Foreign Policy: তাত্ত্বিক ভিত্তি, উপাদান ও গুরুত্ব
বৈদেশিক নীতি (Foreign Policy) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি রাষ্ট্রের মৌলিক ও প্রভাবশালী নিয়ামক, যা বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বৈদেশিক নীতি মূলত একটি রাষ্ট্রের গৃহীত পরিকল্পিত নীতি, কৌশল ও সিদ্ধান্তের পথরেখা যা উক্ত রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক পরিসরে জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা, ক্ষমতা এবং কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে ।
বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র ঠিক করে যে, আন্তর্জাতিক পরিবেশে সে কীভাবে অন্যান্য রাষ্ট্র এবং অ-রাষ্ট্রীয় কর্মক বা অ্যাক্টর (যেমন: আন্তর্জাতিক সংস্থা, বহুজাতিক কোম্পানি, এনজিও, সন্ত্রাসী সংগঠন ইত্যাদি)-এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও পরিচালনা করবে।
বৈদেশিক নীতি বিষয়ক শাস্ত্র পাঠের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্র ও অ-রাষ্ট্রীয় কর্মকের (non-state actors) পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার স্বরূপ অনুধাবন করা এবং সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, স্বার্থ সংরক্ষণ কৌশল এবং আন্তর্জাতিক পরিক্রমায় তার অবস্থান বিশ্লেষণ করা।
বস্তুত, বৈদেশিক নীতি কেবল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রের
অবস্থান নির্ধারণ করে না, বরং একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা
পরিস্থিতিতেও তা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
বৈদেশিক নীতি ও দেশীয় নীতি উভয়েই একটি রাষ্ট্রের
সার্বিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও এদের লক্ষ্য ও কার্যপরিধি আলাদা, তবে তারা একে
অপরের পরিপূরক। কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এই দুটি নীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায়
রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, বৈদেশিক নীতিকে সহজে বুঝতে আমরা জাতীয় নীতির সাথে
এর পার্থক্যের চিত্র তুলে ধরতে পারি। যথাঃ
টেবিল ১: বৈদেশিক
নীতি ও দেশীয় নীতির মধ্যে পার্থক্য
|
ক্র. |
বিষয় |
বৈদেশিক
নীতি (Foreign Policy) |
দেশীয়
নীতি (Domestic Policy) |
|
১ |
উদ্দেশ্য |
আন্তর্জাতিক পরিবেশে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা |
অভ্যন্তরীণ শাসন, উন্নয়ন ও জনকল্যাণ |
|
২ |
কার্যপরিধি |
কূটনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, নিরাপত্তা, সামরিক
জোট, যুদ্ধ-শান্তি |
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা, কৃষি, শিল্প,
পরিবেশ ইত্যাদি |
|
৩ |
প্রধান প্রণয়নকারী সংস্থা |
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রপ্রধান, কূটনৈতিক মিশন |
সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ, অর্থ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা
মন্ত্রণালয় ইত্যাদি |
|
৪ |
প্রভাবের ক্ষেত্র |
আন্তঃরাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক |
জাতীয় বা অভ্যন্তরীণ |
|
৫ |
অভিযোজনের ভিত্তি |
বৈশ্বিক রাজনীতির পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক সংকট |
জনগণের প্রয়োজন, নির্বাচনী অঙ্গীকার, অভ্যন্তরীণ
বাস্তবতা |
টেবিল
২: বৈদেশিক নীতি ও দেশীয় নীতির মধ্যে সম্পর্ক
|
ক্র. |
সম্পর্কের দিক |
ব্যাখ্যা |
|
১ |
পারস্পরিক প্রভাব |
বৈদেশিক নীতি যেমন একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ
রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে; তেমনি, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অবস্থা তার বিদেশনীতি নির্ধারণে
ভূমিকা রাখে |
|
২ |
অভিন্ন লক্ষ্য |
উভয় নীতির উদ্দেশ্য জাতীয় স্বার্থ ও
স্থিতিশীলতা রক্ষা |
|
৩ |
জনমতের প্রভাব |
জনমতের চাপে বৈদেশিক নীতিও
পরিবর্তিত হতে পারে, যেমন নির্বাচনপূর্ব নীতিগত অবস্থান |
|
৪ |
অর্থনৈতিক সংযুক্তি |
বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি অভ্যন্তরীণ
শিল্প, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলে |
|
৫ |
নিরাপত্তার সংযোগ |
বৈদেশিক নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলায়
নেওয়া পদক্ষেপ দেশীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে |
বৈদেশিক
নীতির তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
বৈদেশিক নীতি অধ্যয়নে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণ কাঠামোর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এসব তাত্ত্বিক ফ্রেমওয়ার্ক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের আচরণ, স্বার্থ ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, এই তাত্ত্বিক
বিশ্লেষণ বৈদেশিক নীতির জটিল বাস্তবতা অনুধাবনের জন্য অতি জরুরি। এই তত্ত্বগুলোর মধ্যে
বাস্তববাদ, উদারবাদ এবং কনস্ট্রাকটিভিজম তিনটি প্রধান ও প্রভাবশালী তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাস্তববাদ (Realism) বৈদেশিক নীতির একটি প্রথাগত ও প্রভাবশালী তাত্ত্বিক ধারা। এই তত্ত্বে রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান ও কার্যকর কর্মক (actor) হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বাস্তববাদীরা দাবী করেন যে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা মূলত নৈরাজ্যপূর্ণ (anarchic), যেখানে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব নেই, এবং প্রতিটি রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে শক্তি অর্জন বা শক্তি ভারসাম্যে চেষ্টা চালায়।
এই তত্ত্ব অনুসারে, কোন রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে শক্তি অর্জন ও টিকে থাকার কৌশল নির্ধারণ করা। সামরিক শক্তি, ক্ষমতার ভারসাম্য, জোট গঠন ইত্যাদিকে বাস্তববাদী বিশ্লেষণের প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
উদাহরণ হিসেবে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধের কথা বলা যায়। বাস্তববাদ অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক Power Struggle বা শক্তি অর্জনে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে। ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করে,
কারণ হিসেবে রাশিয়া উল্লেখ করে যে, রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ন্যাটোর সম্প্রসারণ (বিশেষত
ইউক্রেনের সম্ভাব্য ন্যাটো সদস্যপদ) রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ফলে, এই
যুদ্ধে রাশিয়ার বৈদেশিক নীতি মূলত তার নিরাপত্তা, প্রভাবক্ষেত্র ও শক্তি বজায় রাখার
লক্ষ্যকে অনুসরণ করেছে যা বাস্তববাদের এক ক্লাসিক দৃষ্টান্ত।
উদারতাবাদ (Liberalism) হচ্ছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, যা রাষ্ট্রের আচরণ ব্যাখ্যা করতে সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং নীতিগত মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেয়। উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্র কেবল নিরাপত্তা অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করে না, বরং পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার পথেও এগিয়ে যায়।
জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO), ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রভৃতি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতা ও নিয়মতান্ত্রিক সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে। উদারতাবাদীরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকে বৈদেশিক নীতির মূল উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে। এই তত্ত্বের আলোকে বৈদেশিক নীতি কেবল বাস্তব নিরাপত্তার বিষয় নয়, বরং নৈতিক ও আদর্শিক স্বার্থের প্রতিফলনও বটে।
যেমনঃ উদারতাবাদে বলা হয়, রাষ্ট্রগুলো কেবল সংঘাত নয়, বরং সহযোগিতার মধ্য দিয়েও বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইইউ (EU) গঠন করে। এটি যুদ্ধ এড়ানোর একটি কৌশল এবং পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করার মডেল।
কনস্ট্রাকটিভিজম (Constructivism) এক আধুনিক ও বিকল্প (ক্রিটিক্যাল) তাত্ত্বিক ধারা, যা ধারণা বা আইডিয়া, পরিচয়, ভাষাগত বয়ান ও সামাজিক নিয়মকে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির গঠন ও আচরণের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে।
কনস্ট্রাকটিভিস্টদের মতে, রাষ্ট্রের স্বার্থ ও পরিচয় কোনো প্রাকৃতিক বা নির্দিষ্ট বাস্তবতা নয়; বরং এটি সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত। তারা যুক্তি দেন যে, বৈদেশিক নীতির প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, জাতীয় পরিচয়, ও পারস্পরিক সম্পর্কের রূপরেখার উপর নির্ভর করে।
উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি তার আগের আগ্রাসী পরিচয় থেকে সরে এসে "শান্তিপ্রিয়
ও দায়িত্বশীল আন্তর্জাতিক অংশীদার" হিসেবে একটি নতুন জাতীয় পরিচয় গঠনের চেষ্টা করে।
জার্মানির বৈদেশিক নীতি এখন মানবাধিকার, শান্তি রক্ষা, এবং ইউরোপীয় সহযোগিতার উপর
ভিত্তি করে গঠিত। এই পরিচয়গত পরিবর্তন কনস্ট্রাকটিভিজমের মূল ধারণার উদাহরণ।
সার্বিকভাবে, এসব তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
বৈদেশিক নীতি অধ্যয়নের বিভিন্ন বিশ্লেষণী মাত্রা প্রদান করে। বাস্তববাদ যেখানে শক্তির
রাজনীতি ও নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের আচরণ ব্যাখ্যা করে, সেখানে উদারতাবাদ
সহানুভূতিশীল ও নীতিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায়, আর কনস্ট্রাকটিভিজম রাষ্ট্রের
আচরণকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ তৈরি করে। এই বহুমাত্রিক
বিশ্লেষণ আমাদের বৈদেশিক নীতিকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের সুযোগ করে দেয়।
বৈদেশিক
নীতির প্রধান ধারণাসমূহ
ক্ষমতা
(Power) বৈদেশিক নীতির একটি মৌলিক ধারণা, যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্র বা
অরাষ্ট্রীয় কর্মকদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এই ক্ষমতা হতে পারে সামরিক,
অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা প্রযুক্তিগত। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র তার বৈদেশিক নীতিতে প্রায়ই
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের
আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ইরানের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, এবং ইরানকে আন্তর্জাতিক আলোচনায়
আসতে বাধ্য করে। এই উদাহরণ থেকে বুঝা যায় কীভাবে অর্থনৈতিক শক্তি একটি কার্যকর বৈদেশিক
নীতির হাতিয়ার হতে পারে।
নিরাপত্তা (Security) ধারণাটি রাষ্ট্রের জনগণ, ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি ও প্রস্তুতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে প্রতিরক্ষা জোট, সামরিক উন্নয়ন ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালায়। যেমনঃ ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণ এবং পূর্ব ইউরোপে মার্কিন সেনা মোতায়েন ইত্যাদি রাশিয়ার সম্ভাব্য হুমকি থেকে পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার এক বাস্তব উদাহরণ। নিরাপত্তা বৈদেশিক নীতির এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে সামরিক ও কৌশলগত পরিকল্পনার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি।
কূটনীতি
(Diplomacy) বৈদেশিক নীতির এক শান্তিপূর্ণ ও আলোচনানির্ভর উপাদান। রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের
স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কূটনৈতিক উপায়ে যোগাযোগ
রক্ষা করে। যেমনঃ ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত,
বাহরাইন ও মরক্কোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ করা হয়, যা “আব্রাহাম অ্যাকর্ডস বা
আব্রাহাম চুক্তি” নামে পরিচিত। এই চুক্তি কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী
শত্রুতা দূর করার বাস্তব উদাহরণ, যা উক্ত রাষ্ট্রগুলোর বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা (International Cooperation) বৈদেশিক নীতির এমন একটি দিক যেখানে রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করে। বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ কিংবা মহামারীর মতো বিষয়গুলো প্রতিরোধে এককভাবে কোনো রাষ্ট্র সফল হতে পারে না।
যেমনঃ ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে প্রায় ২০০টি রাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে বৈশ্বিক
উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে একমত হয়। এই উদাহরণটি থেকে বুঝা যায় যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ব্যতীত
আধুনিক বৈদেশিক নীতি কার্যকর খুবই জটিল।
জাতীয় স্বার্থ
(National Interest) একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির মূল চালিকাশক্তি। এটি নির্দেশ করে,
একটি রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও কৌশলগত অবস্থান রক্ষার
জন্য কী কী নীতি গ্রহণ করে বা করবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত তার “অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি” অনুসরণ
করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদার করছে, যাতে তার
কৌশলগত প্রভাব এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।
আত্ম-নির্ভরতা
ও সার্বভৌমত্ব (Autonomy and Sovereignty) এমন একটি ধারণা যা বলে প্রতিটি রাষ্ট্রের
স্বাধীন সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা থাকতে হবে। কোনো বৈদেশিক চাপ বা হস্তক্ষেপ যেন অভ্যন্তরীণ
নীতিতে প্রভাব না ফেলে, এটি বৈদেশিক নীতিতে অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমনঃ উত্তর কোরিয়া
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নিজের পরমাণু কর্মসূচিকে তার সার্বভৌম অধিকারের অংশ
হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
আইডেন্টিটি
ও ভাবমূর্তি (Identity and Image) রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। পরিচিতি
ও ভাবমূর্তি একটি রাষ্ট্রকে ‘কে আমি?’ এই প্রশ্নের উত্তর মাফিক তার বৈদেশিক নীতি
সাজানোর কথা বলে। অর্থাৎ, একটি রাষ্ট্র কীভাবে নিজেকে দেখে এবং বিশ্ব তাকে কেমন দেখে,
সেটিও বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। যেমনঃ কানাডা নিজেকে “শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী”
দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত করেছে এবং তার বৈদেশিক নীতিতেও সেই ভাবমূর্তির
প্রতিফলন দেখা যায়।
গ্লোবালাইজেশন
(Globalization) এমন একটি ধারণা, যা বৈদেশিক নীতিকে আন্তঃনির্ভরশীলতার
(Interdependence) বাস্তবতায় পরিচালিত করে। বর্তমান বিশ্বে তথ্যপ্রবাহ, বাণিজ্য, প্রযুক্তি
ও অভিবাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গভীর সংযোগ তৈরি হয়েছে। যেমনঃ COVID-19 মহামারির
সময় দেশগুলো একে অপরের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বিনিময়
করে, যা গ্লোবালাইজেশনের বাস্তব উদাহরণ।
বৈদেশিক নীতির উপাদানঃ
বৈদেশিক নীতি একটি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক
আচরণের প্রতিফলন, যা বহুবিদ উপাদান দ্বারা প্রভাবিত। এ উপাদানগুলো প্রধানত অভ্যন্তরীণ
(internal) ও বহিঃস্থ (external) দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি উপাদান নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে
ভিন্ন মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, এবং এদের সমন্বিত প্রভাবেই একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে তার অবস্থান ও কৌশল নির্ধারণ করে ।
অভ্যন্তরীণ
উপাদানসমূহ
একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক
কাঠামো, যেমন গণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা, তার বৈদেশিক নীতির উপর সরাসরি
প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস, প্রেসিডেন্ট, এবং নির্বাচনী রাজনীতি
বৈদেশিক নীতি গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, চীনের মতো একদলীয় ব্যবস্থায় বৈদেশিক নীতি
নির্ধারণ অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত ও ধারাবাহিক হয়। নেতার ব্যক্তিগত আদর্শ ও বৈদেশিক দৃষ্টিভঙ্গিও
এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
"America First" নীতির মাধ্যমে বহুপাক্ষিক বৈদেশিক নীতি থেকে পিছিয়ে গিয়ে
দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।
একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও বৈশ্বিক
সম্পদের উপর নির্ভরতা তার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ,
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সম্পদ-নির্ভর রাষ্ট্রগুলো নিরবচ্ছিন্ন শক্তি আমদানির জন্য
মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ কৌশল গ্রহণ করে থাকে। আবার, বাংলাদেশ
দক্ষিণ এশিয়ায় রপ্তানিমুখী শিল্প ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বহুপাক্ষিক বাণিজ্য
চুক্তি ও আঞ্চলিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত বৈদেশিক
নীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। জনগণের চাপ ও মিডিয়া কাভারেজ অনেক সময় রাষ্ট্রকে প্রতিক্রিয়াশীল
অবস্থান নিতে বাধ্য করে। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনেক মুসলিম দেশে জনমতের
চাপে সরকারগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে, যদিও তাদের কৌশলগত স্বার্থ অন্য
কিছু বলছে। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে বৈদেশিক ইস্যু নিয়ে দ্রুত গণসাড়া
সৃষ্টি হয়, যা রাষ্ট্রনেতাদের নীতিগত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকি, বিশেষ করে
সীমান্ত বিরোধ বা সন্ত্রাসবাদের মতো ইস্যু, বৈদেশিক নীতিকে রক্ষণশীল বা আগ্রাসী করে
তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত তার ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বা বালাকোট অভিযানের মাধ্যমে
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সক্রিয় সংঘাতে জড়ায়, যার পেছনে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা উদ্বেগ
ও রাজনৈতিক চাহিদা কাজ করেছে।
২. বহিঃস্থ উপাদানসমূহ
বিশ্বে শক্তির কাঠামো, যেমন ক্ষমতার
মেরুকরণ (bipolarity/multipolarity), ক্ষমতার স্থানান্তর, এবং হেজেমনি ইত্যাদি
একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, স্নায়ুযুদ্ধকালে
দুর্বল রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্র অথবা সোভিয়েত ব্লকে অবস্থান নেয়। বর্তমানে, চীন ও
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা অনেক দেশকে নতুন কৌশলগত জোট গঠনে প্ররোচিত করছে, যেমন—QUAD,
AUKUS, বা Indo-Pacific Strategy।
আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন: জাতিসংঘ,
WTO, IMF ইত্যাদি এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট নিয়ম ও কাঠামোর মধ্যে
থাকতে বাধ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে ফিলিপাইন ও চীনের মধ্যে বিরোধে
আন্তর্জাতিক সালিশ আদালত (PCA) ২০১৬ সালে ফিলিপাইনের পক্ষে রায় দিলেও চীন তা প্রত্যাখ্যান
করে, কিন্তু অন্য দেশগুলোর কৌশলগত অবস্থান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী চীনের বিপরীতে
যেতে থাকে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক,
হোক তা বন্ধুত্বপূর্ণ বা বৈরী, রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার
করে। যেমনঃ পাকিস্তান তার বৈদেশিক নীতি সর্বদা ভারতকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলে, ঠিক তেমনি
নেপাল বা ভুটান তাদের ভূ-অবস্থানগত কারণে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার
সহায়ক বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করে।
জলবায়ু পরিবর্তন, অতিমারি, অভিবাসন
সমস্যা বা সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি বৈশ্বিক ইস্যুতে রাষ্ট্রগুলোকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার
পথে অগ্রসর হতে বাধ্য হয়। এর বড় কারণ এই ইস্যুগুলো কোন একক দেশের পক্ষে সমাধা করা
সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে প্রয়োজন সমন্বিত ভূমিকা বা সহযোগিতা। যেমনঃ কোভিড-১৯ মহামারির
সময় বিশ্বের বহু দেশ ভ্যাকসিন কূটনীতি বা মানবিক সহায়তা ভিত্তিক বৈদেশিক নীতি গ্রহণ
করে।
কেস
স্টাডি: বৈদেশিক নীতির গুরুত্ব বিশ্লেষণ
বৈদেশিক
নীতির প্রভাব ও গুরুত্ব বোঝাতে বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমনঃ
কিউবান মিসাইল সংকট (Cuban Missile Crisis)ঃ ১৯৬২ সালে কিউবান মিসাইল সংকট আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক ক্রিটিক্যাল মূহুর্ত হিসেবে বিবেচিত। এই সংকট শুরু হয় যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের নিকটবর্তী রাষ্ট্র কিউবাতে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করে। এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য এক বিরাট হুমকি হিসেবে দেখা হয়। সোভিয়েতের এই কার্যের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
তিনি কিউবার সমুদ্রপথে নৌ অবরোধ আরোপ করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে ক্ষেপণাস্ত্র
সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বকে আতঙ্কিত করে রাখা এই
সংকট অবশেষে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছায় যখন সোভিয়েতরা তাদের ক্ষেপণাস্ত্র
সরিয়ে নেয় এবং যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় আক্রমণ না করার শর্তে সোভিয়েতদের নিরাপত্তা
প্রতিশ্রুতি দেয়। এই সংকট প্রমাণ করে কিভাবে তৎপর ও সুচিন্তিত বৈদেশিক নীতি ও
কূটনৈতিক কৌশল বিশ্বশান্তি রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে।
ইরাক যুদ্ধ (Iraq War)ঃ ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন একটি
আন্তর্জাতিক জোট ইরাক আক্রমণ করে, যার ভিত্তি ছিল ইরাকের Weapons of Mass
Destruction (WMD) থাকার আশঙ্কা এবং সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ইরাকের সম্পর্ক। ইরাক
যুদ্ধ বহু বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করেছে, এবং এতে
যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে র কূটনৈতিক সম্পর্ক ও বৈদেশিক নীতিরও পরিবর্তিন ঘটেছে।
যুদ্ধের ফলাফল এবং পরবর্তীতে থাকা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখায় যে, কিভাবে ভুল
অনুমান এবং অপর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য কোন রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে নেতিবাচক
প্রভাব ফেলতে পারে।
উপসংহার:
বৈদেশিক নীতি একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আদর্শিক অবস্থান রক্ষার কৌশলগত উপায়। এটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নির্দেশ করে না, বরং এর মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজের অবস্থান, উদ্দেশ্য ও অগ্রাধিকার বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরে। বৈদেশিক নীতি গঠনে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কাঠামো, জনমত, নেতৃত্বের আদর্শ, এবং বাহ্যিক আন্তর্জাতিক কাঠামো, শক্তির ভারসাম্য ও আঞ্চলিক জটিলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক নির্ভরশীলতায়
আবদ্ধ, সেখানে বৈদেশিক নীতিকে শুধু ক্ষমতার কৌশল হিসেবেই দেখা যায় না; বরং এটি উন্নয়ন,
শান্তি, পরিবেশ রক্ষা, এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যম হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। এছাড়া,
বহুপাক্ষিকতা, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেমনঃ জলবায়ু পরিবর্তন বা অতিমারি বা প্যান্ডেমিক
মোকাবিলা, এবং উদীয়মান শক্তির উত্থানের ফলে বৈদেশিক নীতির রূপ ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে।
সার্বিকভাবে, বৈদেশিক নীতি হলো সেই কূটনৈতিক দর্পণ যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব
স্বার্থ সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা পালনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।
- বদিরুজ্জামান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


No comments