Post-colonialism: জ্ঞান, শক্তি ও পরিচিতির ঔপনিবেশিক নির্মাণ
![]() |
| Post-colonialism in Art |
Post-colonialism-কে বাংলায় বললে উত্তর-উপনিবেশবাদ বা উপনিবেশোত্তরবাদও বলা যায়। Post-colonialism- ধারণাটির সংজ্ঞায়ন নিয়ে পণ্ডিতবর্গের মধ্যে বিতর্কের কমতি নাই। ধারণাটির অধীনে এক বিস্তর বিষয়াবলী আলোচিত হয়। বস্তুত, Post-colonialism- ধারণাটির সংজ্ঞায়ন সম্পর্কিত মতানৈক্য সত্ত্বেও, যারা Post-colonial দৃষ্টিভঙ্গি বা তাত্ত্বিক দুনিয়া নিয়ে গবেষণারত আছেন, তারা Post-colonialism- তত্ত্বের সমর্থনে কতিপয় Assumptions বা মৌলিক বৈশিষ্ট্য পেশ করেন। তারা বলেন, এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ Post-colonialism বা উত্তর-উপনিবেশবাদ তত্ত্বের ভীত রচনা করে।
Post-colonialism- তত্ত্বের প্রথম বৈশিষ্ট্যখানা আধুনিক বিশ্ব (Modern World) নির্মাণে ঔপনিবেশিক শাসনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি বলে, ঔপনিবেশিক যুগে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের উত্থান ও পতনের (Colonial Rapture) ধারাবাহিকতায় ঔপনিবেশিক আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা উপাদান এখনো আধুনিক বিশ্বকে প্রভাবিত করে চলছে।
Post-colonialism- তত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি বলে, Post-colonialism তত্ত্বের ব্যবহৃত ‘Post’ উপসর্গটি দ্বারা এটা বুঝায় না যে ক্লাসিক্যাল উপনিবেশবাদের সমাপ্তি ঘটেছে; অথবা, এই উপসর্গটির অর্থ এইও নয় যে, ক্লাসিক্যাল উপনিবেশবাদ এখনো চলমান রয়েছে। বরং, Post-colonialism তত্ত্বমতে, ক্ল্যাসিকাল উপনিবেশবাদের উত্থান ও পতনের ফলাফল হিসেবে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার গঠন ও পরিচিত নির্মিত হয়েছে।
Post-colonialism তত্ত্বঃ সংজ্ঞা, বিতর্ক, সমালোচনা
Post-colonialism- ধারণাটি সংজ্ঞায়নের প্রাক্কালে, Post-colonialism নিয়ে চলমান বিতর্কগুলোকে, বিশেষত তিনটি গুরুতর সমালোচনা বা প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর খোজা জরুরি। যথাঃ
১. Post-colonialism তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা পশ্চিমা একাডেমিক দুনিয়ায় কেন সেভাবে প্রাধান্য পায় না? পশ্চিমা একাডেমিকরা কেন Post-colonialism তত্ত্ব বা ধারণাটিকে এড়িয়ে যেতে চান?
সম্ভাব্য উত্তরঃ কতিপয় পশ্চিমা বিশেষজ্ঞের মতে, Post-colonialism- তত্ত্বের ‘Post’ উপসর্গটি দ্বারা বুঝায় যে, আমরা এখন ক্লাসিক্যাল উপনিবেশবাদের অন্তর্গত ‘সাম্রাজ্যবাদ’ ও ‘হেজমন’ যুগের পরের ধাপে রয়েছি। পশ্চিমা একাডেমিকদের কাছে Post-colonialism-এর এরূপ সংজ্ঞায়ন অধিক পছন্দের। অন্যদিকে, Post-colonialist- তাত্ত্বিকেরা এই তত্ত্বের যে বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করেন, সেখানে 'Post' দ্বারা আধুনিক বিশ্বকে ক্লাসিক্যাল উপনিবেশবাদের উত্থান-পতনের ফলাফল হিসেবে দেখানো হয়। পশ্চিমা একাডেমিকরা Post-colonialism তত্ত্বের তাত্ত্বিকদের উক্ত সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যগুলো এড়িয়ে যেতে চান। এজন্যই তারা ‘Post’ উপসর্গটি দ্বারা কেবল ক্লাসিক্যাল উপনিবেশবাদের সমাপ্তিকে বুঝান, এর ধারাবাহিকতাকে নয়।
এভাবে পশ্চিমা একাডেমিকরা নিজেদের জন্য একটি নিরাপদ অবস্থান তৈরি করেন। কারণ, Post-colonialism তত্ত্বের আলোচনাগুলো থেকে পরবর্তীতে নব্য-উপনিবেশবাদ (Neo-colonialism), সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism) এবং তৃতীয় বিশ্ব (Third World)–এর মতো ধারণার উদ্ভব ঘটে, যা সরাসরি পশ্চিমাদের আধুনিকতার বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফলস্বরূপ, পশ্চিমা একাডেমিকরা প্রাথমিক পর্যায়েই Post-colonialism- তত্ত্বের সংজ্ঞায়নকে অস্বীকার করে বস্তুত নিজেদেরকে সমালোচনা থেকে মুক্ত রাখতে চান। এভাবে, তারা Post-colonialism তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যকে প্রত্যাখ্যান করে দাবি করেন যে ‘Post’ উপসর্গটি কেবল উপনিবেশবাদের অবসানকেই নির্দেশ করে, এর স্থায়ী প্রভাব বা বর্তমান অস্তিত্বকে নয়।
২. Post-colonialism তত্ত্বের আলোচ্য পরিধি কতটুকু হবে তা নিয়ে দ্বিতীয় বড় বিতর্কটি শুরু হয়। যে রাষ্ট্র/ সমাজ একদা উপনিবেশের অন্তর্গত ছিলো, তারা সবাই কী Post-colonialism তত্ত্বের আলোচ্য পরিসরে পড়বে? যেমন ধরুন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশগুলো একদা উপনিবেশভুক্ত ছিলো। পরবর্তীতে, তারা নিজেরাও উপনিবেশিক (সাম্রাজ্যবাদী) রাষ্ট্র হয়ে ওঠেন। ফলে, এই রাষ্ট্রগুলোকে কী ভারতীয় উপমহাদেশ, সেনেগাল বা ব্রাজিলের মত উপনিবেশভুক্ত দেশের সাথে একই কাতারে Post-colonialism তত্ত্বে আলোচিত হবে? অথবা, যদি এভাবে বলি, Post-colonialism তত্ত্বে এমন কোন নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য কী রয়েছে যার সাহায্যে ঐতিহাসিকভাবে উপনিবেশভুক্ত দেশগুলোর মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব?
সম্ভাব্য উত্তরঃ Post-colonialism তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা এই প্রশ্নগুলোর জবাবে বলেন যে, উপনিবেশভুক্ত রাষ্ট্রের মাঝে পৃথক পৃথক ঔপনিবেশিক ইতিহাস, স্মৃতি ও প্রভাব লক্ষণীয়। তবে, উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার ঔপনিবেশিক শাসন-কাঠামো ও নীতি ব্যবস্থা, বিশেষত, যেগুলো বর্তমান রাষ্ট্র-কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে জায়গা করে নিয়েছে তার সবকিছুই Post-colonialism-এর আলোচ্য পরিধি অন্তর্গত।
৩. Post-colonialism তত্ত্বকে ঘিরে তৃতীয় অভিযোগটি হল এই তত্ত্ব কেন উপনিবেশবাদের বস্তুতান্ত্রিক উপাদানকে কম, কিন্তু উপনিবেশবাদে সাংস্কৃতিক উপাদানকে সর্বাদিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে?
সম্ভাব্য উত্তর: এই তৃতীয় ধাপের সমালোচকদের সিংহভাগই মার্কসবাদী চেতনা দ্বারা প্রভাবিত। ফলে, তারা বলেন যে, মার্কসবাদ তত্ত্বে যে সকল বস্তুগত উপাদানকে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেমনঃ পুজিঁবাদী ব্যবস্থা, দারিদ্র, অসমতা, শ্রেণীগত বৈষম্য প্রভৃতিকে Post-colonialism তত্ত্বের তাত্ত্বিক কাঠামোয় একরকমের অবজ্ঞা করা হয়েছে বা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উপরন্তু, Post-colonialism তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা Post-Structuralism তত্ত্বের তাত্ত্বিকদের প্রদত্ত উপাদান, যেমনঃ সামাজিক প্রতিনিধিত্ব (Representation), পরিচিতি (Identity), এবং সংস্কৃতিকে (Culture) অধিক মূল্যায়ন করে।
এই অভিযোগকে কতিপয় Post-colonialism তত্ত্বের তাত্ত্বিকগণ স্বীকারও করেন। তবে পাশাপাশি তারা এটিও বলেন যে, উপনিবেশবাদের সাংস্কৃতিক ও বস্তুগত উপাদানগুলো একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে। তারা বলেন, এখানে যদি শুধু বস্তুগত উপাদানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী উপাদানগুলো আধুনিক বিশ্বকে প্রভাবিত করেছে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণে ঘাটতি থেকে যায়।
যেমনঃ Post-colonialism তত্ত্বের জনপ্রিয় লেখক Edward Said বলেন, ক্লাসিক্যাল সাম্রাজ্যবাদ বা ক্লাসিক্যাল উপনিবেশবাদের একটি মৌলিক উপাদান ছিলো উপনিবেশিক অঞ্চলে বা সমাজে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বাস্তবায়ন। এই সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির সফল চাষাবাদই আফ্রিকা, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন উপনিবেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদকে সফলভাবে টিকিয়ে রেখেছিলো। সমীকরণটি ছিলো এরূপ: এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বর্বর (Savage), অসভ্য (Uncivilized)-দের ‘সভ্য’ (Civilized) করতে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অধিক। অর্থাৎ, ইউরোপীয় ‘সভ্য’ (European Civilized) বনাম অন্যান্য অঞ্চলের ‘অসভ্য’ (Others Uncivilized)-দের মাঝে মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজনে, ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের ‘সভ্য’ সংস্কৃতির অধীনে অত্র অঞ্চলের 'অসভ্যদের’ রাখবে যাতে তারা সাম্রাজ্যবাদীদের ন্যায় সভ্য হয়ে উঠতে পারে।
Edward Said বলেন, ইউরোপের সভ্যদের বাদে অন্যান্য অঞ্চলের অসভ্যদের বুঝাতে পশ্চিমারা “The White Man’s Burden” কথাটি উল্লেখ করতেন, এবং এই বিপত্তি (Burden) প্রতিরোধে সাম্রাজ্যবাদীরা “Mission Civilisatrice” বা ‘সভ্য করার মিশন’ চালু করেন, যাতে সাম্রাজ্যবাদের আলোকে সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটিয়ে উক্ত অসভ্যদের সভ্য করা যায়। এই রূপান্তরের অজুহাতে, অর্থাৎ, সাম্রাজ্যবাদ বিকাশে উপনিবেশিক শক্তি অত্র “অসভ্যদের” প্রতি অত্যাচার- নির্যাতনের যেমন বৈধতা (Legitimacy) পায়, তেমনি সাংস্কৃতিক রূপান্তরের প্রয়োজনে উপনিবেশিক অঞ্চলে নানা বস্তুতান্ত্রিক অবকাঠামো বা উপনিবেশিক এন্ট্রাপ্রাইজ গড়ে তোলে।
এমনও দেখা যায় যে, Post-colonialism তত্ত্বের অনেক লেখক, যারা মার্কসবাদী আদর্শের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত, তারাও স্বীকার করছেন যে, কার্ল মার্কসের মার্কসবাদ তত্ত্ব মূলত ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রেক্ষাপটে বিকশিত হয়েছে। যদিও মার্কস পৃথিবীর সকল শ্রমিকের মুক্তির কথা বলেছেন, তার মার্কসবাদ তত্ত্বের ভিত্তি ছিল মূলত ইউরোপীয় শ্রমিকদের শোষণমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। Post-colonialism-ই একমাত্র তত্ত্ব যা মার্কসবাদ এবং কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে।
মার্কসের দার্শনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তা ও লেখনির মূল প্রভাব ছিল উনিশ শতকের ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের পরিবেশ। বিশেষ করে, জার্মান (প্রুশিয়া), ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের প্রভাবশালী দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকদের লেখা ও ঐ দেশের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত মার্কসবাদ তত্ত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। Post-colonialism-এর তাত্ত্বিকরা বলেন, যদিও মার্কস বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর কথা স্মরণ করেছেন, তার বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা ও সুপারিশ ছিল মূলত ইউরোপ-কেন্দ্রিক। উদাহরণস্বরূপ, মার্কস তার শ্রেণী সংগ্রাম (Class Struggle) তত্ত্বে অর্থনৈতিক উপাদানকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের ধারণা উপস্থাপন করেন। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত সামাজিক বিন্যাসের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যেমন—বর্ণ (Race), লিঙ্গ (Gender), গোত্র (Caste), ও নৃগোষ্ঠী (Ethnicity) ইত্যাদির প্রভাবকে মার্কসবাদ প্রায়ই অবজ্ঞা করেছে বা এড়িয়ে গেছে।
এক্ষেত্রে Post-colonialism তত্ত্বের তাত্ত্বিকরা সামাজিক বিন্যাস, সামাজিক রূপান্তর এবং সামাজিক পরিচিতির গঠনে এসব উপাদানের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। তারা মনে করেন, এই উপাদানগুলো প্রায়শই পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় জড়িত থেকে শ্রেণী বিন্যাসকেও প্রভাবিত করে, যা সমাজের জটিলতা ও বৈচিত্র্য বোঝার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।
Post-colonialism- তত্ত্বের সূচনা:
Post-colonialism তত্ত্ব কোনো একক লেখক বা নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার মাধ্যমে উদ্ভূত হয়নি। বরং, এটি একাধিক প্রভাবশালী লেখক ও ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে বিকশিত হয়েছে। বিশেষ করে সাবেক উপনিবেশভুক্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা কিছু মহান সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ, যেমনঃ Chinua Achebe, Ngugi wa Thiong’o, Wole Soyinka এবং Ousmane Sembene প্রমূখের রচনাগুলো Post-colonialism তত্ত্বের সূচনা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাদের লেখনির মাধ্যমে এই তত্ত্বের বীজ বোনা হয় এবং তা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়।
এরপর ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে সাহিত্য সমালোচকরাও Post-colonialism তত্ত্ব বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তারা ঔপনিবেশিক যুগের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে Post-colonialism তত্ত্বের দার্শনিক ও সমালোচনামূলক ভিত্তি গড়ে তোলেন। এ ছাড়া Subaltern Study Group-এর অবদানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, যারা ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও সমাজকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে পুনঃমূল্যায়ন করে উপনিবেশিক শাসনের নানান অসঙ্গতি তুলে ধরেন।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত ঔপনিবেশোত্তর ঘটনাপ্রবাহও Post-colonialism তত্ত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৫ সালের ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং সম্মেলনে বিশ্বশক্তির আধিপত্যের বিরুদ্ধে নতুন এক আন্তর্জাতিক সংহতির সূচনা হয়। একইভাবে মিশর, ঘানা, ভারত, কিউবা, ভিয়েতনাম, চীনসহ বহু দেশের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলন ঔপনিবেশিক শক্তির পতনে সহায়ক হয়। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা Post-colonialism তত্ত্বের তাত্ত্বিক ভিত্তি আরও দৃঢ় ও সমৃদ্ধ করেছে।
বিশেষ করে, বিংশ শতাব্দীর উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম ও আন্দোলনগুলো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের মানসিকতা ও মনোভঙ্গির সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা মূলত ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদের (European Superiority) ভিত্তিকে গভীরভাবে চ্যালেঞ্জ করে। এসব আন্দোলন Post-colonialism তত্ত্বের জ্ঞানের পরিসরকে উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলন, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা ও আলজেরিয়ায় মার্কসবাদী ও মাওবাদী আদর্শভিত্তিক বিপ্লব, এসব সম্মিলিতভাবে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বদৃষ্টিকে চ্যালেঞ্জ জানায় এবং Post-colonial আলোচনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
এই বি-উপনিবেশিকরণ (Decolonization) আন্দোলনগুলো Post-colonialism তত্ত্বের জন্য নতুন ধারণা, কাঠামো ও বয়ান গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। Post-colonialism-এর তাত্ত্বিকরা আধুনিকতা, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতীয়তা প্রভৃতি প্রেক্ষাপটে প্রচলিত ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী বয়ানকে সমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করেন। Gandhi, Frantz Fanon, Albert Memmi প্রমুখ উপনিবেশবিরোধী নেতারা জোর দিয়ে বলেছিলেন, বি-উপনিবেশিকরণ কেবল সাম্রাজ্যবাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত শাসন থেকে মুক্তির নাম নয়; বরং এর অর্থ সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির মূল শিকড় উপড়ে ফেলা, যা ছাড়া প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়।
তারা আরও জোর দিয়ে বলেন যে, কেবল কাঠামোগত বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জনই যথেষ্ট নয়, কারণ সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও দমনমূলক চর্চার অবসান একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ভাঙন ঘটাতে প্রয়োজন ছিল এমন এক বিকল্প, স্থানীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ, যা ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের বিপরীতে দাড়াতে পাড়বে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তা, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্নির্মাণে সক্ষম হবে। এটি শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, বরং মানসিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির পথও সুগম করবে—যা পোস্ট-কলোনিয়াল সমাজকে নিজের মর্যাদা, পরিচয় ও আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।
Post-colonial পরিস্থিতিকে অনেক বিশেষজ্ঞ ‘প্যারাডক্স’ বা বৈপরীত্যের সঙ্গে তুলনা করেন। কারণ, সাবেক উপনিবেশভুক্ত দেশের মানুষদের মধ্যে তাদের ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি একদিকে যেমন ভীতি, রাগ বা ঘৃণা কাজ করে, অন্যদিকে আবার সেই শাসকদের সংস্কৃতি, আদর্শ কিংবা আধুনিকতার ধারায় টান অনুভূত হয়। অর্থাৎ, সাবেক উপনিবেশিক দেশগুলো তাদের ঔপনিবেশিক অতীতের স্মৃতিচারণ থেকে মুক্তি চায়, কিন্তু একই সঙ্গে তারা সেই পুরনো শাসকদের মতো আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতেও আগ্রহী। Post-colonialism- তত্ত্ব এই দ্বৈত মনোভাব এবং জটিল মানসিকতার প্রকৃত রূপ আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে।
Post-colonial কথাসাহিত্য, বিশেষ করে উপন্যাস, Post-colonialism- তত্ত্বের ভিত্তি রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রথম প্রজন্মের Post-colonial কথাসাহিত্যিকেরা তাদের রচনায় তুলে ধরেন কীভাবে ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক আদলে, বিশেষ করে বর্ণ (Racial) ও লিঙ্গভিত্তিক (Gendered) দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে ওঠা জাতীয় পরিচিতি (National Identity) নির্মিত হয়েছিল। তারা এসব পুরনো পরিচিতিকে ভেঙে নতুন জাতীয় পরিচিতি নির্মাণের চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘আনন্দমঠ’, ‘পথের দাবী’, ‘যুগবাণী’ ইত্যাদি সাহিত্যকর্ম এই প্রক্রিয়ার অংশ।
তবে, পুরনো পরিচিতি ভুলে যাওয়া এবং নতুন পরিচিতি বা সাংস্কৃতিক রূপান্তর সৃষ্টি করা মোটেও সহজ কাজ নয়। এই প্রচেষ্টায় ঔপনিবেশবাদের অনেক সংস্কৃতি ও অভ্যাস আজও রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, Post-colonial তত্ত্বের কথাসাহিত্যে দেখা যায় কিভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের ভাষাকে ধরে রেখে জাতীয় পরিচিতি গড়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে, Wole Soyinka-এর মত Post-colonial লেখকরা স্থানীয় চলিত ভাষাকে জাতীয় পরিচিতি পুনঃনির্মাণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, আবার Ousmane Sembene স্থানীয় ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণকে এই প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেছেন।
ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি কীভাবে জাতীয় পরিচিতিকে (National Identity) প্রভাবিত করেছে এবং আধুনিক রাষ্ট্রের বয়ান নির্মাণে ভূমিকা রাখছে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণে Edward Said-এর লেখনী অত্যন্ত কার্যকর। Said তাঁর Post-colonialism তত্ত্বের বিকাশে Michel Foucault ও Antonio Gramsci-এর চিন্তাধারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ‘Orientalism’ তত্ত্বে Said তুলে ধরেন যে, ইউরোপ কেন্দ্রিক আধুনিক জ্ঞানের বিকাশে উপনিবেশিক পশ্চিমা সাম্রাজ্যের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য।
Said ব্যাখ্যা করেন, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের শাসন বজায় রাখতে একটি বিশেষ উপনিবেশিক প্রকল্প গ্রহণ করেছিল, যার মাধ্যমে তারা প্রাচ্যের অর্থাৎ উপনিবেশভুক্ত অঞ্চলের উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক পরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করতো। উপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়ার পরও সাবেক উপনিবেশ রাষ্ট্রগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের উপাদান এখনো স্পষ্টভাবে বিরাজমান।
Edward Said বলেন, সাবেক উপনিবেশভুক্ত রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পশ্চিমা প্রকল্প অনুসরণের প্রবণতাটি দুইটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ: (ক) এর মাধ্যমে সাবেক উপনিবেশে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক উপাদানের অবস্থান আরও দৃঢ় হয়, এবং (খ) এই দৃঢ় অবস্থান অ-পশ্চিমি বা প্রাচ্যের সঙ্গে পশ্চিমাদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বিস্তারের মূল লক্ষ্য। Said তার বিখ্যাত Orientalism গ্রন্থে দাবি করেন যে, আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে উপনিবেশিক শক্তির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে থাকা সমাজতত্ত্ব বা বস্তুবাদী জ্ঞানের সঙ্গে উপনিবেশিক শক্তির নিবিড় সংযোগ রয়েছে। তাই আধুনিক সময়, আধুনিক ভাষ্য ও আধুনিক কর্মকাণ্ড (Agency) বোঝার জন্য জ্ঞান ও শক্তির (Knowledge and Power Nexus) মধ্যকার সম্পর্ককে অনুধাবন করাটা অপরিহার্য।
Post-colonialism তত্ত্বের তাত্ত্বিক কাঠামো গঠনে Subaltern Studies এর ভূমিকাও অসাধারণ। এই জ্ঞানের শাখাটি Antonio Gramsci-এর সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ (Cultural Hegemony) তত্ত্ব থেকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এখানে সমাজের প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাস বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়। বেশিরভাগ সময় এই শাখা দক্ষিণ এশিয়া ও তার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ওপর গুরুত্বারোপ করে, এবং এর প্রধান প্রবক্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দক্ষিণ এশিয়ার পণ্ডিতগণ।
Post-colonialism আদতে কী?
আসলে, Post-colonialism ধারণাটি বোঝার জন্য কোনো একক পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি নেই। বরং কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আমরা এই তত্ত্বের মূল ধারণাগুলো অনুধাবন করতে পারি। যেমন:
১। Post-colonialism তত্ত্বটি সাম্রাজ্যবাদের এক সংকটকালীন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে তার তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তোলে। এই সংকটকালীন মুহূর্তটি আধুনিক বিশ্ব বিনির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার কাঠামো মূলত সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদের উত্থান-পতনের দোলাচালে গড়ে উঠেছে, যেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোও নিজস্ব অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক লিগ্যাসি বা উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় উপমহাদেশকে নেওয়া যেতে পারে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন (১৭৫৭–১৯৪৭) এই অঞ্চলের প্রশাসনিক কাঠামো, বিচারব্যবস্থা, রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, শিক্ষা পদ্ধতি এবং ইংরেজি ভাষার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। স্বাধীনতার পর ভারত, পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে স্বশাসিত হলেও তারা উপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে—যেমন Westminster ধাঁচের সংসদীয় গণতন্ত্র, ইংরেজি আইন ব্যবস্থা (Common Law), এবং ঔপনিবেশিক আমলের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো। একদিকে এই রাষ্ট্রগুলো নতুন জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে প্রাক্তন উপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এভাবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরও সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উপনিবেশিক প্রভাব অব্যাহত থাকা Post-colonialism তত্ত্বের ক্ষমতা, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের দ্বন্দ্বকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে।
২. Post-colonialism তত্ত্বের প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো জ্ঞান ও শক্তির মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করা। মানবিক, সমাজবিজ্ঞান ও অন্যান্য শাখার অনেক বিশেষজ্ঞের মধ্যে, বিশেষ করে ভাষা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপকেন্দ্রিক প্রবণতা লক্ষণীয়। এই ইউরোপকেন্দ্রিক জ্ঞানের উৎস, যেমন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, গভীরভাবে ঔপনিবেশবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং এটি আমেরিকা ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে মজবুত করতে ব্যবহৃত হয়। Post-colonialism তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য হলো এই ইউরোপকেন্দ্রিক জ্ঞানকে স্থানীয় পর্যায়ের জ্ঞানের দ্বারা প্রতিস্থাপন করা। অর্থাৎ, পাঠ্যপুস্তকে প্রচলিত ধারণাগুলো, যা অধিকাংশই ইউরোপ ও আমেরিকা কেন্দ্রিক উৎস থেকে এসেছে, তাদের প্রশ্ন করা এবং ঐ ধারণার আসল উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপটের আলোকে তা বিশ্লেষণ করা।
উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস শিক্ষাকে ধরা যেতে পারে। ঔপনিবেশিক আমলে লেখা অনেক ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে ব্রিটিশ শাসনকে “সভ্যতার অগ্রদূত” হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল, যেখানে রেলপথ নির্মাণ, আধুনিক শিক্ষা বা প্রশাসনিক সংস্কারকে প্রধান সাফল্য হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু পোস্ট-কলোনিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি এসব বিবরণকে প্রশ্ন করে—যেমন, রেলপথ কি সত্যিই স্থানীয় উন্নয়নের জন্য ছিল, নাকি কাঁচামাল দ্রুত ইউরোপে পাঠানোর উপায়? আধুনিক শিক্ষা কি জনগণকে আলোকিত করার জন্য, নাকি শাসন ব্যবস্থার জন্য উপযোগী কর্মচারী তৈরির জন্য? এইভাবে ইউরোপকেন্দ্রিক বর্ণনার বদলে স্থানীয় জনগণের অভিজ্ঞতা, প্রতিরোধ আন্দোলন, সাংস্কৃতিক ধ্বংস ও অর্থনৈতিক শোষণের দিকগুলোকে সামনে আনা হয়, যা স্থানীয় জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেয়।
৩। Edward Said, Chandra Mohanty, Gayatri Spivak, এবং Trinh Minh-ha-র বিস্তর লেখনিতে স্পষ্ট হয় যে, রাজনৈতিক ও বস্তুগত (সামরিক ও অর্থনৈতিক) শক্তির সঙ্গে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির একটি গভীর যোগসূত্র রয়েছে, যার মাধ্যমে পশ্চিমারা নিজেদের “Others” থেকে আলাদা করতে চায়। বিশেষ করে, Chandra Mohanty তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Under Western Eyes: Feminist Scholarship and Colonial Discourse-এ দেখিয়েছেন কিভাবে পশ্চিমা নারীবাদের ধারণা, যেমন “Third World Women,” উপনিবেশিক চিন্তার এক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কাজ করে।
পশ্চিমা নারীবাদীরা “Third World Women” ধারণার মাধ্যমে এক ধরনের একপাক্ষিক বিশ্লেষণ তুলে ধরে, যেখানে পশ্চিমা নারীদের শিক্ষিত, স্বাধীন এবং অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু, তৃতীয় বিশ্বের সাবেক উপনিবেশভুক্ত দেশের নারীদের পরাধীন, নিরক্ষর, বন্দিত্ব বা অবরোধবাধিত বলে চিত্রায়িত করা হয়। বিশ্ব মিডিয়া ও একাডেমিয়া পশ্চিমাদের সহায়ক হওয়ায়, এই পশ্চিমা নারীবাদী জ্ঞানের প্রসার এবং প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
এর সাথে আমরা পূর্বে Edward Said-এর কথা উল্লেখ করেছিলাম, যিনি দেখিয়েছেন কিভাবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উপনিবেশভুক্ত সমাজকে ‘সভ্য করার মিশনে’ নেমেছিল। এই বয়ান তাদের ঔপনিবেশিক কাঠামোকে বৈধতা প্রদান করে। সভ্য করার এই প্রক্রিয়ার দুটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো—বর্ণতাত্ত্বিক (racial) এবং লিঙ্গভিত্তিক (gendered) সাংস্কৃতিক রূপান্তর। অর্থাৎ, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সমাজগুলোকে ইউরোপীয়দের মতো উন্নত, উদার ও আধুনিক মনস্ক মনে করা হয়নি। বরং এই সমাজগুলোতে বর্ণ ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের উপস্থিতি পশ্চিমা সমাজের চেয়ে বেশি বলে ধরা হয়েছে।
ফলে, পশ্চিমা নারীবাদী সংস্কৃতির আলোকে এই উপনিবেশভুক্ত সমাজগুলোকে রূপান্তর করার চেষ্টা আজও চলে, যা আধুনিক যুগেও স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। Post-colonialism তত্ত্ব নির্দেশ করে, এই নারীবাদী আদর্শকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আবারো বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
৩। Post-colonialism- তত্ত্বের তাত্ত্বিকদের একটি বড় অংশ মার্কসবাদ তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত। তা সত্বেও, উপনিবেশ নির্মাণ, উত্তর-উপনিবেশ ও জাতীয় শক্তির মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্লেষণে তারা মার্কসবাদের মত শুধু অর্থনৈতিক বস্তুতান্ত্রিকতাকে প্রাধান্য না দিয়ে, উপরন্তু, বর্ণ (Race), নৃগোষ্ঠী (Ethnicity), লিংগ (Gender), গোত্র (Caste), ধর্ম, জাতিরাষ্ট্র ও সামাজিক শ্রেণি বিন্যাসের (Social Class) আলোকে উপনিবেশ, উপনিবেশ-পরবর্তী যুগ, ও জাতীয় শক্তির মধ্যে সম্পর্ক নিরূপনের চেষ্টা করেন। এই বিকল্প তবে কার্যকরী গবেষণা পদ্ধতির সাহায্যে মার্কসবাদী Post-colonialism- তত্ত্বের তাত্ত্বিকদের কাছে, পশ্চিমা আদলে গড়া আন্তর্জাতিক শক্তি কাঠামো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এবং এই পদ্ধতির সাহায্যে তারা শক্তি সম্পর্কে প্রচলিত স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বয়ানগুলোকে গভীরভাবে ব্যাক্ষা করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, Frantz Fanon-এর কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ফ্যানন মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হলেও তিনি শুধু অর্থনৈতিক শোষণের দিকটিই দেখেননি; বরং বর্ণ, সংস্কৃতি, মানসিকতা ও পরিচয়কে কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসন প্রভাবিত করেছে, সেটিও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর Black Skin, White Masks গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক শাসন শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক স্তরেও উপনিবেশিত জনগণকে প্রভাবিত করে, যেখানে শাসিতরা ধীরে ধীরে শাসকের ভাষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে নিজেদের মানসিক কাঠামোর অংশ বানিয়ে নেয়। একইভাবে, Gayatri Chakravorty Spivak ও Homi K. Bhabha–এর মতো তাত্ত্বিকরা জাতি, গোত্র, লিঙ্গ ও সামাজিক শ্রেণি বিন্যাসের মতো বিষয়কে বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যাতে বোঝা যায় পশ্চিমা ধাঁচের আন্তর্জাতিক শক্তি কাঠামো কীভাবে স্থানীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। এভাবে Post-colonial মার্কসবাদী বিশ্লেষণ অর্থনৈতিক বস্তুতান্ত্রিকতার সীমা ছাড়িয়ে বহুমাত্রিক সামাজিক বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে আসে।
৪. অধিকাংশ Post-colonialism- তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা এই তত্ত্বটি দ্বারা Modernity বা আধুনিকতাকে সমালোচনার সুরে ব্যাক্ষা করতে চান। এই তাত্ত্বিকদের ভাষায়, আধুনিকতা ধারণার উন্মেষ ঘটে ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় রেনেসাঁস প্রেক্ষাপটে। তবে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, আধুনিকা ধারণার বিস্তার ঘটে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের বদৌলতে। উপনিবেশের পরিধি যত বেড়েছে, ইউরোপীয় আধুনিকতার ছবক তত বৈশ্বিক হয়েছে। এছাড়াও, উত্তর আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ইতিহাসও ইউরোপীয় আধুনিকতার ধারণায় জায়গা করে নিয়েছে, এবং “আধুনিকতা” ধারণাটি সার্বজনীন হয়েছে।
পরবর্তীতে, পশ্চিমারা নিজেদের আধুনিক ও উন্নত পরিচয়ে পরিচিত করতে থাকে। তারা প্রচার করে, আধুনিকতার মাধ্যমেই উন্নত হওয়া যায় (Theory of Modernization), আধুনিকতার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আধুনিকতার মাধ্যমে একটি অগ্রসর, যৌক্তিক ও নিরাপদ রাষ্ট্র গড়ে তোলা যায়। এভাবে, পশ্চিমা শক্তি পরিচয়ের এক নতুন সমীকরণ প্রচার করে। অর্থাৎ, আধুনিক হওয়া মানে উন্নত হওয়া, আর প্রথাগত থাকা মানে অনুন্নত থাকা।
ফলে, বি-উপনিবেশ প্রক্রিয়ায় যে নতুন নতুন রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে, তারা পশ্চিমা শক্তির অত্র সমীকরণের ফাঁদে পা দেয়। তারা পশ্চিমের মত উন্নত হতে হবে এই চিন্তায় আধুনিকতার নানা প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে শুরু করে, বিশেষত উদারনৈতিক অর্থনীতি ও বিশ্বায়নে। এভাবেই, আধুনিকতার ধারণাকে বিশ্লেষণ করে Post-colonialism- তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিক্রমা অনুধাবনে সাহায্য করে।
৬. Post-colonialism- তত্ত্বে জাতিরাষ্ট্র (Nation) এবং জাতীয়তাবাদ (Nationalism)-কে খুবই গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণ করা হয়। এর প্রধান কারণ, Post-colonialism- তত্ত্বটির বিকাশে জাতিরাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের বড় ভূমিকা রয়েছে। যেমন ধরুন, Post-colonialism- তত্ত্বের প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে ওঠ বি-উপনিবেশ প্রক্রিয়ার উপর। এই বি-উপনিবেশ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছিলো জাতীয়তাবাদী শক্তির মাধ্যমে।
এই জাতীয়তাবাদ, স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রকে স্বতন্ত্র পরিচয়ের (Identity) দিকে ধাবিত করে। যে পরিচয় গড়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের আলোকে। এই জাতীয়তাবাদ প্রভাবিত স্বতন্ত্র পরিচিতি জাতিরাষ্ট্রের সামনে ঔপনিবেশিক পরিচিতি ও সাংস্কৃতিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে যাতে উপনিবেশিক বয়ান নির্মিত পরিচিতিকে (Colonial constructed Identity) তারা প্রত্যাখ্যান করে, এবং তার বদলে নিজেদের স্থানীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসকে তারা প্রাধান্য দিতে শেখে।
তবে, সাম্প্রতিক Post-colonialism- তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের স্বতন্ত্র পরিচিতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারা বলেন, যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এই জাতিরাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে তার কেন্দ্রে আছে অন্য এক সামাজিক বয়ান- “Imagined Community” বা কল্পিত সমাজ। নতুন এই Post-colonialism- তত্ত্বের তাত্ত্বিকেরা বলেন জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের নিমিত্তে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের যে স্বতন্ত্র পরিচিতি গড়ে উঠেছে, সেখানে নৃগোষ্ঠি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ প্রভৃতিকে নির্ধারকের ভিত্তিতে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের স্বতন্ত্র পরিচিতি বা কল্পিত সমাজ তৈরি হয়। অর্থাৎ, এই নির্ধারকের অংশ হলে তুমি জাতিরাষ্ট্রের অত্র কল্পিত সমাজের অংশ, না হলে তুমি অন্য কোন পরিচয়ের অধিকারী। এভাবে জাতিরাষ্ট্র ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করে।
উপসংহার
Post-colonialism- কেবল একটি সাহিত্যিক বা তাত্ত্বিক ধারা নয়, বরং এটি উপনিবেশ-পরবর্তী বাস্তবতাকে বোঝার একটি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি। এই তত্ত্ব ক্ষমতা, সংস্কৃতি, ভাষা ও পরিচয়ের জটিল সম্পর্ককে উন্মোচিত করে, যেখানে উপনিবেশবাদের উত্তরাধিকার এখনও রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরে বিদ্যমান। Post-colonial বিশ্লেষণ আমাদের শেখায় যে মুক্তির ঘোষণার পরেও প্রকৃত মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সাংস্কৃতিক বহুত্বকে সম্মান করা হয়, এবং উপনিবেশিক মানসিকতার অবসান ঘটে। অতএব, Post-colonialism-কেবল অতীতের সমালোচনা নয়, বরং এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও ন্যায়, সমতা এবং আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের আহ্বান।
-ভাবানুবাদ
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল লেখকঃ
গীতা চৌধুরি
নর্দান এরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়,
এরিজোনা, যুক্তরাষ্ট্র
নর্দান এরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়,
এরিজোনা, যুক্তরাষ্ট্র


No comments