Feminist IR Theory: নারীবাদী দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দর্শন
![]() |
| Cynthia Enloe and His Book: Bananas, Beaches and Bases (1990) |
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নারীবাদী তত্ত্ব
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রে নারীবাদ তত্ত্বের (Feminist Theory) তিনটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, ‘জেন্ডার লেন্স’ প্রয়োগের মাধ্যমে নারীবাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রথাগত তাত্ত্বিক কাঠামো ও চর্চাকে একটি ‘লিঙ্গায়িত ক্ষেত্র (gendered field)' হিসেবে উপস্থাপন করে, যেখানে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয়ত, এই তত্ত্ব জেন্ডারকে একটি সামাজিকভাবে নির্মিত একটি ধারণা (Socially Constructed Concept) হিসেবে ব্যাখ্যা করে, অর্থাৎ, কীভাবে রাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক কাঠামোতে 'পুরুষত্ব' (masculinity)-কে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এবং 'নারীত্ব' (femininity)-কে প্রান্তিক করে রাখা হয়ে নারীবাদ তত্ত্বটি তা ব্যাক্ষা করে। তৃতীয়ত, নারীবাদ তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্র গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন গবেষণা পদ্ধতি্র সুপারিশ করে। তত্ত্বটি বলে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক শাস্ত্রের গবেষকদের তাদের নিজস্ব অবস্থান (positionality) সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, অর্থাৎ গবেষণায় লিঙ্গভিত্তিক বৈষাম্য করা যাবে না। কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রের গবেষণা শুধু তথ্য খোঁজা বা বিশ্লেষণের বিষয় নয়, এটি অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রে নারীবাদ তত্ত্ব শুরুতে খুব বেশি আলোচনায় ছিল না। ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগে Cynthia Enloe ও Jean Elshtain- এর লেখনি্র হাত ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নারীবাদের সূচনা ঘটে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে J. Ann Tickner, V. Spike Peterson এবং Christine Sylvester-এর লেখনীতে তত্ত্বটি আরও পোক্ত হয় এবং বিস্তার লাভ করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেন্দ্রিক নারীবাদীদের প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণা ছিল এই শাস্ত্রের প্রচলিত তত্ত্ব ও ধারণার প্রকৃতিকে সমালোচনা করা। বিভিন্ন লেখনি ও বক্তব্যের মাধ্যমে নারীবাদী্রা দাবী করেন যে, এই শাস্ত্রটি সর্বাংশে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।
Cynthia Enloe পরবর্তী প্রজন্মের নারীবাদীরা শুধু সমালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তারা, গবেষণার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অভিজ্ঞতালব্ধ (empirical) জ্ঞানকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেন, যা প্রচলিত গবেষণা পদ্ধতি নিয়েও নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করে। যেমনঃ নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা বলতে শুরু করে, গবেষক নিজে কোন অবস্থান থেকে লিখছেন, তা বোঝাও জরুরি।
এই নারীবাদী ভাবনা ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যেও জায়গা করে নেয়। ১৯৯০ সালে International Studies Association (ISA)-এর অধীনে “Feminist Theory and Gender Studies” নামে একটি বিশেষ সেকশন তৈরি হয়। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে International Feminist Journal of Politics নামে একটি গবেষণা সাময়িকী প্রকাশিত হতে শুরু করে।
এই সব উদ্যোগের মাধ্যমে নারীবাদী তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি স্বীকৃত ও প্রভাবশালী চিন্তাধারায় পরিণত হতে শুরু করে। বর্তমানে, এই তত্ত্ব শুধু সমালোচনার পর্যায়ে নেই, বরং একে গবেষণা, শিক্ষা ও নীতিনির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
প্রচলিত তত্ত্বের সমালোচনা: নারীবাদী পুনর্বিবেচার
নারীবাদী চিন্তাবিদরা দাবী করেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রচলিত বা মূলধারার ধারণা (কনসেপ্ট) বা তত্ত্বগুলো স্বভাবতই লিঙ্গায়িত (gendered), অর্থাৎ, সেগুলোর সঙ্গে পুরুষত্ব (masculinity) ও নারীত্ব (femininity)-এর নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক অর্থ ও প্রতীক জড়িয়ে রয়েছে। বিশেষ করে ক্লাসিক্যাল বাস্তববাদ (Classical Realism) ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে স্বার্থপর, আত্মনির্ভরশীল এবং ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিয়োজিত একক সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করে। নারীবাদীরা এই উপস্থাপনকে পুরুষতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার একটি প্রতিফলন হিসেবে মূল্যায়ন করেন।
নারীবাদীরা দেখান, যেসব আচরণ বা বৈশিষ্ট্যকে Realism ‘মানব প্রকৃতি’ হিসেবে ধরে নেয় (যেমন: ক্ষমতা অর্জনের প্রবণতা), তা মূলত Thomas Hobbes-এর দার্শনিক ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত এবং সেটি নারীদের বিশেষ করে ‘মা বা সেবা প্রদানকারীদের' সামাজিক অভিজ্ঞতাকে অন্তর্ভুক্ত করে না। হবসের “State of Nature”-এর বর্ণনায় মানুষকে এমনভাবে চিত্রিত করা হয়েছে যেন তারা নারী দ্বারা জন্ম নেওয়া নয় বরং মাটি থেকে ছত্রাকের মতো বেরিয়ে এসেছে। এই "স্ব-সৃষ্ট" ব্যক্তিসত্তার ধারণা থেকে রাষ্ট্রের ধারণাও গঠিত হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রকে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রিক, এবং সামাজিকভাবে সম্পর্কহীন একক হিসেবে দেখানো হয়, যা বাস্তববাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যাখ্যার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
নারীবাদী বিশ্লেষণ অনুসারে, Classical Realism কেবল পুরুষতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বাস্তববাদ একটি সামরিক (militarized) এবং আধিপত্যশীল পুরুষত্বের (hegemonic masculinity) মডেল হিসেবে প্রাতিষ্ঠা করতে চায়। এই মডেলের মাধ্যমে এমন এক পুরুষত্বকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও সহিংসতার উপর ভিত্তি করে গঠিত। এর বিপরীতে থাকা অন্যান্য পুরুষত্ব এবং নারীত্বের রূপকে (উদারবাদী আদর্শ) অবজ্ঞা করা হয়। নারীবাদী চিন্তায় বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যুদ্ধ ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রচলিত কনসেপ্টগুলো লিঙ্গভিত্তিক। এই কনসেপ্টগুলোয় পুরুষকে দেখানো হয় শক্তিশালী রক্ষক হিসেবে, আর নারীকে দুর্বল ও রক্ষার প্রয়োজনীয় সত্তা হিসেবে। যেমনঃ ১৯৯২ সালে Ann Tickner লিখেছেন:
“Security is often seen as a man’s job; women are to be protected, not protectors.”
- (নিরাপত্তাকে প্রায়ই পুরুষের কাজ হিসেবে দেখা হয়; নারীরা রক্ষাকারী নয়, বরং তাদের রক্ষা করতে হয়।)
Tickner বলেন, এই ধরনের বয়ান যুদ্ধকে ন্যায্যতা দেয় এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও জোরদার করে তোলে।
Jean Elshtain তার নারীবাদী বিশ্লেষণে দেখান যে, যুদ্ধ ও রাজনীতিতে লিঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উপাদান (ফ্যাক্টর) হিসেবে কাজ করে। তিনি উল্লেখ করেন, পাশ্চাত্য রাজনৈতিক চিন্তায় পুরুষকে সবসময় “Just Warrior” (ন্যায় যোদ্ধা) এবং নারীকে “Beautiful Soul” (নির্দোষ আত্মা) হিসেবে চিত্রিত করা হয়। যেমনঃ তিনি বলেন,
“Women are beautiful souls, who must be protected from the dirty world of politics and war, whereas men are the just warriors who do the protecting.”
– (নারীরা হলো পবিত্র আত্মা, যাদের রাজনীতি ও যুদ্ধের নোংরা জগৎ থেকে রক্ষা করতে হয়; আর পুরুষরা সেই ন্যায্য যোদ্ধা, যারা রক্ষার কাজ করে।)
এই ধরনের বর্ণনা নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়ে এক ধরনের অতি সরলীকারী (Stereotype) কাঠামো তৈরি করে, যেখানে নারীর ভূমিকা হয়ে ওঠে নিষ্ক্রিয় ও প্রাইভেট জগতের, আর পুরুষ হয় পাবলিক ও ক্ষমতার জগতের প্রতিনিধি। ফলে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্বগুলো পুরুষতান্ত্রিক অভিজ্ঞতাকেই মূলধারা হিসেবে গ্রহণ করে এবং নারীর অবস্থানকে অস্বীকার করে।
এছাড়া, নারীবাদ তত্ত্ব বিশেষভাবে লক্ষ্য করে যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে “পাবলিক” ও “প্রাইভেট” সেক্টরের মধ্যকার বিভাজনও লিঙ্গভিত্তিক। উদাহরণস্বরূপ, Niccolò Machiavelli তার বিখ্যাত গ্রন্থ “দ্যা প্রিন্স”-এ রাজনীতিকে “Virtù” (পুরুষোচিত সাহসিকতা ও কর্তৃত্ব) এবং “Fortuna” (নারীত্ব-সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা বা ভাগ্য) হিসেবে উল্লেখ করেন। ম্যাকিয়াভেলি তার দ্যা প্রিন্স গ্রন্থে বলেন,
“Fortune is a woman and it is necessary, if you wish to master her, to conquer her by force.”
Realism-ও এই Fortuna-কে সকল অরাজকতা বা আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তার প্রতীক হিসেবে দেখে, অর্থাৎ Anarchy হিসেবে দেখে এবং তাকে দমন করতে বা তার উপর প্রভুত্ব কায়েম করতে পুরুষোচিত নেতৃত্ব বা শক্তিশালী রাষ্ট্র কাঠামোকে আদর্শ মনে করে। এর ফলে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রাজনীতি এক ধরনের লিঙ্গীয় ক্ষমতার কাঠামোতে বন্দী হয়ে পড়ে, যেখানে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা বৈধতা পায়, এবং নারীত্বকে হুমকি বা দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
নারীবাদী পণ্ডিতরা লিবারাল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির (Liberal International Political Economy) মৌলিক ধারণাগুলোকে সমালোচনা করেন। তারা বলেন, লিবারাল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ব্যবহৃত “Rational Economic Man” ধারণাটি মূলত একটি লিঙ্গবিশেষ ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্মিত পুরুষসত্তার প্রতিফলন। কারণ, এই ধারণাটি মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক, মুনাফাভিত্তিক, প্রতিযোগিতামূলক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা চালিত হিসেবে ব্যাক্ষা করে। যেমনঃ Charlotte Hooper তার Manly States: Masculinities, International Relations, and Gender Politics (২০০১) নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন,
“The rational economic man is not gender-neutral; he is modeled on a particular kind of masculinity.”
-(Rational Economic Man আদতে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ নয়; এটি এক বিশেষ ধরনের পুরুষত্ব ধারনার উপর নির্মিত।)
এই বিশেষ ধরনের পুরুষত্ব ধারনাটি নারী, সেবা ও সামাজিক আন্তঃনির্ভরতার মতো মানবিক উপাদানগুলোকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি শাস্ত্রের মূলধারা থেকে বাদ দেয়। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতিতে মানবিক সম্পর্ক, নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং সেবার অর্থনৈতিক গুরুত্ব হাস পায়।
এছাড়া, নারীবাদীরা বলেন যে, লিবারাল এবং মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বগুলো "Private Sphere বা ব্যক্তিগত পরিসর", অর্থাৎ নারীদের দ্বারা পরিচালিত পরিবার, গৃহস্থালি, এবং সেবার মূল্যায়নকে সেভাবে প্রাধান্য দেয়নি। এই গৃহস্থালি শ্রম, যদিও অর্থনৈতিক উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য, তবুও মূলধারার তত্ত্বে তা অদৃশ্য রয়ে যায়। নারীরা অবৈতনিকভাবে যে কাজগুলো করেন, যেমন: সন্তান পালন, অসুস্থদের সেবা, মানসিক শ্রম, গৃহস্থালি ইত্যাদি, তা সামাজিক প্রজননের (social reproduction) অন্যতম ভিত্তি হলেও অর্থনীতির পরিসরে সেগুলো গণন করা হয় না। যেমনঃ Silvia Federici তার Caliban and the Witch গ্রন্থে বলেন,
“Without women’s unpaid reproductive labor, the wage labor system would collapse.”
- নারীর অবৈতনিক প্রজনন শ্রম ছাড়া মজুরিভিত্তিক শ্রম ব্যবস্থা ধসে পড়ত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে নারী-পুরুষ, নারীত্ব ও পুরুষত্ব
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রচলিত তত্ত্বগুলো অনেক সময় নারীর অভিজ্ঞতা, ভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করে। নারীবাদী গবেষকরা বলেন, তারা ভিন্ন এক বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেন, যেখানে নারীর জীবন, কাজ ও অভিজ্ঞতা বিবেচনাধী্ন থাকে। তাদের মতে, লিঙ্গ (gender) কেবল ব্যক্তি পরিচয়ের বিষয় নয়; এটি সমাজ ও রাজনীতিতে নানা ধরণের প্রভাব তৈরি করে। এই কারণে নারীবাদী বিশ্লেষণ দুইটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। যথাঃ (ক) নারী ও পুরুষ যেসব সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে, সেগুলোকে স্পষ্ট করা। এবং (২) ‘নারীত্ব’ ও ‘পুরুষত্ব’ বলতে আমরা যা বুঝি, সেগুলো সমাজ কীভাবে তৈরি করেছে, তা বিশ্লেষণ করা।
নারীবাদী গবেষকরা, বিশেষ করে সিনথিয়া এনলো (Cynthia Enloe), নিরাপত্তা বিষয়টি বুঝাতে এক ভিন্ন ব্যাক্ষা তুলে ধরেন। তার মতে, নিরাপত্তা কেবল যুদ্ধ, অস্ত্র বা রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং, নিরাপত্তা একটি সামাজিকভাবে নির্মিত কনসেপ্ট বা ধারণা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং গণমাধ্যমের সাহায্যে গড়ে ওঠে ও টিকে থাকে। Enloe বলেন, আমাদের চারপাশে যেসব বিষয়কে আমরা সাধারণ বা স্বাভাবিক বলে মনে করি, তার অনেক কিছুই আসলে সামরিক এবং পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। তি্নি বলেন, সামরিক শক্তি ও নিরাপত্তা কেবল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত বা যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতিতেও গভীরভাবে গেঁথে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, সেনাবাহিনীর ছদ্মবেশী পোশাক (camouflage) বর্তমানে ফ্যাশনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে, যাকে যুদ্ধ ও সামরিক শক্তির স্টাইল ও সৌন্দর্যবর্ধনের উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। Rambo নামক চলচ্চিত্র সি্রিজে, একজন একক, সহিংস পুরুষ Rambo -কে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার এক মহান রক্ষক হিসেবে দেখানো হয়, যার মাধ্যমে যুদ্ধকে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় করে তুলে ধরা হয়। আবার, মার্কিন সেনাবাহিনীর অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে সামরিকীকরণ খুব অল্প বয়স থেকেই ব্যক্তির নিকট একটি স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। এছাড়াও, সামরিক ঘাঁটির আশেপাশে যৌনপেশার প্রচলন ও নিয়ন্ত্রণ নারীদেহের ওপর সামরিক কাঠামোর কর্তৃত্বকে স্পষ্ট করে।
এছাড়াও, প্রতিরক্ষা নীতিমালায় কৌশল করে “মাতৃত্ব” বা “পরিবার” শব্দের ব্যবহার যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতাকে ঢেকে দেয়, এবং সামরিক পদক্ষেপকে সুরক্ষা ও নি্রাপত্তার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে। এসব কৌশলের মাধ্যমে সামরিক পদক্ষেপ ও সহিংসতাকে সমাজে একটি দরকারি, স্বাভাবিক ও বৈধ কাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা নারীর অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে এরিয়ে যায়। এই সব দৃষ্টান্ত থেকেই Enloe বলেছিলেন যে, নারীবাদী নিরাপত্তা বিশ্লেষণে "ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক (The personal is political)”- এই ধারণার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।
এই কাঠামোয় নারীরা কেবল ভুক্তভোগী নন, বরং সক্রিয় অংশগ্রহণকারীও। উদাহরণস্বরূপ, মায়েরা তাদের সন্তানদের যুদ্ধে উৎসাহ দেন, নারীরা, বিশেষত সেনাদের স্ত্রী, নার্স, সঙ্গী বা “পিনআপ গার্ল” প্রমূখ যুদ্ধে পুরুষদের পক্ষে একধরনের মানসিক-সামাজিক সমর্থন জোগান। এর মাধ্যমে যুদ্ধ ও সামরিক পদক্ষেপ শুধু পুরুষদের একক বিষয় নয়, বরং তা একটি লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক বিষয় হয়ে ওঠে। তাই যুদ্ধ শেষ হলে শুধু রাস্তা-ঘাট বা বাড়ি ঠিক করলেই হয় না, সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্কও নতুনভাবে গড়ে তুলতে হয়, যাতে ভবিষ্যতে যুদ্ধ রোধ করা যায়।
নারীবাদীরা যুদ্ধ ও সামরিক কাঠামোয় গঠিত পুরুষত্বের ধরণ নিয়েও গবেষণা করেছেন। প্রথম গল্ফ যুদ্ধের সময় দেখা যায় যে “যোদ্ধা নাগরিক (warrior citizen)” নামক মডেলটি আধিপত্য বিস্তার করেছে, এতে ‘কঠোরতা’ ও ‘দুর্বলতা’র এক ধরনের মিশ্রণ ছিল। নারীবাদীরা বলেন যে, সেনাবাহিনীতে সমকামী ও অন্যান্য কৃ্ত্রিম লিঙ্গ বৈচিত্র্যের প্রবেশে বিরোধিতা এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) স্বীকারে অনীহা সবই একটি ভয়হীন, কঠোর, পুরুষ-রক্ষক মিথ (masculine protector myth) বজায় রাখার প্রচেষ্টা। Enloe এই মিথটিকে “womenandchildren” নাম দিয়ে আখ্যা দিয়েছেন, যেখানে নারী ও শিশুকে দুর্বল হিসেবে দেখিয়ে পুরুষকে তাদের রক্ষক চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি (IPE)-এর প্রেক্ষাপটে নারীবাদীরা বলেন, নারীরা অনেক ধরনের কাজ করেন যেগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যেমনঃ কৃষিকাজ, বাসার কাজ, অসুস্থদের সেবা, এমনকি যৌনশ্রম। এই কাজগুলোকে নারীবাদীরা “পুনরুৎপাদনমূলক শ্রম” (reproductive labor) হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেগুলো সমাজ ও অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে খুব দরকারি। নারীবাদীরা আরও বলেন, আমাদের সমাজে এমন এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা কাজ করে, যেখানে মনে করা হয় যে, যুক্তি, প্রতিযোগিতা আর নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করাই সবচেয়ে ভালো গুণ এবং এই গুণগুলো পুরুষত্বেই আছে। এই ভাবনাটি বিশ্বায়ন আর অর্থনৈতিক সংস্কারের সময় আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
নারীবাদী বিশ্লেষকরা বলেন যে, বিশ্বায়নের (globalization) ফলে একদিকে এমন এক শ্রেণি তৈরি হয়েছে যারা ধনী, উচ্চশিক্ষিত এবং অনেক ক্ষমতাশালী এবং তাদের বেশিরভাগই পুরুষ। এদের বলা হয় “Global Jet-Setting Manager Class," যারা তাদের পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হচ্ছেন। অন্যদিকে, এই একই সময়ে এক ধরনের সেবা-ভিত্তিক অর্থনীতি (service-based economy) গড়ে উঠেছে, যেখানে কম বেতন দিয়ে মূলত নারীদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, এটাকে নারীবাদী্রা “নারীকেন্দ্রিক নিম্ন-মজুরিভিত্তিক সেবা অর্থনীতি” বলে আখ্যা দেন। তাদের দাবী, এর ফলে সমাজে সামাজিক ও আর্থিকভাবে নারী-পুরুষ বৈষম্য আরও বেড়ে চলেছে।
নারীবাদীরা আরও বলেন যে, সোভিয়েত পতনের পর পূর্ববর্তী সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো যখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন সেখানকার নারীদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। অনেক নারীকে চাকরি বা রাজনীতি থেকে সরিয়ে তাদেরকে শুধু সৌন্দর্য বা যৌনতার দৃষ্টিতে চিত্রিত করা শুরু হয়, যাকে নারীবাদী্বরা যৌনবস্তুকরণ (sexual objectification ) বলে নামকরণ করেন, যেখানে নারীকে শুধু দেহ বা ভোগ পণ্য হিসেবে দেখা হয় । ফলে সমাজে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আরও নেতিবাচক হয়ে ওঠে।
নারীবাদীরা মনে করেন, পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশের দ্রুত উন্নয়ন (যেমন: দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর) মূলত একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার ফল। তারা বলেন, ঔপনিবেশিক আমলে যেভাবে পুরুষ কর্তৃত্ব জোরদার করা হয়েছিল, সেই “অতিরিক্ত পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব” (inflated paternalism) এই দেশগুলোয় এখনো টিকে আছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে তা এই দেশগুলোর উন্নয়ন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরুষের কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে অত্র দেশগুলোয় একধরনের পুরুষকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেলের উদ্ভব ঘটেছে।
অন্যদিকে, নারীবাদী গবেষকরা স্বীকার করেন যে, বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য বৈশ্বিক আর্থিক সংস্থাগুলো এখন কিছু “লিঙ্গ সংবেদনশীল নীতি” (gender-sensitive policies) গ্রহণ করছে, যার ফলে দরিদ্র বা প্রান্তিক পর্যায়ের নারীর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই নীতিগুলো এখনো নারীর “পুনরুৎপাদনমূলক শ্রম” (যেমন: সন্তান পালন, গৃহকর্ম, সেবামূলক কাজ)-এই সব কিছুর অর্থনৈতিক মূল্যকে মূলধারার উন্নয়ন নীতিতে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে না।
নারীবাদী গবেষণা-পদ্ধতি (Feminist Methodology)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নে অধিকাংশ নারীবাদী গবেষক Postpositivist গবেষণাপদ্ধতির পক্ষে সমর্থন প্রদান করেন। এই পদ্ধতিতে কেবল তথ্য সংগ্রহ বা পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর না করে, বিষয়বস্তু এবং প্রচলিত তত্ত্বগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করা হয়। যেহেতু নারীবাদ একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলাফল, তাই নারীবাদী গবেষণা প্রায়ই এমন প্রশ্ন তুলে ধরে যা নারীর বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং নারীবাদী আন্দোলনের জন্য ব্যবহারিক জ্ঞানের ভিত্তি গড়তে সহায়তা করে।
পজিটিভিস্ট গবেষণাপদ্ধতিতে সাধারণত গবেষক এবং গবেষণাবস্তুর মধ্যে একটি নিরপেক্ষ দূরত্ব বজায় থাকে, অর্থাৎ তারা একে অপর থেকে আলাদা থাকে। তবে নারীবাদী গবেষকরা এই সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে নিজের অনুভূতি, অভিজ্ঞতা এবং অবস্থানকে গবেষণার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করেন। অনেক নারীবাদী গবেষক গবেষণার সময় নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করেন, যা ‘feminist standpoint theory’ নামে পরিচিত। তারা নির্দিষ্ট সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে চান। এছাড়াও, কেউ কেউ ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাকেও গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করেন, যা গবেষণাকে আরও বাস্তবসম্মত ও সহজবোধ্য করে তোলে। তবে কিছু নারীবাদী গবেষক পজিটিভিস্ট পদ্ধতিই ব্যবহার করেন, তবে তাদের গবেষণার প্রশ্নাবলী নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে গঠিত হয়, যাতে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
নারীবাদী গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো reflexivity। এর মানে হলো গবেষক নিজেই সবসময় সতর্ক ও সচেতন থাকে যে, গবেষণার ক্ষেত্রে তার অবস্থান কী, কীভাবে সে তথ্য সংগ্রহ করছে এবং তা থেকে জ্ঞান আহরণ করছে। এই ধরণে গবেষণায় গবেষক শুধু বাইরের তথ্যই দেখেই সিদ্ধান্ত নেন না, বরং নিজের ভাবনা, অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক অবস্থানকেও বিবেচনায় নেন। এই বিষয়টি নারীবাদী গবেষণাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যান্য প্রচলিত গবেষণা পদ্ধতির থেকে আলাদা করে তুলেছে। আরও সহজ করে বললে, reflexivity মানে হলো গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষকের নিজেকে এবং তার কাজের প্রভাবকে বুঝতে পারা। এতে করে গবেষণার সময় রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতা ব্যবহারের পেছনের কারণ এবং জ্ঞান কীভাবে ক্ষমতার সাপেক্ষে তৈরি হয় তা বিশ্লেষণ করা। এর ফলে গবেষণা হয় আরও গভীর এবং গ্রহণযোগ্য। এভাবেই নারীবাদী গবেষণা গভীর ও বিস্তৃত বস্তুনিষ্ঠতা (robust objectivity) হয়ে ওঠে, যা সাধারণ পজিটিভিস্ট বা অন্যান্য তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে খুব কম পাওয়া যায়।
উপসংহার
নারীবাদ (Feminism) একটি বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, যা শুধু নারীর অধিকার নিয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক বিকল্প ও প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-কাঠামো তৈরিতে প্রচেষ্টা চালায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামক শাস্ত্রে নারীবাদ তত্ত্ব এক নতুন পদ্ধতি হিসেবে বিকশিত হয়, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রের প্রচলিত তত্ত্বের (লিঙ্গভিত্তিক) উপেক্ষিত বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়। নারীবাদ তত্ত্ব বলে যে, এই শাস্ত্রে ব্যবহৃত অনেক ধারণা যেমনঃ “Power”, “Security”, “State” বা “International System” আসলে লিঙ্গভিত্তিক এবং সাধারণত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। নারীবাদী্রা দাবী করেন যে, যুদ্ধ, কূটনীতি ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতিতে নারীদের অবদান প্রায়শই লুকিয়ে রাখা হয় বা অবহেলা করা হয়। পাশাপাশি, নারীবাদী গবেষণাপদ্ধতি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামক শাস্ত্রকে আরও গভীর থেকে, অভিজ্ঞতা এবং নৈতিকতার আলোকে ক্রিটিক্যালি বিশ্লেষণ করে। এটি শুধু একটি একাডেমিক বিশ্লেষণ পন্থা নয়, এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) ও মানবিক (Humane) বিশ্বব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে নির্মিত ও বিকশিত তত্ত্ব। সুতরাং, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নে নারীবাদ (Feminism) কেবল নতুন কোন তত্ত্ব নয়, বরং এটি বিদ্যমান ক্ষমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ এবং নতুন বিকল্প গঠনের হাতিয়ার।


No comments