International Monetary System: ইতিহাস, প্রকারভেদ ও কার্যক্ষমতা
![]() |
| International Monetary System |
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা (International Monetary System) একটি সম্মিলিত আর্থিক কাঠামো বা সিস্টেম, যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একে অন্যের সঙ্গে অর্থ লেনদেন করে। এই ব্যবস্থায় নির্ধারিত হয় কীভাবে এক দেশের মুদ্রা আরেক দেশের মুদ্রায় রূপান্তর বা বিনিময় হবে (exchange rate), কখন এবং কীভাবে লেনদেন সম্পন্ন হবে, এবং কোন কোন নিয়ম-কানুন মেনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুদ্রা আদান-প্রদান চলবে। এই পুরো সিস্টেমটি পরিচালনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর মতো সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও পুঁজির প্রবাহকে সহজ, নিরাপদ ও স্থিতিশীল রাখে।
এই সিস্টেম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমনঃ কোন দেশের মুদ্রা অন্য দেশের মুদ্রার সঙ্গে কত অনুপাতে বিনিময় হবে (বিনিময় হার/ exchange rate), মুদ্রার দামের ওঠানামার সীমা কত হবে, এবং আন্তর্জাতিক লেনদেন কী নিয়মে সম্পন্ন হবে ইত্যাদি বিষয় এই International Monetary System-এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এছাড়া, আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকট মোকাবিলা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা একটি কার্যকর ও নীতিনির্ধারক ভূমিকা পালন করে।
International Monetary System-এর বিকাশঃ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা সময়ের সাথে সাথে অনেক ধাপে পরিবর্তিত হয়েছে এবং প্রতিটি ধাপে এটি নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিয়েছে। শুরুতে ছিল স্বর্ণ মান ব্যবস্থা (Gold Standard), যেখানে প্রতিটি দেশের মুদ্রার মান নির্ধারিত হতো নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণের ভিত্তিতে। এটি বেশ কিছুদিন পর্যন্ত কার্যকর ছিল, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। এরপর ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস সম্মেলনে গৃহীত হয় ব্রেটন উডস ব্যবস্থা (Bretton Woods Monetary System)। এখানে অধিকাংশ দেশের মুদ্রাকে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের সাথে স্থির হারে যুক্ত করা হয়, আর ডলারকে স্বর্ণের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে এক ধরনের স্থিতিশীল বিনিময় হার বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল। তবে ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন ডলারের স্বর্ণ রূপান্তর বন্ধ করে দেয়, তখন এই ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে।
এরপর বিশ্বব্যাপী চালু হয় ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম (Floating Exchange Rate System), যেখানে প্রতিদিন বাজারের চাহিদা ও যোগানের ওপর ভিত্তি করে মুদ্রার মান ওঠানামা করে। এই ব্যবস্থা অনেক বেশি নমনীয় হলেও এর মাধ্যমে মুদ্রার অনিশ্চয়তা বাড়ে এবং কিছু অর্থনৈতিক ঝুঁকিও তৈরি হয়। এই পুরো ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। যেমন: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) আর্থিক সংকটে থাকা দেশগুলোকে ঋণ প্রদান ও নীতিগত সহায়তা দেয়; SWIFT নামক বৈশ্বিক লেনদেন নেটওয়ার্ক নিরাপদ ও দ্রুত অর্থ স্থানান্তর নিশ্চিত করে; এবং বিশ্ব ব্যাংক (World Bank) বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও সহায়তা প্রদান করে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে?
যখন একটি দেশ অন্য একটি বা একাধিক দেশ থেকে পণ্য (goods) ক্রয় করে, তখন সেই পণ্যের বিনিময়ে অর্থ প্রেরণের প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপঃ যুক্তরাষ্ট্র যদি ব্রাজিল থেকে কফি আমদানি করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ব্রাজিলকে কফির মূল্য পরিশোধ করবে। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা হলো মার্কিন ডলার (USD), আর ব্রাজিলের মুদ্রা হলো ব্রাজিলিয়ান রিয়াল (BRL)। এই পরিস্থিতিতে, ডলারের বিনিময়ে ব্রাজিল কীভাবে রিয়াল গ্রহণ করবে, তা নির্ধারণ করতে একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার (exchange rate) প্রয়োজন হয়।
একইভাবে, যখন জাপান সৌদি আরব থেকে তেল আমদানি করে, তখন জাপানকেও সৌদি আরবকে অর্থ প্রদান করতে হয়। জাপানের মুদ্রা হলো ইয়েন (JPY), আর সৌদি আরবের মুদ্রা হলো সৌদি রিয়াল (SAR)। কিন্তু আন্তর্জাতিক তেল বাজারে সাধারণত মূল্য নির্ধারণ হয় মার্কিন ডলারে (USD)। ফলে জাপানকে প্রথমে ইয়েন দিয়ে মার্কিন ডলার কিনতে হয় এবং তারপর সেই ডলার সৌদি আরবকে দিতে হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় মুদ্রা রূপান্তর, লেনদেনের নিয়ম ও আন্তর্জাতিক অর্থপ্রদানের পদ্ধতি সবই আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার (International Monetary System) আওতায় পড়ে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বৈশ্বিক অর্থনীতি নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে চলে।
বিনিময় হারের মাধ্যমে এক দেশের মুদ্রা অন্য দেশের মুদ্রার সাথে কী হারে বিনিময় (exchange) হবে, তা নির্ধারিত হয়। এই হার মুদ্রার আপেক্ষিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে কার্যকর, স্বচ্ছ এবং নির্ভরযোগ্য করে তোলে। যদি বিনিময় হার সম্পর্কিত কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম বা কাঠামো না থাকে, তাহলে বৈদেশিক লেনদেনে জটিলতা, বিলম্ব এবং অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, যা বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত করতে পারে। এই কারণেই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক, পণ্য আমদানি-রপ্তানি এবং আর্থিক লেনদেন সচল রাখতে একটি সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক বিনিময় কাঠামো অপরিহার্য। এটি বিভিন্ন দেশের মুদ্রা বিনিময়ের নিয়মাবলী নির্ধারণ করে এবং মুদ্রার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেন সহজ, দ্রুত এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-কানুন (rules), রীতি (practices), প্রথা (conventions) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা (international institutions) প্রয়োজন হয়। যেমনঃ মুদ্রার রূপান্তর কিভাবে হবে, পেমেন্টের সময়সীমা কি হবে, এবং কোন দেশে কীভাবে অর্থ স্থানান্তরযোগ্য হবে ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণের জন্য একটি কাঠামো থাকা জরুরি। এই পূর্ণাঙ্গ কাঠামোকেই বলা হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা।
এই ব্যবস্থা মূলত বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থ আদান-প্রদান করার জন্য একটি নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল পদ্ধতি প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপঃ একজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যদি যুক্তরাজ্যে পড়াশোনার জন্য টিউশন ফি পাঠাতে চান, তাহলে তাকে তার বাংলাদেশি টাকা (BDT) ব্রিটিশ পাউন্ড (GBP) এ রূপান্তর করতে হবে এবং তারপর নির্দিষ্ট ব্যাংকিং চ্যানেল, যেমনঃ SWIFT কোডের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করতে হবে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক নিয়ম ও প্রোটোকল অনুসরণ করে সম্পন্ন হয়, যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার আওতায় পড়ে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য
সমস্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থায় কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। যেমনঃ
১। পেমেন্টের নিয়মাবলী (rules of payment),
২। বিনিময় হার নির্ধারণের পদ্ধতি (exchange rate mechanism), এবং
৩। মুদ্রার মানের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা (maintaining currency stability)।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো দেশের মুদ্রার ওপর যখন চাপ পড়ে বা মুদ্রার মূল্য পতন ঘটে, তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা IMF আর্থিক সহায়তা দিয়ে সেই দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। একইভাবে, SWIFT (Society for Worldwide Interbank Financial Telecommunication) সিস্টেম আন্তর্জাতিক লেনদেনের নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করে। এই কাঠামোগুলো ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক আদান-প্রদান কার্যকরভাবে পরিচালনা করা কঠিন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার মানদণ্ড
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থাকে সাধারণত দুটি মানদণ্ডে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়:
(i) বিনিময় হারের ভূমিকা (Role of Exchange Rate)ঃ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার প্রথম মানদণ্ড হচ্ছে এক দেশের মুদ্রার বিনিময় হার কীভাবে নির্ধারিত হয়। এটি সাধারণত তিনটি পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ধারিত হতে পারে। যথাঃ স্থির হার (Fixed Exchange Rate), ভাসমান হার (Floating Exchange Rate) এবং নিয়ন্ত্রিত ভাসমান হার (Managed or Pegged Float Rate)। স্থির বিনিময় হারের উদাহরণ হিসেবে ব্রেটন উডস ব্যবস্থা (Bretton Woods System) উল্লেখযোগ্য। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি দেশের মুদ্রাকে মার্কিন ডলারের (USD) সাথে একটি নির্দিষ্ট হারে যুক্ত রাখা হত, আর ডলার ছিল সরাসরি স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্য। অর্থাৎ মুদ্রার মান পূর্বনির্ধারিত থাকত এবং খুব একটা পরিবর্তন হত না।
অপরদিকে, বর্তমান আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার অধিকাংশ দেশ ভাসমান বিনিময় হার (Floating Exchange Rate) পদ্ধতি অনুসরণ করে। এই পদ্ধতিতে মুদ্রার মান প্রতিদিন বৈশ্বিক মুদ্রা বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়। এতে কোনো নির্দিষ্ট হারে আটকে থাকা হয় না। তবে কিছু দেশ এই দুইয়ের মধ্যবর্তী একটি পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে, যাকে নিয়ন্ত্রিত ভাসমান হার বা Managed Float বলা হয়। এই ব্যবস্থায় মুদ্রার বিনিময় হার মূলত বাজারই ঠিক করে, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনে বাজারে হস্তক্ষেপ করে হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখে। অনেক সময় এটিকে Pegged Float System নামেও ডাকা হয়।
(ii) রিজার্ভ সম্পদের প্রকৃতি (Nature of Reserve Assets)ঃ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হলো রিজার্ভ সম্পদের প্রকৃতি। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য একটি দেশ কোন ধরণের সম্পদ বা মুদ্রাকে রিজার্ভ হিসেবে সংরক্ষণ করবে, সেটাই এই মানদণ্ডে নির্ধারিত হয়। প্রাচীন ও মধ্য ও আধুনিক সময়ের মুদ্রা ব্যবস্থায় স্বর্ণ (Gold) ছিল প্রধান রিজার্ভ সম্পদ। তখনকার Gold Standard System-এ প্রতিটি দেশের মুদ্রা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত থাকত। মুদ্রার মান সরাসরি স্বর্ণের মূল্যের ওপর নির্ভর করত। ফলে দেশগুলো স্বর্ণের রিজার্ভের ভিত্তিতে বৈদেশিক লেনদেন পরিচালনা করত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা (Foreign Currency) প্রধান রিজার্ভ সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে মার্কিন ডলার (USD), ইউরো (EUR), ইয়েন (JPY) ইত্যাদি মুদ্রাগুলোকে অধিকাংশ দেশ রিজার্ভ হিসেবে সংরক্ষণ করে। যেমনঃ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধানত মার্কিন ডলার রিজার্ভ হিসেবে ধরে রাখে, যা আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও একটি আধুনিক রিজার্ভ সম্পদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হলো SDR (Special Drawing Rights)। এটি একটি কৃত্রিম আন্তর্জাতিক মুদ্রা, যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) কর্তৃক তৈরি ও পরিচালিত হয়। SDR সরাসরি কোনো দেশের মুদ্রা নয়, বরং এটি একটি নির্দিষ্ট মুদ্রার ঝুড়ি (basket of currencies)-এর উপর ভিত্তি করে গঠিত। এই ঝুড়িতে মার্কিন ডলার, ইউরো, চীনা ইউয়ান, জাপানি ইয়েন ও ব্রিটিশ পাউন্ড অন্তর্ভুক্ত থাকে। SDR-এর মূল উদ্দেশ্য হলো, সদস্য দেশগুলো যেন আন্তর্জাতিক লেনদেন, ঋণ পরিশোধ বা রিজার্ভ ঘাটতি মোকাবেলায় এটি ব্যবহার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো দেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়লে SDR ব্যবহার করে IMF-এর মাধ্যমে সাহায্য পেতে পারে বা অন্য সদস্য দেশের সঙ্গে লেনদেন করতে পারে। এটি একটি সহায়ক রিজার্ভ সম্পদ, যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিনিময় হার পদ্ধতির গুরুত্ব
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে বিনিময় হার পদ্ধতি (Exchange Rate Regime)। এই পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ধারিত হয় যে, এক দেশের মুদ্রা অন্য দেশের মুদ্রার সাথে কোন হারে বিনিময় হবে। এর উপর নির্ভর করে বৈদেশিক বাণিজ্য, পুঁজি চলাচল, ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য। একটি সুষম ও নির্ভরযোগ্য বিনিময় হার পদ্ধতি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, এবং মুদ্রার স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক হয়।
স্থায়ী বিনিময় হার ব্যবস্থা (Fixed Exchange Rate System)
স্থায়ী বিনিময় হার বা নির্ধারিত হার পদ্ধতি বলতে এমন এক মুদ্রানীতিগত ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে একটি দেশের জাতীয় মুদ্রাকে অন্য একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মুদ্রার সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট হারে আবদ্ধ (Pegged) করে রাখা হয়। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো মুদ্রার মানে স্থিতিশীলতা আনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পূর্বানুমানযোগ্যতা বজায় রাখা, এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। এধরনের ব্যবস্থায় মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের চাহিদা-জোগানের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয় না, বরং সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত হারে স্থির থাকে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ব্রেটন উডস ব্যবস্থা (Bretton Woods System), যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এই ব্যবস্থায় পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মুদ্রাকে মার্কিন ডলারের সঙ্গে নির্দিষ্ট হারে পেগ বা স্থির করে রাখা হয়েছিল। আবার মার্কিন ডলার ছিল স্বর্ণের সঙ্গে রূপান্তরযোগ্য—প্রতি আউন্স স্বর্ণের মূল্য ছিল ৩৫ মার্কিন ডলার। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির মুদ্রাব্যবস্থায় এক ধরনের স্থিতিশীলতা ও আস্থা তৈরি হয়েছিল।
এই পদ্ধতিতে যেমনঃ ফ্রান্সের ফ্রাঁ (Franc), জার্মানির ডয়েচ মার্ক (Deutsche Mark), এবং ব্রিটিশ পাউন্ড (Pound Sterling) ডলারের নির্দিষ্ট হারে আবদ্ধ ছিল, তেমনি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশও তার মুদ্রার মান ব্রিটিশ পাউন্ডের সঙ্গে পেগ করে রেখেছিল। উদাহরণস্বরূপঃ ১৯৭২ সালে ১ ব্রিটিশ পাউন্ড = ১৮.৯৫ বাংলাদেশি টাকা নির্ধারিত ছিল। এধরনের হার বজায় রাখতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে হতো, যাতে প্রয়োজনমতো হস্তক্ষেপ করে নির্ধারিত হারে বিনিময় বজায় রাখা যায়। আরেকটি আলোচিত উদাহরণ হলো চীনঃ যারা ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তাদের ইউয়ান (Yuan)-কে মার্কিন ডলারের সঙ্গে পেগ করে রেখেছিল (প্রায় ৮.২৮ ইউয়ান = ১ মার্কিন ডলার)। এটি চীনের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতায় সহায়তা করেছিল এবং তাদের শিল্প ও বাণিজ্য বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
তবে এই ব্যবস্থার কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমনঃ যদি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায় বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, তাহলে নির্ধারিত হারে মুদ্রা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতি মুদ্রা সংকটে পড়তে পারে। ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের সময় অনেক দেশের স্থায়ী বিনিময় হার ভেঙে পড়ে, যার ফলে তারা বাধ্য হয় ভাসমান হার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হতে।
নমনীয় বা ভাসমান বিনিময় হার ব্যবস্থা (Floating Exchange Rate System)
নমনীয় বা ভাসমান বিনিময় হার ব্যবস্থা বলতে এমন একটি মুদ্রানীতিগত ব্যবস্থা বোঝায়, যেখানে একটি দেশের মুদ্রার বিনিময় হার প্রতিদিন বাজারের চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। এই ব্যবস্থায় সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ করে না, বরং ছেড়ে দেয় বাজারের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়। ফলে, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা একটি প্রতিযোগিতামূলক ও মুক্ত বাজার ব্যবস্থার সুবিধা পান।
এই পদ্ধতির সূচনা হয় ১৯৭১ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন স্বর্ণ মান (Gold Standard) পরিত্যাগ করেন এবং মার্কিন ডলারকে স্থায়ীভাবে ভাসমান বিনিময় হারে রূপান্তরিত করেন। এই পদক্ষেপের ফলে ব্রেটন উডস ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং অধিকাংশ দেশ ভাসমান হার ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া-সহ অধিকাংশ উন্নত দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে মুদ্রার মানকে বাজারভিত্তিক রেখেই চলাচলের স্বাধীনতা দেয়।
উদাহরণস্বরূপঃ ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় মার্কিন অর্থনীতি বিপর্যস্ত হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় মার্কিন ডলারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়। ফলে ডলারের বিনিময় হার ইউরো, ইয়েন এবং পাউন্ডের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। আবার একই সময়ে জাপানের অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকায় জাপানি ইয়েন (Yen) নিরাপদ মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত হয়ে ওঠে, যার ফলে ইয়েনের মানও বেড়ে যায়।
এই ব্যবস্থার একটি সুবিধা হলো, যখন কোনো দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন মুদ্রার মান কমে যায়, যার ফলে সেই দেশের রপ্তানি পণ্য তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে ওঠে এবং রপ্তানি বাড়ে। এতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে এর একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো অস্থিরতা (Volatility)। রাজনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বাজার গুজবের কারণে হঠাৎ মুদ্রার মান অনেক বেশি ওঠানামা করতে পারে। এতে করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকির মুখে পড়ে এবং পণ্যের দাম অস্থির হতে পারে, যা মুদ্রাস্ফীতির (Inflation) ঝুঁকি তৈরি করে। তাই কিছু দেশ যদিও ভাসমান হার পদ্ধতি অনুসরণ করে, তবুও মাঝে মাঝে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সীমিত হস্তক্ষেপ করে, যা নিয়ন্ত্রিত ভাসমান ব্যবস্থা (Managed Floating Exchange Rate) নামে পরিচিত।
মধ্যবর্তী পদ্ধতি (Intermediate or Hybrid Exchange Rate Regimes)
স্থায়ী এবং নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থার মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে কিছু সংকর/ হাইব্রিড বা মধ্যবর্তী পদ্ধতি, যেগুলোকে মধ্যবর্তী বা হাইব্রিড পদ্ধতি বলা হয়। এই ধরনের পদ্ধতি মূলত স্থিতিশীলতা ও নমনীয়তার মধ্যে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে, যাতে মুদ্রার মান একদিকে যেমন বেশি ওঠানামা না করে, আবার অন্যদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী মান সামঞ্জস্য করা যায়। অনেক উন্নয়নশীল দেশ এই ধরণের পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে।
১. Adjustable Peg – সামঞ্জস্যযোগ্য আবদ্ধ হার পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে একটি দেশের মুদ্রাকে অন্য একটি শক্তিশালী মুদ্রার সঙ্গে নির্দিষ্ট হারে আবদ্ধ (peg) করে রাখা হয়, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনে সেই হার পরিবর্তন (adjust) করা হয়। এটি স্থায়ী পদ্ধতির মতো হলেও এতে নমনীয়তার কিছু সুযোগ রাখা হয়। যেমনঃ বাংলাদেশ ১৯৮৩ সালে Adjustable Peg পদ্ধতি গ্রহণ করে। তখন বাংলাদেশি টাকা একটি নির্দিষ্ট হারে ডলারের সাথে আবদ্ধ ছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের ওঠানামা অনুযায়ী সরকার সেই হারে পরিবর্তন আনতে পারত।
২. Crawling Peg – ধীরে ধীরে পরিবর্তনশীল আবদ্ধ হার
এই পদ্ধতিতে মুদ্রার মান ধাপে ধাপে এবং পূর্বনির্ধারিত হারে নিয়মিতভাবে পরিবর্তিত হয়, যেন হঠাৎ বড় ধরনের ধাক্কা বা শক থেকে অর্থনীতি রক্ষা পায়। এতে মুদ্রার মান ধীরে ধীরে অবচয় বা মূল্যায়ন করা হয়, যেমন প্রতি মাসে ১% হারে। যেমন: ইজরায়েল, মেক্সিকো এবং ইকুয়েডর অতীতে Crawling Peg পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। এটি সাধারণত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে আক্রান্ত দেশগুলোর জন্য সহায়ক, যেখানে মুদ্রার মান ধীরে কমানো হয় রপ্তানি প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে।
৩. Wide-Band System – বিস্তৃত সীমার ভাসমান হার
এই পদ্ধতিতে মুদ্রার মান একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করতে পারে। যেমন, ±২.২৫% বা ±৫%। যদি বাজারে চাহিদা ও জোগানের কারণে মুদ্রার মান নির্ধারিত সীমার বাইরে চলে যায়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে মান নিয়ন্ত্রণ করে। যেমনঃ ইউরোপীয় মুদ্রা ব্যবস্থা (European Monetary System - EMS) এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মুদ্রাকে একটি কেন্দ্রীয় মান (ECU – European Currency Unit)-এর সাথে ±২.২৫% সীমার মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হতো। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা ইউরোর সূচনা ও ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ঐক্যের ভিত্তি তৈরি করে।
৪. Managed Float / Dirty Float – নিয়ন্ত্রিত ভাসমান হার পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে মুদ্রার বিনিময় হার সাধারণভাবে বাজারের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়, কিন্তু সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাঝে মাঝে বাজারে হস্তক্ষেপ করে মুদ্রার মান নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্যবস্থা বাজার স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যে সমন্বয় আনার চেষ্টা করে। যেমনঃ বাংলাদেশ বর্তমানে এই Managed Float পদ্ধতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন বাজারে টাকার মান অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, তখন ডলার বিক্রি করে বা কিনে হস্তক্ষেপ করে টাকার মান নিয়ন্ত্রণ করে। আরেকটি উদাহরণ হল ভারত। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক (RBI) ১৯৯৩ সাল থেকে এই ব্যবস্থা অনুসরণ করছে এবং প্রয়োজনে বাজারে হস্তক্ষেপ করে রুপি স্থিতিশীল রাখে।
এই মধ্যবর্তী ব্যবস্থা গুলো সেইসব দেশের জন্য উপযোগী যারা একদিকে বাজারের স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে চায়, আবার অন্যদিকে হঠাৎ মুদ্রা পতন বা অস্থিরতা ঠেকাতে প্রস্তুত থাকে। এতে করে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে মুদ্রার মান স্থিতিশীল থাকে, যা ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং মূল্যস্ফীতির জন্য সহায়ক।
Target Zone Arrangementঃ
Target Zone Arrangement হলো এমন একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রানীতি ব্যবস্থা যেখানে কয়েকটি দেশ সম্মিলিতভাবে একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হারের লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং তাদের মুদ্রার মান নির্ধারিত সীমার (যেমনঃ ±১০%) মধ্যে রাখতে চেষ্টা করে। এই ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলো যৌথভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করে যাতে মুদ্রার মূল্য অত্যধিক ওঠানামা না করে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। এটি একটি মধ্যবর্তী পদ্ধতি, যেখানে বাজারের প্রাকৃতিক গতিবিধিকে কিছুটা মুক্ত রাখা হয়, কিন্তু সীমিত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মুদ্রার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে এই ধরনের ব্যবস্থার দুটো প্রধান উদাহরণ হলো Plaza Accord (১৯৮৫) এবং Louvre Accord (১৯৮৭)। Plaza Accord-এ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো একত্রে একটি সমঝোতায় আসে। তাদের লক্ষ্য ছিল মার্কিন ডলারের অতিরিক্ত মূল্যায়ন কমিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য পুনঃস্থাপন করা। মার্কিন ডলারের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি কমে গিয়েছিল এবং বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছিল। এই সমঝোতার মাধ্যমে দেশগুলো মার্কিন ডলারের মান কমানোর জন্য বাজারে যৌথ হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে ডলারের বিনিময় হার কিছুটা কমে এবং বাণিজ্যে ভারসাম্য ফিরে আসে।
এরপর ১৯৮৭ সালে Louvre Accord গঠিত হয়, যেখানে একই দেশগুলো মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে স্থিতিশীল রাখতে সম্মত হয়। তারা বাজারে একযোগে হস্তক্ষেপ করে মুদ্রার মান অতিরিক্ত ওঠানামা থেকে বিরত রাখে। এই সমঝোতার ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা বাড়ে এবং দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহযোগিতা দৃঢ় হয়।
এই Target Zone Arrangement-র মাধ্যমে দেশগুলো অর্থনীতিতে অস্থিরতা কমানোর পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য একটি পূর্বানুমানযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়। এটি বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে বড় ধরনের ওঠানামা ও মন্দার ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করে। তাই, এই পদ্ধতিটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই সব পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে, বিনিময় হার ব্যবস্থার পছন্দ সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, বৈদেশিক চাপ, মুদ্রানীতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। অর্থাৎ, একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনীতির গঠন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ এবং সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো এই পছন্দকে প্রভাবিত করে। কোনও একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার পদ্ধতি সব দেশের জন্য সমানভাবে কার্যকর বা উপযোগী নয়। এজন্য অধিকাংশ দেশ সময়ের সঙ্গে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিনিময় হার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে। ফলে, তারা প্রয়োজন অনুসারে স্থায়ী, নমনীয় বা মধ্যবর্তী পদ্ধতির মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিয়ে প্রয়োগ করে যাতে দেশের অর্থনীতি সর্বোচ্চ স্থিতিশীলতা ও বৃদ্ধি পায়।
সার্বিকভাবে, প্রতিটি বিনিময় হার পদ্ধতির কিছু সুবিধা এবং সীমাবদ্ধতা থাকে। স্থায়ী বিনিময় হার ব্যবস্থা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পূর্বাভাসযোগ্যতা নিশ্চিত করলেও, এতে নমনীয়তার অভাব থাকে যা বাজারের দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে, নমনীয় বা ভাসমান বিনিময় হার বাজারের বাস্তবতা প্রতিফলিত করে এবং অর্থনীতিকে প্রতিযোগিতামূলক রাখে, কিন্তু এটি কখনও কখনও অস্থিরতা এবং মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ায়। এজন্য দেশগুলো তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক কাঠামো, বৈদেশিক চাপ, মুদ্রানীতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে উপযুক্ত বিনিময় হার ব্যবস্থা বেছে নেয়।
রিজার্ভের গুরুত্বঃ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো রিজার্ভ সম্পদের প্রকৃতি বা নেচার অফ রিজার্ভ অ্যাসেটস (Nature of Reserve Assets)। এখানে বোঝানো হয়, কোন ধরনের সম্পদ আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে রিজার্ভ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। এটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়: (ক) পণ্যভিত্তিক রিজার্ভ (Commodity Reserves) এবং (খ) ফিডিউশিয়ারি বা কাগুজে রিজার্ভ (Fiduciary বা Fiat Reserves)।
পণ্যভিত্তিক রিজার্ভ ব্যবস্থায় অর্থের পেছনে একটি বাস্তব মূল্যধারী পণ্য থাকে, যেমনঃ স্বর্ণ। ইতিহাসে গ্লোবাল গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড (Gold Standard) ছিল এর প্রধান উদাহরণ, যেখানে প্রত্যেক দেশের মুদ্রার মান নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার সঙ্গে যুক্ত থাকত। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের মুদ্রাকে সোনার সঙ্গে রূপান্তরযোগ্য রাখত, ফলে মুদ্রার একটি অন্তর্নিহিত মূল্য (Intrinsic Value) থাকত।
অন্যদিকে, ফিডিউশিয়ারি বা ফিয়াট রিজার্ভ হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে মুদ্রার পেছনে কোনো বাস্তব পণ্য নেই, বরং এটি সরকারের ঘোষণায় বৈধ অর্থ হিসেবে স্বীকৃত। আজকের দিনে অধিকাংশ প্রধান মুদ্রা যেমন মার্কিন ডলার (USD), ইউরো (EUR), জাপানি ইয়েন (JPY) ফিয়াট মানদণ্ডে পরিচালিত হয়। এছাড়া, Special Drawing Rights (SDRs) – যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) দ্বারা তৈরি একটি কৃত্রিম রিজার্ভ সম্পদ – সেটিও ফিডিউশিয়ারি রিজার্ভের একটি উদাহরণ, যার কোনো বাস্তব মূল্য নেই; এটি শুধু সদস্য দেশগুলোর মাঝে ঋণ ও লেনদেনের সুবিধা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই দুই ধরনের রিজার্ভ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়
১. পূর্ণ পণ্যভিত্তিক মানদণ্ড (Pure Commodity Standard):
এই ব্যবস্থা এমন যেখানে দেশের মুদ্রার মূল্য নির্ভর করে একটি বাস্তব পণ্যের ওপর, সাধারণত সোনা। অর্থাৎ, মুদ্রা সরাসরি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণের বিনিময়ে রূপান্তরযোগ্য থাকে। যেমনঃ ক্লাসিক্যাল গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড (১৮৭০–১৯১৪)। এ সময়ে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও অন্যান্য উন্নত দেশগুলো তাদের মুদ্রার মান সোনার সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল। যেমনঃ যুক্তরাজ্যের পাউন্ড স্টার্লিংকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার সঙ্গে আবদ্ধ করা হয়। ফলে, কেউ যেকোনো সময়ে নির্দিষ্ট মূল্য দিয়ে সোনা অথবা পাউন্ড স্টার্লিং আদান-প্রদান করতে পারত। এই ব্যবস্থার সুবিধা ছিল মুদ্রার মানে স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আস্থা। তবে, সোনার সরবরাহ সীমিত হওয়ায় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সোনার পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ত।
২. পূর্ণ ফিডিউশিয়ারি মানদণ্ড (Pure Fiduciary Standard):
এই ব্যবস্থায় মুদ্রার কোনো বাস্তব পণ্যের পেছনে ভিত্তি থাকে না। মুদ্রার মূল্য শুধু সরকারের ঘোষণার ওপর নির্ভর করে এবং এটি সাধারণত কাগজের অর্থ (ফিয়াট মানদণ্ড)। যেমনঃ Inconvertible Paper Standard (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অধিকাংশ দেশ এই ব্যবস্থায় চলে আসে। যেখানে মুদ্রার কোনো সোনায় রূপান্তরযোগ্যতা থাকে না। যেমনঃ মার্কিন ডলার, ইউরো, ইয়েন, ব্রিটিশ পাউন্ড ইত্যাদি এখন ফিয়াট মুদ্রা, অর্থাৎ এগুলো সরকারের বিশ্বাস এবং আইনসম্মত স্বীকৃতির ওপর ভিত্তি করে মূল্য বহন করে। এই ব্যবস্থায় সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক নীতি পরিচালনা ও আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য নীতি গ্রহণ করে। তবে, এর ফলে অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি বা অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকি থাকে যদি নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হয়।
৩. মিশ্র মানদণ্ড (Mixed Standard):
এই ব্যবস্থা হলো স্বর্ণ ও ফিয়াট দুই ধরনের রিজার্ভের সংমিশ্রণ। কিছু মুদ্রা পণ্যভিত্তিক রিজার্ভে এবং কিছু ফিয়াট অর্থে পরিচালিত হয়। যেমনঃ ব্রেটন উডস ব্যবস্থা (১৯৪৪–১৯৭১)। এই ব্যবস্থায় বিশ্বের প্রধান মুদ্রাগুলো মার্কিন ডলারের সাথে স্থায়ী হারে আবদ্ধ ছিল। অন্যদিকে, মার্কিন ডলারকে সোনায় রূপান্তরযোগ্য রাখা হয়েছিল, ডলারের প্রতি আউন্স সোনার মান নির্ধারিত ছিল ৩৫ ডলার। অর্থাৎ, অন্য দেশগুলো তাদের মুদ্রাকে ডলারের সাথে পেগ করলেও, ডলারকে সোনায় রূপান্তরযোগ্য হিসেবে ধরে রাখা হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পেলেও, মার্কিন ডলারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং সোনার অভাবে ১৯৭১ সালে এই ব্যবস্থা ভেঙে যায়।
সার্বিকভাবে, এই তিন ধরনের মানদণ্ডের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পছন্দ ও প্রয়োগ পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ দেশ ফিয়াট মানদণ্ডে কাজ করলেও, অতীতের পণ্যভিত্তিক ও মিশ্র মানদণ্ডের অভিজ্ঞতা অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কার্যকরী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা
একটি কার্যকরী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা বিভিন্ন দেশের মধ্যে পণ্য ও সেবার লেনদেন কেন্দ্রিক অর্থ চলাচল বা বিনি্ময়কে সহজ ও নির্বিঘ্ন করতে সাহায্য করে। এর মূল কাজ হলো বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাণিজ্য (free trade) কে সমর্থন করা, যাতে দেশগুলো তাদের উৎপাদনে বিশেষীকরণ (specialization) করতে পারে। এর ফলে সামগ্রিক বৈশ্বিক উৎপাদন এবং মানুষের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। তবে, শুধু উৎপাদন বাড়লেই কাজ শেষ নয়, সেই লাভ ও কল্যাণের ন্যায়সঙ্গত ও সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
একটি কার্যকরী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার কাঠামো এমন হওয়া উচিত যা (১) বিশ্বব্যাপী মোট উৎপাদন সর্বাধিক করবে এবং (২) দেশের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কল্যাণের সঠিক ভাগ নিশ্চিত করবে। অর্থাৎ, দেশগুলো যখন একসাথে কাজ করে উৎপাদন বাড়াবে, এবং যখন সবাই তাদের ন্যায্য অংশ পাবে, তখনই এই মুদ্রা ব্যবস্থা সফল হবে। যদি কোনো দেশ বা গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে বেশি সুবিধা নিতে চায় বা কল্যাণ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে বিবাদ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ভেঙে পড়তে পারে। যেমনঃ যদি কোনো দেশ “অপশনাল ট্যারিফ (Optional Tariff)” বা অতিরিক্ত কর আরোপ করে, তাহলে অন্য দেশও একইভাবে জবাব দিতে পারে, যার ফলে সব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমনঃ বর্তমানে ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি।
আদতে, একটি কার্যকরী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যা বিশ্ব বাণিজ্য ও বৈশ্বিক কল্যাণের সুশৃঙ্খল বিকাশ নিশ্চিত করবে, দেশের মধ্যে ও দেশের বাইরে আস্থা ও সহযোগিতা বাড়াবে, এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার কার্যক্ষমতার মানদণ্ড (Performance Tests)
একটি কার্যকরী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর এবং সঠিকভাবে কাজ করছে তা বুঝতে অর্থনীতিবিদরা তিনটি প্রধান পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে। যতাঃ (১) সমন্বয় (Adjustment), (২) তারল্য (Liquidity), এবং (৩) আস্থা (Confidence)।
প্রথমত, সমন্বয় (Adjustment) হলো একটি দেশের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস বা অর্থনৈতিক লেনদেনের ভারসাম্য ঠিক রাখার পদ্ধতি। এতে দেশের জাতীয় আয়, আপেক্ষিক মূল্য বা মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তন করে অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। তবে এই সমন্বয় প্রক্রিয়া প্রায়শই ব্যয়বহুল হয়। যেমনঃ এর ফলে অর্থনৈতিক সংকোচন বা বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে, আবার মূল্যস্ফীতি বাড়ারও আশঙ্কা থাকে। তাই কার্যকরী মুদ্রা ব্যবস্থার লক্ষ্য থাকা উচিত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বয়ের মোট ব্যয় কমানো এবং সেই খরচ ন্যায়সঙ্গতভাবে ভাগ করে নেয়া। বাস্তবে এটি কঠিন, কারণ প্রত্যেক দেশ নিজেদের খরচ নিয়েই চিন্তিত এবং অন্য দেশকে বেশি দায়িত্ব নিতে চায় না। দেশগুলোর ভেতরের বিভিন্ন গোষ্ঠীও সমন্বয় নীতির বিরোধিতা করতে পারে; যেমন শ্রমিক ইউনিয়ন বেকারত্ব বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, আবার আমদানিকারক শিল্প মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে ক্ষতির আশঙ্কায় বাধা দেয়।
দ্বিতীয়ত, তারল্য (Liquidity) বলতে বোঝায় আন্তর্জাতিক মুদ্রার রিজার্ভ বা সংরক্ষিত অর্থের পরিমাণ। এই রিজার্ভে থাকে স্বর্ণ, রূপান্তরযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ আঁকড়ার অধিকার (SDRs), এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) নেট রিজার্ভ। তারল্যের কাজ হলো দেশের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টসের অস্থায়ী ভারসাম্যহীনতা কাটিয়ে ওঠা, যাতে অর্থনীতি সংকুচিত না হয় বা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি না বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এটি দীর্ঘমেয়াদী জটিল অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে, যেখানে সমন্বয় প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত তারল্য থাকলে দেশগুলো সহজে ও কম খরচে অর্থনৈতিক সমন্বয় করতে পারে।
তৃতীয়ত, আস্থা (Confidence) হলো বৈদেশিক বিনিয়োগকারী ও অন্যান্য দেশের কাছে একটি দেশের বা আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার বিশ্বাস ও স্থিতিশীলতার অনুভূতি। যখন কোনো একটি রিজার্ভ সম্পদে আস্থা কমে যায়, তখন দ্রুত অন্য রিজার্ভে অর্থ স্থানান্তর হয়, যাকে বলে “স্থিতিশীলতার সংকট (Crisis of Confidence)”। একটি ভালো মুদ্রা ব্যবস্থা এমন নিয়ম ও প্রক্রিয়া থাকা উচিত যা এই সংকটগুলো রোধ করতে পারে এবং প্রয়োজনে তা মোকাবিলার ব্যবস্থা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০-এর দশকে ব্রেটন উডস সিস্টেমের পতনের অন্যতম কারণ ছিল এই আস্থাহীনতা ও রিজার্ভ সংকট।
সার্বিকভাবে, একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার জন্য দরকার সমন্বয়ের দক্ষতা, পর্যাপ্ত তারল্য, এবং বিনিয়োগকারী ও অংশগ্রহণকারীদের অবিচল আস্থা। এই তিনটি পরীক্ষায় সফলতা সিস্টেমের স্থিতিশীলতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।
উপসংহার
আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা হলো একটি বৈশ্বিক কাঠামো, যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা একে অপরের সাথে লেনদেন করে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ হয় এবং বৈদেশিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে মুদ্রা ব্যবস্থা বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন: গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড, ব্রেটন উডস পদ্ধতি, এবং বর্তমান ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবস্থা। প্রতিটি ব্যবস্থা তার সময়ের নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণ করেছে এবং বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির পরিবর্তনের সাথে অভিযোজিত হয়েছে। মুদ্রা ব্যবস্থার কাঠামো বুঝতে হলে প্রথমে আন্তর্জাতিক রিজার্ভের ধরন বুঝতে হয়ঃ স্বর্ণ (Gold), ফিয়াট মানের মুদ্রা (Fiat Currency), এবং SDR-এর মতো সম্পদ এই রিজার্ভের মূল উপাদান। মুদ্রা ব্যবস্থার কার্যকারিতা পরিমাপের জন্য তিনটি প্রধান পারফরম্যান্স টেস্ট ব্যবহার করা হয়: সমন্বয় (Adjustment), তারল্য (Liquidity), এবং আস্থা (Confidence)।
বিনিময় হার ব্যবস্থার ধরন, যেমনঃ Fixed, Floating বা Managed Float, একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, মুদ্রানীতি এবং বৈদেশিক চাপে নির্ভর করে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, একক কোনো ব্যবস্থা সব দেশের জন্য উপযুক্ত নয়। বরং, দেশগুলো সময় ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তাদের ব্যবস্থা পরিবর্তন করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান। যেমন: কিছু রিজার্ভ মুদ্রার প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা (বিশেষ করে মার্কিন ডলারের প্রতি), রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘাত, আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের অভাব, আর্থিক সংকটে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি ইত্যাদি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বহুমুখী হয়ে উঠছে। ইউরো, রেনমিনবি, ডিজিটাল মুদ্রা (CBDC) ও ক্রিপ্টোকারেন্সির উত্থান আন্তর্জাতিক লেনদেন ও রিজার্ভ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করছে। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তন, জিওপলিটিকাল সংঘাত, এবং প্রযুক্তি পরিবর্তন আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার ভবিষ্যত গঠনে বড় প্রভাব ফেলছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


No comments