Rimland Theory: বিকাশ, বৈশিষ্ট্য ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা
![]() |
| N. Spykman's Rimland Theory |
স্পাইকসম্যানের রিমল্যান্ড তত্ত্বটি, Halford Mackinder প্রবর্তিত Heartland Theory-র বিকল্প তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে উপস্থাপিত হয়। যেখানে Heartland তত্ত্বে ইউরেশিয়ার বিস্তর ভূমিকে ভূরাজনৈতিক শক্তিমত্তার কেন্দ্র (Pivot) হিসেবে দাবী করে, Rimland তত্ত্বটি সেক্ষেত্রে ইউরেশিয়ার খোলা বিস্তর ভূখণ্ডের বিপরীতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলসমূহকে Rimland অঞ্চল হিসেবে নাম করণ করেন। অর্থাৎ, পশ্চিম ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়াকে রিমল্যান্ড তত্ত্বে বৈশ্বিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্পাইকসম্যানের মতে, এই উপকূলীয় অঞ্চলের উপর যার প্রভুত্ব থাকবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ হবে। এই চিন্তাধারাটি শুধু একটি তাত্ত্বিক অনুমান নয়; বরং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরোধমূলক কৌশল (Containment Strategy), এবং বর্তমানের ইন্দো-প্যাসিফিক (Indo-Pacific) অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় তত্ত্বটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
এই নিবন্ধে আমরা স্পাইকসম্যানের রিমল্যান্ড তত্ত্বের উৎপত্তি, মৌলিক ধারণা ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ করব। পাশাপাশি হার্টল্যান্ড তত্ত্বের সাথে এর তুলনামূলক আলোচনা, সমসাময়িক ভূরাজনীতিতে এর প্রয়োগ ও গুরুত্ব কতটুকু তা নিয়ে আলোচনা করবো।
নিকোলাস স্পাইকসম্যান: প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
নিকোলাস জন স্পাইকসম্যান (Nicholas J. Spykman) ১৮৯৩ সালে নেদারল্যান্ডসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতৃসূত্রে ছিলেন ডাচ এবং মাতৃসূত্রে ইন্দোনেশিয়ান (Indonesian) । তরুণ বয়সে তিনি সাংবাদিকতা ও কূটনীতি বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বৈশ্বিক অস্থিরতা, উপনিবেশিক রাজনীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার মতো বিষয়সমূহ তাঁর চিন্তাজগতে গভীর প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং সেখানেই তাঁর শিক্ষাজীবন ও একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং এরপর ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় থেকেই তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্র অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন এবং ধীরে ধীরে ভূরাজনীতি (Geopolitics) বিষয়ে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি দৃঢ় হয়। ১৯৩৫ সালে
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন Institute of International Studies, যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৌশলগত গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এই ইনস্টিটিউটটি পরবর্তীকালে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা কৌশল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
স্পাইকসম্যানের একাডেমিক পাঠক্রম ছিল বহুমাত্রিক ও আন্তঃবিষয়ক (multidisciplinary and interdisciplinary) । তাঁর শিক্ষাজীবনে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ের সমন্বয় ঘটেছিল। এই সমন্বিত জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণে একটি স্বতন্ত্র, সমন্বিত ও কৌশলভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী (Realist) চিন্তাবিদ ও কৌশলগত বিশ্লেষক (Strategic Analyst), যিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে শক্তির ভারসাম্য (Balance of Power), ভৌগোলিক অবস্থান এবং কৌশলগত গুরুত্ব এর ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করতেন। তাঁর মতে, ভূগোল (Geography), আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি অপরিহার্য কাঠামোগত বাস্তবতা, যা নির্ধারণ করে আন্তর্জাতিকভাবে কোন রাষ্ট্র কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।
স্পাইকসম্যানের রিমল্যান্ড তত্ত্ব যে তাত্ত্বিকদের দ্বারা প্রভাবিত
স্পাইকসম্যানের ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব নির্মাণে কয়েকজন প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ও সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমনঃ
আলফ্রেড থায়ার মাহান (Alfred Thayer Mahan)
আলফ্রেড থায়ার মাহান ছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর একজন বিচক্ষণ কর্মকর্তা ও সামুদ্রিক কৌশলবিদ (naval strategist)। তিনি ১৯০০ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত “The Influence of Sea Power upon History” গ্রন্থে উপস্থাপন করেন যে, যেসব রাষ্ট্র নৌ-শক্তি (sea power) ও সমুদ্রপথের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, তারাই ইতিহাসে বিশ্বশক্তি (global power) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মাহানের মতে, একটি জাতির সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নির্ভর করে তার বাণিজ্যিক নৌবহর, যুদ্ধজাহাজের সক্ষমতা এবং উপকূলীয় ঘাঁটি ও গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক কেন্দ্র বা Chokepoint দখলের উপর। এই দৃষ্টিভঙ্গিই পরবর্তীকালে স্পাইকসম্যানের চিন্তার জগৎকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।
স্পাইকসম্যান মাহানের চিন্তাধারা থেকে বুঝেছিলেন যে, সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলো কেবলমাত্র বাণিজ্য ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং এগুলোই আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য ও কৌশলগত আধিপত্যের নির্ধারক হিসেবে কাজ করে থাকে। এই ধারণা তাঁর Rimland Theory গঠনের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যেখানে তিনি ইউরেশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে, (যেমন: ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া) বিশ্ব-ক্ষমতার আসল কেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন করেন।
স্যার হাফোর্ড ম্যাকিন্ডার (Halford Mackinder)
স্যার হাফোর্ড ম্যাকিন্ডার ছিলেন একজন প্রখ্যাত ব্রিটিশ ভূ-রাজনীতিবিদ ও ভূগোলবিদ, যিনি ১৯০৪ সালে তাঁর ঐতিহাসিক “The Geographical Pivot of History” প্রবন্ধে Heartland তত্ত্বটি উপস্থাপন করেন। এই তত্ত্বে তিনি যুক্তি দেন যে, ইউরেশিয়ার কেন্দ্রভাগ (Heartland), বিশেষত পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া ইত্যাদি বিশ্ব রাজনীতিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ভূ-কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।
ম্যাকিন্ডারের বিখ্যাত উক্তি:
এখানে, Heartland হলো ইউরেশিয়ার ভূ-মধ্যভাগ, এবং World Island হলো ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার সম্মিলিত ভৌগোলিক অঞ্চল।
নিকোলাস স্পাইকসম্যান (Nicholas Spykman) ম্যাকিন্ডারের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে বলেন যে, ইউরেশিয়ার কেন্দ্র নয়, বরং তার চারপাশের উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ, অর্থাৎ Rimland হচ্ছে প্রকৃত ক্ষমতার কেন্দ্র। তাঁর দৃষ্টিতে, উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতেই রয়েছে: গুরুত্বপূর্ণ স্থল ও নৌপথের মিলনস্থল, বিশ্বের প্রধান জনবসতি ও বাণিজ্য কেন্দ্র, এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কৌশলগত Chokepoints বা সমুদ্রপথ।
এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তিনি নির্মাণ করেন তোলেন নিজস্ব Rimland তত্ত্ব, যা পরবর্তীতে স্নায়ুযুদ্ধের (Cold War) কৌশল ও আধুনিক ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
কার্ল হুসেফার (Karl Haushofer)
কার্ল হুসেফার ছিলেন একজন প্রভাবশালী জার্মান ভূ-রাজনীতিবিদ, যিনি জার্মানিতে “জিওপলিটিক্স” (Geopolitik) ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন, বিশেষত হিটলারের কাছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, কৌশল এবং সার্বভৌমত্ব সরাসরি নির্ভর করে তার ভৌগোলিক সীমা, প্রাকৃতিক সম্পদ, এবং আসন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানের ওপর। হুসেফারের মতে, ভূগোল শুধু সীমা নির্ধারণ করে না, এটি একেকটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও সম্প্রসারণ নীতির ভিত্তিও নির্ধারণ করে। তাঁর এই চিন্তাভাবনা বিশেষভাবে নাৎসি জার্মানির কৌশলগত পরিকল্পনা ও সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। তবে স্পষ্টভাবে উল্লেখযোগ্য, নিকোলাস স্পাইকসম্যান হুসেফারের কাজ থেকে বিশ্লেষণধর্মী ধারণাগুলো গ্রহণ করলেও, তিনি কখনোই হুসেফারের জাতিগত জাতীয়তাবাদ (ethnonationalism) কিংবা সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ (imperialist ideology) গ্রহণ করেননি।
স্পাইকসম্যান হুসেফারের কিছু মূল ধারণা, যেমনঃ ভূগোলই রাষ্ট্রক্ষমতার ভিত্তি; ভৌগোলিক সীমানা নিয়েই সংঘাত ও প্রতিযোগিতা গড়ে ওঠে; এবং কৌশলগত অবস্থান বিশ্ব রাজনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ধারণ করে। এই ধারণাগুলো গ্রহণ করলেও, তিনি তা একটি যুক্তিসম্মত ও মানবিক বাস্তববাদের কাঠামোতে রূপান্তর করেন। তাঁর কাছে ভূগোল ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝার খুব জরুরি এক কাঠামো, কিন্তু কখনোই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের হাতিয়ার নয়, হুসেফারের যে ধারণাটি (Lebensraum) হিটলারকে যুদ্ধ সূচনায় প্ররোচিত করেছিলো।
উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson)
উড্রো উইলসন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৮তম প্রেসিডেন্ট এবং আন্তর্জাতিকতাবাদ ও নৈতিক কূটনীতির অন্যতম প্রবক্তা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি “চৌদ্দ দফা (Fourteen Points)” প্রস্তাব করেছিলেন, যেখানে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে শান্তি, আত্মনিয়ন্ত্রণ (self-determination), এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি সম্মিলিত কাঠামো গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। এই ভাবনাই জন্ম দেয় জাতিসংঘের পূর্বসূরি “League of Nations”–কে।
নিকোলাস স্পাইকসম্যান (Nicholas Spykman) তাঁর প্রাথমিক একাডেমিক জীবন ও চিন্তায় উইলসনের আন্তর্জাতিকতাবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আইন এবং কূটনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা, হিটলারের উত্থান এবং লিগ অব নেশনসের ব্যর্থতা স্পাইকসম্যানকে এক বাস্তববাদী বিশ্লেষক হিসেবে গড়ে তোলে। তিনি উপলব্ধি করেন যে আদর্শবাদ শুধু আশার ভিত্তি তৈরি করতে পারে, কিন্তু শক্তির ভারসাম্য (Balance of Power) ও কৌশলগত বাস্তবতা (Strategic Reality) অনুধাবন না করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে টিকে থাকা অনিশ্চিত। এই বাস্তবতা থেকেই তিনি নির্মাণ করেন তাঁর বিখ্যাত রিমল্যান্ড তত্ত্ব (Rimland Theory), যেখানে তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ভূগোল, শক্তি, নিরাপত্তা ও প্রতিযোগিতার কৌশলগত কাঠামো হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
রিমল্যান্ড তত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ
রিমল্যান্ড তত্ত্বের সূচনা হয় এক জটিল ও উত্তাল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, যখন বিশ্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী রূপ বিবেচনাপূর্বক রাষ্ট্রগুলো নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। এই সময়ের বাস্তবতা, যেমন: সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন, ফ্যাসিবাদের উত্থান (Rise of Fascism), এবং পূর্ব-পশ্চিম মেরুকরণের সূচনা ইত্যাদি স্পাইকসম্যানকে একটি নতুন ও কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে।
১৯৪২ সালে স্পাইকসম্যান তাঁর বিখ্যাত America’s Strategy in World Politics: The United States and the Balance of Power গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক দায়িত্ব বিশ্লেষণ করে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউরোপ ও এশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে সক্রিয় না থাকে, তাহলে কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলো সেখানে আধিপত্য বিস্তার করবে, যা বিশ্বশান্তি ও শক্তির ভারসাম্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। তিনি যুক্তি দেন, কেবল ভূখন্ডভিত্তিক নিরাপত্তা (continental security) নয়, বরং বহির্বিশ্বে কৌশলগত উপস্থিতি ও জোট গঠন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা ও প্রভাব প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।
১৯৪৪ সালে স্পাইকসম্যানের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ কাজ The Geography of the Peace। এই গ্রন্থেই রিমল্যান্ড তত্ত্ব (Rimland Theory) পূর্ণতা পায়। তিনি এই গ্রন্থে বিশ্লেষণ করেন: বিশ্ব রাজনীতিতে ভূগোল (geography) কতটা গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে; কেন উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ (rimlands)-ই প্রকৃত কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র; এবং কীভাবে স্থল ও সমুদ্র শক্তির (land-sea power) সংমিশ্রণ বিশ্ব আধিপত্যের চাবিকাঠি।
স্পাইকসম্যানের মতে,“যে রিমল্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে, সে ইউরেশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে; আর যে ইউরেশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, সে বিশ্বের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।”
হার্টল্যান্ড ও রিমল্যান্ড তত্ত্বের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
নিকোলাস স্পাইকসম্যানের রিমল্যান্ড তত্ত্ব মূলত স্যার হাফোর্ড ম্যাকিন্ডারের হার্টল্যান্ড তত্ত্বের একটি সমালোচনামূলক পুনর্ব্যাখ্যা। উভয় তত্ত্বই ইউরেশিয়া মহাদেশকে বৈশ্বিক শক্তির মূল ক্ষেত্র হিসেবে দেখলেও, তারা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ধারণা ব্যাখ্যা করেন। নিচের সারণীতে দুটি তত্ত্বের প্রধান পার্থক্যগুলি উপস্থাপন করা হলো:
রিমল্যান্ডের ভৌগোলিক সীমানা
স্পাইকসম্যান (Nicholas Spykman) রিমল্যান্ডকে সংজ্ঞায়িত করেন ইউরেশিয়ার কেন্দ্রভাগ, Heartland-এর চারপাশে অবস্থিত উপকূলীয় ও উপ-উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ হিসেবে। তিনি একে তিনটি ভৌগোলিক উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করেন, প্রতিটির রয়েছে স্বতন্ত্র ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব।
১। পশ্চিমা রিমল্যান্ড (Western Rimland)
পশ্চিমা রিমল্যান্ড (Western Rimland) বলতে সাধারণত ইউরোপের উপকূলবর্তী এবং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা শক্তিশালী দেশসমূহকে বোঝানো হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন এবং বেনেলাক্স রাষ্ট্রসমূহ (বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ)। এই অঞ্চলটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে ছিল প্রধান ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু। মার্কিন নেতৃত্বাধীন NATO-র সামরিক ঘাঁটিগুলো এই রিমল্যান্ডে স্থাপিত হয় এবং এখান থেকেই কন্টেইনমেন্ট নীতির বাস্তব প্রয়োগ শুরু হয়, যার লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব প্রতিরোধ করা। এই অঞ্চলকে হার্টল্যান্ডে (বিশেষত পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়া) মার্কিন ও পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে পশ্চিমা রিমল্যান্ড ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
২। দক্ষিণী রিমল্যান্ড (Southern Rimland)
দক্ষিণী রিমল্যান্ড (Southern Rimland) অঞ্চলটি ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে পড়ে মধ্যপ্রাচ্য, উপসাগরীয় দেশসমূহ, দক্ষিণ এশি্যা, এবং উত্তর আফ্রিকা। এই রিমল্যান্ড অঞ্চলটি বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহের মূল কেন্দ্র, বিশেষত পারস্য উপসাগর ঘিরে থাকা জ্বালানি সম্পদের জন্য পরিচিত। এখানকার ভূরাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাসবাদ, মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক লড়াই, মি্যানমারের গৃহযুদ্ধ, এবং ঔপনিবেশিক শাসনের জটিল উত্তরাধিকার। তাছাড়া, হরমুজ প্রণালী এবং মালাক্কা প্রণালীর মতো কৌশলগত চোকপয়েন্ট এই অঞ্চলকে বৈশ্বিক শক্তির প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। সমুদ্রপথ ও স্থলপথ উভয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় দক্ষিণী রিমল্যান্ড আধুনিক ভূ-রাজনীতিতে এক অনিবার্য অধ্যায় হয়ে উঠেছে।
৩। পূর্বী রিমল্যান্ড (Eastern Rimland)
পূর্বী রিমল্যান্ড বলতে মূলত পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূলীয় এবং দ্বীপ-রাষ্ট্রসমূহকে বোঝানো হয়। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ। এই অঞ্চল ভূরাজনীতির দিক থেকে বর্তমানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তপ্ত ক্ষেত্র।
বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব চীন সাগর ঘিরে চীনের আঞ্চলিক দাবি, নৌবাহিনীর আধিপত্য বিস্তার, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কৌশলগত প্রতিক্রিয়া—সব মিলিয়ে পূর্বী রিমল্যান্ড হয়ে উঠেছে পরাশক্তিদের মুখোমুখি অবস্থানের এক কেন্দ্রবিন্দু। এই অঞ্চলেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বাণিজ্যপথ, উচ্চ জনসংখ্যার বসতি, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, এবং আধুনিক সামরিক সক্ষমতা।
এছাড়াও, এখানকার বহু গুরুত্বপূর্ণ চোকপয়েন্ট (যেমন মালাক্কা প্রণালী) এবং উচ্চ গতির বন্দর ও নৌঘাঁটিগুলো রিমল্যান্ড তত্ত্বকে বাস্তবতার সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত করে তোলে। পূর্বী রিমল্যান্ড তাই শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক ধারণা নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, নিরাপত্তা কৌশল ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য এক অনিবার্য অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
রিমল্যান্ড তত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
ক। ভূমি ও সমুদ্র শক্তির সমন্বয় (Geopolitical Hybridity)
রিমল্যান্ড এমন এক ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল, যেখানে স্থলশক্তি ও সমুদ্রশক্তি- এই দুই কৌশলগত ক্ষমতার লড়াই, প্রতিযোগিতা এবং কখনো কখনো সহযোগিতা ঘটতে দেখা যায়। ম্যাকিন্ডারের Heartland Theory মূলত স্থলভাগকেন্দ্রিক, যেখানে স্থলভূমির গভীরতাকে নিরাপত্তা ও সামরিক আধিপত্যের উৎস বলা হয়েছে। অন্যদিকে, আলফ্রেড থায়ার মাহানের Sea Power Theory সম্পূর্ণভাবে নৌশক্তির প্রাধান্যকে তুলে ধরে, যেখানে সামুদ্রিক পথ ও নৌবাহিনীর শক্তিকে বৈশ্বিক আধিপত্যের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্পাইকসম্যান এই দুই চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে দেখান যে, প্রকৃতপক্ষে রিমল্যান্ড অঞ্চলগুলোতেই স্থল ও সমুদ্র শক্তির পারস্পারিক মি্থস্ক্রিয়া সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। তাই রিমল্যান্ড হলো সেই ভূ-রাজনৈতিক সেতুবন্ধন, যেখান থেকে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি রিমল্যান্ড তত্ত্বকে এক অনন্য বিশ্লেষণী কাঠামোতে পরিণত করেছে, যা কেবল তাত্ত্বিক নয়, বাস্তব কৌশলগত নীতিনির্ধারণেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
শক্তির ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণনীতি (Balance of Power and Containment)
নিকোলাস স্পাইকসম্যান বিশ্বাস করতেন যে, রিমল্যান্ড অঞ্চলের উপর যদি কোনো একক পরাশক্তি, যেমনঃ অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমানে চীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা গোটা ইউরেশিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আর ইউরেশিয়ার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা মানে হলো বিশ্ব রাজনীতির শক্তির ভারসাম্য ভেঙে পড়বে। এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে স্পাইকসম্যান যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দেন যে, রিমল্যান্ডে তাদের সক্রিয় কৌশলগত উপস্থিতি বজায় রাখতে হবে, অন্যথায় কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলো আধিপত্য বিস্তার করবে।
এই ধারণাই পরবর্তীতে “Containment Doctrine” বা প্রতিরোধ নীতি হিসেবে রূপ পায়, যা ছিল স্নায়ুযুদ্ধকালীন মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের মূল দর্শন। এই নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র NATO, SEATO, CENTO প্রভৃতি জোট গঠন করে এবং রিমল্যান্ডজুড়ে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে সোভিয়েত সম্প্রসারণ প্রতিরোধে উদ্যোগ নেয়। ফলে, স্পাইকসম্যানের তত্ত্ব কেবল তাত্ত্বিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি আধুনিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার অন্যতম কার্যকর ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
সংঘাত ও প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু (Zone of Conflict and Competition)
রিমল্যান্ড অঞ্চলগুলো ইতিহাসজুড়ে পরাশক্তিদের সংঘর্ষ, ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও সামরিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক সামরিক সংঘর্ষ, সবকিছুই ঘটেছে এই রিমল্যান্ডের ভৌগোলিক সীমানার ভেতরেই। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পরাশক্তি রিমল্যান্ডের কৌশলগত অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে, যেমন Okinawa (জাপান), Diego Garcia (ভারত মহাসাগর), Qatar ও Bahrain—যা তাদের বৈশ্বিক উপস্থিতি বজায় রাখার অংশ।
আধুনিক ভূ-অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাতেও রিমল্যান্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর/ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এই রিমল্যান্ড অঞ্চলজুড়ে অবকাঠামো নির্মাণ ও বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এক বিশাল ভূরাজনৈতিক প্রভাব বলয় তৈরির চেষ্টা করছে চীন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র তার Indo-Pacific Strategy-এর মাধ্যমে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার মিত্রদের সহযোগে যৌথভাবে চীনা প্রভাব মোকাবিলা করার পরিকল্পনা করছে।
ফলে বোঝা যায়, রিমল্যান্ড তত্ত্ব শুধু একটি তাত্ত্বিক চিন্তা নয়, বরং এটি আজকের বিশ্ব ভূরাজনীতির বাস্তব কৌশলগত কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
রিমল্যান্ড তত্ত্বের কৌশলগত গুরুত্বঃ
বিশ্ব ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত রিমল্যান্ড অঞ্চলগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামরিক কৌশলের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্পাইকসম্যান এই অঞ্চলগুলোর কৌশলগত তাৎপর্য চিহ্নিত করার মাধ্যমে দেখান যে, রিমল্যান্ড নিয়ন্ত্রণই বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে। এই বিশেষ গুরুত্বের পেছনে কয়েকটি মুখ্য কারণ কাজ করে:
ক। সামরিক কৌশলগত অবস্থান
রিমল্যান্ড অঞ্চলগুলো হলো স্থল ও সমুদ্রপথের সংযোগস্থল, যা একে দ্বৈত কৌশলগত ব্যবহারযোগ্য এলাকা করে তোলে। এই অঞ্চলগুলোতে মহাশক্তিগুলো তাদের সামরিক উপস্থিতি সুদৃঢ় করতে অসংখ্য ঘাঁটি স্থাপন করেছে এবং করছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপে NATO’র সামরিক ঘাঁটি, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি, এবং এশিয়ায় ওকিনাওয়া (জাপান) ও ডিয়েগো গার্সিয়া (ভারত মহাসাগর) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলো রয়েছে। হার্টল্যান্ড থেকে আগত স্থলশক্তি, যেমনঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আধুনিক যুগের রাশিয়া ও চীনের সাথে মহা সমুদ্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যকার কৌশলগত সংঘাত বা উত্তেজনা রিমল্যান্ড কেন্দ্র করে ঘটে থাকে। তাই রিমল্যান্ড এক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক দ্বন্দ্বের মঞ্চ হিসেবে বি্বেচিত হয়, যা আন্তর্জাতিক রাজনী্তিতে শক্তি ভারসাম্য রক্ষায় নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে।
অর্থনৈতিক প্রবাহের কেন্দ্র (Economic and Trade Corridors)
রিমল্যান্ড অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ চোকপয়েন্ট ও নৌপরিবহন পথসমূহ বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিরা-উপশিরা হিসেবে কাজ করে। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে প্রায় ২৫% বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং ৩০% সামুদ্রিক তেল পরিবহণ হয়, যেখানে দিনে প্রায় ৮০ থেকে ১০০টি জাহাজ পারাপার ঘটে। হরমুজ প্রণালী মধ্যপ্রাচ্যের তেল রপ্তানির প্রধান পথ হিসেবে বিশ্বের সামুদ্রিক তেলের প্রায় ২০% (প্রতিদিন প্রায় ২১-২২ মিলিয়ন ব্যারেল) বহন করে। সুয়েজ খাল প্রতি বছর প্রায় ১৮,৮০০টি জাহাজের মাধ্যমে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের ১০% পরিবহন নিশ্চিত করে।
বিশ্বের সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রায় ৩০% এবং তেলের ১১ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য দক্ষিণ চীন সাগরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা এটিকে আজকের সবচেয়ে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জলসীমা হিসেবে রূপ দিয়েছে। রিমল্যান্ডে অবস্থিত বন্দরনগরীগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর বন্দর বছরে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন TEUs (Twenty-foot Equivalent Units) কন্টেইনার ট্রাফিক পরিচালনা করে, হংকং বন্দর ১৮.৩ মিলিয়ন TEUs, দুবাইয়ের জেবেল আলি বন্দর ১৫ মিলিয়ন TEUs এবং ইউরোপের বৃহত্তম রোটারডাম বন্দর ১৪.৩ মিলিয়ন TEUs বার্ষিক কন্টেইনার ট্রাফিকের মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। এইসব চোকপয়েন্ট ও বন্দর বিশ্বের অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব রাখে এবং রিমল্যান্ড অঞ্চলে যে কোনো প্রকার সামরিক বা রাজনৈতিক উত্তেজনা বিশ্ব বাণিজ্য ও শক্তি ভারসাম্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বর্তমানের ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে হরমুজ প্রণালী নিয়ে এরকম এক সঙ্কট তৈ্রি হয়।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) ও ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি রিমল্যান্ড তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত। চীনের BRI প্রকল্প রিমল্যান্ড অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক ভূ-অর্থনৈতিক সংযোগ এবং বাণিজ্যিক অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে চীনের প্রভাব বলয় বিস্তৃত হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন রিমল্যান্ডের কৌশলগত উপকূলীয় এলাকা যেমন দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বাণিজ্যপথ সম্প্রসারণ করছে, যা তার সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রাধান্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মালাক্কা, হরমুজ প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মতো চোকপয়েন্টগুলোর ওপর চীনের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ এবং স্থানীয় রাষ্ট্রগুলোর ওপর ঋণ ও বিনিয়োগের মাধ্যমে কূটনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে রিমল্যান্ডে চীনের বিস্তৃত প্রভাবের বিপরীতে শক্তি ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো, কোয়াড এবং অন্যান্য নিরাপত্তা জোটের মাধ্যমে ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে এবং মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে রিমল্যান্ডে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথের নিরাপত্তা রক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা গুরুত্বপূর্ণ নৌপথগুলোকে নেতৃত্ব দিয়ে রিমল্যান্ডে চীনের প্রভাব ও নিজের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে।
প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য (Natural Resources and Energy Reserves)
রিমল্যান্ড অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চল, দক্ষিণ চীন সাগর, আফ্রিকার উপকূল এবং কাস্পিয়ান সাগর প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বের মোট প্রমাণিত তেলের প্রায় ৪৮% এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৩২% রয়েছে, বিশেষ করে সাউদি আরব, ইরাক, ইরান, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিশাল রিজার্ভ আছে। রাশিয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চল ও কাস্পিয়ান সাগর বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ তেল ও গ্যাস উৎপাদন এলাকা, যেখানে আজারবাইজান, রাশিয়া ও কাসাকস্তানের অংশে বড় বড় তেলক্ষেত্র অবস্থিত। দক্ষিণ চীন সাগরেও প্রচুর সামুদ্রিক খনিজ ও গ্যাস সম্পদ রয়েছে, যা অঞ্চলটির ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রধান কারণ।
আফ্রিকার উপকূল বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় দেশগুলোতে বড় বড় তেলক্ষেত্র ও সমুদ্রসম্পদ বিদ্যমান। এছাড়া রিমল্যান্ড অঞ্চলের উপকূলীয় জলসীমায় প্রচুর মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ রয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন দেশ ও শক্তির মধ্যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তীব্র, কারণ এগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কৌশলগত ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়।
সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন (Civilizational and Cultural Confluence)
রিমল্যান্ড অঞ্চলগুলোতে বহু সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলন ঘটে, যার মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয়, ইসলামি, ভারতীয়, চৈনিক এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংস্কৃতি। এই অঞ্চলগুলোতে রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্ম, জাতিগত বৈচিত্র্য এবং দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহাসিক সংঘাতের একত্রিত অবস্থান রিমল্যান্ডকে একটি জটিল, বহুমাত্রিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা হিসেবে গড়ে তোলে। তাই রিমল্যান্ড শুধু সামরিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সাংস্কৃতিক ও মানসিক ভূগোলের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার:
নিকোলাস স্পাইকসম্যানের রিমল্যান্ড তত্ত্ব (Rimland Theory) একটি ক্লাসিক ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ হলেও, এটি আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর এক তত্ত্ব। ইউরেশিয়ার উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোকে বৈশ্বিক শক্তি প্রতিযোগিতার কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে এই তত্ত্ব দেখায় যে বিশ্ব রাজনীতিতে ভূমি ও সমুদ্রশক্তির মিলনস্থলগুলো কৌশলগতভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বিশ্বে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI), যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘর্ষ, ইত্যাদির অধিকাংশই রিমল্যান্ড অঞ্চলে সংঘটিত হচ্ছে। এগুলো প্রমাণ করে, বিশ্বশক্তির ভারসাম্য এখনো এই অঞ্চলগুলোতে নির্ধারিত হচ্ছে। রিমল্যান্ড তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে ভূগোল কেবল একটি মানচিত্র নয়, উপরন্তু এটি এক কৌশলগত চিন্তার ভিত্তি। একুশ শতকের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবন ও বিশ্লেষণে রিমল্যান্ড তত্ত্ব একটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে কাজ করে, যা আগামী দিনগুলোতেও বৈশ্বিক নীতি ও নিরাপত্তা কৌশল নির্ধারণে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।


No comments