International Crimes ও বিচার ব্যবস্থা: ইতিহাস, গুরুত্ব ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ
![]() |
| Karl Brant at Nuremburg Tribunal |
আন্তর্জাতিক অপরাধ (International Crimes) কী?
আন্তর্জাতিক অপরাধ (International Crimes) বলতে এমন সব গুরুতর অপরাধকে বোঝানো হয়, যা মানবতা, আন্তর্জাতিক শান্তি এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়। এসব অপরাধ আন্তর্জাতিক আইন, প্রথা এবং মৌলিক আদর্শগুলোর প্রতি হুমকিস্বরূপ। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এই অপরাধগুলো একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সংঘটিত হয়, তথাপি এগুলোর প্রভাব আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধের মধ্যে রয়েছেঃ গণহত্যা (Genocide), মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (Crimes Against Humanity), যুদ্ধাপরাধ (War Crimes), এবং আগ্রাসনের অপরাধ (Crime of Aggression)। এ সকল অপরাধ মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত রূপ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য চরম উদ্বেগের বিষয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম মৌলিক লক্ষ্য। ফলে, আন্তর্জাতিক অপরাধের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা বিচারব্যবস্থা (Tribunals/ Courts) এই অপরাধে জড়িতদের কেবল শাস্তিই দেয় না, বরং এই বিচারব্যবস্থা ভবিষ্যৎ অপরাধ প্রতিরোধের এক কার্যকর কৌশল হিসেবেও কাজ করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংঘটিত হয় না; বরং ব্যক্তি পর্যায়েও সংঘটিত হতে পারে। এজন্য আন্তর্জাতিক আইনে দায়ী ব্যক্তি বা নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (International Criminal Court – ICC) বা জাতিসংঘের অধীন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের (Special Tribunals) মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনার বিধান রাখা হয়েছে। এই বিচার ব্যবস্থাগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থাকলেও, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সংরক্ষণে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সাধারণত সুপরিকল্পিত, সংগঠিত এবং বৃহৎ পরিসরে এই অপরাধ সংঘটিত হয়। নির্দিষ্ট কোন জাতিগোষ্ঠী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়কে ধ্বংস, নিপীড়ন বা বিতাড়নের মাধ্যমে দমন বা নির্মুল করার উদ্দেশ্যে এই ঘৃণ্য অপরাধগুলো সংঘটিত হয়। এই অপরাধগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, এবং বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি বড় আঘাত; ফলে, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। এমনকি অপরাধ সংঘটনের বহু বছর পরেও অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার বিধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনে ‘রাষ্ট্রীয় আদেশ অনুসরণ’ বা ‘উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ’ অনুসরণ ইত্যাদি যুক্তি অপরাধীকে এসব অপরাধের দায় থেকে রেহাই দেয় না। বরং ব্যক্তির নিজস্ব দায়িত্ববোধ ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে নৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
যদিও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ সম্পর্কিত বিচারব্যবস্থার ভূমিকা অনস্বীকার্য, তথাপি ন্যায়বিচার বাস্তবায়নে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় । যেমন: বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব ইত্যাদি। এসব চ্যালেঞ্জ বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় অবস্থান আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ সম্পর্কিত বিচারব্যবস্থার কার্যকর পদক্ষেপ, কঠোর আইনি ব্যবস্থা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এরূপ অপরাধের প্রবণতা কমিয়ে ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী মানবিক মূল্যবোধের সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নি্রাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব।
International Crimes: প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগ
১. প্রাচীন যুগে আন্তর্জাতিক অপরাধের ধারণা:
আন্তর্জাতিক অপরাধ (International Crimes) আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের একটি মৌলিক ধারণা হলেও, এর মূলভিত্তি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর বিচারব্যবস্থা ও নৈতিক আদর্শে নিহিত। প্রাচীন সমাজে কিছু অপরাধ রাষ্ট্রীয় আইন ও ধর্মীয় নৈতিকতার আলোকে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হতো। এর এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হচ্ছে ব্যাবিলনের বিখ্যাত হাম্মুরাবির বিধি (Code of Hammurabi), যা খ্রিস্টপূর্ব আঠারো শতকে প্রণীত হয়। এই বিধিতে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা, নিপীড়ন বা অনৈতিক আচরণের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছিল, যা আধুনিক ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ (Crimes against Humanity) এবং ‘যুদ্ধাপরাধ’ (War Crimes) এর প্রাথমিক ধারণার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। যদিও তৎকালীন শাস্তির প্রক্রিয়া ছিল শাসকের একক ক্ষমতাধীন, তথাপি এই বিধির ভিত্তিতে ব্যবী্লনে ন্যায় ও অন্যায়ের এক মৌলিক পার্থক্য ও বিচারিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল, যা আধুনিক আন্তর্জাতিক অপরাধ সম্পর্কিত বিচারব্যবস্থার সূচনা বিন্দু হিসেবে কাজ করে।
প্রাচীন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রে, বিশেষ করে মনুসংহিতা ও মহাভারত-এ ‘ধর্মযুদ্ধ’ (Dharma Yuddha) বা নৈতিক যুদ্ধের নিয়মাবলি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত ছিল। এই নীতিমালায় নিরস্ত্র ব্যক্তি, অসহায় জনগণ, নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদের উপর আক্রমণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। যুদ্ধের সময় শত্রুর প্রতি মানবিক আচরণ এবং ন্যায্যতা রক্ষার এই বিধানসমূহ আজকের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের মূল নীতিগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। অন্যদিকে, রোমান সাম্রাজ্যে প্রচলিত ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ খেলা এবং দাসপ্রথা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত। জনসমক্ষে গ্ল্যাডিয়েটরদেরকে হত্যা করা এবং দাসদের প্রতি নির্মম আচরণ তৎকালীন সমাজে বিনোদনের এক অংশ হিসেবে বৈধতা পেয়েছিল। যদিও এসব কর্মকাণ্ড আজকের দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক অপরাধের আওতাভুক্ত, তবে তখন সেগুলো ছিল সামাজিকভাবে গৃহীত ও স্বীকৃ্ত এক প্রথা।
ইসলামী শরিয়াতে যুদ্ধ, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার সংক্রান্ত বেশ কিছু সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, যা আধুনিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অনেক নীতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ইসলামী শরিয়াতে যুদ্ধের সময় নিরীহ নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসহায় ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের ক্ষতি করার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধের আগে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিতেন, “তোমরা প্রতারণা করো না, বিশ্বাসঘাতকতা করো না, শিশুদের হত্যা করো না, নারীদের হত্যা করো না, গাছপালা ও ফসল ধ্বংস করো না” (সহীহ হাদীস)। এসব নির্দেশনা যুদ্ধকালীন মানবিক আচরণ ও মানবাধিকারের প্রতি ইসলামের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। ইসলামী আইন অনুযায়ী, যুদ্ধ শুধু আত্মরক্ষা বা নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় অনুমোদিত, আর তা-ও নির্দিষ্ট নৈতিক সীমার মধ্যে পরিচালিত হতে হবে। এই নীতিগুলো ‘আন্তর্জাতিক মানবিক আইন’ বা International Humanitarian Law–এর অনেক ভিত্তির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সুতরাং, ইসলামী দর্শনে যুদ্ধের ন্যায়সংগততা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের ধারণা আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই প্রাচীনকালীন আইন ও নৈতিক বিধানগুলো যদিও আধুনিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো ছিল না, তবুও মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের ধারণার উপর ভিত্তি করে অপরাধবোধ ও শাস্তির এক প্রাথমিক দর্শন উপস্থাপন করে। এসব বিধান ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক মূল্যবোধ এবং স্থানীয় শাসকদের নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ফলে, বিচার ও শাস্তির কার্যক্রম ছিল অনেকাংশেই রাজনৈতিক প্রভাব এবং শাসকের ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তবুও, এ সকল প্রাচীন নিয়মাবলি মানবতার সুরক্ষা, নৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। পরবর্তীতে, এই নৈতিক ও আইনি ধারাগুলো আধুনিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন গঠনের ঐতিহাসিক ও দর্শনগত ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
২. মধ্যযুগ: ধর্মযুদ্ধ ও দাসবাণিজ্য
মধ্যযুগে আন্তর্জাতিক অপরাধের ধারণা আধুনিক আইনি কাঠামোর মতো সুসংহতভাবে গঠিত না হলেও, এই সময়ে ধর্মীয় সংঘাত, উপনিবেশবাদী আগ্রাসন এবং সাম্রাজ্যবাদের নামে ব্যাপক মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। বিশেষত, একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে সংঘটিত ক্রুসেডগুলো তার অন্যতম উদাহরণ, যেখানে ইউরোপীয় খ্রিস্টান শাসকরা ‘পবিত্র ভূমি জেরুজালেম’ পুনর্দখলের নামে ইসলামি ভূখণ্ডে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে হাজার হাজার নিরীহ মুসলিম, ইহুদি এবং এমনকি খ্রিস্টান ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করে। তৎকালীন সমাজে এসব যুদ্ধকে ধর্মীয় কর্তব্য ও পবিত্র অভিযান হিসেবে বৈধতা দেওয়া হলেও, আধুনিক আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার চিন্তাধারা অনুযায়ী এসব কার্যকলাপ যুদ্ধাপরাধ (War Crimes), মানবতাবিরোধী অপরাধ (Crimes against Humanity), এমনকি গণহত্যার (Genocide) পর্যায়ে পড়ে। এছাড়াও মধ্যযুগে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ এবং উপনিবেশ স্থাপনের নামে সংঘটিত দাস ব্যবসা, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, স্থানীয় জনগণের নিপীড়ন ও নিধনের ঘটনাগুলোও মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যদিও সেসময় এসব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো আন্তর্জাতিক বিচারিক ব্যবস্থা ছিল না, তবে এদের ঐতিহাসিক মূল্যায়ন আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত আধুনিক আইনের নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
আধুনিক আন্তর্জাতিক অপরাধের ধারণা সুসংহত হওয়ার বহু আগেই, পঞ্চদশ থেকে আঠারো শতাব্দীর ঔপনিবেশিক যুগকে মানবতাবিরোধী অপরাধের এক কালো অধ্যায় হিসেবে বি্বেচনা করা হয়। এই সময় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো, বিশেষত ব্রিটেন, স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স প্রমুখ আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করে। ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো স্থানীয় জনগণের উপর ব্যাপক নিপীড়ন, দাসত্ব, গণহত্যা এবং সাংস্কৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। উদাহরণ হিসেবে এখানে আমরা স্প্যানিশ দখলদার বাহি্নী্র (Spanish Conquistadors) লাতিন আমেরিকা আক্রমন ও আগ্রাসনের কথা বলতে পারি। এই আক্রমনের ফলে মেসো-আমেরিকা সভ্যতা (মায়া, ইনকা ও আজটেক সভ্যতা) নামে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস হয়। এই আগ্রাসন শুধু ভূমি দখলেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং স্থানীয় অধিবাসীদের গণহত্যা ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরের মাধ্যমে একটি জীবন্ত সভ্যতাকে ধ্বংস করে।
এছাড়াও, ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চলা ট্রান্স-আ্যাটলান্টিক দাসবাণিজ্য (Trans-Atlantic Slave Trade) ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য অপরাধ। অনুমান করা হয়, প্রায় এক কোটি আফ্রিকান মানুষকে জোরপূর্বক অপহরণ করে আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়, যেখানে তাদের অনেকেই ভয়াবহ সমুদ্রযাত্রার ক্লেশে মৃত্যুবরণ করেন। এই প্রক্রিয়ায় শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো জাতিগোষ্ঠী, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছে। যদিও সমসাময়িক কালে এই সমস্ত কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নীতির মাধ্যমে বৈ্ধতা পেতো, তবে আধুনিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের আলোকে নিঃসন্দেহে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে। ফলে, ঔপনিবেশিক যুগকে আন্তর্জাতিক অপরাধ চিন্তার বিকাশের একটি নির্ধারক প্রাক-ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৩. ঔপনিবেশিক যুগে আন্তর্জাতিক অপরাধের উত্থান (১৮শ – ১৯শ শতক):
১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ সালে, ‘কঙ্গো ফ্রি স্টেট’ অঞ্চলে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত শাসনামলকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ইতিহাসের এক নৃশংসতম অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়ে কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে গম ও কফি সংগ্রহের স্বার্থে বেলজিয়ান শাসকরা নির্বিচারে স্থানীয় কঙ্গোবাসীদের উপর হত্যাযজ্ঞ, ব্যাপক ধর্ষণ, নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। শাসকদের নৃশংস আচারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায় এবং অসংখ্য পরিবার ধ্বংস হয়। এই নৃশংসতা ছিল সুচিন্তিত ও সংগঠিত, যার মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকেই সঙ্কটে ফেলা হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা এই ঘটনাকে আধুনিক গণহত্যার (Genocide) প্রাথমিক এবং জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেন, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ সম্পর্কিত বিচারের প্রয়োজনীয়তাকে ত্বরান্বিত করে।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এশিয়া ও আফ্রিকায় শাসনের নামে ব্যাপক দমননীতি ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। এর মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয় হলো ব্রিটিশ শাসনের সময় ভারতের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (Jallianwala Bagh Massacre, ১৯১৯), যেখানে শান্তিপূর্ণ ও নিরীহ প্রতিবাদকারীদের ওপর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক অত্যাচারের প্রকৃত চেহারা আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ পায় এবং এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। অন্যদিকে, ১৯৫০-এর দশকে কেনিয়ার কিকুয়ু বিদ্রোহ দমন (Kikuyu Rebellion repression) সময় হাজার হাজার আফ্রিকানকে বন্দী শিবিরে আটক রেখে কঠোর নির্যাতন, মৃত্যুদণ্ড ও মানবিক অধিকার হরণ করা হয়।
এইসব গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ভয়াবহ প্রভাবের কারণে আধুনিক যুগে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিশ্বব্যাপী স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলো বিশ্বসম্প্রদায়কে মানবাধিকারের রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট করে তোলে। এর ফলে ১৯৪৮ সালে ‘Genocide Convention’ এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) এর মত প্রতিষ্ঠানের সূচনা ঘটে। আজকের বিশ্বে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এসব আন্তর্জাতিক কাঠামো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
৪. বিংশ শতকের দুই বিশ্বযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক অপরাধের আইনি স্বীকৃতি:
বিশ্ব ইতিহাসে বিংশ শতককে সংঘর্ষ, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক মর্মান্তিক অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪–১৯১৮) ধ্বংসযজ্ঞ ও সহিংসতার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলায় মনোযোগী হয়, যদিও তা ছিল প্রাথমিক ও অপ্রতুল। ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তি (Versailles Treaty) সম্পাদিত হয়, যার মাধ্যমে জার্মানিকে যুদ্ধের দায়ে (war guilt) অভিযুক্ত করা হয় এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির জন্য তখনো কোনো স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হয়নি। এ কারণে যুদ্ধকালীন গণহত্যা, নিরীহ জনগণের ওপর সহিংসতা, রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি অপরাধের জন্য কেউ কার্যকরভাবে দণ্ডিত হয়নি। ফলে, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য একটি শক্তিশালী বিচার কাঠামোর অভাব থেকেই যায়, যা পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আরও ভয়াবহ অপরাধগুলোর পথ সুগম করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯–১৯৪৫) আন্তর্জাতিক অপরাধ ও মানবতাবিরোধী নৃশংসতার ইতিহাসে এক চরম দৃষ্টান্ত। এই সময়ে সংঘটিত অপরাধগুলো আধুনিক আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক বিচারব্যবস্থা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে জঘন্য ঘটনা ছিল ‘হোলোকাস্ট’ (Holocaust), যা ইতিহাসের বৃহত্তম ও পরিকল্পিত গণহত্যা (Genocide) হিসেবে স্বীকৃত। অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিরা প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি, এবং এর পাশাপাশি রোমা জনগোষ্ঠী, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, সমকামী, রাজনৈতিক বিরোধী সহ আরও লক্ষাধিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, যেমন: Auschwitz, Treblinka, Sobibor প্রভৃতি। হোলোকাস্ট মানবজাতির নৈতিক বিবেককে চরমভাবে নাড়া দেয় এবং গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তির প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালোভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট অনুভূত হয়।
অন্যদিকে, এশিয়া মহাদেশেও সংঘটিত হয় ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ। ১৯৩৭ সালে চীনের নাঞ্জিং শহরে জাপানি সামরিক বাহিনী যে ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ চালায়, তা ‘নাঞ্জিং গণহত্যা’ (Nanjing Massacre) নামে পরিচিত। মাত্র ছয় সপ্তাহে আনুমানিক তিন লক্ষ নিরীহ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয় এবং ২০,০০০ এর বেশি নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। এই বর্বরতা যুদ্ধবিধি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত এবং এটি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক নিন্দা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এইসব ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ, ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের মতো বিচার কাঠামো গঠনের অন্যতম প্রধান প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করে।
১৯৪৫ সালে শুরু হয় ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল (Nuremberg Trials), যা ছিল ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রায়ালে প্রথমবারের মতো ‘Crimes against Humanity’ (মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ), ‘War Crimes’ (যুদ্ধাপরাধ) এবং ‘Genocide’ (গণহত্যা) — এই আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর আইনগত সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় এবং তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। নাৎসি নেতৃত্বের ২৪ জন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে বিচার পরিচালিত হয়, যেখানে ইচ্ছাকৃত গণহত্যা, দাসশ্রম, নির্যাতন, এবং পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞের প্রমাণ উপস্থাপিত হয়। এই বিচার প্রক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয় যে, রাষ্ট্রীয় আদেশ পালনকারী ব্যক্তিও আন্তর্জাতিক অপরাধের দায় এড়াতে পারে না। “আমি কেবল আদেশ মেনে চলেছি” এই যুক্তি আর বৈধতা থাকে না। ফলে ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের এক মাইলফলক হিসেবে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে, ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত জাপানে অনুষ্ঠিত হয় টোকিও ট্রাইব্যুনাল (Tokyo Tribunal), যাকে "International Military Tribunal for the Far East (IMTFE)"-ও বলা হয়। এখানে জাপানি সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন অপরাধ, গণহত্যা, বেসামরিক মানুষের ওপর দমননীতি এবং যৌন সহিংসতার মতো অপরাধের বিচার করা হয়। ‘নাঞ্জিং গণহত্যা’, ‘কমফোর্ট উইমেন’ ইস্যু সহ একাধিক দৃষ্টান্তমূলক মামলার মাধ্যমে টোকিও ট্রাইব্যুনালও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রথমত, গণহত্যা প্রতিরোধ ও দমন সনদ (Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide) প্রণয়ন করা হয়, যা গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই সনদের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহের ওপর দায়িত্ব আরোপ করা হয় যেন তারা ভবিষ্যতে গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তি নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সনদটি গণহত্যার একটি আইনি সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়, যা পরবর্তী আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর ভিত্তি তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, একই বছরে গৃহীত হয় সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (Universal Declaration of Human Rights), যা মানবাধিকারের রক্ষায় একটি সর্বজনীন মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ঘোষণাপত্র পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য সমান অধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দাবি করে এবং জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে তা রক্ষার বিষয়ে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ করে। ফলে ১৯৪৮ সাল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী বছর হিসেবে বিবেচিত হয়।
৫. জাতিসংঘ এবং আধুনিক আন্তর্জাতিক আইন (১৯৯০-বর্তমান):
১৯৯০, আন্তর্জাতিক অপরাধ অধ্যয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক দশক। ১৯৯০-এর দশকে, ইউরোপ ও আফ্রিকায় দুটি নৃশংসতম গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১৯৯৫ সালে বসনিয়ার স্রেব্রেনিকা (Srebrenica) শহরে বসনিয়ান সার্ব বাহিনী পরিকল্পিতভাবে প্রায় ৮ হাজার মুসলিম পুরুষ ও কিশোরকে হত্যা করে। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে নৃশংসতম গণহত্যা। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সাবেক যুগোস্লাভিয়া সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICTY) গঠন করে, যা প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিশ্চিত করে। একই দশকে, ১৯৯৪ সালে, আফ্রিকার রুয়ান্ডায় ঘটে যায় মানব ইতিহাসের এক ভয়াবহ হত্যাকান্ড। রুয়ান্ডায় মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে প্রায় ৮ লাখ টুটসি ও মধ্যপন্থী হুতু জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা হয়। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম দ্রুততম ও পরিকল্পিত গণহত্যা। এই অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে জাতিসংঘ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা (ICTR)। ICTR গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে একাধিক উচ্চপর্যায়ের অপরাধীর বিচার করে ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
যদিও যুগোস্লাভি্যা বা বসনিয়া ট্রাইবুন্যাল ও রুয়ান্ডা ট্রাইবুন্যাল আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তবে এগুলো ছিল নির্দিষ্ট অঞ্চল ও সময়সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে বিশ্বব্যাপী সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে একটি স্থায়ী ও সার্বজনীন আদালতের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এই প্রেক্ষাপটে, ২০০২ সালে রোম সনদ (Rome Statute) অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (International Criminal Court – ICC)। এটি বিশ্বের প্রথম স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত, যা মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও আগ্রাসনের অপরাধ বিচার করে। ICC-এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ব্যক্তিবিশেষকে জবাবদিহির মুখোমুখি করা এবং গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা। আদালতটি রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সচেষ্টভাবে কাজ করে, এবং বিশ্বব্যাপী একটি শক্ত বার্তা দেয় যে, মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ কখনোই ক্ষমা করা হবে না।
যদিও বিশ্বের শতাধিক দেশ ICC-এর সদস্য, কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিধর রাষ্ট্র, যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন, এখনো এই আদালতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়নি, যা আদালতের বৈশ্বিক কার্যকারিতায় কিছু সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। তবুও, ICC আধুনিক আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বিশ্বশান্তি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
৬. সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত:
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিক এমন কিছু আন্তর্জাতিক অপরাধের কথা এখানে উল্লেখ করা হল। যথাঃ
২০০৩ সালে সুদানের দারফুর অঞ্চলে সংঘটিত সহিংসতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ইতিহাসে এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সেখানে Janajaweed মিলিশিয়া ও সরকারের মদদপুষ্ট বাহিনীগুলো ক্ষমতা সংরক্ষণ ও জাতিগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, জাতিগত নিধন চালায়। এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত ও নিঃস্ব হয় এবং প্রায় ২৫ লাখ সুদানবাসী বাস্তুচ্যুত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ২০০৯ ও ২০১০ সালে সুদানে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সুদানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এটি ছিল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো চলমান রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে ICC-এর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, যা আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার প্রতিষ্ঠায় এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারে রাষ্ট্রপ্রধানের মত উচ্চপদস্থ ব্যক্তিও দায়মুক্ত নন এবং মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য যেকোনো পর্যায়ের ব্যক্তি জবাবদিহির আওতাধীন।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী মানবাধিকার সংকট হল রোহিঙ্গা সঙ্কট। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা, জাতিগত নির্মুল প্রক্রি্যা ও চলমান দমন–পীড়ন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বাস্তবায়নের এক বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী (Tatmadaw) রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অভিযান চালায়, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে একটি পরিকল্পিত জাতিগত নিধন বা Ethnic Cleansing হিসেবে বিবেচিত। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন- বান কি মুন কমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে এই অভিযানে "genocidal intent", অর্থাৎ গণহত্যার উদ্দেশ্য বিদ্যমান ছিল। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া, গণধর্ষণ, শিশু হত্যাসহ অন্যান্য ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়, যার ফলে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, যে সংখ্যা পরবর্তীতে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গাম্বিয়া সরকার ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ)–এ (Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide)-এর অধীনে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলাটি এখনও বিচারাধীন এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যেখানে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছোট রাষ্ট্র (গাম্বিয়া) একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের (মিয়ানমার) বিরুদ্ধে মানবাধিকারের পক্ষে আইনি লড়াই চালাচ্ছে। এই পদক্ষেপ শুধু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচারের পথ উন্মুক্ত করেনি, বরং আন্তর্জাতিক আইনের কার্যকর প্রয়োগ এবং দায়মুক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গড়ে তুলেছে।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বেসামরিক বসতি, হাসপাতাল, স্কুলসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে নিয়মিত আক্রমণ চালানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি হাজার হাজার শিশু ও সাধারণ মানুষ অপহরণ, নির্যাতন এবং সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, যা যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একটি শক্তিশালী বার্তা হিসেবে বিবেচিত।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে গাজা উপত্যকায় দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উপর এক নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিরোধী পরিস্থিতিতেও হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে, বসতি ধ্বংস করা হচ্ছে এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো "genocide" বা গণহত্যার সাথে তুলনা করেছে। ফলে, ২০২৪ সালের মে মাসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ (war crimes) এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের (crimes against humanity) অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেমআন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)। আদালতের মতে, ইসরায়েল গাজায় খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে—যাকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী “starvation as a method of warfare” হিসেবে গণ্য করা হয়। আদালতে উপস্থাপিত প্রমাণে নির্যাতন, নির্বিচারে হত্যা, নিপীড়ন, যৌন সহিংসতা ও পরিকল্পিতভাবে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে ধরা হয়। যদিও ইসরায়েল ICC-এর সদস্য নয়, তবে আদালতের সদস্যভুক্ত যে কোনো দেশে অভিযুক্ত নেতাদের গ্রেপ্তার ও হস্তান্তর বাধ্যতামূলক।
এই সমস্ত ঘটনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ও বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, রাজনৈতিক চাপ এবং বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা প্রায়শই আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। তবুও, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একজোট হয়ে কার্যকর বিচার ও প্রতিরোধ নিশ্চিত করার দাবী জানান। সাম্প্রতিক এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের প্রয়োগকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি মানবাধিকার রক্ষা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইনি ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরিতে সচেষ্ট ভূমিকা রাখছে। এই প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ সম্পর্কিত বিচার ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটছে, যা ভবিষ্যতে আরও কার্যকর ও ব্যাপক মানবাধিকার সুরক্ষায় পথকে প্রশস্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


No comments