Diplomats: কূটনৈতিক ভূমিকা, বিবর্তন ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
Diplomats: কূটনৈতিক ভূমিকা, বিবর্তন ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
![]() |
| ইংরেজ রাজদূতকে নিজের সম্পদের সংগ্রহ দেখাচ্ছেন আইভান দ্য টেরিবল |
১। ভূমিকাঃ
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল ও বহুমাত্রিক পরিসরে কূটনীতি (Diplomacy) এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এটি কেবল রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক পরিচালনার একটি পদ্ধতি নয়, বরং রাষ্ট্রের সার্বভৌম স্বার্থ সংরক্ষণ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি, এবং বাণিজ্য, নিরাপত্তা, সংস্কৃতি ও পরিবেশসহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান মাধ্যম। কূটনীতির কার্যকর বাস্তবায়নের মূল চালিকাশক্তি হলেন কূটনীতিকগণ (Diplomats), যারা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিমালা ও জাতীয় আদর্শ প্রতিনিধিত্ব করে বৈশ্বিক পরিসরে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যে আইনি সুরক্ষা ও বিশেষাধিকার তারা ভোগ করেন, তাকে বলা হয় “Diplomatic Immunity”, যা আন্তর্জাতিক আইন (ভিয়েনা কনভেশন) দ্বারা সংরক্ষিত।
কূটনীতির ইতিহাস বহু প্রাচীন, যার শিকড় প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের মৌর্য যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। কালক্রমে এটি বিবর্তিত হয়েছে এবং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে কূটনৈতিক চর্চাও নিয়মতান্ত্রিক ও আইনি কাঠামোর আওতায় এসেছে, বিশেষ করে ১৯৬১ সালের ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনস’ কূটনীতিকদের অধিকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে। কূটনীতিকদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়, যেমনঃ রাষ্ট্রদূত (Ambassador), হাইকমিশনার (High Commissioner), মিশন প্রধান (Head of Mission), কনসাল (Consul) প্রভৃতি, এবং তাদের শ্রেণী অনুসারে দায়িত্ব ও কৌশলগত গুরুত্ব একেক ক্ষেত্রে একেক রকম হয়।
এই প্রবন্ধে আমরা কূটনীতিকদের ভূমিকা, তাদের শ্রেণিবিন্যাস, ইতিহাসে কূটনৈতিক অনুশীলনের চরিত্র, আন্তর্জাতিক আইনে তাদের আইনি সুরক্ষা তথা “Diplomatic Immunity”-র কাঠামো, এবং আধুনিক সময়ে কূটনীতির সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করবো।
২। কূটনীতিক (Diplomat) কারা?
কূটনীতিক (Diplomat) হলেন একজন রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি, যিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ, বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়ন, এবং দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে নিয়োজিত থাকেন। তারা সাধারণত কোনো বিদেশি রাষ্ট্রে নিযুক্ত হন, যেমনঃ রাষ্ট্রদূত (Ambassador), দূতাবাসের কর্মকর্তা বা কনসাল হিসেবে, এবং সেখানকার সরকারের সঙ্গে নিজ দেশের পক্ষে যোগাযোগ রক্ষা এবং সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যিনি যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত আছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা, বাংলাদেশি নাগরিকদের সহায়তা প্রদান, এবং দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি এই সকল দায়িত্ব পালন করেন কূটনীতিক হিসেবে।
কূটনীতিকগণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম মূল চালিকাশক্তি। তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং নিরাপত্তা বিষয়ক নানা তথ্য সংগ্রহ করে নিজ রাষ্ট্রকে অবহিত করেন এবং নিজ রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো “Diplomatic Immunity” বা কূটনৈতিক রক্ষাকবচ। আন্তর্জাতিক আইন (বিশেষত ১৯৬১ সালের Vienna Convention on Diplomatic Relations) অনুযায়ী কূটনীতিকদের নির্দিষ্টক্ষেত্রে সুরক্ষা প্রদান করে, যেন তারা স্বাধীনভাবে ও নিরাপদে দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
৩। কূটনীতিকদের ভূমিকা (Roles of Diplomats)
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রসমূহের সম্পর্ক গঠনে কূটনীতিকরা গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন করেন। তারা কেবল আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি নন, বরং পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নকারী, পারস্পরিক সম্পর্কের রক্ষক এবং আন্তর্জাতিক সংঘাতের সমাধানকারী হিসেবে কাজ করেন। নিচে কূটনীতিকদের কতিপয় প্রধান ভূমিকা তুলে ধরা হলোঃ
ক) রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বঃ কূটনীতিকরা বিদেশে অবস্থিত দূতাবাস (Embassy) বা কনস্যুলেট (Consulate)-এর মাধ্যমে নিজ দেশের সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করেন। রাষ্ট্রপ্রধান বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তারা স্বাগতিক দেশের সরকার ও জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখেন। অনেক সময় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপ্রধানের বিশেষ দূত হিসেবেও তারা অংশগ্রহণ করেন। এভাবে কূটনীতিকরা নিজ দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিচয় বহির্বিশ্বে তুলে ধরেন।
খ) দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নঃ কূটনীতিকরা দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সম্পর্ক উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। তারা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে চুক্তি, সহযোগিতা, বিনিয়োগ বা বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। উদাহরণস্বরূপ, একটি দেশের রাষ্ট্রদূত জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা OIC-এর মতো বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মে নিজ দেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন ও কৌশলগত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
গ) তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণঃ কূটনীতিকদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো স্বাগতিক দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। তারা এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে নিজেদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান, যাতে নীতি নির্ধারকেরা বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কখনো কখনো এই তথ্য গোয়েন্দা তথ্যের বিকল্প হিসেবেও বিবেচিত হয়।
ঘ) সমস্যা সমাধান ও আলোচনাঃ আন্তর্জাতিক বিরোধ, যুদ্ধের ঝুঁকি বা বাণিজ্যিক বিরোধের ক্ষেত্রে কূটনীতিকরা শান্তিপূর্ণ সমাধানে মধ্যস্থতা ও আলোচনায় নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি, বন্দিমুক্তি আলোচনা কিংবা পানির উৎস ভাগাভাগি ইত্যাদি ইস্যুতে কূটনৈতিক আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম। তারা সংকটকালে উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকেন। যেমনঃ বর্তমানে আমেরিকার শুল্ক ইস্যু নিয়ে যে সঙ্কট তৈরি হয়, সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার বিশেষ একটি দলকে আমেরিকায় পাঠায় শুল্ক সংকট সমাধানের আশায়। এই দলটি কূটনীতিকের ভূমিকা পালন করে, যার ফলে ৩৫ শতাংশ থেকে সোজা ২০ শতাংশে রেসিপ্রোকাল শুল্ক হার নেমে আসে।
ঙ) নাগরিক সুরক্ষা ও কনস্যুলার সেবাঃ বিদেশে অবস্থানরত নিজ দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা কূটনীতিকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তারা নাগরিকদের জরুরি সহায়তা, আইনি পরামর্শ, পাসপোর্ট/ভিসা ইস্যু, জন্ম/মৃত্যু নিবন্ধন, এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রয়োজন হলে সেই সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। কোনো দুর্যোগ বা যুদ্ধাবস্থায় নাগরিকদের উদ্ধার করাও কূটনীতিকদের আওতাভুক্ত কাজ।
চ) সফট পাওয়ার বিকাশঃ কূটনীতিকরা নিজ দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা ও সাহিত্য বিদেশে তুলে ধরার মাধ্যমে ‘সফট পাওয়ার’ প্রয়োগ করেন। তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র (যেমন: গোয়েথ ইনস্টিটিউট, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ), এবং শিক্ষাবিনিময় কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেন। যেমনঃ জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর হয়েছে যা গণতান্ত্রিক ও আদর্শবাদী দর্শনের সাথে সম্পর্কিত, তাকে বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ে উপস্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সফট পাওয়ার উন্নয়নের চেষ্টা করছ।
ছ) অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিঃ বিনিয়োগ, বাণিজ্য চুক্তি, রপ্তানি বৃদ্ধি, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রে কূটনীতিকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তারা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, ব্যবসায়িক পরিবেশ তুলে ধরা এবং বাণিজ্য মেলাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। যেমনঃ বাংলাদেশি কূটনীতিকদের “Branding Bangladesh” উদ্যোগ ও “ডিজিটাল বাংলাদেশ”-এর সম্ভাবনা তুলে ধরা।
জ) জলবায়ু রক্ষায় ভূমিকাঃ আধুনিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিষয়ক আলোচনায় কূটনীতিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তারা COP সম্মেলন, প্যারিস চুক্তি, বা জলবায়ু অর্থায়ন সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেন এবং দেশের স্বার্থ তুলে ধরেন। যেমনঃ বাংলাদেশ জলবায়ু হুমকির সম্মুখীন দেশ হিসেবে Climate Vulnerable Forum (CVF)-এ কূটনৈতিক ভূমিকা এখানে উল্লেখযোগ্য।
ঝ) ডিজিটাল দুনিয়ায় সমন্বয়ঃ আধুনিক যুগে তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে কূটনীতিকরা টুইটার, লিঙ্কডইন, ফেসবুকের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নীতিকে তুলে ধরেন, যা ‘Public Diplomacy’-র অংশ। একইসাথে, সাইবার হুমকি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠাতেও তাদের ভূমিকা রয়েছে। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্রের State Department-এর “#DiplomacyAtWork” ক্যাম্পেইন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাইবার নিরাপত্তা উদ্যোগে কূটনৈতিক ভূমিকা।
ঞ) মানবাধিকার ও মানবিক বিশ্ব নির্মাণঃ বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, শরণার্থী সঙ্কট বা গণহত্যার প্রেক্ষাপটে কূটনীতিকরা মানবিক সহায়তা, নিন্দা প্রস্তাব বা আন্তর্জাতিক ত্রাণ সমন্বয়ে ভূমিকা পালন করেন। যেমনঃ রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের কূটনীতিকরা আন্তর্জাতিক মহলে শরণার্থীদের জন্য সহানুভূতিশীল মনোভাব ও সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছেন।
৪। ইতিহাসে কূটনীতিকদের ভূমিকাঃ
প্রাচীনযুগঃ
কূটনৈতিক কার্যক্রমের সূচনা মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই হয়েছে, যখন রাষ্ট্রব্যবস্থা সুগঠিত না হলেও শাসকগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। কূটনীতির প্রাচীনতম নিদর্শনটি পাওয়া যায় প্রাচীন মিশরে। আমার্না পত্রমালা (Amarna Letters) নামে পরিচিত খ্রিষ্টপূর্ব ১৪শ শতাব্দীর কিছু মাটির ফলকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, মিশর, ব্যাবিলন, অ্যাসিরিয়া ও হিট্টাইট সাম্রাজ্যের মধ্যে কূটনৈতিক বার্তা, উপঢৌকন এবং রাজকীয় বিবাহ নিয়ে চিঠিপত্র আদান-প্রদান হতো। এসব চিঠিতে শাসকেরা পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সামরিক সহায়তা এবং অর্থনৈতিক বিনিময়ের চুক্তি করতেন। এক্ষেত্রে দূতেরা শুধু বার্তাবাহক নয়, বরং শান্তি প্রতিষ্ঠার দূত হিসেবেও কাজ করতেন। ব্যাবিলন ও অ্যাসিরিয়া, এই দুই সাম্রাজ্যও কূটনৈতিক প্রথার বিকাশে ভূমিকা রাখে। এই দুই সভ্যতায় দূত প্রেরণের পাশাপাশি, চুক্তি রক্ষার জন্য দেবতার নামে শপথ করার সংস্কৃতিও ছিল। কূটনীতিকদেরকে কখনো কখনো "বিশ্বাসযোগ্য দূত" বা "রাজা ও দেবতার প্রতিনিধি" হিসেবে বিবেচনা করা হত।
ভারতের প্রাচীন রাজনৈতিক দর্শনেও কূটনীতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এ কূটনীতির একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো পাওয়া যায়। তিনি “দূত” (ambassador), “সান্ধি-বিগ্ৰহ” (treaty & warfare), “মিত্র” (ally) ও “চক্র” (mandala theory) ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কীভাবে পরিচালিত হবে, তার ব্যাখ্যা দেন। কৌটিল্যের মতে, “এক রাষ্ট্রের প্রতিবেশী তার স্বাভাবিক শত্রু এবং শত্রুর প্রতিবেশী তার স্বাভাবিক মিত্র।” এই ধারণা আধুনিক রাজনীতির রিয়ালিজম তত্ত্বের সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। তাঁর গুপ্তচর ও দূত প্রেরণের কৌশলগুলো পরবর্তী মৌর্য সাম্রাজ্যেও ব্যবহৃত হয়েছে।
চীনেও প্রাচীন কূটনৈতিক ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। কনফুসিয়াস ও সান জু’র রাজনৈতিক চিন্তাধারায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়। চীনের “সন অব হেভেন” শাসকের প্রতিনিধিরা পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহে দূত পাঠাতেন, যা ট্রিবিউটারি সিস্টেম হিসেবে পরিচিত ছিলো।
গ্রিক সভ্যতা কূটনীতিকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। নগর-রাষ্ট্রগুলো যেমন এথেন্স, স্পার্টা, থিবস প্রভৃতি একে অপরের সঙ্গে শান্তিচুক্তি ও সামরিক জোটে আবদ্ধ হতো। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে পেলোপোনেশীয় যুদ্ধের সময় এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে যুদ্ধ এড়াতে একাধিকবার কূটনৈতিক দূতাবস্থা গঠন করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত সংঘাত অনিবার্য হয়, তবু এটি দেখায় যে, কূটনৈতিক আলোচনার চর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে কূটনৈতিক অনুশীলন আরও সূক্ষ্ম হয়। রোমানরা কূটনীতিকদের ‘সেক্রেট ডিপ্লোম্যাসি’-র মাধ্যমে গোপন চুক্তি, দালালি এবং প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করত। Cicero, Tacitus-এর মতো রোমান চিন্তাবিদরা দূতাবস্থা ও নৈতিকতার সংযোগ নিয়ে আলোচনা করেন। রোমান ‘আইন’ ও ‘পূজা’র মাধ্যমে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হতো।
সবশেষে, প্রাচীন ইহুদি, পার্সি এবং আরব সভ্যতায়ও কূটনৈতিক রীতিনীতি বিদ্যমান ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট বিভিন্ন জাতির সঙ্গে শান্তিচুক্তি করতেন এবং কূটনৈতিক সহাবস্থানের মাধ্যমে সাম্রাজ্য শাসন করতেন।
এইসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে, প্রাচীন যুগের কূটনীতিকরা শুধু শান্তির বার্তাবাহক ছিলেন না, বরং তারা রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী দূরদর্শী দূত হিসেবে কাজ করতেন। রাজনৈতিক সমঝোতা, সামরিক জোট, বাণিজ্যিক বিনিময় এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়—সব ক্ষেত্রেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
ইসলামি যুগে কূটনীতিকদের ভূমিকা
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগ থেকে ইসলামি বিশ্বে কূটনীতিকদের ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। ইসলামের সূচনালগ্নেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় দূত প্রেরণের প্রথা গড়ে ওঠে। হিজরতের পর মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নবী (সা.) মদিনা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রাজ্য ও শাসকের নিকট দূত পাঠান। যেমনঃ রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ, মিশরের শাসক মুকাওকিস, আবিসিনিয়ার রাজা নাজাশী প্রমুখ। এই দূতেরা ইসলামি বার্তা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি কূটনৈতিক সৌহার্দ্য স্থাপন, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। নবী করিম (সা.)-এর অন্যতম দূত ছিলেন সাহাবি ধুল-কিফলি (রা.), যিনি পারস্য সম্রাটের দরবারে যান, যদিও সম্রাট তার সাথে অবমাননাকর আচরণ করেন। অন্যদিকে, মিশরের শাসক মুকাওকিস সম্মান প্রদর্শন করে নবী (সা.)-কে হাদিয়া পাঠান এবং রমলা বিনতে আবু সুফিয়ানকে নবী (সা.)- এর নিকট প্রেরণ করেন।
খলিফা আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-এর আমলেও বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে দূত প্রেরণ ও শান্তিচুক্তি সাক্ষরের রীতি চালু থাকে। এক্ষেত্রে ইসলামী কূটনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল সদ্ভাব, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, শান্তির বার্তা এবং পারস্পরিক স্বীকৃতির ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন। ইসলামী সভ্যতায় পরবর্তীতে উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে রাষ্ট্রদূতরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রাজনৈতিক সমঝোতা এবং যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এইসব উদাহরণ প্রমাণ করে, ইসলামি যুগে কূটনীতি ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, সংকট সমাধান ও মুসলিম বিশ্বের সম্প্রসারণ ঘটানো হয়।
ইউরোপীয় মধ্যযুগে কূটনীতি ও কূটনীতিকদের ভূমিকা
মধ্যযুগীয় ইউরোপে কূটনৈতিক কার্যক্রম প্রধানত পরিচালিত হতো ধর্মীয় কর্তৃত্ব এবং রাজতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত প্রভাবের মাধ্যমে। এই সময় কূটনীতিকে আজকের মতো পেশাদার কাঠামোতে না দেখে বরং ধর্মীয় আদেশ, পবিত্র কর্তৃত্ব এবং রাজসভার ব্যক্তিগত দূতের মাধ্যমে পরিচালনা করা হতো। এ যুগের কূটনৈতিক চর্চায় রোমান ক্যাথলিক চার্চ এক কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়, যার মাধ্যমে কূটনীতি কার্যত একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক একত্র অনুশীলনে পরিণত হয়। বিশেষ করে, পোপদের প্রেরিত ধর্মীয় দূতেরা অর্থাৎ, Papal Nuncios-রা ছিলেন পোপের প্রতিনিধি, যাঁরা বিভিন্ন ইউরোপীয় রাজদরবারে রাজনৈতিক আলোচনা, দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তি এবং জোট গঠনের উদ্দেশ্যে নিযুক্ত হতেন। এই দূতেরা শুধু ধর্মীয় নির্দেশ পালনে নয়, বরং রাজনীতির কৌশলগত পরিচালনায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো "Investiture Controversy", যেখানে পোপ গ্রেগরি সপ্তম এবং জার্মান সম্রাট হেনরি চতুর্থের মধ্যে যাজক নিয়োগের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। এই দ্বন্দ্ব সমাধানে বহু দফা কূটনৈতিক আলোচনা হয়, যেখানে পোপীয় দূত এবং রাজদরবারের প্রতিনিধি উভয়ের মাধ্যমে সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত এই সংকট সাময়িক সমাধানে পৌঁছায়, কিন্তু এটি মধ্যযুগীয় কূটনীতিতে চার্চ ও রাজমহলের টানাপোড়েনের এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। আরেকটি উদাহরণ হলো পোপ ইনোসেন্ট তৃতীয়। তিনি কূটনৈতিক কৌশল ব্যবহার করে ইউরোপীয় রাজাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন, বিশেষ করে চতুর্থ ক্রুসেড চলাকালে। যদিও এই ক্রুসেড ধর্মীয় উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় বলে দাবি করা হয়, বাস্তবে এর পেছনে একাধিক কূটনৈতিক লেনদেন ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ কাজ করেছিল, যেখানে পোপের দূতেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই সময়ের কূটনীতিকে এককভাবে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় বলা যায় না, বরং তা ছিল একধরনের "Sacral Diplomacy", যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিক কর্তৃত্ব এবং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত ছিল। পরবর্তীতে, ইতালীয় শহররাষ্ট্রগুলো (যেমন—ভেনিস, ফ্লোরেন্স, মিলান) স্থায়ী দূতাবাস ব্যবস্থা চালু করে। ভেনিস ছিল অন্যতম অগ্রণী রাষ্ট্র যেখানে চতুর্দশ শতকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, অটোমান তুরস্ক এবং ফ্রান্সের দরবারে দূতাবাস স্থাপন করেছিল। এর মাধ্যমে এক নতুন ধরনের পেশাদার কূটনীতিক শ্রেণির জন্ম হয়। এ সময়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গোপনীয়তা, গুপ্তচরবৃত্তি, এবং প্রাসঙ্গিকতার ওপর ভিত্তি করে নীতি নির্ধারণ।
মুঘল যুগে কূটনীতি ও কূটনীতিকদের কার্যক্রম
মুঘল সাম্রাজ্যে কূটনীতিকরা রাজ্যশাসনের একটি অপরিহার্য অংশ ছিলেন। তারা শুধু রাজনৈতিক চুক্তি বা শান্তি প্রতিষ্ঠাই করতেন না, বরং ধর্ম, বাণিজ্য ও সংস্কৃতিগত সম্পর্ক রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। সম্রাট আকবর কূটনীতিকে ব্যবহার করেন সাম্রাজ্য বিস্তার ও ধর্মীয় সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য। তিনি রাজপুত রাজাদের সঙ্গে আত্মীয়তা ও মৈত্রীর মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা একধরনের সামাজিক কূটনীতি (social diplomacy)। তাছাড়া, তিনি পারস্য, তুরান (মধ্য এশিয়া), এবং অটোমান সাম্রাজ্যের সাথেও কূটনৈতিক যোগাযোগ বজায় রাখেন। তাঁর দরবারে একাধিক বিদেশি দূত উপস্থিত ছিল, যেমনঃ আব্দুর রাজ্জাক (পারস্যের দূত), যিনি মুঘল দরবারে নিয়মিত বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক বার্তা আদান-প্রদান করতেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়েও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হয়। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি থমাস রো ১৬১৫ সালে জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন এবং কূটনৈতিক আলোচনা করে বাণিজ্য সুবিধা আদায় করেন। এটি ছিল ইংরেজদের ভারত বিজয়ের সূচনালগ্ন। এ ছাড়া পর্তুগিজ ও ওলন্দাজদের সাথেও মুঘল সম্রাটদের দূতাবিনিময় চলত। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলেও কূটনৈতিক দূত পাঠানোর ঘটনা রয়েছে, বিশেষ করে পারস্য ও উজবেক শাসকদের কাছে। এইসব দূতরা রাজনৈতিক তথ্য সংগ্রহ, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সামরিক বা বাণিজ্যিক চুক্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতেন।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক কূটনীতির রূপ
আধুনিক কূটনীতির সূচনা মূলত ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির (Treaty of Westphalia) মাধ্যমে ঘটে। এই চুক্তির মাধ্যমে ত্রিশ বছর ধরে চলা ইউরোপের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হয় এবং এক নতুন রাজনৈতিক ধারণা—সার্বভৌমত্ব (sovereignty)—আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এর ফলে রাষ্ট্রগুলো স্বতন্ত্র ও সমান অধিকারসম্পন্ন একক সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ওয়েস্টফেলিয়ার পরে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে স্থায়ী কূটনীতিক নিযুক্ত করতে থাকে, যারা অন্য রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন এবং সেই রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও নীতিগত আলোচনায় অংশ নিতেন।
এর প্রায় দেড় শতক পরে, ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেস (Congress of Vienna) আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। নেপোলিয়নের ইউরোপজয় এবং ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী বিশৃঙ্খলা থেকে ইউরোপকে পুনর্গঠন করতে এই কংগ্রেস আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনটি সফল করতে Clemens von Metternich নামক অস্ট্রিয়ার অভিজ্ঞ ও প্রভাবশালী কূটনীতিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নীতিমালা ছিল ইউরোপের উচিত "শক্তির ভারসাম্য (Balance of Power)” নীতি অনুসরণ করা, যাতে তারা পারস্পারিক সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত থেকে বিরত থাকতে পারে এবং ইউরোপীয় আন্তর্জাতিক সিস্টেমে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। ভিয়েনা কংগ্রেসে প্রথমবারের মত কূটনৈতিক ‘র্যাংক ও প্রোটোকল’ নির্ধারিত হয়। যেমনঃ Ambassador > Envoy > Minister Resident > Chargé d’affaires। এই সমীকরণটি আজকের কূটনীতিক শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তি গড়ে তোলে। এই সময় থেকেই কূটনীতিকদের ভূমিকা প্রথাগত সৌজন্য ও বার্তাবাহক থেকে আরও বৃহত্তর পরিসরে উন্নীত হয়। রাষ্ট্রীয় কৌশলের বাস্তবায়নকারী, চুক্তির নেপথ্য কারিগর, এমনকি কখনও কখনও গোপন আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে তারা ভূমিকা রাখতে থাকেন।
উদাহরণস্বরূপ, উনবিংশ শতকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা “Scramble for Africa” নামে পরিচিত এক কৌশলগত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এ সময়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম প্রভৃতি রাষ্ট্র আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। এই উপনিবেশ ভাগাভাগি করার প্রক্রিয়া চলে মূলত কূটনৈতিক চুক্তি ও সম্মেলনের মাধ্যমে, যার এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত ১৮৮৪ সালের বার্লিন কনফারেন্স। এই সম্মেলনে ইউরোপীয় দেশগুলো কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে আফ্রিকার ভূখণ্ড বিভাজন করে, যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনগণের মতামত উপেক্ষা করা হয়। এ সময় ব্রিটিশ কূটনীতিক লর্ড স্যালিসবুরি ও ফরাসি কূটনীতিক জুল ফেরি-এর মতো ব্যক্তিত্বরা আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশ সম্প্রসারণে সরাসরি ভূমিকা রাখেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো বেলজিয়ামের রাজা King Leopold II-এর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে তিনি Congo Free State-কে তার 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হন।
অন্যদিকে, উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রও ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে তার উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে। ১৮২৩ সালে ঘোষিত Monroe Doctrine-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তির পশ্চিম গোলার্ধে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে এবং নিজস্ব কূটনৈতিক বলয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অব্যহত রাখে। এই নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম গোলার্ধকে (Western Hemisphere), বিশেষত লাতিন আমেরিকাকে তাদের প্রভাবাধীন অঞ্চল হিসেবে দেখতে শুরু করে, এবং একাধিক দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানকে সুসংহত করে। পরবর্তী সময়ে Open Door Policy-এর মাধ্যমে চীন ও পূর্ব এশিয়ায়ও যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে।
বিশ শতকে কূটনীতিকদের ভূমিকায় বিস্তার
বিশ শতকে কূটনীতিকদের ভূমিকা শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বহুপাক্ষিকতা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, নিরাপত্তা কাঠামো এবং মানবাধিকার বিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রেও প্রসার লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিপুঞ্জ (League of Nations) গঠনের মাধ্যমে ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতা (International Cooperation)’ ধারণাটি জনপ্রিয় হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কূটনীতিকদের প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা আরও স্পষ্ট ও গভীরতর হয়ে ওঠে। এই মার্কিন কূটনীতিক Cordell Hull জাতিসংঘ গঠনের অন্যতম প্রধান স্থপতি হিসেবে কাজ করেন এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় কূটনৈতিক আলোচনার পথ সুগম করেন।
এই সময় স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা কূটনীতিকে এক ভিন্ন রূপ দেয়। ১৯৪৭ সালে মার্কিন কূটনীতিক George F. Kennan সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণ রোধে "Containment Doctrine" প্রণয়ন করেন, যা মার্কিন বৈদেশিক নীতির ভিত্তি হয়ে ওঠে। এই নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ও কূটনৈতিক উপায়ে সোভিয়েত প্রভাব প্রতিহত করার কৌশল গ্রহণ করে, যার বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং ইউরোপীয় মিত্রতার ক্ষেত্রে, যেমনঃ ন্যাটো। একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে কূটনীতিকদের ভূমিকা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। বিশেষত ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী Henry Kissinger নতুন এক কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেন, যাকে বলা হয় "Shuttle Diplomacy", যেখানে তিনি একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি যাতায়াত করে গোপন আলোচনার মাধ্যমে শান্তিচুক্তি নিশ্চিত করেন।
বিশ শতকে উপনিবেশবাদের অবসান ও নতুন রাষ্ট্রসমূহের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে কূটনৈতিক ভূমিকা আরও বৈচিত্র্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এই বাস্তবতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৭১ সালে ভারতের কূটনীতিকরা আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরে সক্রিয় জনমত গঠন করেন। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনেও এই প্রচেষ্টা কার্যকর ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিক Archer Blood কর্তৃক প্রেরিত “Blood Telegram” মার্কিন প্রশাসনের নির্লিপ্ততার বিরুদ্ধে একটি নৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়।
সব মিলিয়ে বিশ শতকে কূটনীতিকরা হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক শান্তি, সংঘাত ব্যবস্থাপনা, জোট গঠন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, এবং মানবিক বিপর্যয়ের মোকাবেলায় সক্রিয় নিয়ামক। একদিকে যেমন তারা বিশ্বযুদ্ধ ও স্নায়ুযুদ্ধের মতো বৈশ্বিক সংঘাতে সমঝোতার পথ খুঁজে বের করেন, অন্যদিকে নব্য-স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
সমকালীন বিশ্বে কূটনীতিকদের নতুন রূপ ও চ্যালেঞ্জ
একবিংশ শতাব্দীতে কূটনীতিকদের ভূমিকা শুধু রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় সীমাবদ্ধ নেই; বরং তারা এখন বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবিক বিপর্যয় ও প্রযুক্তিনির্ভর কূটনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। আধুনিক বিশ্বায়িত বাস্তবতায় কূটনীতিকদের কাজ আগের চেয়ে অনেক বেশি আন্তঃসম্পর্কিত, জটিল এবং বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, যেখানে বিশ্বের শতাধিক দেশের কূটনীতিকদের আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন, বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস, এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে এক আন্তর্জাতিক ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চুক্তি প্রমাণ করে যে, বর্তমান যুগে কূটনীতিকরা আন্তর্জাতিক পরিবেশনীতি গঠনে কীভাবে মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
একইভাবে, ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারির সময় কূটনীতির এক নতুন ধারা সূচনা হয়, যাকে বলা হয় “ভ্যাকসিন কূটনীতি (Vaccine Diplomacy)”। চীন, ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন বন্ধুপ্রতিম বা দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বিতরণ করে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কৌশল হিসেবে ভ্যাকসিন কূটনীতিকে ব্যবহার করে। এভাবে, জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও মানবিক সংকট সমাধানেও কূটনীতিকরা কার্যকর ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশি কূটনীতিকগণ আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয় প্রচারণা চালান এবং বৈশ্বিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, মানবাধিকার কাউন্সিল এবং ওআইসি-র মতো আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরা হয়। এছাড়া কফি আনান কমিশনের সুপারিশ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা, এবং বিশ্ব জনমতের চাপ সৃষ্টি ইত্যাদি সবই কূটনীতিকদের সংগঠিত প্রচেষ্টার ফল। এছাড়াও আজকের যুগে সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল সুরক্ষা, জলবায়ু শরণার্থী, সন্ত্রাসবাদ দমন, বাণিজ্যযুদ্ধ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়েও কূটনীতিকদের সচেতন ও সক্রিয় হতে হচ্ছে। অনেক সময় তারা আন্তঃসরকার সংস্থা (IGOs), আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (INGOs) ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন।
৫। কূটনীতিকদের শ্রেণিবিন্যাস
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনায় কূটনীতিকদের ভূমিকায় পেশাগত ও কার্যকর শ্রেণিবিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬১ সালের “ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনস”-এ কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের কাঠামো ও শ্রেণিগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভিয়েনা কনভেনশন কূটনীতিকদের দায়িত্ব, ক্ষমতা ও মর্যাদাকে স্তরভেদে উল্লেখ করে, যাতে কূটনীতিকরা রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ ও কূটনৈতিক কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে নিম্নে কূটনীতিকদের শ্রেণী বিন্যাস তুলে ধরা হলঃ
ক) রাষ্ট্রদূত (Ambassador)ঃ রাষ্ট্রদূত হলেন কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ স্তরের কূটনীতিক প্রতিনিধি। তিনি সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের প্রধান হিসেবে কাজ করেন এবং সর্বোচ্চ কূটনৈতিক মর্যাদা ভোগ করেন। রাষ্ট্রদূত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, সাংস্কৃতিক এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের কাজ পরিচালনা করেন। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ উপস্থাপন ও প্রভাবিত করার জন্য কংগ্রেস, আমেরিকান প্রশাসন ও থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন। একইভাবে, ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা চুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন।
খ) মিনিস্টার বা এনভয় (Minister or Envoy)ঃ রাষ্ট্রদূতের পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক পদ হলো মিনিস্টার বা এনভয়। তাঁরা অনেক সময় বিশেষ রাষ্ট্র বা নির্দিষ্ট কার্যক্ষেত্রে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োজিত হন। যেমনঃ শান্তি আলোচনায় বা বিশেষ মিশনে তারা নিজ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। Envoy-রা কিছু সময় "Minister Plenipotentiary" পদেও নিয়োগ পান, যার মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রপ্রধানের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বা প্রস্তাব নিয়ে অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন। উদাহরণস্বরূপঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন Envoy Harry Hopkins যুক্তরাজ্যে বিশেষ কূটনৈতিক মিশনে নিয়োজিত ছিলেন। আবার, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় নিযুক্ত বিশেষ রাষ্ট্রদূত বা এনভয়রা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংকট নিরসনে মধ্যস্থতা করেন।
গ) চার্জ দ্য অ্যাফেয়ারস (Chargé d’Affaires)ঃ চার্জ দ্য অ্যাফেয়ারস হচ্ছেন দূতাবাসের দ্বিতীয় সারির কর্মকর্তা, যারা রাষ্ট্রদূতের অনুপস্থিতিতে দূতাবাসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অনেক সময় রাষ্ট্রদূতের পদ শূন্য থাকলে বা কূটনৈতিক টানাপোড়েনের সময় চার্জ দ্য অ্যাফেয়ারস পদটি ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপঃ যুদ্ধকালীন বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অবনতির সময় রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করা হলে সংশ্লিষ্ট দেশে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ারস কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যান। যেমনঃ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কূটনীতিক Archer Blood রাষ্ট্রদূত না হয়েও কার্যত দূতাবাস পরিচালনা করতেন এবং "Blood Telegram"-এর মাধ্যমে পরিস্থিতির প্রতিবেদন পাঠান।
ঘ) কনসাল জেনারেল ও কনসালঃ এরা রাষ্ট্রদূত বা দূতাবাসের চেয়ে আলাদা একটি কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, যা মূলত কনস্যুলেট বা বাণিজ্যিক ও নাগরিক সেবা কেন্দ্র পরিচালনায় নিয়োজিত। কনসাল জেনারেল সাধারণত একটি বড় শহরে নিযুক্ত হন যেখানে দূতাবাস নেই, এবং তারা ভিসা প্রদান, পাসপোর্ট নবায়ন, অভিবাসী সমস্যার সমাধান, বাণিজ্যিক প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি কাজ করেন। রাজনৈতিক কূটনীতির চেয়ে তাঁদের কাজ বেশি প্রশাসনিক ও সেবামূলক। যেমনঃ নিউইয়র্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল প্রবাসী বাংলাদেশিদের নাগরিক সেবা দেন, বাণিজ্যিক যোগাযোগ তৈরি করেন এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
৬। কূটনীতিকদের মর্যাদা ও দায়মুক্তি (Diplomatic Immunity)
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ব্যবস্থায় কূটনৈতিক দায়মুক্তি (Diplomatic Immunity) একটি স্বীকৃত ও আবশ্যিক নীতি, যা ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনস, ১৯৬১-এর মাধ্যমে আইনতভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই নীতির মূল উদ্দেশ্য হলঃ কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিক যেন স্বাগতিক রাষ্ট্রে বাধাহীন ও ভয়ের বাইরে থেকে নিজের রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বমূলক কাজগুলো সম্পাদন করতে পারেন। দায়মুক্তি কূটনীতিকদেরকে স্বাগতিক দেশের আইনগত ব্যবস্থা, যেমনঃ গ্রেফতার, বিচার, তল্লাশি ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে। যদিও এর মাধ্যমে ফৌজদারি বা দেওয়ানি অপরাধ থেকেও দায়মুক্তি পাওয়া যায়, তবে এর অপব্যবহার রোধে কিছু পন্থাও রয়েছে।
এই দায়মুক্তি নিছক ব্যক্তি নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপঃ যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূত যদি ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করেন, তবে তাকে আদালতে হাজির করা যাবে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর অপরাধ করলেও তাকে সরাসরি গ্রেফতার করা যাবে না, বরং এই অপরাধের প্রেক্ষিতে স্বাগতিক দেশ রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিকে persona non grata ঘোষণা করতে পারে।
Persona Non Grata ঃ
‘পারসোনা নন গ্রাটা (Persona Non Grata)’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক কৌশল। এটি লাতিন শব্দ, যার অর্থ “অপ্রিয় ব্যক্তি”। এটি কূটনৈতিক রীতিতে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদ, যেখানে স্বাগতিক রাষ্ট্র বলছে, “আমরা এই ব্যক্তিকে আমাদের দেশে আর চাই না।” ভিয়েনা কনভেনশনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে কোনো সময়, কোনো কারণ ব্যাখ্যা না করেই, একটি রাষ্ট্র বিদেশি কূটনীতিককে persona non grata ঘোষণা করতে পারে। তবে, persona non grata সেই ব্যক্তির কূটনৈতিক দায়মুক্তির সুবিধাকে বাতিল করে না, বরং তাকে “অবাঞ্ছিত” হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সাধারণত তার দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য ৪৮ বা ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়। যদি তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশ না ছাড়েন, তবে তখন রাষ্ট্র তাকে কূটনৈতিক মর্যাদা ছাড়া বিদেশি নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে আইনত ব্যবস্থা নিতে পারে।
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে persona non grata ঘোষণা বহুবার সংঘটিত হয়েছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় গুপ্তচরবৃত্তি, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, অপেশাদার আচরণ, বা রাজনৈতিক বৈরিতার প্রেক্ষিতে। যেমন:
- ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যে ‘স্ক্রিপাল বিষপ্রয়োগ’ কেলেঙ্কারিতে ব্রিটিশ সরকার সন্দেহ করে যে রুশ কূটনীতিকেরা নোভিচক রাসায়নিক দিয়ে একটি গুপ্তহত্যা চেষ্টায় জড়িত। এর জবাবে ব্রিটেন ২৩ জন রুশ কূটনীতিককে persona non grata ঘোষণা করে। পরে সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ও ইউরোপের বহু দেশ আরও রুশ কূটনীতিক বহিষ্কার করে। রাশিয়াও পাল্টা বহিষ্কার করে।
- ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বেশ কয়েকজন কিউবান কূটনীতিক ‘কমিউনিস্ট প্রচার’ ও আমেরিকান নাগরিকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে persona non grata ঘোষিত হন।
- এছাড়া, ইসরায়েল, ভারত, চীন, তুরস্ক, সৌদি আরবসহ অনেক রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক নীতি রক্ষার্থে কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে।
Persona non grata ব্যবস্থাটি এমন এক ধরনের কূটনৈতিক প্রতিবাদ ও সতর্কবার্তা, যার মাধ্যমে স্বাগতিক রাষ্ট্র তার সার্বভৌমতা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার বার্তা দেয়। এটি যুদ্ধ বা বিরুদ্ধতা ঘোষণার চেয়ে অনেক শান্তিপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ হলেও, এর কূটনৈতিক প্রভাব অনেক গভীর ও প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারে। অনেক সময় এটি দুই রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদী উত্তেজনা, কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি, এমনকি রাষ্ট্রদূতের প্রত্যাহারেও পরিণত হয়।
সার্বিকভাবে, কূটনৈতিক দায়মুক্তি যতটা না কূটনীতিকের ব্যক্তিগত সুবিধা, তার চেয়েও বেশি একটি রাষ্ট্রের সম্মান, মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যম। তবে এর প্রয়োগ হতে হবে অত্যন্ত সতর্কভাবে, কারণ এর অপব্যবহার বিশ্বে রাজনৈতিক অনাস্থা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে। আর যখনই কোনো কূটনীতিক সীমা লঙ্ঘন করেন, তখন persona non grata ঘোষণাই হয় আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী সবচেয়ে ভদ্র, কিন্তু দৃঢ় প্রতিক্রিয়া।
৭। ভবিষ্যতের কূটনীতি: রূপান্তর ও চ্যালেঞ্জ
আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতা কূটনৈতিক চর্চাকেও নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের কূটনীতি আর শুধু রাষ্ট্রের প্রতিনিধি দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণের সীমিত কাঠামোয় আবদ্ধ নেই; বরং এটি হয়ে উঠছে বহুমাত্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারী, প্রযুক্তিগত বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) উত্থান কূটনৈতিক পেশাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
প্রথমত, ডিজিটাল কূটনীতি বা e-diplomacy ভবিষ্যতের অন্যতম প্রধান রূপান্তর। আজকের যুগে রাষ্ট্রদূত কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু ভিয়েনা চুক্তির কাঠামোয় সীমাবদ্ধ থাকছে না, তারা টুইটার, এক্স, ইউটিউব, কিংবা ফেসবুক ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় নীতির প্রচার চালাচ্ছে। এভাবে "পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি" হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের soft power প্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
দ্বিতীয়ত, বহুরাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় (non-state) একাধিক শক্তি এখন কূটনৈতিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করছে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এখন কেবল দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কোম্পানি, সিভিল সোসাইটি, এনজিও, এবং এমনকি পরিবেশ আন্দোলনকারীরাও কূটনৈতিক নীতিনির্ধারণে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
তৃতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা ভবিষ্যতের কূটনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রের গোপন তথ্য, সামরিক পরিকল্পনা কিংবা অর্থনৈতিক কৌশল এখন হ্যাকিং ও সাইবার হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে, সাইবার ডিপ্লোম্যাসি এখন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। যেমনঃ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে আলাদা কূটনৈতিক ইউনিট গঠন করছে।
চতুর্থত, জলবায়ু কূটনীতি বা climate diplomacy হয়ে উঠছে আগামীর আন কেন্দ্রীয় বিষয়। উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে জলবায়ু ন্যায্যতা, গ্রিন ফান্ড, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ইত্যাদি নিয়ে কূটনৈতিক দর কষাকষি দিন দিন তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র ও উপকূলবর্তী দেশগুলোর জন্য এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও, গ্লোবাল সাউথের উত্থান, আঞ্চলিক সংহতি (যেমন Indo-Pacific কৌশল), কৃত্রিম সীমান্ত বিরোধ, AI দ্বারা চালিত disinformation, এবং মহাকাশ কূটনীতি (space diplomacy) ইত্যাদি বিষয় আগামী দিনগুলোতে কূটনৈতিক পেশার কাঠামো ও কৌশল পুনর্গঠন করতে বাধ্য করবে।
তবে এই রূপান্তরের ভেতরেই রয়েছে কিছু গভীর চ্যালেঞ্জ। যেমন: কূটনৈতিক পেশার গোপনীয়তা ও সংবেদনশীলতা বজায় রাখা, জাতীয় স্বার্থ বনাম মানবিক মূল্যবোধের ভারসাম্য রক্ষা, নতুন প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকানো এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সীমা নির্ধারণ করা। এর জন্য দরকার দূরদর্শী কূটনৈতিক শিক্ষা, আন্তঃসংস্কৃতিক বোঝাপড়া এবং দ্রুত অভিযোজন ক্ষমতা।
৮। উপসংহারঃ
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিবর্তনে কূটনীতিকরা কেবল রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নন, বরং বৈশ্বিক শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সহাবস্থানের রূপকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রাচীন বার্তাবাহক থেকে আধুনিক কৌশলবিদ পর্যন্ত, ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে তাদের ভূমিকা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে বিভিন্ন কূটনৈতিক শ্রেণিবিন্যাস কূটনীতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সুসংহত করেছে। আজকের বিশ্বায়িত বিশ্বে কূটনীতিকরা বহুমাত্রিক ও আন্তঃবিষয়ক দক্ষতায় দীক্ষিত, যারা রাজনীতি ছাড়াও অর্থনীতি, পরিবেশ, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগামীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জলবায়ু সংকট, সাইবার হুমকি এবং বৈশ্বিক অস্থিরতায় কূটনৈতিক ব্যবস্থা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। এই বাস্তবতায় কূটনীতিকদের দক্ষতা, অভিযোজন ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি রাষ্ট্রীয় স্বার্থরক্ষার প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠবে। সুতরাং, কূটনীতিকদের অতীতের ইতিহাস যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভবিষ্যতের বহুমাত্রিক বাস্তবতায় তাদের ভূমিকার পর্যালোচনা ও কৌশলগত পুনর্বিন্যাস সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
-বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


No comments