম্যাকিয়াভেলির এই চিন্তায় রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য ক্ষমতা ধরে রাখা এবং প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করতে চায়। রাষ্ট্র যদি ভাগ্যের ওপর ভরসা করে, তাহলে সে দুর্বল হবে। তাই তাকে আগেভাগে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামূলক কার্যকলাপকে আগ্রাসী পদক্ষেপে রূপান্তর করে, যা Security Dilemma-এর মূল দর্শনের সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ, একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা উদ্যোগকে আক্রমণাত্মক হিসেবে দেখে এবং সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানায়।

থুসিডাইডিস, হবস ও ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতির নৈরাজ্য, অবিশ্বাস, ও ক্ষমতা প্রতিযোগিতা–এই তিনটি ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করে, যা নিরাপত্তা সংকট (Security Dilemma)-এর প্রধান দার্শনিক ভিত্তি। আধুনিক নিরাপত্তা তত্ত্ব, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদ (Realism) তত্ত্বটি এই চিন্তাধারার ওপর দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা সংকটকে ব্যাখ্যা করে। 

আধুনিক তাত্ত্বিকগণের অবদান

নিরাপত্তা সংকট (Security Dilemma) ধারণার আধুনিক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় জন হার্জ (John H. Herz) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন এবং বলেন যে রাষ্ট্র তাদের আত্মরক্ষা ও অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে সামরিক শক্তি বাড়ায়, যা অন্য রাষ্ট্রের কাছে হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ফলে রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসে ভোগে এবং শক্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, যা এক নিরাপত্তাহীনতার চক্র (Circle of Insecurity) তৈরি করে। যেমনঃ স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার বাড়ায়, যা শেষ পর্যন্ত পারস্পরিক ভয় এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার তীব্রতা বৃদ্ধি করে।

রবার্ট জার্ভিস (Robert Jervis) ১৯৭৮ সালে তাঁর “Offense-Defense Balance” তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। যেখানে তিনি বলেন যে, সব অস্ত্রই সমানভাবে হুমকিপূর্ণ নয়; কিছু অস্ত্র মূলত আত্মরক্ষামূলক (defensive), আবার কিছু আক্রমণের জন্য বেশি উপযোগী (offensive)। যখন প্রতিরক্ষামূলক ক্ষমতা সহজে চিহ্নিত করা যায় এবং আক্রমণের থেকে বেশি কার্যকর হয়, তখন নিরাপত্তা সংকট কমে যায়। যেমনঃ পারমাণবিক অস্ত্রের “Mutual Assured Destruction” নীতির কারণে দুই রাষ্ট্র একে অন্যকে আক্রমণ করতে ভয় পায়, ফলে একধরনের স্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু একই সঙ্গে, অস্ত্র প্রতিযোগিতাও তীব্র হয়। এই প্রক্রিয়াকে Deterrence বলে।

কেনেথ ওয়াল্টজ (Kenneth Waltz) তাঁর “Neorealism” বা “Structural Realism” তত্ত্বে বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা হলো একটি নৈরাজ্যকর (Anarchy) পরিবেশ যেখানে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তি বাড়াতে বাধ্য হয়, যা অন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করে। এর ফলে নিরাপত্তা সংকট বা নিরাপত্তাহীনতার চক্র তৈরি হয়। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক প্রতিযোগিতা, যেখানে ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার সম্প্রসারণ করছে এবং একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস আরও বাড়াচ্ছে।

এই তাত্ত্বিক অবদানগুলো নিরাপত্তা সংকটের প্রকৃতি ও জটিলতা বুঝতে সাহায্য করে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংঘাত ও সম্পর্ক বিশ্লেষণে অপরিহার্য।

কেস স্টাডি: বাস্তব বিশ্বে নিরাপত্তা সংকট

১.

স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্বরাজনীতির সবচেয়ে সংকটপূর্ণ সময়ের একটি অধ্যায়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ব্যাপক সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এই সময়কালকে Security Dilemma বা নিরাপত্তা সংকটের ক্লাসিক উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়। তখন উভয় মহাশক্তি একে অপরকে নিজেদের শত্রু মনে করে এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি সংগ্রহ করে। এই পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা ছিলো অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ, প্রতিটি পক্ষ অপর পক্ষের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকে আক্রমণাত্মক (Offensive) হুমকি হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে তারা নিজেদের সামরিক শক্তি ক্রমাগত বাড়াতে থাকে, যা আবার প্রতিপক্ষকেও অধিক শক্তি অর্জনে প্ররোচিত করে (Action-Reaction Cycle of Security Dilemma)। এই চক্রটি একটি ধ্বংসকারী মানুসিক প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছিল যা সারা বিশ্বকে পরমাণু যুদ্ধের আতঙ্কে ফেলে দিয়েছিল।

একটি বিশেষ ঘটনা হলো ১৯৬২ সালের কিউবা মিসাইল সংকট, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপকে নিজেদের জন্য অতি মারাত্মক হুমকি মনে করে কিউবা ঘিরে নৌ অবরোধ ঘোষণা করে। এই উত্তেজনাপূর্ণ সংঘর্ষ প্রায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করেছিল। পরস্পরের সন্দেহ ও আস্থা অভাবে এই সংকট গড়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এটি সমাধান হয়। এই ঘটনাটি স্পষ্ট করে যে কিভাবে রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে অপরের কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং কীভাবে এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে।

২.

দক্ষিণ চীন সাগর বিশ্বব্যাপী একটি গুরত্বপূর্ণ সামরিক ও বাণিজ্যিক জলপথ। এই অঞ্চলে চীনের সাম্প্রতিক সামরিকায়ন এবং ভূ-রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা Security Dilemma-এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। চীন এখানে বিভিন্ন কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করে সামরিক ঘাঁটি গড়ছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং ব্রুনেইয়ের জন্য সরাসরি নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই পদক্ষেপের জবাবে, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর ‘Freedom of Navigation Operations’ (FONOPs) নামে অভিযান চালিয়ে এই অঞ্চলে নৌপথে স্বাধীনতা রক্ষা করার চেষ্টা করছে।

আবার, দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি হুমকি স্বরূপ বিবেচিত করে চীন, যার প্রতিক্রিয়ায় চীন আবারো সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা উদ্বেগ ও সন্দেহ বাড়ছে। ফলে দক্ষিণ চীন সাগর ঘিরে এক ক্লিয়ার Security Dilemma তৈরি হয়েছে, যেখানে প্রত্যেক দেশ নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য যে সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে তা অপর পক্ষের কাছে হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই নিরাপত্তা সংকট অঞ্চলটিতে সামরিক উত্তেজনা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে জটিল ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে।

৩.

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক দীর্ঘদিন যাবত উত্তেজনা ও সংঘর্ষপূর্ণ। কাশ্মীর ইস্যু এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে প্রধান বিরোধের কারণ। এই সংঘাত ও সন্দেহের প্রেক্ষাপটে, উভয় দেশই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে, যা Security Dilemma-এর একটি বাস্তব উদাহরণ। ১৯৯৮ সালে উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে তাদের সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন করে। এই পদক্ষেপটি আন্তর্জাতিক পরিসরে উদ্বেগ সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও নিরাপত্তা সংকট তীব্রতর করে। পরবর্তীতে কাশ্মীরের সীমান্তে সংঘর্ষের ঘটনাগুলো এই অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে দেয় যা উভয় পক্ষকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুনরায় শক্তি বাড়াতে বাধ্য করে। সাম্প্রতিক ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধও এই নিরাপত্তা সংকট থেকেই উদ্ভূত।

উপসংহারঃ

নিরাপত্তা সংকট (Security Dilemma) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক মৌলিক ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী ধারণা। এটি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ এবং নিরাপত্তার জন্য প্রতিযোগিতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা সহজেই যুদ্ধ ও অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে। নিরাপত্তা সংকটের ফলে রাষ্ট্রগুলো প্রায়শই প্রতিরক্ষামূলক (Defensive) পদক্ষেপ গ্রহণ করে যা অপরের জন্য হুমকি (Offensive) হিসেবে দেখতে পারে, যা একটি চক্রাকার সংঘাতের (Offensive to Defensive and Vice Versa= Circle) জন্ম দেয়। এই সংকট সম্পূর্ণরূপে এড়ানো কঠিন হলেও, পারস্পারিক আস্থা নির্মাণ, সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে এর তীব্রতা ও বিরূপ প্রভাব যথেষ্ট কমানো সম্ভব। যথাযথ কূটনীতি ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা সংকটের নেতিবাচক প্রভাব কিছু পরিমাণে প্রশমিত করা যায়, যা স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবেশ গঠনে সহায়ক। অতএব, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপত্তা সংকটের প্রভাব বুঝে সঠিক নীতি প্রণয়ন (শক্তি ভারসাম্য) এবং কার্যকর সহযোগিতার বিকাশ অত্যন্ত জরুরি।





অনুবাদক: বদিরুজ্জামান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মূল গ্রন্থ: International Encyclopedia of Political Science

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.