Foreign Policy Analysis (FPA): বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণের পদ্ধতি, পর্যায় ও প্রক্রিয়া
| Donald Trump visits the Middle East |
Foreign policy analysis- কে সংক্্ষেপে FPA বলা হয়, যার সহজবোধ্য পারিভাষিক অর্থ হতে পারে বৈদেশিক/ পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষণ। এরূপ বিশ্লেষণের প্রধান উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক/ পররাষ্ট্র/ বৈদেশিক নীতিকে শাস্ত্রীয় গবেষণা পদ্ধতির আলোকে বিশ্লেষণ করা, এবং শাস্ত্র ও বৈদেশিক নীতির মধ্যকার যোগসূত্র স্থাপন করা।
কোন শাস্ত্র (উদাহরণস্বরূপ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) যেমন নানা তত্ত্বের সহযোগে গড়ে ওঠে, একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিও তেমনি নানা প্রেক্ষাপট ও অনুষঙ্গ বিবেচনায় প্রণীত হয়। উল্লেখ্য, এই বৈচিত্র্যময় প্রেক্ষাপট ও অনুষঙ্গকেও অত্র শাস্ত্রের তত্ত্বের আলোকে ব্যাক্ষা করা হয়। অর্থাৎ, বৈদেশিক নীতিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামক শাস্ত্রটি বলে, রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির অমুক নীতিটি তার অন্তর্ভুক্ত তমুক তত্ত্বের আলোকে গৃহীত হয়েছে বা প্রভাবিত হয়েছে, অথবা নীতিটি নতুন কোন চিন্তা বা প্রেক্ষাপট বিবেচনায় গৃহীত হয়েছে যা এই শাস্ত্রের তত্ত্বগুলো ব্যাক্ষা করতে পারে না।
যদি, আরও সহজ করে বলি, রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণে, যে বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করছে, অর্থাৎ, নীতিনির্ধারক (Policymaker), তার ব্যক্তিগত বা সামাজিক প্রেক্ষাপট (Background) এবং আন্তর্জাতিক সিস্টেম সম্পর্কে নীতিনির্ধারকের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা বিশ্লেষণ করা একান্ত জরুরি। বস্তুত, বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ (FPA) প্রধানত এই কাজটিই করে থাকে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক শাস্ত্রের ক্ষেত্রে বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণে নীতিনির্ধারকের বৈচিত্র্যময় চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিরীক্ষা করা খুবই জরুরি। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামক শাস্ত্রটি নিজে যেমন নানা তত্ত্বের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে, এই শাস্ত্রের অন্তর্গত তত্ত্বগুলোও ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। ফলে, নীতিনির্ধারক নীতি প্রণয়নকে শাস্ত্রের তত্ত্বগুলোও বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাক্ষা করে।
যেমন ধরুন বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রের Realism তত্ত্বটি বলে, নীতিনির্ধারকরা বৈদেশিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থকে অধিক প্রাধান্য দেয়। জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্তি ভারসাম্য বজায় রাখার কথা বলে।
আবার, যদি International Society তত্ত্বের আলোকে বলি, একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি আবশ্যিকভাবে শৃঙ্খলা (Order) এবং ন্যায়বিচার (Justice) নামক মূল্যবোধদ্বয়ের আদলে প্রণীত হতে হবে। এই মূল্যবোধদ্বয়ের আলোকে রাষ্ট্র এমন এক বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করবে যার সহায়তায় একটি বিধিবদ্ধ (Rule-based) এবং শৃঙ্খলায় আবদ্ধ (Well-ordered) আন্তর্জাতিক সমাজ তৈরি হবে, যেমনটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে হয়েছে এবং তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছে বিশ্বের নানা অঞ্চল।
আবার, যদি উদারতাবাদ (Liberalism) তত্ত্বের আলোকে বলি, একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ‘'মুক্তি (Freedom)’ ও ‘গণতান্ত্রিক (Democratic)’’ মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। এই তত্ত্বের দাবী, রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নির্ধারকেরা যদি মুক্তি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করে তবে সংঘাতের বদলে রাষ্ট্রের সহবস্থান নিশ্চিত হবে।
এছাড়াও, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক শাস্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা: আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি (International Political Economy- IPE)-ও রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণে অংশ নেয়। তাদের ভাষ্যমতে, রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সিস্টেমকে স্থিতিশীল রাখা। এই স্থিতিশীল সিস্টেমে একটি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি (Economic growth & welfare) ত্বরান্বিত হয়।
তবে, এই তত্ত্বগুলোর মাঝে Realism ও Liberalism তত্ত্বদুটি বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ বিশ্লেষণে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এর অন্যতম কারণ, এই তত্ত্বদুটির আগমন ও বিকাশ ঘটেছে ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্র/ সাম্রাজ্যের সিদ্ধান্ত ও নীতি বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটে।
যেমন: যে নীতিনির্ধারকেরা প্রতিরক্ষা (Defence) বা নিরাপত্তা (Security) নিয়ে বেশি চিন্তিত, তারা রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে Realist বা বাস্তববাদীদের সুপারিশ অনুসারে নির্ধারণ করেন, যাতে আন্তর্জাতিক সিস্টেমে জাতীয় স্বার্থের লড়াইয়ে শক্তি অর্জনের দরুন সে টিকে থাকতে পারে। আবার, যে নীতিনির্ধারকেরা বহুপাক্ষিকতা (Multilateralism) ও উদারবাদী অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলায় সঠিক পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেন, তারা বৈদেশিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক আদর্শের বাস্তবায়ন চান, অর্থাৎ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের (জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলা ও পারস্পরিক সহবস্থান ও সহযোগিতার প্রসার ঘটাতে চান।
তবে, নীতিনির্ধারকদের সব সিদ্ধান্তই যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামক শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত তত্ত্বগুলোর আলোকে ব্যাক্ষা করা যায় এমনটি নয়। অনেকক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য শাস্ত্রের সহযোগিতারও প্রয়োজন দেখা দেয়। যেমন: অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব বা মনোবিজ্ঞান। মূলত, নীতিনির্ধারকদের ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপটের (Background) বৈচিত্রের ফলে বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণকেও নানা শাস্ত্রের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হয়।
বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ পদ্ধতি (Approaches)
কোনো রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে বিশ্লেষণ করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অন্যতম বিশিষ্ট তাত্ত্বিক রবার্ট জ্যাকসন (Robert Jackson) এবং জর্জ সরেনসন (Georg Sørensen) তাদের বিখ্যাত গ্রন্থ Introduction to International Relations–এ বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি পদ্ধতি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদেশিক নীতিকে ব্যাখ্যা করে থাকে। যথা:
১। প্রথাগত পদ্ধতি (Traditional Approach):
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণের সবচেয়ে পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলোর একটি হলো প্রথাগত বিশ্লেষণ পদ্ধতি (Traditional Approach)। এই পদ্ধতির মূল ভিত্তি হলোঃ রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সিস্টেমের কেন্দ্রবিন্দু এবং রাষ্ট্র একটি যুক্তিবাদী বা রেশনাল, সার্বভৌম কর্মক (Actor) হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রের এই কাজের মূল উদ্দেশ্য জাতীয় স্বার্থ (national interest) রক্ষা করা। এই বয়ান অনুসারে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি আদতে এক ধরনের ক্ষমতার লড়াই (power politics), যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, এবং নিজ ভৌগোলি্ক অখণ্ডতা রক্ষায় সর্বদা সজাগ ও সক্রিয় থাকে।
বৈ্দেশিক নীতি বিশ্লেষণের প্রথাগত পদ্ধতিটি মূলত বাস্তববাদ তত্ত্ব (Realism)-এর বয়ানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই তত্ত্ব অনুসারে, আন্তর্জাতিক সিস্টেম নৈরাজ্যপূর্ণ (anarchic), যেখানে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই, ফলে প্রত্যেক রাষ্ট্র নিজের স্বার্থ আদায়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। এখানে আন্তর্জাতিক আইন, নৈতিকতা বা আদর্শের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পায় ক্ষমতা, সামরিক শক্তি এবং কৌশলগত হিসাবনিকেষ। ফলে, বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণে এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, সামরিক সক্ষমতা, মিত্রতা বা এলাইয়েন্স গঠন, এবং প্রতিপক্ষ প্রতিরোধের কৌশল।
এই পদ্ধতির এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো স্নায়ুযুদ্ধ (Cold War)। স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আদর্শিক প্রভাব (ideological dominance) টিকিয়ে রাখার জন্য ভিন্ন ভিন্ন বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে Containment Policy-এর অন্তর্ভুক্তি ও তার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কৌশলগত প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রথাগত বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বড় উদাহরণ, যা সরাসরি প্রথাগত পদ্ধতির সাহায্যে বিশ্লেষণ করা যায়। এছাড়াও উভয় মহাশক্তি তাদের বৈদেশিক নীতিতে NATO ও Warsaw Pact এর মতো সামরিক জোট গঠনের কথা অন্তর্ভুক্ত করেন, যার মাধ্যমে তারা একে অপরের বিপরীতে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন, যা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক কৌশলগত সিদ্ধান্তের উদাহরণ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ভারতের ১৯৭৪ সালের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা, যার কোডনেম ছিল "Smiling Buddha"। এটি ছিল ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক কৌশলগত প্রভাব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নেওয়া একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে যখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত। এই সিদ্ধান্তকে নিছক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হিসেবে নয় বরং একটি রাষ্ট্রীয় কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কীভাবে একটি রাষ্ট্র তার স্বার্থ রক্ষায় প্রথাগত দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে।
এছাড়াও, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক যুদ্ধও এই প্রথাগত পদ্ধতির আলোকে বিশ্লেষণ করা যায়। যদিও ৯/১১ এর প্রেক্ষাপটে ইরাকের বি্রুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রমাণাদি নিয়ে বিতর্ক ছিলো, তথাপি যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে ইরাক গোপনে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (Weapons of Mass Destruction- WMD) তৈরি করছে, যা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই প্রেক্ষিতে, যুক্তরাষ্ট্র তার বৈদেশিক নীতি্র মাধ্যমে ইরাকে pre-emptive strike চালানোকে বৈ্ধতা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে এই আক্রমনের ব্যাক্ষায় বলা হয়, "নিজেকে রক্ষার জন্য আগেভাগেই শত্রুকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া সংগত ও প্রয়োজন।" প্রথাগত পদ্ধতি্র সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমনের প্রেক্ষাপটও পরিষ্কার হয়ে যায়।
তবে প্রথাগত পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র ব্যতীত অন্যান্য Actor, যেমনঃ আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও, বহুজাতিক কোম্পানি বা আন্তর্জাতিক জনমত ইত্যাদির প্রভাবকে প্রায় উপেক্ষা করা হয়। এমনকি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নেতৃত্বের চরিত্র বা আদর্শগত মতাদর্শ প্রভৃতিকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে এটি কখনও কখনও অতিরিক্ত সরলীকরণ ব্যাক্ষা দি্যে থাকে। আধুনিক বৈদেশিক নীতিতে যেখানে নৈতিকতা, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা (Interdependence) ও নন-স্টেট Actor-এর ভূমিকা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে প্রথাগত পদ্ধতির শুধু রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় যথেষ্ট নয়।তবে সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, প্রথাগত পদ্ধতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল বাস্তবতা বোঝার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী এবং কার্যকর পদ্ধতি। বিশেষ করে, শক্তির ভারসাম্য, কৌশলগত প্রতিযোগিতা বা নিরাপত্তা কূটনীতি (security diplomacy)-এর প্রেক্ষাপটে এই পদ্ধতির বিশ্লেষণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী মনে হয়।
২। তুলনামূলক বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ (Comparative Foreign Policy Analysis - CFPA)
তুলনামূলক বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ বা Comparative Foreign Policy Analysis (CFPA)-কে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি গবেষণার ক্ষেত্রে এক আধুনিক বিশ্লেষণ কাঠামো হিসেবে গণ্য করা হয়। তুলনামূলক বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ বা CFPA বিভিন্ন রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ এবং তুলনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলমান কূটনৈতিক কার্যক্রম ও তার নীতিগত পার্থক্য অনুধাবনে সহায়তা করে। একটি রাষ্ট্র কীভাবে ও কেন তার বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করে এবং তা অন্যান্য রাষ্ট্রের বৈ্দেশিক নীতির সঙ্গে কীভাবে তুলনাযোগ্য তা নির্ধারণ করাই CFPA-এর মূল লক্ষ্য। বিশেষত ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে, আচরণবাদী (behavioral) পদ্ধতির আগমনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষণায় সংখ্যাভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণের প্রাধান্য দেখা দেয়, যেখানে আচরণবাদী গবেষকেরা একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে কেবল বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে, বরং বিভিন্ন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সাথে অত্র রাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতির তুলনামূলক বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দেয়।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে বলা হয় যে, কোন রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি কেবল আন্তর্জাতিক কাঠামো দ্বারাই প্রভাবিত হয় না, বরং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা, শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি, আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, এবং নাগরিক সমাজ, এমনকি অর্থনৈতিক প্রবণতা ও সামাজিক চাপের দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। তাই তুলনামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের কথা বলে এবং পররাষ্ট্রনীতিকে কেবল রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বা নিরাপত্তা দিয়ে ব্যাখ্যা না করে বরং বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করার কথা বলে।
উদাহরণস্বরূপ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেমন যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতি গঠনে কংগ্রেস, মিডিয়া, এবং বিভিন্ন লবিং গ্রুপের প্রভাবকে গুরুত্ব দেয়, আবার, চীনের মত একদলীয় শাসনব্যবস্থায় চীন তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারক এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়।
রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এবং তাতে ইতিহাস, ভূগোল ও সংস্কৃতি ইত্যাদি কীভাবে ভূমিকা রাখে তা পর্যালোচনা করাও তুলনামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
যেমনঃ ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে পারমাণবিক অস্ত্রের কৌশলগত ভারসাম্য থাকলেও ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে আঞ্চলিক নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা এবং বহুপাক্ষিক কূটনীতির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়, যেখানে পাকিস্তান নিরাপত্তা-ভিত্তিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কি্ত কূটনীতিতে অধিক মনোযোগী।
আবার নর্ডিক দেশসমূহ, যেমনঃ সুইডেন ও নরওয়ে, তাদের বৈদেশিক নীতিতে মানবাধিকার, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতার মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয়, যা তুলনামূলক বিশ্লেষণে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বি্বেচিত।
তবে, তুলনামূলক বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমনঃ প্রতিটি রাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকায় প্রত্যক্ষ তুলনা থেকে অনেক সময় যথার্থ ফলাফল পাওয়া যায় না। তদুপরি, বৈদেশিক নীতির অনেক তথ্য গোপন থাকে বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রকাশযোগ্য হয় না, ফলে গবেষণায় তথ্যসংগ্রহের ঘাটতি দেখা দেয়। এছাড়া, অনেক সময় হঠাৎ রাজনৈতিক পরিবর্তন বা আন্তর্জাতিক সংকট রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে প্রভাব ফেলে যা পূর্বাভাসযোগ্য নয়, এর বড় উদাহরণ সোভিয়েত ইউনি্যনের পতন।
সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, তুলনামূলক বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর তাত্ত্বিক কাঠামো প্রদান করে। বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায়, যেখানে রাষ্ট্র পারস্পরিক নির্ভরতা, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বহুপাক্ষিক নীতিতে যুক্ত, সেখানে তুলনামূলক বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের জন্য রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির প্রকৃতি ও গঠন বুঝতে একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়।
৩। আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ও প্রক্রিয়া (Bureaucratic Structures and Process):
আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ও প্রক্রিয়া (Bureaucratic Structures and Process) একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ কাঠামো। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয়, রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কেবল শীর্ষ নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রপ্রধানের সিদ্ধান্ত দ্বারা নির্ধারিত হয় না; বরং নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, মন্ত্রণালয়, সামরিক ও নিরাপত্তা সংস্থা, এবং প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যকার সংঘাত, প্রতিযোগিতা, ও সমন্বয়ের ফলাফল হিসেবেই তা গঠিত হয়।
গ্রাহাম অ্যালিসনের ১৯৭১ সালে রচিত “Essence of Decision” নামক গ্রন্থের Bureaucratic Politics Model অধ্যায় থেকে মূলত এই বিশ্লেষণ পদ্ধতির সূচনা হয়। তিনি দেখান, ১৯৬১ সালের কিউবান মিসাইল সংকট কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্টের একক সিদ্ধান্ত নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিআইএ, ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাঝে দ্বন্দ্ব ও পলিসি প্রতিযোগিতার এক ফলাফল। এই দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, নীতিনির্ধারকদের মধ্যে “Where you stand depends on where you sit” অর্থাৎ, আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তার ওপর আপনার ও আপনার সিদ্ধান্তের অবস্থান নির্ভর করে।
এই পদ্ধতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো: আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ ও ধীরগতি সম্পন্ন প্রক্রিয়া, যেখানে ফাইল প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ধাপ, এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগে দীর্ঘ সময় লাগে। যেমনঃ একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি অনুমোদনে কেবল রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়; বরং অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কাস্টমস বিভাগ, এমনকি আইন মন্ত্রণালয়কেও প্রয়োজনবোধে সম্পৃক্ত হতে হয়, যার ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া জটিল ও ধী্রগতি্র হয়ে পড়ে।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি গঠনে Ministry of External Affairs ছাড়াও National Security Council, Ministry of Defence, এবং বিভিন্ন Think Tank ও Intelligence Agency-র মধ্যে মতানৈক্য এবং প্রক্রিয়াগত দ্বন্দ্ব প্রায়ই পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করে। আবার, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে State Department, Pentagon, NSA এবং CIA’র ভূমিকা আলাদা হলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বা অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা অনেক সময় বিদেশে মার্কিন অবস্থানকে জটিল করে তোলে।
তবে এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি সীমাবদ্ধতা হলো, এটি অনেক সময় রাষ্ট্রের বৃহত্তর কৌশলগত উদ্দেশ্য বা আদর্শগত লক্ষ্যকে অবহেলা করে, এবং নীতিনির্ধারকদের সক্ষমতাকে অতিমাত্রায় কাঠামোগত প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ করে ফেলে। তদুপরি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর আমলাতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল বা ব্যক্তিনির্ভর হওয়ার কারণে এই মডেল সবসময় কার্যকরভাবে কাজও করে না। তবুও, আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ও প্রক্রিয়া পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ টুলস, যা কেবল পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছে তা নয়, বরং কিভাবে ও কার মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ইত্যাদি প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মাধ্যমে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণকে আরও কার্যকারি করে তোলে।
৪। মানসিক প্রক্রিয়া ও মনস্তত্ত্ব (Cognitive Process and Psychology):
মানসিক প্রক্রিয়া ও মনস্তত্ত্বভিত্তিক বিশ্লেষণ (Cognitive Process and Psychology) বৈদেশিক নীতিকে ব্যাখ্যার এক গুরুত্বপূর্ণ আচরণবাদী পদ্ধতি, যা মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক (individual) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। এই পদ্ধতি অনুসারে, বৈদেশিক নীতিতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো প্রধানত নীতিনির্ধারকের (ব্যক্তির) বা নেতৃত্বের (রাষ্ট্রপ্রধানের) মানসিক অবস্থা, উপলব্ধি, পূর্বানুভব, স্মৃতি, মানসিক সংকীর্ণতা (cognitive bias), এবং আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অর্থাৎ, একজন রাষ্ট্রনায়ক বা নীতিনির্ধারক কীভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করছেন, কোন তথ্য তিনি গ্রহণ করছেন বা উপেক্ষা করছেন ইত্যাদি মানসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির (রাষ্ট্রনায়ক বা নীতিনির্ধারক) সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রকৃতিকে বুঝতে সাহায্য করে।
মনোবিজ্ঞানের কিছু মৌলিক ধারণার উপর ভিত্তি করে মানসিক প্রক্রিয়া ও মনস্তত্ত্বভিত্তিক বিশ্লেষণ নামক বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ পদ্ধতি্র আবির্ভাব ঘটে। যেমন:
- Cognitive Dissonance (জ্ঞানগত দ্বন্দ্ব)
- Selective Perception (পছন্দনির্ভর উপলব্ধি)
- Groupthink (দলভিত্তিক একমুখী সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া)
- Heuristics (স্বল্পতথ্য নির্ভর সিদ্ধান্ত পদ্ধতি) ইত্যাদি।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসনের ভিয়েতনাম যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনেক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে Cognitive Dissonance তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়, যেখানে জনসন পরাজয়ের আশঙ্কা ও বাস্তব তথ্য উপেক্ষা করে নিজস্ব পূর্বধারণা ও বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্বান্ত যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। আবার, ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন দল ‘Groupthink’ বা দলগত মনোভাবের কারণে বিরুদ্ধতথ্য এড়িয়ে গেছেন বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন। এছাড়া, সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতা বা ইতিহাসভিত্তিক ব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যাকে বলা হয় Historical Analogy। যেমনঃ ইরান বা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় ১৯৩৮ সালের মিউনিখ চুক্তি থেকে শেখা “Appeasement doesn’t work” যুক্তি ব্যবহার করেন।
এই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি, নীতিনির্ধারকের সীমাবদ্ধতা, তথ্য প্রক্রিয়াকরণে ভুল, বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের (overconfidence bias) মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করে। এই পদ্ধতির ভাষায়, বৈদেশিক নীতি সবসময় যৌক্তিক ও গণিতভিত্তিক নয়, বরং মানবিক দুর্বলতা, মানসিক চাপ, ও আবেগ দ্বারা তা প্রভাবিত হয়। তবে, এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হলো, প্রায়শই ব্যক্তি-নির্ভর এবং মনস্তাত্ত্বিক উপাত্ত প্রাপ্তি কঠিন হওয়ার কারণে অনেকক্ষেত্রে মানসিক প্রক্রিয়া ও মনস্তত্ত্বভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বৈদেশিক নীতিকে ব্যাখ্যা করা জটিল হয়ে যায়। এছাড়াও, এই পদ্ধতিতে, ব্যক্তির সিদ্ধান্তে সামাজিক বা আন্তর্জাতিক কাঠামোগত বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাবের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা যায় না।
তবুও, Cognitive and Psychological Approach বৈদেশিক নীতিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, যা সিদ্ধান্তগ্রহণকে কেবল গঠনমূলক কাঠামো নয় বরং ব্যক্তি ও অভ্যন্তরীণ মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন হিসেবেও বোঝার সুযোগ করে দেয়।
৫। Multilevel ও Multidimensional তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
বৈদেশিক নীতির বিশ্লেষণে Multilevel এবং Multidimensional তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি দ্বারা একটি সমন্বিত ও বহুমুখি দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়। এই পদ্ধতি মনে করে যে, কোনও একটি মাত্র তত্ত্ব বা তাত্ত্বিক কাঠামো দ্বারা বৈদেশিক নীতি ব্যাখ্যা করা যায় না; বরং রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে বুঝতে হলে আন্তর্জাতিক, রাষ্ট্রীয় (domestic), প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিক পর্যায়ের বিভিন্ন উপাদানকে একসাথে বিশ্লেষণ করতে হবে। অর্থাৎ, বহুমাত্রিক (multidimensional) এবং বহুস্তরবিশিষ্ট (multilevel) তাত্ত্বিক কাঠামোর সাহায্যে বৈদেশিক নীতিকে বিশ্লেষণ করা।
এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, বৈদেশিক নীতিকে বিশ্লেষণের প্রয়োজনে এটি একইসাথে কাঠামোগত (structural), প্রাতিষ্ঠানিক (institutional), ও আচরণগত (behavioral) উপাদানগুলোকে বিবেচনাধাীন রাখে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে আন্তর্জাতিক স্তরে এর ভূ-রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, রাষ্ট্রীয় স্তরে কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক মতাদর্শ, ডেমোক্রেসি বা লবিস্ট গোষ্ঠীর ভূমিকা এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট বা গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকদের মানসিক অবস্থা প্রভৃতি উপাদানকে একত্রে গ্রহণ করতে হবে। পদ্ধতিটি বলে, এককভাবে কোনো একটি পর্যায় বা লেভেল থেকে বিশ্লেষণ করলে বৈদেশিক নীতির পূর্ণ ছবি পাওয়া সম্ভব নয়।
এছাড়া, এই পদ্ধতিতে Level of Analysis Problem-এর সমাধান করার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ, বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কোন স্তরে (international system, state, individual) সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করা নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে তা সমাধানের কথা এই পদ্ধতিটি বলে। যেমনঃ স্নায়ুযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পারস্পরিক বৈরিতা অনেকাংশে ছিল আন্তর্জাতিক স্তরের কাঠামোগত বাস্তবতার ফল (Neorealism)। কিন্তু আফগানিস্তান বা ইরাকে হস্তক্ষেপের নীতিগুলো অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসাব ও ব্যক্তিগত মানসিক অবস্থান দ্বারা চালিত ছিল (Classical Realism)।
এই বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিটি সমসাময়িক বৈশ্বিক রাজনীতি বিশ্লেষণে কার্যকর, কারণ সমসাময়িক বিশ্বে বৈদেশিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোন একক কারণ নয় বরং বহুবিধ ও পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত উপাদান একযোগে কাজ করে। বিশ্বায়ন, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা এই বিশ্লেষণ কাঠামোতে স্থান পায়। তবে, এই পদ্ধতির একটি চ্যালেঞ্জ হলো এর জটিলতা। কারণ বহুবিধ স্তর ও উপাদান বিশ্লেষণ করা গবেষকের বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে সময়সাপেক্ষ এবং গবেষণার তথ্যসংগ্রহকে কঠিন করে তোলে। তবুও, Multilevel and Multidimensional Approach বৈদেশিক নীতিকে বহুমাত্রিক বাস্তবতার ভিত্তিতে তুলনামূলকভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ ও গভীর বিশ্লেষণের সুযোগ দেয়।
৬। "Construction of Social Identity" ভিত্তিক বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ:
জ্যাকসন ও সরেনসনের মতে, একটি রাষ্ট্র কিভাবে নিজেকে আন্তর্জাতিক সমাজের অংশ হিসেবে কল্পনা ও উপস্থাপন করে, তা তার বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি Constructivist তাত্ত্বিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। এ তত্ত্ব বলা হয় যে, রাষ্ট্রের আচরণ কেবল শক্তির ভারসাম্য বা অর্থনৈতিক স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয় না, বরং সামাজিকভাবে নির্মিত পরিচয় (socially constructed identity), বিশ্বাস (beliefs), এবং আদর্শিক মূল্যবোধ (normative values) দ্বারাও নির্মিত হয়।
এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রাষ্ট্র কেবল একটি বস্তুগত সত্তা নয়; বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক নির্মাণ, সময়ের সাথে সাথে যার পরিচয় পরিবর্তি্ত হয় এবং নতুন পরিচয়কে সে আন্তর্জাতিক পরিক্রমায় তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে জার্মানি তার আগের আগ্রাসী ও সামরিক পরিচয় থেকে সরে এসে এক নতুন "শান্তিকামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র" হিসেবে আত্মপরিচয় নির্মাণ করে। এর প্রভাব সরাসরি তার বৈদেশিক নীতিতে প্রতিফলিত হয়, যেমন: ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সমর্থন, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকে গুরুত্ব দেওয়া, এবং বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষা মিশনে জার্মানি্র অংশগ্রহণ। এই উদাহরণ থেকে বুঝা যায়, কীভাবে একটি রাষ্ট্রের (জার্মানি্র) কল্পিত পরিচয় তার বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো দক্ষিণ আফ্রিকা। বর্ণবাদের অবসানের পর নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যহীন সমাজ হিসেবে গড়ে তোলে। এই পরিচয় তার বৈদেশিক নীতিতেও প্রতিফলিত হয়, যেখানে তারা আফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মানবিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র এবং শান্তির পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রাখে। এই সামাজিক পরিচয় তাদের রাষ্ট্রীয় নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
জ্যাকসন ও সরেনসন এই প্রসঙ্গে আরও ব্যাখ্যা করেন যে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং “norm entrepreneurs” যেমন জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, রাষ্ট্রগুলোকে একটি নির্দিষ্ট আদর্শিক কাঠামোর অনুসারে আচরণ করতে উৎসাহিত করে। ফলে রাষ্ট্রগুলোর মাঝে এক ধরনের বৈশ্বিক পরিচয় বা "আধুনিক রাষ্ট্র" হওয়ার চাপ তৈরি হয়, যা তাদের বৈদেশিক নীতিকে পরিবর্ধনে সাহায্য করে। তবে তারা সতর্ক করে বলেন যে, এই সামাজিক প্রক্রিয়ায় বৈচিত্র্য অনেক সময় হারিয়ে যায়, এবং বিশ্বব্যাপী একধরনের সাংস্কৃতিক একরূপতা (cultural homogenization) তৈরি হয়, যেমন ইউরোপী্য ইউনি্যনে হয়েছে।
সবশেষে, কনস্ট্রাক্টিভিস্ট বা সামাজিক পরিচিতি নির্ভর বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ পদ্ধতিটি আরও বলে যে, বৈদেশিক নীতি একটি গতিশীল ও পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ইতিহাস, মানসিকতা, নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবের সম্মিলনে গড়ে ওঠে। এটি কেবল বাহ্যিক স্বার্থরক্ষার নয়, বরং আত্মপরিচয় প্রকাশের একটি উপায়ও বটে।
বৈদেশিক নীতির পর্যায়গত বিশ্লেষণ (Level of Analysis)
বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণে আমরা বিভিন্ন স্তর থেকে বুঝতে চেষ্টা করি একটি দেশ কী কারণে, কোন প্রেক্ষাপটে এবং কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে। এই স্তরগুলো বিভিন্ন ধরনের কারণ ও প্রভাব তুলে ধরে, যা দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব স্তর একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি গভীরভাবে বুঝতে সহায়ক হয় এবং দেশের পররাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
১। Individual Level Analysis (ব্যক্তি-ভিত্তিক বিশ্লেষণ)
বৈদেশিক নীতির ব্যক্তি পর্যায়ের বিশ্লেষণে বৈদেশিক নীতি নীতিনির্ধারনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির (রাষ্ট্রপ্রধান/ নীতিনির্ধারক/ আমলা) ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, মানসিক অবস্থা, সিদ্ধান্তগ্রহণের ধরন এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই স্তরে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে বিশ্লেষণ করা হয়। একটি রাষ্ট্র কীভাবে আন্তর্জাতিক পরিবেশে নিজেকে উপস্থাপন করবে, তা অনেক সময় নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ এবং মানসিক অবস্থা উপর।
উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ৯/১১ হামলার পর “ইভিল অ্যাক্সিস” (শয়তানের জোট) তত্ত্ব উপস্থাপন করেন এবং ইরাক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এটি ছিল তার নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, ও নিরাপত্তাবোধের প্রতিফলন, যা পুরো আমেরিকার বৈদেশিক নীতিকে রূপান্তর করে, একে মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক করে তোলে। আবার, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ব্যক্তিগত নেতৃত্বের কৌশল, হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের ভাবমূর্তি গঠনের মাধ্যমে প্রতিবেশী নীতিকে পুনর্গঠন করেছেন। ফলে, আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের কৌশলগত অংশীদারের সংখ্যা বাড়লেও, তার ধর্মভিত্তিক রাজনী্তি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে ভারতের বৈ্দেশিক সম্পর্ককে তলানী্তে ঠেকিয়েছে।
২. State Level Analysis (রাষ্ট্রীয় বা অভ্যন্তরীণ স্তর)
বৈদেশিক নীতির রাষ্ট্রীয় স্তরের বিশ্লেষণে দেখানো হয় কীভাবে একটি রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কাঠামো, প্রশাসনিক অবকাঠামো, সামাজিক আদর্শ এবং জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে। রাষ্ট্রীয় স্তরের বিশ্লেষণে বলা হয় যে, একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, পার্লামেন্ট, বা প্রেসার গ্রুপগুলোর ভূমিকা অনেক সময় সে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক শাসন ও বৈশ্বিক শান্তির পক্ষে অবস্থান নেয়, কারণ দেশটির অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ ও সাংবিধানিক কাঠামো এই নীতিগুলোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্যদিকে, চীনের মতো একদলীয় কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের ওপর গুরুত্ব দেয়, যা তার পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রতিফলিত হয়। যেমন: দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী কূটনীতি ও নতুন অর্থনৈ্তিক ও কৌশলগত পদক্ষেপ “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ”।
৩. System Level Analysis (আন্তর্জাতিক কাঠামো বা ব্যবস্থাগত স্তর)
বৈদেশিক নীতির System level- এর বিশ্লেষণে মূলত দেখানো হয় আন্তর্জাতিক সিস্টেমের, অর্থাৎ ক্ষমতার ভারসাম্য (balance of power), আন্তর্জাতিক ক্ষমতার মেরুকরণ (polarity), এবং প্রধান রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি্র প্রভাবে কীভাবে একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি পরিবর্তি্ত হয়। এই বিশ্লেষণে বলা হয়, কোনো একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অনেক সময় শুধু তার নিজস্ব অভ্যন্তরীণ স্বার্থ দ্বারা নয় বরং বৈশ্বিক শক্তির সম্পর্ক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেও নির্ধারিত হয়।
যেমনঃ স্নায়ুযুদ্ধের সময় ক্ষমতার দ্বিমেরুকরণ (bipolarity), অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতার লড়াই, অন্যান্য ছোট ও মাঝারি শক্তির জন্য এক গঠনমূলক কাঠামো তৈরি করে। তৎকালে, বাংলাদেশ, ভারত কিংবা মিসরের মতো দেশগুলোও তাদের পররাষ্ট্রনীতি এই দুই পরাশক্তির মধ্যকার প্রতিযোগিতা মাথায় রেখে গড়ে তোলে। একইভাবে, বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা একটি নতুন ‘quasi-bipolar’ বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি করছে, যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোকে নিজের পররাষ্ট্রনীতি ভারসাম্যপূর্ণ করতে হচ্ছে, যেমন: বাংলাদেশ এক্ষেত্রে “মাল্টিভেক্টর” কূটনীতি অনুসরণ করছে।
৪. Global Level Analysis (বৈশ্বিক বা বিশ্বস্তরীয় বিশ্লেষণ)
বৈদেশিক নীতির Global Level- এর বিশ্লেষণে বিশ্বের আধুনিক ও উদারনৈতিক রূপকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে বৈদেশিক নীতিকে ব্যাখ্যা করতে বৈশ্বিক প্রবণতা ও সামাজিক নির্মাণকেই মূল উপাদান হিসেবে ধরা হয়। এখানে বৈশ্বিক সামাজিক পরিচয় (Global social identity), প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্বব্যাপী চর্চিত মূল্যবোধ ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান বিশ্বে “গ্লোবাল সাউথ” বা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো নিজেদের উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে উন্নীত করতে চায় এবং তাই তারা বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতি, মানবাধিকার ইস্যু ও বৈশ্বিক বাণিজ্যে নিজেদের দৃশ্যমানতা বাড়াতে সচেষ্ট।
আবার, জাতিসংঘ বা ইইউ-এর মতো সংস্থাগুলো “norm entrepreneurs” হিসেবে কাজ করে, যা রাষ্ট্রের সামনে কিছু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মত Norms বা Behavior বৈধতা দি্যে থাকে । যেমনঃ আফ্রিকার অনেক রাষ্ট্র আজ গণতন্ত্র, নারী অধিকার, এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত সহায়তার অংশ হিসেবে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিকে পুনর্গঠন করছে। COVID-19 মহামারী চলাকালীন সময়ে অনেক দেশ ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’ ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অংশ করে তুলেছিলো যা গ্লোবাল স্তরের প্রভাবে বৈদেশিক নীতি প্রণয়নের এক স্পষ্ট উদাহরণ।
উপসংহার (Conclusion):
বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া, যা আমাদের একটি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সিদ্ধান্ত এবং কূটনৈতিক কার্যক্রম বুঝতে সাহায্য করে। কীভাবে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা যায়, অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, বা আন্তর্জাতিক সমস্যার মোকাবিলা করা যায় প্রভৃতি্র ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করা হয়, এবং বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ আমাদের বিভিন্ন পদ্ধতি এবং স্তরের সাহায্যে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির প্রকৃ্ত রূপ আমাদের সামনে তুলে ধরে, বিশেষত কেনো, কখন, কীভাবে একটি রাষ্ট্র তার বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। জ্যাকসন ও সরেনসনের মতো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রের পন্ডিতেরা বলেন যে, বৈদেশিক নীতিকে বোঝার জন্য আমাদের শুধু রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তই নয়, বরং তার ভেতরের কাঠামো, নেতৃত্ব, মানসিকতা, আন্তর্জাতিক পরিবেশ, এবং সামাজিক পরিচয়কেও বিবেচনায় নিতে হয়। আসলে, একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ সবসময় একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে সময়, প্রেক্ষাপট এবং বহুমাত্রিক কারণ একত্রে কাজ করে, এবং রাষ্ট্রের আচারণ ও তার বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করে। তাই, বৈদেশিক নীতির ন্যায় এরূপ গতিশী্ল ক্ষেত্রকে সঠিকভাবে বুঝতে ও বিশ্লেষণে একটি মাত্র পদ্ধতি বা তত্ত্বকে নয়, বরং আমাদের উচিত হবে বিভিন্ন পদ্ধতি ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিভংগিকে একত্রে ব্যবহার করা, আর এভাবেই আমরা বৈদেশিক নীতিকে পরিপূর্ণ ও অর্থবহভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি।
- বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল বইঃ Introduction to International Relations

No comments