Header Ads

Header ADS

Treaty, Convention, Doctrine ও বিধিবদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

Part of the clay tablet of Kadesh Treaty written in Akkadian


ভূমিকা:

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল ও বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, সহযোগিতা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির নিমিত্তে একটি সুসংহত, বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আইনি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। এই আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠায় ও রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক আইন শুধু রাষ্ট্রের আচরণ নিয়ন্ত্রণই করে না, বরং এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কেও একটি স্পষ্ট ও কাঠামোবদ্ধ ধারণা প্রদান করে।

বিভিন্ন উপাদান সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক আইন গঠিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চুক্তি (Treaty), কনভেনশন (Convention), রেজুলেশন (Resolution), চুক্তিপত্র (Agreement), এবং সমঝোতা স্মারক (MoU)। এই উপাদানগুলো রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং পারস্পারিক সম্পর্ক পরিচালনের এক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যদিও প্রতিটি উপাদানের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব পৃথক, তবুও তারা একে অপরের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

আধুনিক বিশ্বে আন্তর্জাতিক আইনের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সন্ত্রাসবাদ, শরণার্থী সংকট, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধানে আন্তর্জাতিক আইন এক নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য কাঠামো। তবে আন্তর্জাতক আইনের কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের আন্তরিকতা, সদিচ্ছা এবং দায়িত্বশীল আচরণের উপর।

এই প্রবন্ধে আমরা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় উপাদান, যথাঃ চুক্তি, কনভেনশন, রেজুলেশন, সমঝোতা স্মারক এবং চুক্তিপত্র সম্পর্কে আলোচনা করবো যাতে আমাদের নিকট আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পথ আরও সুগম হয়।

১. আন্তর্জাতিক চুক্তি (Treaty)

আন্তর্জাতিক চুক্তি (Treaty) এমন একটি লিখিত ও আনুষ্ঠানিক দলিল, যার মাধ্যমে দুই বা ততোধিক পক্ষ (রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থা) কোন নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ওপর পারস্পরিক সম্মতি প্রদান করে এবং সে সম্মতি একটি দলি্ল হয়ে উভয়ের পারস্পারিক সম্পর্ক পরিচালনায় এক আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধী্ন এবং এর মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী পক্ষসমূহের অধিকার, দায়িত্ব, ও আচরণ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক মৌলিক ও অপরিহার্য উপাদান, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক সহযোগিতা, নিরাপত্তা, বাণিজ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, মানবাধিকার রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো নানাবিধ বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান সুসংহত করে। আন্তর্জাতিক চুক্তি কেবল একটি লিখিত দলিল নয়; এটি একাধারে একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, একটি আইনগত কাঠামো, এবং একটি পারস্পরিক আস্থার প্রকাশ। চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহ শুধু নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে না, বরং একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অংশ হিসেবে কাজ করে, যেখানে প্রতিটি পক্ষের সম্মান, অধিকার এবং দায়িত্বকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়।

১৯৬৯ সালে আন্তর্জাতিক চুক্তি সংক্রান্ত অন্যতম মৌলিক ও বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত আইনি দলিল Vienna Convention on the Law of Treaties স্বাক্ষরিত হয়। এই দলি্লের অনুচ্ছদে ২(১)(ক)- তে আন্তর্জাতিক চুক্তির একটা সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছেঃ

“A treaty is an international agreement concluded between States in written form and governed by international law, whether embodied in a single instrument or in two or more related instruments and whatever its particular designation.”

-” একটি (আন্তর্জাতিক) চুক্তি হল কতিপয় রাষ্ট্রের মাঝে সম্পাদিত লিখিত এক দলি্ল। এটি আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। এর নাম বিভিন্ন হতে পারে (যেমনঃ Treaty, Convention, Agreement, Protocol, Charter, বা অন্য কোনো উপাধি)।”

আন্তর্জাতিক চুক্তির বৈশিষ্ট্যঃ

আন্তর্জাতিক চুক্তি কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি বৈধ, বাধ্যতামূলক, এবং কাঠামোবদ্ধ দলিল। নিচে আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করা হলো:

ক. লিখিত এবং আনুষ্ঠানিক দলিলঃ

আন্তর্জাতিক চুক্তির (Treaty) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো, এটি সর্বদাই লিখিত রূপে সম্পাদিত হতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায়, মৌখিক চুক্তি কোনো রাষ্ট্রের জন্য আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈ্রি করে না এবং কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে তা কার্যকর দলিল হিসেবেও গৃহীত হয় না। এ কারণে, রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পাদিত প্রতিটি চুক্তি একটি নির্দিষ্ট কাঠামো ও ভাষায়, লিখিত রূপে প্রস্তুত করা হয়, যেখানে প্রতিটি পক্ষের আইনগত অধিকার, দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকে। এই লিখিত দলিলই ভবিষ্যতে যে কোনো বিরোধ বা ভুল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি আইনগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে এবং বহুসংখ্যক দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এসব চুক্তির সবই লিখিত দলিল হিসেবে স্বীকৃত এবং তা অনুমোদন (Ratification) ও কার্যকারিতার জন্য সংসদীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে। যেমনঃ ১৯৯৬ সালের বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এই চুক্তিটি লিখিতভাবে দুই দেশ স্বাক্ষর করে, যাতে ফারাক্কা বাঁধ থেকে গঙ্গার পানি নির্ধারিত সময়কালের জন্য তা কীভাবে ভাগ করা হবে, তার নির্দিষ্ট হিসাব ও বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি ত্রিশ বছর মেয়াদি একটি আইনি দলিল, যা ভবিষ্যতের জন্য দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টনের একটি লিখিত রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ২০১২ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ক চুক্তি। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ের ভিত্তিতে সম্পাদিত এই লিখিত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল (Exclusive Economic Zone – EEZ) এবং মহীসোপান (Continental Shelf) নির্ধারিত হয়। এটি শুধু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের অধিকার সুনিশ্চিত করে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের মধ্যে স্বাক্ষরিত BEPA (Bangladesh-Japan Economic Partnership Agreement) চুক্তিও একটি লিখিত দলিল, যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও জোরদার হয়েছে। এই চুক্তিতে ট্যারিফ হ্রাস, অবকাঠামোগত বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা সংক্রান্ত বিষয়সমূহ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত রয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই চুক্তিগুলোর প্রতিটি লিখিত হওয়ার কারণে তা শুধু আন্তর্জাতিক আইনগতভাবে স্বীকৃত নয়, বরং বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে এই চুক্তিগুলোকে নির্ভরযোগ্য ও বৈধ ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। চুক্তির লিখিত রূপ রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ভবিষ্যৎ জটিলতা নিরসনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

খ. আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক হতে পারে

আন্তর্জাতিক চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হলো, আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক উভয় ধরনের হতে পারে। যখন কোনো চুক্তি মাত্র দুটি রাষ্ট্র বা পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়, তখন তা দ্বিপাক্ষিক (bilateral) চুক্তি হিসেবে পরিচিত পায়। আর যদি তিন বা ততোধিক রাষ্ট্র এই চুক্তির অংশ হয়, তবে তা বহুপাক্ষিক (multilateral) চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই গঠনগত পার্থক্য চুক্তির সুযোগ-সুবিধা, বাধ্যবাধকতা এবং কার্যকারিতাকেও নানা মাত্রায় প্রভাবিত করে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির বাস্তবতায়, বাংলাদেশ এই দুই ধরনের চুক্তিরই অংশ। উদাহরণস্বরূপঃ ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ গঙ্গা নদীর পানি নির্ধারিত মৌসুমে কীভাবে ভাগাভাগি করবে তা নির্দিষ্ট হয়, এবং চুক্তিটি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পানি-কেন্দ্রিক রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সাধারণত দুই দেশের স্বার্থ, সীমান্ত, পানি, বাণিজ্য বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় কেন্দ্রিক হয়ে থাকে এবং তা উভয় পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

অন্যদিকে, বহুপাক্ষিক চুক্তির ক্ষেত্রে একাধিক রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের কারণে এর ব্যাপ্তি ও প্রভাব বিস্তৃত । যেমনঃ ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি (Paris Climate Agreement) একটি বহুপাক্ষিক চুক্তি, যাতে প্রায় সব দেশ স্বাক্ষর করে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় সম্মিলিত বৈশ্বিক উদ্যোগের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপি্ত হয়। বাংলাদেশ এই চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে এর মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও অভিযোজন সহায়তা লাভের সুযোগ পেয়েছে।

এছাড়াও বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিভিন্ন চুক্তি ও কনভেনশনে (যেমন: UNCLOS – সমুদ্র আইন বিষয়ক কনভেনশন, WTO-এর প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তি) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। এসব চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায়ই অংশ নিচ্ছে না, বরং নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় করছে।

গ. আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতাঃ

চুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদনকারী রাষ্ট্রসমূহের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতা তৈরি করাও আন্তর্জাতিক চুক্তির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোনো বৈধ ও লিখিত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর ও অনুমোদনের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র চুক্তির শর্তাবলি মেনে চলতে আইনত বাধ্য থাকে। এই বাধ্যবাধকতা শুধু নৈতিক বা রাজনৈতিক নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার আওতাধীয়। যদি কোনো পক্ষ চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে, তবে আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা এবং বিরূপ কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা অনেকক্ষেত্রে চুক্তিতেই উল্লেখিত থাকে।

আন্তর্জাতিক আইনত বাধ্যতামূলক বহু চুক্তির স্বাক্ষরদাতা ও অনুমোদনকারী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই চুক্তিগুলোর ফলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে কিছু নির্দিষ্ট আইনগত দায়িত্ব পালনের প্রতি বাধ্যগত থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৯ সালে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (Treaty on the Non-Proliferation of Nuclear Weapons - NPT)-তে স্বাক্ষর করে। এই বহুপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ একটি non-nuclear weapon state হিসেবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, অর্থাৎ, বাংলাদেশ কখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বা অর্জন করবে না এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি শুধু শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে। এই প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বা কূটনৈতিক চাপের সম্মুখীন হতে পারে।

এছাড়া বাংলাদেশ International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR), Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women (CEDAW), এবং United Nations Convention on the Law of the Sea (UNCLOS)-এর মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি অনুমোদন করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে মানবাধিকার, নারী অধিকার, ও সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইনসমূহ মেনে চলার বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করেছে।

এইসব চুক্তি শুধু বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির ধারাকে প্রভাবিত করে না, বরং অভ্যন্তরীণ আইনি কাঠামোতেও পরিবর্তনের দাবি তোলে, যাতে আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। ফলে, আন্তর্জাতিক চুক্তির আইনগত বাধ্যবাধকতা কেবল কূটনৈতিক মর্যাদার প্রশ্ন নয়, বরং একটি দায়িত্বশীল ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অন্যতম মাধ্যম।

ঘ. চুক্তি সম্পাদনের ধাপসমূহঃ

আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর হওয়ার জন্য এটি শুধু স্বাক্ষর করাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, যাতে চুক্তিটি একটি বৈধ ও বাধ্যতামূলক আইনি দলিল হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। সাধারণত এই প্রক্রিয়া তিনটি মূল ধাপে সম্পন্ন হয়: স্বাক্ষর (Signature), অনুমোদন বা অনুসমর্থন (Ratification), এবং কার্যকারিতা (Entry into Force)।

প্রথম ধাপ, স্বাক্ষর, মূলত একটি রাজনৈতিক সম্মতির বহিঃপ্রকাশ। এই পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র বা সরকার চুক্তির মৌলিক উদ্দেশ্য ও ধারাসমূহের প্রতি একমত পোষণ করে, কিন্তু এটি তখনো আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না। উদাহরণস্বরূপঃ কোনো দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধির মাধ্যমে কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করা হয়ে থাকে। যেমনঃ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও, আমেরিকা চুক্তিটি অনুমোদন দেয় নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করেছে।

দ্বিতীয় ধাপটি হলো অনুমোদন বা অনুসমর্থন (Ratification)। এটি হলো সেই ধাপ, যেখানে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র চুক্তিটি অভ্যন্তরীণ আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করে। অনেক সময় সংসদের অনুমোদন, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর অথবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যাচাইকরণ এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশ কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করলে তা কখনো কখনো জাতীয় সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে যদি সেটি অভ্যন্তরীণ আইনে প্রভাব ফেলে।

তৃতীয় ও শেষ ধাপ হলো কার্যকারিতা (Entry into Force)। একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর হয় তখনই, যখন চুক্তিতে নির্ধারিত শর্ত (যেমন নির্দিষ্ট সংখ্যক রাষ্ট্রের অনুসমর্থন) পূর্ণ হয়। এই ধাপের পরই সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের জন্য চুক্তিটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। যেমনঃ United Nations Charter ১৯৪৫ সালে ৫০টি রাষ্ট্র দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অনুসমর্থনের ধাপ সম্পন্ন হলে এটি ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয় এবং এই দিনটিকেই এখন জাতিসংঘ দিবস (UN Day) হিসেবে পালন করা হয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই তিনটি ধাপই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনঃ ১৯৯৪ সালে UNCLOS (United Nations Convention on the Law of the Sea) চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করার পর ২০০১ সালে বাংলাদেশ এই চুক্তিটিকে অনুসমর্থন করে এবং কার্যকরভাবে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত অধিকার ও কর্তব্য প্রয়োগ শুরু করে। এভাবেই আন্তর্জাতিক চুক্তির তিনটি ধাপঃ স্বাক্ষর, অনুমোদন ও কার্যকারিতা, রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আইনের পূর্ণতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে।

ঙ. আন্তর্জাতিক আইনের অধীন পরিচালিতঃ

আন্তর্জাতিক চুক্তি কেবল রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সমঝোতা নয়, একটি সুসংহত আইনি কাঠামোর অধীনে এই চুক্তিগুলো পরিচালিত হয়। এই সুসংহত আইনি কাঠামোর মূল ভিত্তি Vienna Convention on the Law of Treaties, ১৯৬৯। এই কনভেনশনটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সংক্রান্ত সকল কার্যপ্রণালীর জন্য একটি সাধারণ ও বৈধ নির্দেশিকা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা চুক্তি বিষয়ে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করে।

Vienna Convention, ১৯৬৯-এ, একটি চুক্তির গঠনের প্রক্রিয়া, স্বাক্ষর, অনুসমর্থন, কার্যকারিতা, সংশোধন, বাতিলকরণ, এবং বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কিভাবে প্রযোজ্য হবে তার স্পষ্ট নির্দেশনা উল্লেখিত রয়েছে। এই কনভেনশনের অধীনে, একটি চুক্তি তখনই বৈধ বলে গণ্য হয়, যখন তা কোনো জোরপূর্বকতা, প্রতারণা বা ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নয়, বরং তা রাষ্ট্রসমূহের স্বাধীন সম্মতির ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়। উদাহরণস্বরূপঃ যদি কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে সামরিক বা রাজনৈতিক চাপে ফেলে কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করায়, তাহলে সেই চুক্তি Vienna Convention-এর Article 52 অনুযায়ী বাতিলযোগ্য (voidable) বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ, কোনো পক্ষের সম্মতি যদি বলপূর্বক বা হুমকির মাধ্যমে আদায় করা হয়, তাহলে সেই চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের চোখে বৈধ নয় এবং সেটি বাতিলযোগ্য।

Bangladesh সহ অধিকাংশ রাষ্ট্র Vienna Convention-এর নীতিমালা অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করে, যদিও সব দেশ এখনো এই কনভেনশনের সদস্য নয়। তবুও, এই কনভেনশনের বেশিরভাগ বিধানকে customary international law হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা সদস্য না হলেও রাষ্ট্রসমূহ মেনে চলে।

চ. চুক্তির বিভিন্ন নাম থাকতে পারেঃ

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চুক্তি বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে পারে—যেমন: Treaty, Convention, Agreement, Protocol, Charter, Covenant ইত্যাদি। নাম ভিন্ন হলেও এগুলোর আইনগত বৈধতা ও গুরুত্ব নির্ধারিত হয় মূলত চুক্তির বিষয়বস্তু, বাধ্যবাধকতার মাত্রা, ও সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের সম্মতি অনুযায়ী। কখনো কখনো একটি নাম নির্দিষ্ট ধরণের চুক্তির আইনি কাঠামো বা উদ্দেশ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

উদাহরণস্বরূপ, “Convention” শব্দটি সাধারণত এমন চুক্তির জন্য ব্যবহৃত হয়, যা একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড স্থাপন করে। যেমনঃ Geneva Convention সশস্ত্র সংঘাতে মানবিক আচরণের নিয়ম নির্ধারণ করে যা একটি বহুপাক্ষিক ও বাধ্যতামূলক আইনি কাঠামো হিসেবে গৃহীত হয়। আবার, “Protocol” মূলত কোনো পূর্ববর্তী চুক্তির পরিপূরক বা পরবর্তী সংশোধনী নির্দেশ করে। যেমনঃ Kyoto Protocol ছিল United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCCC)-এর একটি সম্পূরক দলিল, যা উন্নত দেশগুলোর জন্য নির্দিষ্ট নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্য নির্ধারণ করে।

অন্যদিকে, “Charter” শব্দটি অনেক সময় একটি প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার ভিত্তি দলিল বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো United Nations Charter, যা জাতিসংঘের সৃষ্টি, কাঠামো ও কার্যপদ্ধতি বর্ণনা করেছে এবং এই সনদ অনুমোদনের মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ সনদকে আইনগতভাবে মেনে চলতে বাধ্য।

সার্বিকভাবে, চুক্তির নাম যতই ভিন্ন হোক না কেন, এগুলোর আইনগত কার্যকারিতা নির্ভর করে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত বাধ্যবাধকতা, পক্ষসমূহের সম্মতি, এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তার কাঠামো কেমন হবে ইত্যাদি বিষয়ের উপর। নামের ভিন্নতা কখনো কখনো শুধু চুক্তির ধরণ বা পরিপ্রেক্ষিত নির্দেশ করলেও, বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবই আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা পরিচালিত ও মূল্যায়িত হয়।

ছ. সংশোধনযোগ্যঃ

আন্তর্জাতিক চুক্তি একবার স্বাক্ষরের পর অচল বা অপরিবর্তনীয় হয় না বরং সময় ও প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে সেগুলো সংশোধন বা পর্যালোচনা করা যায়। পক্ষসমূহের সম্মতিতে বা পূর্বনির্ধারিত শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এসব চুক্তি বাতিল বা প্রত্যাহারও করা সম্ভব। এই বৈশিষ্ট্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপঃ ১৯৮৭ সালের Montreal Protocol-এ ওজনস্তর ক্ষয়কারী রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব সম্প্রদায় সম্মত হয়। পরবর্তীতে পরিবেশবিষয়ক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রেক্ষিতে এটি একাধিকবার সংশোধিত হয় এবং আরও নতুন রাসায়নিক যেমনঃ Hydrofluorocarbons (HFCs) নিষিদ্ধ তালিকায় যুক্ত হয়। ফলে, আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো প্রয়োজনে অভিযোজিত হতে পারে এবং কেবল কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব প্রয়োগে সময়োপযোগী হয়ে উঠতে পারে।

আন্তর্জাতিক চুক্তির গুরুত্বঃ

আন্তর্জাতিক চুক্তি কেবল রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পর্কের কাঠামো নির্ধারণ করে না, বরং বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। রাষ্ট্রসমূহ যখন কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, তখন তারা ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ে পারস্পরিক দায়িত্ব পালনের জন্য আইনগত এবং নৈতিকভাবে বাধ্য থাকে। উদাহরণস্বরূপঃ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি (Paris Climate Agreement) বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ, যেখানে দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাতে নিজেদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এবং তা পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এ ধরণের চুক্তি প্রমাণ করে যে, বিশ্বব্যাপী সমস্যা মোকাবেলায় সম্মিলিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া, ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন চুক্তি আন্তর্জাতিক শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে। যেমনঃ Treaty of Versailles (1919) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির উপর বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে ইউরোপে এক নতুন ভূরাজনৈতিক বিন্যাস গড়ে তোলে। একইভাবে, NPT (Nuclear Non-Proliferation Treaty, 1970) একটি বহুপাক্ষিক চুক্তি যা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে বৈশ্বিক নিরাপত্তা কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করে এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, UNCLOS (United Nations Convention on the Law of the Sea, 1982) সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, নৌ চলাচলের অধিকার, এবং উপকূলীয় জলসীমা নির্ধারণে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একটি পরিস্কার ও নির্ভরযোগ্য কাঠামো প্রদান করেছে।

এই চুক্তিগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায়, রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট নীতিমালায় আবদ্ধ হলে আন্তর্জাতিক বিরোধ হ্রাস পায় এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম হয়।

২. আন্তর্জাতিক কনভেনশন (Convention)ঃ

আন্তর্জাতিক কনভেনশন (Convention) হলো এমন একটি বহুপাক্ষিক (Multilateral) আইনি দলিল, যা সাধারণত জাতিসংঘ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে গৃহীত হয়। Convention নির্দিষ্ট কোনো বৈশ্বিক সমস্যা বা বিষয়ে একক ও অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতা নিশ্চিত করে থাকে। এটি প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক চুক্তির (Treaty) একটি ধরন বা ভার্সন, তবে এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার অন্যতম হলো—কোন বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে এটি বৃহৎ পরিসরে কোন মানদণ্ড প্রণয়ন করে। অর্থাৎ, কনভেনশন শুধু রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিশ্রুতির দলিল নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য আদর্শ, মান ও রীতিনীতি নির্ধারণ করে দেয়, যা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহকে অনুসরণ করতে হয়।

যেমনঃ মানবাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, যুদ্ধের নিয়ম-কানুন, শিশু অধিকার কিংবা সমুদ্র আইন ইত্যাদি বিষয়ে গৃহীত কনভেনশনগুলো বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের জন্য একটি অভিন্ন আইনি কাঠামো তৈরি করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব Convention রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক স্বাক্ষরের পর আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের (ratification) মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর হয়। তাই আন্তর্জাতিক কনভেনশনকে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি ও বৈশ্বিক শাসনের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়।

আন্তর্জাতিক কনভেনশনের বৈশিষ্ট্যঃ

ক. বহুপাক্ষিক এবং উন্মুক্ত অংশগ্রহণযোগ্য

আন্তর্জাতিক কনভেনশন সাধারণত একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে গৃহীত হয় এবং তা সকল সদস্য রাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত থাকে। এটি একক বা সীমিত অংশগ্রহণ নয়; বরং বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রসমূহকে অংশগ্রহণ ও স্বাক্ষরের সুযোগ দিয়ে একটি সর্বজনীন কাঠামো তৈরি করে। যেমনঃ  ১৯৪৯ সালের Geneva Conventions- এ বর্তমানে প্রায় সব রাষ্ট্রই অনুমোদন করেছে, যা যুদ্ধকালে বে-সামরিক নাগরিক ও যুদ্ধবন্দিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এটি বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক অংশগ্রহণযুক্ত এক আন্তর্জাতিক কনভেনশন।

খ. আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণের ভিত্তি

Convention কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত নীতিমালা ও মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয়। এটি রাষ্ট্রসমূহের জন্য একটি অভিন্ন আইনি কাঠামো প্রদান করে, যাতে বিশ্বজুড়ে সমতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। যেমনঃ UN Convention on the Law of the Sea (UNCLOS, 1982) সমুদ্রসীমা, নিরপেক্ষ জল, সম্পদ বণ্টন, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণ করে যা প্রায় প্রতিটি উপকূলীয় রাষ্ট্র অনুসরণ করে।

গ. নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুতে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে

প্রতিটি কনভেনশন এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সমস্যা বা ইস্যু নিয়ে বৈশ্বিকভাবে একটি সম্মিলিত ও ন্যায্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায়। এর ফলে একটি নিরপেক্ষ ও সমন্বিত নীতিমালা তৈরি হয় যা জাতিসংঘের সদস্য বা সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রকে একটি অভিন্ন অবস্থান গড়ে তোলে। যেমনঃ Convention on the Rights of the Child (CRC, 1989) শিশুদের অধিকার রক্ষায় এক অভিন্ন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। এটি শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও মতপ্রকাশের অধিকারসহ সব মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়।

৩. রেজুলেশন (Resolution)

রেজুলেশন (Resolution) বলতে বোঝায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (UNGA), নিরাপত্তা পরিষদ (UNSC), মানবাধিকার পরিষদ (UNHRC) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার গৃহীত আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত, ঘোষণা বা প্রস্তাব। এটি মূলত কোনো একটি ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক বা নৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। রেজুলেশন দুই ধরনের হতে পারেঃ কখনো তা বাধ্যতামূলক (binding), আবার কখনো তা কেবলমাত্র সুপারিশমূলক (non-binding)। এই বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করেই রেজুলেশন আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে আলাদা গুরুত্ব বহন করে।

Resolution-এর প্রকারভেদ:

ক. বাধ্যতামূলক রেজুলেশন (Binding Resolution):

বাধ্যতামূলক রেজুলেশন সাধারণত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (United Nations Security Council - UNSC) গৃহীত করে, যা জাতিসংঘ সনদের অধ্যায় VI ও VII এর আওতায় প্রণীত হয় এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার লক্ষ্যে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ওপর সরাসরি আইনগত দায়বদ্ধতা আরোপ করে। এই ধরনের রেজুলেশনের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলোঃ যে কোনো সদস্য রাষ্ট্র এতে আপত্তি জানালেও, নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদিত রেজুলেশন মানতে সে বাধ্য থাকবে।

এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো UNSC Resolution ২৩৩৪ (২০১৬)। ২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত রেজুলেশন ২৩৩৪ ছিল ইসরায়েলের দ্বারা অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক দলিল। এই রেজুলেশনে ১৯৬৭ সালের পর পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেমসহ অন্যান্য ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল কর্তৃক গৃহীত ভূমি দখলের কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। জাতিসংঘ এ ধরনের বসতি স্থাপনকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, এসব কার্যক্রম দুই-রাষ্ট্র সমাধান তথা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

রেজুলেশনটিতে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আহ্বান জানানো হয়, যেন তারা এসব অবৈধ বসতির বৈধতা কোনোভাবেই স্বীকৃতি না দেয় এবং ইসরায়েলের এমন কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সহযোগিতা না করে। একইসঙ্গে, শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসনে উভয় পক্ষকে আহ্বান জানানো হয়। এই রেজোলিউশনটি ছিল বাধ্যতামূলক (binding), যা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত এবং ১৪-০ ভোটে পাস হয়, এখানে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভোট থেকে বিরত থাকে।

এই রেজুলেশনটি গৃহীত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ফিলিস্তিনসহ অধিকাংশ দেশ এটিকে স্বাগত জানালেও, ইসরায়েল এটিকে পক্ষপাতদুষ্ট এবং একতরফা বলেই প্রত্যাখ্যান করে। তবুও, রেজুলেশন ২৩৩৪ আন্তর্জাতিক মহলে একটি শক্ত বার্তা প্রেরণ করে যে, ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্ব আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং এটি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। এই রেজোলিউশন আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসংঘের ভূমিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবেও বিবেচিত।

খ. সুপারিশমূলক রেজুলেশন (Non-Binding Resolution):

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (UNGA) কিংবা মানবাধিকার পরিষদের মতো সংস্থাগুলো সাধারণত এমন ধরনের রেজুলেশন গ্রহণ করে, যেগুলো মূলত সুপারিশমূলক (non-binding) হলেও আন্তর্জাতিক পরিসরে নৈতিক অবস্থান নির্ধারণ এবং নীতিনির্ধারণী কাঠামো গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও এসব রেজুলেশন রাষ্ট্রসমূহের জন্য সরাসরি আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না, তবে সেগুলো বৈশ্বিক জনমত, মানবাধিকারের মান, এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে। এগুলো অনেক সময় আন্তর্জাতিক আইন গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবেও বিবেচিত হয়। যেমনঃ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রেজুলেশন ১৫১৪ (১৯৬০), যা “Declaration on the Granting of Independence to Colonial Countries and Peoples” নামে পরিচিত। এটি একটি যুগান্তকারী দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।

এই রেজুলেশনে বলা হয় যে, সমস্ত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে এবং উপনিবেশবাদ মানবাধিকারের পরিপন্থী। যদিও এটি বাধ্যতামূলক ছিল না, তবুও এটি বিশ্বের বহু উপনিবেশাধীন জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনে নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা প্রদান করে। এর ফলে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম নতুন মাত্রা পায় এবং জাতিসংঘের প্ল্যাটফর্মে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিগুলোর প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পায়। এই রেজুলেশন পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি মৌলিক নীতিমালা হিসেবে গৃহীত হয়, যা আজও নব্য ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে।

রেজুলেশনের কার্যকারিতাঃ

রেজুলেশন আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মিলিত মতামত ও অবস্থান প্রকাশ পায়। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যমত্যের প্রতিফলন হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বৈশ্বিক ইস্যুগুলোর নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপঃ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের Resolution 2758 (১৯৭১) কথা বলা যেতে পারে। এই রেজুলেশন তাইওয়ানের বদলে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে (মেইনল্যান্ড চীন) চীনের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বৈধতা দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মতামতের স্পষ্ট প্রকাশ ছিল এই রেজুলেশন ২৭৫৮ (১৯৭১)।

রেজুলেশন নীতিগত নির্দেশনা প্রদানেও কার্যকর ভূমিকা রাখে। যেমনঃ ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে তার জন্য স্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে UNSC Resolution 1373 (২০০১) পাশ হয়। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি কাঠামো ও নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করেছে, যা অনেক রাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করে।

অতীতেও বিভিন্ন রেজুলেশন জাতিসংঘের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় রূপরেখা প্রদান করেছে। উদাহরণস্বরূপঃ UNGA Resolution 1514 (১৯৬০), যা উপনিবেশবাদ বিলুপ্তির ঘোষণা হিসেবে গৃহীত হয়। এই রেজুলেশনটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে স্বাধীনতা আন্দোলনগুলোর জন্য একটি নৈতিক মঞ্চ তৈরি করেছিল। এই রেজুলেশনের ভিত্তিতে জাতিসংঘ বিভিন্ন বিশেষ মিশন পরিচালনা করেছে। যেমনঃ উপনিবেশীয় অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ।

রেজুলেশন আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, যা আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রাষ্ট্রসমূহের আচরণ ও নীতিনির্ধারণে গভীর প্রভাব ফেলে এবং অনেক সময় পরবর্তী চুক্তি, কনভেনশন বা নীতিমালার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

৪. Doctrine কী?

Doctrine (বাংলায়: মতবাদ বা কৌশলগত নীতিমালা) শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ "doctrina" থেকে, যার অর্থ হলো "শিক্ষা", "নীতি", অথবা "শিক্ষণীয় তত্ত্ব"। এটি ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে মূলত ধর্মীয় ও দার্শনিক নীতিবোধ হিসেবে, পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সামরিক কৌশলের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রনেতার ঘোষিত একটি নির্দিষ্ট নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি বা কৌশলগত অবস্থানকে বুঝাতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিতে Doctrine ধারণার আগমন ঘটে।  Doctrine একটি দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিমালা কিংবা বৈদেশিক নীতি কৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এই ধরনের নীতিমালাগুলো সাধারণত আন্তর্জাতিক সংকট, প্রতিরক্ষা নীতি, যুদ্ধনীতি, পররাষ্ট্রনীতি কিংবা আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গে প্রণীত হয়ে থাকে। Doctrine- এ কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, তবে এটি রাষ্ট্রের আচরণ এবং অবস্থানগত চিন্তাধারাকে সুসংহত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।

অক্সফোর্ড ডিকশোনারী অনুসারে,

A doctrine is a stated principle or policy of a government, especially in foreign affairs or military strategy, that guides state behavior in specific circumstances.

— International Relations Glossary (Oxford Dictionary)

সহজভাবে বলা যায়:

Doctrine হলো একটি রাষ্ট্র বা নেতৃত্বের পক্ষ থেকে প্রকাশিত কৌশলগত ঘোষণা, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রটি বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক-সামরিক ঘটনাবলির প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়।

Doctrine কোনো একক সিদ্ধান্ত নয় বরং একটি ধারাবাহিক কৌশলগত কাঠামো যা দীর্ঘ মেয়াদে পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক পদক্ষেপে নির্দেশক হিসেবে কাজ করে।

Doctrine  -এর বৈশিষ্ট্যসমূহ

ক. নীতিগত গাইডলাইন (Strategic Guideline)

Doctrine হলো একটি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রনেতার পক্ষ থেকে ঘোষিত একটি নির্দিষ্ট কৌশলগত নীতিমালা, যা কোনো বিশেষ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এটি একটি সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বা রূপরেখা দেয়, যা সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে সহায়তা করে। যেমনঃ Truman Doctrine (১৯৪৭)। এই Doctrine -এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে যে, বিশ্বের যেখানেই কমিউনিজমের হুমকি ও বিস্তার ঘটবে, সেখানে সে হুমকি মোকাবি্লা ও কমিউনিজমের বিস্তাররোধে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর প্রতি মার্কিন সহায়তা অব্যাহত থাকবে। এটি পরবর্তীতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে এবং স্নায়ুযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে তোলে।

খ. রাষ্ট্রীয় অবস্থান নির্ধারণে সহায়ক

Doctrine একটি রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট ইস্যুতে স্পষ্ট অবস্থান নিতে সহায়তা করে। যুদ্ধ, হস্তক্ষেপ, আত্মরক্ষা, মানবিক সঙ্কট কিংবা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। যেমনঃ Bush Doctrine (২০০১)। বুশ Doctrine-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে যে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে শত্রুভাবাপন্ন অঞ্চল বা ভূখন্ডে আগাম হামলা (pre-emptive strike) চালাতে পারে। বুশ Doctrine থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তা নীতিতে আক্রমণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছে।

গ. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে

Doctrine কেবল অভ্যন্তরীণ নীতিমালা নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচিত হয় এবং অন্যান্য রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমনঃ Monroe Doctrine (১৮২৩)। এই Doctrine- এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ইউরোপ যেন আমেরিকান উপমহাদেশের (উত্তর ও দক্ষিণ বা লাতি্ন আমেরিকার) বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। এটি শুধু আমেরিকার ভূরাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং ইউরোপীয় শক্তিগুলোর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবেও বিবেচিত হয়েছিল।

ঘ. পরিবর্তনশীল ও প্রেক্ষাপট ভিত্তিকঃ

Doctrine সময়, রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ও বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী পরিবর্তিত বা প্রতিস্থাপিত হয়। এটি কোন চিরস্থায়ী আইন নয়, বরং প্রয়োজন অনুসারে নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন Doctrine তৈরি হয়। যেমনঃ সোভি্যেত আমলের Brezhnev Doctrine। এই Doctrine সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমাজতান্ত্রিক ব্লকে হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দিতে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর Sinatra Doctrine (১৯৮৯) নামে নতুন একটি নীতি গ্রহণ করা হয়, যেখানে পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের নীতি নির্ধারণে স্বাধীনতা দেওয়া হয়।

ঙ. কৌশলগত বার্তা প্রদান করে

Doctrine অনেক সময় শুধুমাত্র দিকনির্দেশনা নয়, বরং এটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি একটি বার্তা বা সতর্কতা হিসেবেও কাজ করে। এটি বলপ্রয়োগ ছাড়াই রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারও করতে পারে। উদাহরণস্বরূপঃ Eisenhower Doctrine (১৯৫৭)। এই Doctrine-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো কমিউনিস্ট হুমকি প্রতিহত করতে আমেরিকা সামরিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত। এটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব প্রতিরোধে একটি কৌশলগত বার্তা।

কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ Doctrineঃ

Monroe Doctrine (১৮২৩)

উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপীয় রাজনৈতিক পরিসরে এক পুনর্জাগরণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যেখানে নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় রাজতন্ত্রগুলো পুনরায় তাদের উপনিবেশ বিস্তারের লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই পটভূমিতে, ১৮২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো তাঁর বার্ষিক কংগ্রেস ভাষণে যে নীতি ঘোষণা করেন, তা ইতিহাসে “Monroe Doctrine” নামে খ্যাত। এই ঘোষণার মূল বক্তব্য ছিল—উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা ইউরোপীয় উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে যদি কোনো ইউরোপীয় শক্তি এই অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা সামরিক আগ্রাসনের চেষ্টা করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র সেটিকে তার নিজস্ব নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করবে। একইসঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বা উপনিবেশিক বিরোধে হস্তক্ষেপ করবে না, এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকেও একই ধরনের নিরপেক্ষ আচরণ করতে আহ্বান জানায়।

এই নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে পশ্চিম গোলার্ধকে (Western Hemisphere) তার কৌশলগত স্বার্থের আওতাভুক্ত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে একটি স্বতন্ত্র ভূরাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে। Monroe Doctrine ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত প্রতিরোধমূলক ঘোষণাপত্র, যা লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একপ্রকার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। তদ্ব্যতীত, এটি যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তীকালের হস্তক্ষেপমূলক নীতির (interventionist policy) ভিত্তি স্থাপন করে—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে অঞ্চলগত নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভিভাবক হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে। এই Doctrine-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন ইউরোপীয় আধিপত্য থেকে নিজ অঞ্চলকে দূরে রাখতে চেয়েছে, অন্যদিকে এটি ভবিষ্যতের মার্কিন বৈদেশিক নীতির জন্য একটি কৌশলগত ভিত্তি গড়ে তোলে। পরবর্তীকালে Roosevelt Corollary (১৯০৪) এবং অন্যান্য হস্তক্ষেপমূলক নীতিতে এই Doctrine-এর প্রতিফলন দেখা যায়, যা Monroe Doctrine-এর তাৎপর্য ও প্রভাবকে আরও বিস্তৃত করে তোলে।

Truman Doctrine (১৯৪৭)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে—একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, আর অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট আদর্শ। এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৪৭ সালের ১২ই মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান কংগ্রেসে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেন যে, “এখন পৃথিবী মাত্র দুই ধরনের জীবনের মাঝে বিভক্ত—একটি স্বাধীন গণতন্ত্র, অন্যটি নিপীড়নমূলক একনায়কতন্ত্র।” তিনি ঘোষণা দেন যে যুক্তরাষ্ট্র এখন থেকে যে কোনো দেশকে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করবে যদি সে দেশ কমিউনিজমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। মূলত গ্রিস ও তুরস্কের সমাজতান্ত্রিক অভ্যুত্থান প্রতিরোধ করতেই প্রথমে এই নীতির প্রয়োগ ঘটে। এই ঘোষণার মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিকভাবে Truman Doctrine জন্ম নেয়, যা পরবর্তী ঠান্ডা যুদ্ধের (Cold War) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।

Truman Doctrine-এর মূল দর্শন ছিল Containment Policy, যার অর্থ ছিল—বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়া রোধ করা এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সীমাবদ্ধ রাখা। এই নীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র শুধু রাজনৈতিক ঘোষণা দিয়েই থেমে থাকেনি, বরং সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সহায়তা (যেমন: Marshall Plan), সামরিক প্রশিক্ষণ, এবং গোপন অপারেশন পরিচালনা করে। এটি বিশ্বব্যাপী মার্কিন হস্তক্ষেপমূলক নীতির সূচনা ঘটায় এবং যুক্তরাষ্ট্রকে "বিশ্ব পুলিশের" ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করে। Truman Doctrine এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার বৈদেশিক নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়—যেখানে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানায় সীমাবদ্ধ না রেখে, বৈশ্বিক কমিউনিজমবিরোধী জোট গঠনের পথ প্রশস্ত করা হয়। এই নীতির ধারাবাহিকতায় কোরিয়া যুদ্ধ (১৯৫০-৫৩), ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৫৫-৭৫), এবং বিভিন্ন লাতিন আমেরিকান ও আফ্রিকান দেশে মার্কিন হস্তক্ষেপের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। অতএব, Truman Doctrine ছিল কেবল একটি রাজনৈতিক ঘোষণা নয়, বরং এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত ভূরাজনীতির সূচনা।

Brezhnev Doctrine (১৯৬৮)

১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা Leonid Brezhnev একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করেন, যা পরবর্তীতে Brezhnev Doctrine নামে পরিচিত হয়। এই নীতির মূল বক্তব্য ছিল—"যদি সমাজতান্ত্রিক কোনো দেশে বিপ্লব, সংস্কার, বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ সেই দেশে হস্তক্ষেপ করতে পারবে, এমনকি সামরিক হস্তক্ষেপও বৈধ হবে।" এই নীতির উদ্ভব ঘটে ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় Prague Spring নামে পরিচিত একটি গণতান্ত্রিক সংস্কার আন্দোলনের পটভূমিতে। চেকোস্লোভাকিয়ার নেতা Alexander Dubček দেশে গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে "সামাজিকতাবাদকে মানবিক মুখ" দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এটিকে সমাজতান্ত্রিক ঐক্য ও নিয়ন্ত্রণের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছিল। এর ফলস্বরূপ, সোভিয়েত সেনাবাহিনী ও ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত দেশগুলো মিলে চেকোস্লোভাকিয়ায় সামরিক অভিযান চালায় এবং আন্দোলন দমন করে।

Brezhnev Doctrine-এর তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল—সমষ্টিগত সমাজতান্ত্রিক নিরাপত্তা (Collective Socialist Security)। এর মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক ব্লকের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর একটি সীমা আরোপ করে দেয় এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে। এই নীতির মাধ্যমে মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ওপর নিজের প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছিল। এটি ছিল সমাজতান্ত্রিক ক্যাম্পে একনায়কতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার প্রতিচ্ছবি। Doctrineটি শুধু চেকোস্লোভাকিয়ায় নয়, পরবর্তীতে পোল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে বিরোধী আন্দোলন দমনে নৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে এই নীতিকে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের (Soviet Imperialism) এক প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেন।

Brezhnev Doctrine-এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ছিল গভীর। এটি কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শগত একনায়কতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশই ছিল না, বরং সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের মধ্যে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করার হাতিয়ারও হয়ে ওঠে। যদিও ১৯৮০-এর দশকে গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকার যুগে এই নীতির বিরোধিতা শুরু হয় এবং অবশেষে মিখাইল গর্বাচেভ-এর নেতৃত্বে এই Doctrine আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত হয়, তবুও এর ইতিহাস সমাজতান্ত্রিক আদর্শে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও বাহ্যিক হস্তক্ষেপের একটি জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

Bush Doctrine (২০০১–২০০২)

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার (টুইন টাওয়ার হামলা) পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট George W. Bush এক নতুন বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করেন, যা Bush Doctrine নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই নীতির মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সম্ভাব্য হুমকি সৃষ্টিকারী রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক হামলা (pre-emptive strike) চালানোকে বৈধতা দেওয়া। অর্থাৎ, যদি যুক্তরাষ্ট্র মনে করে কোনো রাষ্ট্র বা সন্ত্রাসী সংগঠন ভবিষ্যতে মার্কিন নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে, তবে সেই হুমকির উৎসকে আগেভাগেই সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিহ্ন করতে পারবে। এমন নীতিগত অবস্থানই ছিল Bush Doctrine-এর কেন্দ্রবিন্দু।

এই Doctrine-এর কার্যকর প্রয়োগ ঘটে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময়। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (Weapons of Mass Destruction - WMD) রয়েছে এবং সেগুলো ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যদিও পরবর্তীতে অনুসন্ধানের দ্বারা এই অস্ত্রের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি, তবুও মার্কিন প্রশাসন Bush Doctrine-এর ভিত্তিতেই সামরিক আগ্রাসনকে বৈধতা দেয়।

Bush Doctrine আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতাবাদী (Realist) ধারার প্রতিফলন হলেও, এটি আন্তর্জাতিক আইনের প্রচলিত মানদণ্ড, বিশেষ করে জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদের আত্মরক্ষার অধিকার সংক্রান্ত বিধানের একটি চ্যালেঞ্জও ছিল বটে। প্রথাগতভাবে self-defense কেবল একটি চলমান বা আসন্ন আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় অনুমোদিত ছিল। কিন্তু, Bush Doctrine এই ধারণাকে সম্প্রসারিত করে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ হুমকি শনাক্ত করে আগাম হামলার নৈতিকতা ও বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এই নীতির সমালোচকরা একে আমেরিকার "unilateralism"-এর প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেন, যেখানে বহুপাক্ষিক কূটনীতিকে পাশ কাটিয়ে চলে যুক্তরাষ্ট্র একক সিদ্ধান্তে যুদ্ধ ঘোষণা করার কথা বলে ।

Bush Doctrine-এর রাজনৈতিক প্রভাব ছিল বৈশ্বিক। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে আগ্রাসী ও প্রতিরক্ষামূলক কূটনীতির বাইরে গিয়ে একটি হাইপার-সিকিউরিটি কাঠামোর ভিতর প্রবেশ করায়। এর ফলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বে মার্কিন নেতৃত্ব ও নৈতিক অবস্থানের ওপর প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, Bush Doctrine-এর ফলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কাঠামোতে অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা পরিবেশ তৈরি হয়।

Gujral Doctrine (১৯৯৬)

১৯৯৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দার কুমার গুজরাল (I. K. Gujral) দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৈদেশিক নীতিতে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন, যা পরে Gujral Doctrine নামে পরিচিতি পায়। এই নীতির মূল প্রতিপাদ্য ছিলঃ দক্ষিণ এশিয়ার ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এমন হতে হবে, যেখানে ভারত কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা না করেই আস্থা, সহযোগিতা ও সদিচ্ছার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলবে। গুজরাল তার নীতিতে পাঁচটি মৌলিক নীতির কথা বলেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো—ভারত তার ছোট প্রতিবেশীদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না এবং তাদের সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করবে। এই নীতির মাধ্যমে ভারত নিজেকে একটি দায়িত্বশীল, শান্তিপূর্ণ এবং সহযোগিতাপূর্ণ আঞ্চলিক নেতৃত্বকারী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে।

Gujral Doctrine-এর অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে একটি "বড় ভাই" নয়, বরং "বড় বন্ধু" হিসেবে উপস্থাপনের কূটনৈতিক কৌশল হিসেবে কাজ করার কথা বলে। বিশেষত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই নীতি কার্যকর করার গুরুত্ব অপরিসী্ম। উদাহরণস্বরূপঃ গুজরালের ক্ষমতাকালে বাংলাদেশের সঙ্গে পানিবন্টন, বাণিজ্যিক চুক্তি ও সীমান্ত সমস্যার সমাধানে ভারতের উদার নীতির পেছনে Gujral Doctrine-এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

এই Doctrine দক্ষিণ এশিয়ায় "soft power diplomacy" এক ক্লাসিক উদাহরণ হয়ে ওঠে। ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা বাড়ানোর প্রয়াস ছিল এর মূল লক্ষ্য। গুজরাল বিশ্বাস করতেন যে, ভারত যদি বড় রাষ্ট্র হিসেবে উদারতা দেখায়, তবে ছোট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি পাবে, যা আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার জন্য অপরিহার্য।

তবে সমালোচকরা এটাও বলেন যে, Gujral Doctrine শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নীতিগত অঙ্গীকারের উপর ভিত্তি করে সফলতা অর্জন করতে পারেনি নানা কারণে। ফলে বর্তমানে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক চরম অবনতি ঘটেছে, বিশেষত, বি্জেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে।

Doctrine-এর তাত্পর্য ও ব্যবহার

Doctrine বা মতবাদ একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যা দেশের কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রথমত, Doctrine একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতির কাঠামো নির্ধারণে সহায়ক হয়। এটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থিরতা ও ধারাবাহিকতা আনে, যার ফলে দেশটি তার আন্তর্জাতিক অবস্থান স্পষ্ট ও সুসংগঠিত করতে পারে। যেমনঃ Truman Doctrine ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধকালে পররাষ্ট্রনীতির একটি মাইলফলক, যা কমিউনিজম বিস্তার রোধে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করেছিল।

দ্বিতীয়ত, Doctrine রাষ্ট্রের কৌশলগত বার্তা এবং মনোভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এটি সরকারের জাতীয় স্বার্থ, প্রতিরক্ষা নীতি, অথবা জোটগত প্রতিশ্রুতির কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জানায়। উদাহরণস্বরূপঃ Bush Doctrine-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি এবং আগাম হামলার নীতি তুলে ধরেছিল, যা বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের অবস্থানকে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করে।

তৃতীয়ত, Doctrine আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। একে বিশ্বনেতৃত্বের দাবির প্রতিফলন হিসেবেও দেখা হয়। যেমনঃ Monroe Doctrine যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম গোলার্ধে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এবং ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের হস্তক্ষেপ রোধে মূল ভূমিকা পালন করেছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বপর্যায়ে একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

চতুর্থত, Doctrine সংকট ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে। কঠিন আন্তর্জাতিক সংকটে দ্রুত ও সংগঠিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে এটি সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপঃ Truman Doctrine ইউরোপে কমিউনিজম বিস্তারের বিরুদ্ধে মার্কিন হস্তক্ষেপকে নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা দিয়েছিল, যা শীতল যুদ্ধের বিভিন্ন সংকট মোকাবেলায় পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে।

পঞ্চমত, Doctrine আন্তর্জাতিক আইন ও রাজনৈতিক ব্যাখ্যার উৎস হিসেবেও বিবেচিত হয়। অনেক সময় এগুলো অলিখিত নীতিমালা হয়ে ওঠে, যা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক ন্যায়ের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ পায়। উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক যুগের Responsibility to Protect (R2P) নীতি, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গণহত্যা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়, Doctrine-এর মতোই আন্তর্জাতিক আইনি ও নৈতিক বুনিয়াদ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সার্বিকভাবে, Doctrine রাষ্ট্রের কূটনৈতিক কৌশলকে গঠন ও প্রভাবিত করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবৃতি নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে কাজ করে। এটি রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক মঞ্চে স্বচ্ছন্দভাবে কৌশলগত অবস্থান গ্রহণে সহায়তা করে এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৫. চুক্তিপত্র বা Agreement

Agreement বা চুক্তিপত্র হলো একটি আনুষ্ঠানিক ও লিখিত দলিল, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দুই বা ততোধিক রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা, কিংবা পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সম্মতিতে স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ নির্দিষ্ট একটি উদ্দেশ্য, নীতি বা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একমত হয়। এটি হতে পারে দ্বিপাক্ষিক (দুই পক্ষের মধ্যে) অথবা বহুপাক্ষিক (একাধিক পক্ষের মধ্যে)। Agreement অনেক সময় Treaty বা Convention-এর মতোই আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যখন তা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় রেজিস্টার করা হয় অথবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুমোদিত হয়।

তবে, সাধারণভাবে Agreement তুলনামূলকভাবে কম আনুষ্ঠানিক এবং দ্রুত কার্যকর হয়, বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে অল্প সময়ের মধ্যে সমঝোতা বা সহযোগিতা নিশ্চিত করা জরুরি। এই ধরনের দলিল সাধারণত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, পরিবেশ, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি স্থানান্তর, পানি বণ্টন, বা সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত হয়। Agreement-এর মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহ একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্ব, অধিকার এবং দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা পরবর্তীতে সেইসব রাষ্ট্রের কূটনৈতিক এবং আইনি আচরণকে প্রভাবিত করে।

Agreement এর বৈশিষ্ট্য

Agreement বা চুক্তিপত্র দ্বিপাক্ষিক কিংবা বহুপাক্ষিক হতে পারে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় এবং সাধারণত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, নিরাপত্তা জোট, বা সীমান্ত বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি একটি ক্লাসিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তির উদাহরণ, যা দুটি দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার ভিত্তি স্থাপন করে। অপরদিকে, বহুপাক্ষিক চুক্তিতে একাধিক দেশ স্বাক্ষরকারী হয়, এবং এটি সাধারণত বৃহত্তর আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক সমস্যা যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য বা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলো মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি একটি বহুপাক্ষিক উদ্যোগ যেখানে প্রায় সকল জাতি বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে একমত হয়।

চুক্তিপত্র সাধারণত নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, যা একে বিষয়ভিত্তিক করে তোলে। এই চুক্তিগুলো বাণিজ্য, প্রযুক্তি স্থানান্তর, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, শিক্ষা, বা মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো নির্দিষ্ট খাতের জন্য স্বাক্ষরিত হয়। উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির মাধ্যমে আইটি খাতে দক্ষতা বিনিময়, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং যৌথ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যা দুই দেশের মধ্যে ডিজিটাল সহযোগিতাকে শক্তিশালী করছে। তদ্রূপ, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তির মাধ্যমে সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ মহড়া ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময়ের পথ সুগম হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক এই চুক্তিগুলো লক্ষ্যভিত্তিক এবং বাস্তবধর্মী, যা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে কার্যকর সহযোগিতা গড়ে তোলে।

তৃতীয়ত, চুক্তিপত্র তুলনামূলকভাবে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য। Treaty বা Convention-এর মতো জটিল ও দীর্ঘ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে অনেক সময় Agreement বা MoU স্বাক্ষরের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে একটি সহযোগিতামূলক কাঠামো গড়ে তোলা যায়। এই ধরনের চুক্তি সংসদীয় অনুসমর্থন ছাড়াই দুই পক্ষের প্রশাসনিক স্তরে বাস্তবায়নযোগ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে উন্নয়ন সহায়তা বিষয়ক চুক্তিগুলো মূলত MoU-এর কাঠামোয় স্বাক্ষরিত হয় এবং তা দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি সহায়তা বা মানবসম্পদ উন্নয়নে তাৎক্ষণিক কার্যকর হয়। আবার, সৌদি আরবের সঙ্গে শ্রমিক পাঠানো সংক্রান্ত চুক্তিপত্রগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে, যা সময়সাপেক্ষ Treaty-এর ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।

Agreement বনাম Treaty

নিচে Treaty এবং Agreement এর মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলো একটি তুলনামূলক ছকে (table) তুলে ধরা হলো:

বিষয়ের ধরন

Treaty (চুক্তি)

Agreement (চুক্তিপত্র)

আইনি বাধ্যবাধকতা

আন্তর্জাতিক আইনে সম্পূর্ণভাবে বাধ্যতামূলক

সাধারণত বাধ্যবাধকতামূলক, তবে কিছু সময় নরম আইনি কাঠামোর অধীনে পড়ে 

আনুষ্ঠানিকতা

অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক

তুলনামূলকভাবে কম আনুষ্ঠানিক

অনুসমর্থনের প্রয়োজন

রাষ্ট্রপ্রধান বা সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন

অনেক সময় কেবল নির্বাহী পর্যায়ে স্বাক্ষর যথেষ্ট

দলিলের ধরন

বিস্তারিত এবং বহু অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট

সংক্ষিপ্ত এবং লক্ষ্যভিত্তিক

উদাহরণ

১৯৮২ সালের UNCLOS (সমুদ্র আইন) চুক্তি

বাংলাদেশ-জাপান উন্নয়ন সহায়তা চুক্তিপত্র (MoU)

কার্যকর হওয়ার ধরণ

সাধারণত দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যকর হয়

তুলনামূলকভাবে দ্রুত কার্যকর হয়

ব্যবহারের ক্ষেত্র

কূটনৈতিক, নিরাপত্তা, মানবাধিকার ইত্যাদিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত

উন্নয়ন, বাণিজ্য, প্রযুক্তি বিনিময় ইত্যাদিতে বেশি ব্যবহৃত

৬. সমঝোতা স্মারক (MoU)

সমঝোতা স্মারক বা MoU (Memorandum of Understanding) হল একটি আনুষ্ঠানিক অথচ অ-আইনি লিখিত দলিল, যা সাধারণত দুটি বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই দলিলে মূলত পক্ষগুলো কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া, অভিপ্রায়, উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যতে একসাথে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এটি চুক্তির মতো বাধ্যবাধকতা তৈরি না করলেও, MoU পক্ষগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে দেয়, যা পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে।

MoU হলো এক ধরনের কৌশলগত দলিল, যা আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যায়ে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে। এই দলিল আইনের দৃষ্টিতে বাধ্যতামূলক না হলেও নীতিগত ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে একটি পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখার নিমিত্তে এরূপ সমোঝতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

বিশেষ করে, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যখন আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পাদনের আগে পারস্পরিক বিশ্বাস, বোঝাপড়া এবং কাঠামো গঠনের প্রয়োজন হয়, তখন MoU একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, অর্থনৈতিক উদ্যোগ, বা কৌশলগত সহযোগিতার শুরুতে MoU স্বাক্ষরের মাধ্যমে সম্পর্কের ভিত শক্তিশালী করা হয়।

সমঝোতা স্মারকের বৈশিষ্ট্যঃ

সমঝোতা স্মারক (MoU) হলো একটি লিখিত দলিল যা দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, অঙ্গীকার ও ভবিষ্যৎ সহযোগিতার দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করে। এটি একটি প্রাথমিক কাঠামো যা পক্ষগুলোর মধ্যে সম্পর্ক গঠনের সূচনা করে এবং সেই সম্পর্ককে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করতে সহায়তা করে। MoU-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি সাধারণত আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না। অর্থাৎ, যদি কোনো পক্ষ এতে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতি পালন না করে, তাহলে অন্য পক্ষের পক্ষে আইনি প্রতিকার চাওয়া কঠিন হয়, যদিও কিছু ক্ষেত্রে একে “gentleman's agreement” হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এছাড়া, MoU দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক উভয়ই হতে পারে। যেমনঃ ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি MoU স্বাক্ষরিত হয় যেখানে হজ ব্যবস্থাপনা ও ধর্মীয় পর্যটনে সহযোগিতার সম্ভাব্যতা নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এটি কোনো বাধ্যতামূলক চুক্তি ছিল না, তবে পরবর্তীতে কার্যকর হজ ব্যবস্থাপনা গঠনে এটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। একইভাবে, ২০২১ সালে BIMSTEC সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ডিজিটাল সহযোগিতা এবং সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি বহুপাক্ষিক MoU স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তথ্য বিনিময়, দক্ষতা উন্নয়ন ও গবেষণামূলক সহযোগিতা বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন করা হয়।

MoU প্রায়ই কারিগরি, প্রতিরক্ষা, কৌশলগত, বা শিক্ষাগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন নিয়ে একটি MoU স্বাক্ষর হয়, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে কারিগরি জ্ঞান বিনিময়ের পথ সুগম হয়। এসব MoU শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ, একাডেমিক বিনিময় ও যৌথ গবেষণা কার্যক্রমে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে।

MoU-এর গুরুত্বঃ

MoU-এর গুরুত্ব বহুমাত্রিক। এটি প্রায়শই একটি পূর্ণাঙ্গ Treaty বা Agreement-এর পূর্বধাপে কাজ করে, যেখানে পক্ষগুলো কোনো স্থায়ী আইনি বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রস্তুত নয়, কিন্তু পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার দরজা খোলা রাখতে চায়। MoU এক্ষেত্রে একটি কৌশলগত প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে যা পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি করে এবং যৌথ উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো প্রদান করে।

উদাহরণস্বরূপঃ ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে কৃষি ও মৎস্য খাতে সহযোগিতা নিয়ে একটি MoU স্বাক্ষরিত হয়। এই স্মারকের মাধ্যমে উভয় দেশই গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি বিনিময়ের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে এই MoU-এর ভিত্তিতে বাংলাদেশে ইন্দোনেশিয়ার কিছু কৃষি প্রযুক্তি পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এছাড়াও, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে একটি MoU স্বাক্ষরিত হয়, যার ভিত্তিতে “Big B” (Bay of Bengal Industrial Growth Belt) প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন রেল ও সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ শুরু হয়। এভাবে, অনেক সময় MoU-এর মাধ্যমেই দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সহযোগিতা শুরু হয়।

MoU ভবিষ্যতের চুক্তি বা Treaty-এর ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করে। পক্ষগুলো MoU-এর মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং যদি তা সফল হয়, তাহলে তার ভিত্তিতে তারা পূর্ণাঙ্গ Treaty বা Agreement স্বাক্ষরে অগ্রসর হয়। যেমনঃ ২০০৫ সালে, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বে-সামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা নিয়ে একটি MoU স্বাক্ষরিত হয়, যা পরবর্তীতে ২০০৮ সালে পূর্ণাঙ্গ "U.S.–India Civil Nuclear Agreement" চুক্তিতে রূপ নেয়।

MoU সম্পর্ক উন্নয়নে একটি সফট কিন্তু কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি পারস্পরিক স্বার্থ নির্ধারণে সহায়তা করে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তি তৈরি করে, এবং অনেক সময় রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা এড়িয়ে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করতে সাহায্য করে।

উপসংহারঃ

আন্তর্জাতিক আইনের প্রধান প্রধান উপাদান হিসেবে Treaty, Convention, Doctrine, Agreement, এবং Memorandum of Understanding (MoU) ইত্যাদি একত্রে একটি জটিল ও সুশৃঙ্খল আইনি কাঠামো গড়ে তোলে, যা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।  যেখানে চুক্তি ও কনভেনশন আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে, সেখানে এগ্রিমেন্ট ও MoU নমনীয় ও বাস্তবমুখী সহযোগিতার ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করে। আর Doctrine রাষ্ট্রীয় কূটনীতি ও কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণে গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের নেতৃত্ব ও নীতি স্থির করে। এই উপাদানগুলো আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় আইনি প্রেক্ষাপট ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন ও সম্পর্ক পরিচালনায় অপরিহার্য। তাই আন্তর্জাতিক আইনের এই বহুমাত্রিক গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত উপাদানগুলোর যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্ব পরিসরে শান্তি, নিরাপত্তা এবং সহাবস্থান বজায় রাখা সম্ভব ও সঙ্গত।

 

-
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

 


No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.