Header Ads

Header ADS

Mahan এর Sea Power তত্ত্ব: নৌ-শক্তি ও ভূরাজনীতি




ভূ-রাজনীতি বা Geopolitics আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি অপরিহার্য শাখা, যা রাষ্ট্রের শক্তি, প্রভাব, নিরাপত্তা এবং কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে রাষ্ট্রগুলো তাদের শক্তি বজায় রাখতে ও বিশ্বমঞ্চে প্রাধান্য বিস্তারের জন্য ভূ-রাজনৈতিক নীতি অবলম্বন করেছে। এই প্রেক্ষাপটে স্থলশক্তি (Land Power) এবং সমুদ্রশক্তি (Sea Power)–এর দ্বন্দ্ব এক দীর্ঘমেয়াদী বিতর্ক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ভূ-রাজনীতির কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব (Heartland Theory, Rimland Theory ইত্যাদি) অনুসারে স্থলভাগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্বশক্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব; আবার এর বিপরীতে Mahan ও Spykesman এর মত প্রভাবশালী ভূ-রাজনৈতিক তাত্ত্বিকগণ দাবী করেন যে, সমুদ্রপথে যোগাযোগ (Sea Lines of Communications- SLOCs) এবং শক্তিশালী নৌবাহিনীই বিশ্বশক্তির মূল চালিকাশক্তি।

এই বিতর্কের কেন্দ্রে অন্যতম প্রভাবশালী নাম হলো Alfred Thayer Mahan (১৮৪০-১৯১৪)। Mahan ছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর একজন বিশিষ্ট কর্মকর্তা, সামরিক কৌশলবিদ এবং নৌ-ইতিহাসবিদ। ১৮৯০ সালে তিনি The Influence of Sea Power upon History, 1660–1783  শীর্ষক তার অমর গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যা সমুদ্রশক্তি এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী হিসেবে গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। Mahan তার Sea Power তত্ত্বে দাবী করেন যে, ইতিহাসে যেসব রাষ্ট্র সমুদ্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, তারা কেবল সামরিক শক্তিতেই প্রাধান্য লাভ করেনি; বরং অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছে। 

Mahan এর Sea Power Theory এর মূল ভিত্তি হলো: রাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি সমুদ্রশক্তি (Sea Power) দ্বারা বাড়ানো যায়। তিনি বলেন যে শক্তিশালী নৌবাহিনী, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নৌপথের নিয়ন্ত্রণ এবং উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র ঘাঁটি স্থাপন রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী করে তোলে। এই তত্ত্ব বিংশ শতাব্দীর সামরিক কৌশল, সাম্রাজ্যবাদ, দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং একবিংশ শতকের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। 

এই নিবন্ধে আমরা Mahan এর Sea Power তত্ত্বের পটভূমি, মূল ধারণা, মৌলিক উপাদান, প্রভাব, সমালোচনা এবং সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করবো। অত্র প্রবন্ধের মাধ্যমে আমরা বুঝতে চেষ্টা করবো কিভাবে Mahan এর Sea Power তত্ত্ব কেবল এক ঐতিহাসিক ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়, বরং সমকালীন আন্তর্জাতিক কৌশল ও নীতি নির্ধারণেও অত্যান্ত প্রাসঙ্গিক। 

Mahan এর Sea Power তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

Mahan এর Sea Power Theory বোঝার জন্য উনবিংশ শতকের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি অপরিহার্য। এই সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা, শিল্পবিপ্লবের প্রভাব, বাণিজ্যিক উদ্ভাবন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যা সমুদ্রশক্তিকে রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং প্রভাবের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে ।

ক.     ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা এবং শক্তিশালী নৌবাহিনীর গুরুত্বঃ পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যথাঃ ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডস প্রথমে উপনিবেশ স্থাপন ও সমুদ্রপথে বাণিজ্য সম্প্রসারণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। উনবিংশ শতকের মধ্যে, আফ্রিকা, এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন অঞ্চল পুরোপুরি ইউরোপীয় উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়।  এই প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তিশালী নৌবাহিনী কেবল প্রতিরক্ষা নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদ প্রাধান্য বিস্তারের মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ নৌবাহিনী (Royal Navy) সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করে ভারতের উপনিবেশ বজায় রাখে এবং পাশাপাশি বৈশ্বিক বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। Mahan তার গ্রন্থে বলেন, ইতিহাসে যে রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী নৌবাহিনী দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ (SLOCs) এবং উপকূলীয় অঞ্চল (Rimland) নিয়ন্ত্রণ করেছে, তারা বিশ্ব রাজনীতিতে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব অর্জন করেছে।

খ.     শিল্পবিপ্লব এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যিক চাপঃ ১৮০০–১৮৫০ সালের মধ্যে শিল্পবিপ্লব ইউরোপীয় অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটায়। নতুন প্রযুক্তি, বাষ্পচালিত যন্ত্রপাতি এবং উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে অধিক পরিমাণে শিল্পপণ্য উৎপাদন সম্ভব হয়। একই সময়ে বাজার সম্প্রসারণ এবং কাঁচামাল সংগ্রহ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর জন্য জরুরি হয়ে ওঠে। এ কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো সমুদ্রপথ এবং বাণিজ্যিক নৌপথের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পরে।  উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ বাণিজ্য নৌপথ ভারত এবং চীনের সাথে যুক্ত ছিল, যা ভারতীয় কাঁচামাল এবং চীনের চা ও সিল্ক বিশ্ববাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করত। এমন পরিস্থিতিতে সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ বৃটেনের অর্থনৈতিক প্রাধান্য নিশ্চিত করতে তৎকালীন ইউরোপীয় বিশ্বব্যবস্থায় জরুরি হয়ে ওঠে। Mahan বলেন যে, সমুদ্রশক্তি (Sea Power) রাষ্ট্রের সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে।

গ.    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান এবং আন্তর্জাতিক কৌশল: ১৮৬১–১৮৬৫ সালের আমেরিকান গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিনত হতে থাকে। দেশটি অভ্যন্তরীণভাবে সংহত এবং শিল্পায়িত হওয়ায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য শক্তিশালী নৌবাহিনী এবং সমুদ্রপথের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে অপরিহার্য হিসেবে বিবেচনা করে। Mahan এর যুক্তি ছিলো, যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকার অর্থেইবৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তবে তাকে উন্নত নৌবাহিনী, বাণিজ্যিক নৌপথ নিয়ন্ত্রণ এবং উপকূলীয় অঞ্চলে শক্তিশালী ও আধুনিক নৌঘাঁটি স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। Mahan দাবী করেন যে, রাষ্ট্রের শক্তি কেবল স্থলভাগের ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং সমুদ্রশক্তি, নৌবাণিজ্য ও উপকূলীয় কৌশলগত অবস্থান রাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রাধান্য নির্ধারণে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, উনিশ শতকের শেষার্ধ্ব থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জার্মানি ও জাপান Mahan এর Sea Power তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের নৌবাহিনীকে শক্তিশালী ও উন্নতকরণের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল। 

ঘ.     আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও সামরিক দৃষ্টিকোণ: উনবিংশ শতকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল শক্তিশালী নৌবাহিনীর কৌশলগত গুরুত্ব। সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে রাষ্ট্রের বাণিজ্য ও নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। Mahan বলেন যে, সমুদ্রশক্তি কেবল আক্রমণ বা প্রতিরক্ষা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, কৌশলগত শক্তিশালী অবস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রাধান্য নিশ্চিত করে। 

Mahan এর Sea Power তত্ত্বের পটভূমি হিসেবে সব ঘটনা এবং প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা, শিল্পবিপ্লবের প্রভাব, বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান ইত্যাদির জটিল ইতিহাসই Mahan কে Sea Power Theory প্রণয়নে অনুপ্রাণিত করেছে।

Sea Power Theory-এর মূল ধারণা: 

Alfred Thayer Mahan এর Sea Power Theory এর মূল ভিত্তি হলো রাষ্ট্রের শক্তি ও প্রভাব সমুদ্রশক্তির মাধ্যমে বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাঁর বিশ্লেষণ কেবল সামরিক কৌশল বা নৌবাহিনীর ক্ষমতার কেন্দ্রিক নয়, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের পারস্পরিক সম্পর্কের নিরিখে গঠিত। Mahan এর Sea Power তত্ত্বকে গভীরভাবে অনুধাবনের কতিপয় ধারণা/ কনসেপ্ট সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরি। যেমন: 

ক।     Sea Power এর সংজ্ঞা: Mahan এর মতে, সমুদ্রশক্তি (Sea Power) হলো রাষ্ট্রের এমন ক্ষমতা, যা নৌবাহিনী, বাণিজ্যিক নৌপথ এবং কৌশলগত উপকূলীয় অবস্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম করে তোলে। তিনি বলেন যে, কেবল স্থলভাগের ক্ষমতা বা সেনা বাহিনী দ্নির্ভর রাষ্ট্রের প্রভাব আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সীমিত; শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনী দ্বারা সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগত প্রাধান্য অর্জনে সক্ষম করে তোলে।

খ।     Command of the Sea: Alfred Thayer Mahan-এর Sea Power তত্ত্বের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো “Command of the Sea” (সমুদ্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা)। এর অর্থ হলো যে রাষ্ট্র সমুদ্রপথে প্রতিদ্বন্দ্বী নৌবাহিনীকে পরাজিত করতে এবং বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, সেই রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। 

Mahan বলেন যে, Command of the Sea (সমুদ্রের উপর নিয়ন্ত্রণ) অর্জন মানে কেবল আক্রমণাত্মক ক্ষমতার্জন (Offensive Power) নয়; বরং পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রক্ষণাবেক্ষণ, নৌপথ নিরাপত্তা, এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার। অর্থাৎ, এটি একটি সমন্বিত কৌশল, যা একটি রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং কূটনৈতিক প্রভাব একসাথে নিশ্চিত করে।

ইতিহাসে এর অন্যতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে Royal Navy (ব্রিটিশ নৌবাহিনী)। ব্রিটিশ রয়েল নৌবাহিনী সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সব সমুদ্রপথের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যপথ ও উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বরাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতো। এর ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য দীর্ঘকাল বৈশ্বিক শক্তি (Global Power) হিসেবে নিজ অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

অন্যদিকে, যেসব রাষ্ট্র নৌবাহিনী শক্তিমত্তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, তারা ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব হারিয়েছে। যেমন: উনবিংশ শতকের শেষ দিকে স্পেন নেদারল্যান্ডস(ডাচ) নৌক্ষমতার পতনের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের পূর্বের প্রভাব-প্রতিপত্তি হারায়। Mahan তার বিশ্লেষণে বলেন যে, Command of the Sea কেবল একটি সামরিক সুবিধা নয়; বরং এটি একটি সর্বাত্মক শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা যা রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে।

গ।     নৌবাহিনী ও বাণিজ্যের পারস্পরিক সম্পর্ক: Alfred Thayer Mahan তার বিখ্যাত The Influence of Sea Power upon History (1890) গ্রন্থে জোর দিয়ে বলেন যে শক্তিশালী নৌবাহিনী এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত এবং পরস্পরের পরিপূরক। তার মতে, একটি রাষ্ট্রের নৌ-শক্তি কখনো একা কার্যকর হতে পারে না; বরং এটি বাণিজ্যিক শক্তির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে কাজ করে। একটি সুরক্ষিত, আধুনিক এবং কৌশলগতভাবে সক্রিয় নৌবাহিনী রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নৌপথ বা Sea Lanes of Communication (SLOCs) নিরাপদ রাখে। এর ফলে বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি, এবং উপনিবেশিক অর্থনীতি বাধাহীনভাবে চলতে পারে। একইসাথে, বাণিজ্যের সম্প্রসারণ রাষ্ট্রকে বিপুল সম্পদ, রাজস্ব এবং কৌশলগত সুবিধা প্রদান করে, যা আবার নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ, নৌবাহিনী বাণিজ্যকে রক্ষা করে, আর বাণিজ্য নৌবাহিনীকে আর্থিক শক্তি যোগায়। এই পারস্পরিক পরিপূরকতা একটি রাষ্ট্রকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে।

Mahan এর ভাষায়,  ইতিহাসে যেসব রাষ্ট্র নৌবাহিনী ও বাণিজ্যের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য তৈরি করতে পেরেছে, তারা বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য Royal Navy-এর আধিপত্য এবং বিস্তৃত বৈশ্বিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কের কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নেতৃত্বের আসন দখল করে। তাদের শক্তিশালী নৌবাহিনী আটলান্টিক, ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরে বাণিজ্যপথকে সুরক্ষিত করে, আর উপনিবেশ থেকে সংগৃহীত সম্পদ তাদের নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে। অন্যদিকে, যেসব রাষ্ট্র নৌবাহিনী ও বাণিজ্যের মধ্যে এই ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেনি, যেমন স্পেন বা নেদারল্যান্ডস, তারা ক্রমে প্রভাব হারিয়েছে। Mahan এর মতে, কেবলমাত্র যুদ্ধজয়ের ক্ষমতা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবাহ ও বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই টেকসই সামুদ্রিক শক্তি এর মূল ভিত্তি।

এছাড়া, Mahan আরও বলেন যে একটি রাষ্ট্রের সমুদ্রশক্তি (Sea Power) কার্যকর হতে হলে তিনটি উপাদান অপরিহার্য: আধুনিক নৌবাহিনী, শক্তিশালী বাণিজ্য এবং কৌশলগত উপকূলীয় নৌঘাঁটি। এই তিনটির সমন্বয় ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে বৈশ্বিক সমুদ্রশক্তি অর্জন সম্ভব নয়। একবিংশ শতকের বর্তমান প্রেক্ষাপটেও এই ধারণা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী নৌবাহিনী বৈশ্বিক বাণিজ্যপথকে সুরক্ষিত রাখে, আর আমেরিকার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক শক্তি তার নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণে সহায়তা করে। একইভাবে, চীনের Belt and Road Initiative (BRI) এবং Maritime Silk Road প্রকল্প চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও চীনের নৌ-শক্তিকে সমন্বিত করে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের আধুনিক রূপ তুলে ধরে। 

Sea Power কীভাবে নির্ধারিত হয়? 

Mahan তাঁর বিখ্যাত The Influence of Sea Power upon History, 1660–1783 গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, একটি রাষ্ট্রের সমুদ্রশক্তি (Sea Power) কিছু মৌলিক উপাদানের কল্যাণে নির্ধারিত হয়। এই উপাদানগুলো কেবল সামরিক কৌশল নয়, বরং রাষ্ট্রের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। যেমন: 

১. ভৌগোলিক অবস্থান: Mahan এর মতে, রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান সমুদ্রশক্তির (Sea Power) একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। সমুদ্রপথে সুবিধাজনক অবস্থান রাষ্ট্রকে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং নৌকৌশল অর্জনে বড় সুবিধা প্রদান করে।  উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেন সমুদ্রবেষ্টিত একটি রাষ্ট্র হওয়ায় সে  ইউরোপীয় মহাশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এছাড়া, ভৌগোলিক অবস্থান ব্রিটেনকে সামুদ্রিক বাণিজ্যিক নৌপথ নিয়ন্ত্রণের আগ্রহী করে তোলে। যেমন- আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যবর্তী আটলান্টিক মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ শুধু শক্তিশালী নৌবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল, যেক্ষেত্রে ব্রিটেন ছিলো এগিয়ে। 

২. ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক গঠন: প্রাকৃতিক সুবিধা, যেমন প্রাকৃতিক বন্দর, দীর্ঘ উপকূলরেখা, এবং নৌযান চলাচল উপযোগী নদী ও মোহনা, সমুদ্রবাণিজ্য ও নৌবাহিনী কার্যক্রমে সহায়ক। Mahan এর মতে, নেদারল্যান্ডস এবং ব্রিটেনের মতো দেশ প্রাকৃতিক বন্দরের (Harbour) কারণে সামুদ্রিক বাণিজ্য ও নৌবাহিনী দ্রুত সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, পোর্টসমাউথ এবং লন্ডনের প্রাকৃতিক বন্দর ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে, যা সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একইভাবে, পর্তুগালের লিসবনও প্রাকৃতিক বন্দরের জন্য বিখ্যাত ছিলো, যা পর্তুগীজদের প্রথম ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে, তাকে পরবর্তীতে অনুসরণ করে স্পেন ও ফ্রান্স, এবং সর্বশেষ ব্রিটেন। 

৩. ভূখণ্ডের আকার ও সম্পদ: বৃহৎ ভূখণ্ড মানে বৃহৎ অর্থনীতি, যা শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সামরিক, অর্থনৈতিক ও কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করে। Mahan এ ক্ষেত্রে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের উদাহরণ দেন। তারা অধিক উপনিবেশ তাদের শক্তিশালী নৌবাহিনী পরিচালনার জন্য অপরিহার্য অর্থনৈতিক, সামরিক ও কাঁচামাল প্রদান করতো। বৃহৎ ভূখণ্ডের মানে কেবল সম্পদ নয়, বরং উৎপাদনশীল জনসংখ্যা ও রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতাও, যা সমুদ্রশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। বৃটিশ ভারতের উদাহরণ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য।   

৪. জনসংখ্যাঃ জনসংখ্যা কেবল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের জন্য চাই দক্ষ মানবসম্পদের সহজলভ্যতা। Mahan বলেন যে, শক্তিশালী সমুদ্রশক্তি গঠনে পর্যাপ্ত জনসংখ্যা প্রয়োজনীয়, যাতে প্রশিক্ষিত নাবিক ও নৌসদস্যদের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেনের জনসংখ্যা ও শ্রমশক্তি তাকে নৌবাহিনী পরিচালনার ক্ষমতা প্রদান করেছে। কিন্তু, উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রচুর মানব সম্পদ বৃটেনের নৌ-শক্তি বিস্তার ও আধুনিকায়নের পথ প্রশস্ত করেছে। 

৫. জাতীয় চরিত্রঃ Mahan জাতীয় চরিত্রকে (National Character) সমুদ্রশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। জনগণের বাণিজ্যপ্রবণতা, সমুদ্রকেন্দ্রিক মনোভাব, সাহসিকতা এবং উদ্যোগী মনোভাব রাষ্ট্রকে সমুদ্রশক্তি (Sea Power) হতে অনুপ্রেরণা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ডাচ ও ব্রিটিশ নাবিকদের উদ্যোক্তা মনোভাব এবং সমুদ্রযাত্রায় তাদের ক্রমাগত অব্যস্থতা ও দক্ষতা রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রভাবশালী করেছে।

৬. সরকারের চরিত্র ও নীতিঃ দক্ষ ও দূরদর্শী সরকার সমুদ্রশক্তি উন্নয়নে অপরিহার্য। সরকার যদি নৌবাহিনী নির্মাণ, বাণিজ্যিক নীতি প্রণয়ন এবং কৌশলগত বন্দরের উন্নয়নে সক্রিয় হয়, তবে রাষ্ট্র সমুদ্রশক্তিতে প্রাধান্য অর্জন করতে পারে। মাহান দেখিয়েছেন যে, ব্রিটিশ সরকার সমুদ্রশক্তি উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ করায় ব্রিটেন বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। 

Sea Power Theory-এর প্রভাবঃ 

Mahan এর Sea Power Theory–এর প্রভাব উনবিংশ ও বিংশ শতকের আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সামরিক কৌশল এবং সামুদ্রিক নীতির উপর ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই তত্ত্ব কেবল শক্তিশালী নৌবাহিনীর গুরুত্ব নয়, বরং কীভাবে সমুদ্রশক্তি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত প্রাধান্য নির্ধারণে প্রভাব ফেলে, তা বিশ্লেষণ করে।

ক. যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রভাবঃ  Mahan-এর Sea Power Theory যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ও সামরিক কৌশলে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট Theodore Roosevelt-এর সময়ে। Mahan তার গ্রন্থের মাধ্যমে দাবী করেন যে, একটি রাষ্ট্র যদি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যপথ ও কৌশলগত নৌঘাঁটি নিয়ন্ত্রণ করে, তবে সে রাষ্ট্র সহজেই আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট Roosevelt এই তত্ত্বকে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক নীতি পরিকল্পনার কেন্দ্রে স্থাপন করেন। 

তার সময়ে নেওয়া কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে Mahan-এর প্রভাব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। প্রথমত, পানামা খাল খনন (১৯১৪) যুক্তরাষ্ট্রকে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে দ্রুত নৌ-সংযোগের সুযোগ দেয়, যা মার্কিন নৌবাহিনীর গতিশীলতা এবং বাণিজ্যিক প্রভাব বাড়ায়। দ্বিতীয়ত, ফিলিপাইন ও হাওয়াই অঞ্চল অধিগ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রশান্ত মহাসাগরে কৌশলগত অবস্থান নিশ্চিত করে, যা পূর্ব এশিয়ার বাজার ও রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হয়। তৃতীয়ত, Roosevelt মার্কিন নৌবাহিনীকে আধুনিকীকরণে উদ্যোগী হন এবং “Great White Fleet” বিশ্বভ্রমণে পাঠান, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার সামুদ্রিক শক্তি প্রদর্শন করায়।

এই সব উদ্যোগের ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র কেবল আটলান্টিক নয়, প্রশান্ত মহাসাগরেও একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। Roosevelt-এর সামুদ্রিক নীতিগুলো Mahan-এর Sea Power তত্ত্বের বাস্তবায়ন হিসেবে কাজ করে এবং বিংশ শতকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বৈশ্বিক মহা সামুদ্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে।

খ. ইউরোপীয় শক্তির উপর প্রভাবঃ Mahan-এর Sea Power তত্ত্ব শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপীয় শক্তির সামুদ্রিক কৌশল ও নীতিকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। উনবিংশ শতকের শেষভাগ এবং বিংশ শতকের শুরুতে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারণ করলে, শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনী ছিল তাদের শক্তি প্রদর্শন, উপনিবেশ রক্ষা এবং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের মূল হাতিয়ার। 

জার্মানি, Kaiser Wilhelm II-এর শাসনামলে, Kaiserliche Marine নামে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলে। এর মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ নৌ আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা এবং বিশ্ব রাজনীতিতে জার্মানির সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা।  Mahan-এর সমুদ্রশক্তির গুরুত্বের ধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জার্মান Admiral Alfred von Tirpitz “Tirpitz Plan” নামক নতুন নৌ পরিকল্পনার অধীনে জার্মান নৌবাহিনী দ্রুত সম্প্রসারিত করতে শুরু করে।

অন্যদিকে, ব্রিটেন তার সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য “Two Power Standard” নীতি বজায় রাখে। এর অর্থ ছিল যে, Royal Navy-কে সর্বদা ইউরোপের দুটি বৃহৎ শক্তির সম্মিলিত নৌবাহিনীর তুলনায় বেশি শক্তিশালী থাকতে হবে। এই নীতি মূলত Mahan-এর তত্ত্বের প্রতিফলন, যেখানে বলা হয়েছিল সমুদ্র নিয়ন্ত্রণই হলো রাষ্ট্রের মহাশক্তি হওয়ার প্রকৃত উৎস। এই নীতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বৈশ্বিক বাণিজ্যপথ, উপনিবেশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভুত্ব ধরে রাখতে সাহায্য করে। 

ফলস্বরূপ, Mahan-এর তত্ত্ব ইউরোপে নৌ প্রতিযোগিতাকে উস্কে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রেক্ষাপট তৈরি করে। জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে Dreadnought class battleship-এর আবির্ভাব, এর বড় দৃষ্টান্ত। 

গ. জাপানি নৌ-বাহিনীতে প্রভাবঃ Mahan-এর Sea Power Theory মেইজি আমলের জাপানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মেইজি পুনর্গঠন (Meiji Restoration)–এর পর জাপান দ্রুত আধুনিকায়নের পথে অগ্রসর হয় এবং আমেরিকার উদাহরণ থেকে বুঝতে পারে যে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী ছাড়া বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ সম্ভব নয়। সেই সময় জাপানি নৌকৌশলবিদ ও নীতিনির্ধারকেরা Mahan-এর The Influence of Sea Power upon History গ্রন্থ অধ্যয়ন করে নৌবাহিনী সম্প্রসারণের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। 

Mahan-এর ধারণা অনুযায়ী, সমুদ্রশক্তি (Sea Power) কেবল যুদ্ধজয়ের জন্য নয়, বরং অর্থনৈতিক প্রাধান্য ও কৌশলগত নিরাপত্তা অর্জনের মূল ভিত্তি। জাপান এই তত্ত্বকে গ্রহণ করে আধুনিক যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ, প্রশিক্ষণ ও নৌঘাঁটি উন্নয়নে মনোযোগ দেয়। এর সরাসরি ফলাফল দেখা যায় রুশ-জাপান যুদ্ধ (১৯০৪-১৯০৫)-এ, যেখানে জাপানি নৌবাহিনী Tsushima যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার Baltic Fleet-কে পরাজিত করে। এই ঐতিহাসিক বিজয় শুধু জাপানকেই নয়, বরং গোটা এশিয়ায় জাপানকে মহাশক্তিতে রূপ দেয় এবং ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা জাপানকেও প্রাচ্যের মহাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। 

ঘ. বিশ্বযুদ্ধসমূহে প্রভাবঃ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও মাহানের তত্ত্ব প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। বিশেষ করে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ যুদ্ধের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপঃ  

জার্মান U-Boat Campaign: প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি সাবমেরিন ব্যবহার করে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রতিষ্ঠিত Allied Convoy System ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে। Mahan-এর তত্ত্ব অনুযায়ী, যে রাষ্ট্র সমুদ্রপথে আধিপত্য বজায় রাখবে, তারই অর্থনৈতিক ও সামরিক জয়লাভ নিশ্চিত হবে। জার্মানির কৌশল ছিল “Sea Denial”, অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে সমুদ্রপথ ব্যবহার থেকে বিরত রাখা। তবে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ ও মার্কিন Anti-Submarine Warfare (ASW) কৌশল, যেমনঃ Sonar, Depth Charges এবং Convoy Escort ইত্যাদি ব্যবস্থার উন্নয়ন, জার্মানির সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে শেষ করে দেয়। 

Battle of Midway (১৯৪২): প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে সংঘটিত এই যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। Mahan-এর Decisive Battle (আক্রমণাত্মক যুদ্ধ) ধারণা অনুযায়ী, একবার সমুদ্রযুদ্ধে প্রতিপক্ষের নৌবাহিনীকে বিধ্বস্ত করলে সমুদ্রপথে প্রাধান্য নিশ্চিত হয়। Midway-এ মার্কিন নৌবাহিনী জাপানের চারটি Aircraft Carrier ধ্বংস করে, যার ফলে জাপান আর প্রশান্ত মহাসাগরে কৌশলগত শক্তি হারিয়ে ফেলে। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে যে Carrier-Centric Naval Strategy, যা Mahan-এর সমুদ্রনিয়ন্ত্রণ তত্ত্বের আধুনিক রূপ—যুদ্ধের ফল নির্ধারণে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

Pacific Island Hopping Campaign:  যুক্তরাষ্ট্রের “Island Hopping” কৌশলও Mahan-এর ধারণার সরাসরি প্রতিফলন। Forward Naval Bases নীতির আদলে যুক্তরাষ্ট্র ধাপে ধাপে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট ছোট অনেক দ্বীপ দখল করে নৌঘাঁটি স্থাপন করে, যাতে করে যুদ্ধকালে জাপানের বাণিজ্যিক ও সামরিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের Sea Lines of Communication (SLOCs) কেটে দেয়, যা জাপানের নৌশক্তি নির্ভর যুদ্ধক্ষমতা দুর্বল করে ফেলে। 

Mahan এর Sea Power Theory-এর সমালোচনা

যদিও Mahan এর Sea Power Theory আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সামুদ্রিক নীতি বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তবুও এটি একাধিক কারণে সমালোচিত। যথাঃ 

প্রথমত, Mahan স্থলশক্তির (Land Power) গুরুত্বকে যথেষ্ট প্রাধান্য দেননি। ইতিহাস থেকে প্রমাণিত এবং হালফোর্ড ম্যাকিন্ডারের Heartland তত্ত্বমতে, নৌ-শক্তির মাধ্যমে সমুদ্রের উপর আধিপত্য বিস্তারের ন্যায় স্থলভাগ নিয়ন্ত্রণও আন্তর্জাতিক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। স্থলভাগের ভূকৌশলগত অবস্থান, অভ্যন্তরীণ সম্পদ এবং স্থল সেনার ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী করতে পারে, যা মাহানের নৌ-কেন্দ্রিক বিশ্লেষণে কম গুরুত্ব পেয়েছে।

দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন Mahan এর Sea Power তত্ত্বকে আরও সীমিত করেছে। আধুনিক যুদ্ধ কেবল নৌবাহিনীর উপর নির্ভরশীল নয়; বিমান বাহিনী, সাবমেরিন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সংযোজন সমুদ্রশক্তির প্রাধান্য হ্রাস করেছে। উদাহরণস্বরূপঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমুদ্র যুদ্ধেই এভিয়েশন ও সাবমেরিন কৌশলের ভূমিকা নৌবাহিনীর ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।

তৃতীয়ত, Mahan তার তত্ত্বে আধুনিক রাষ্ট্রের শক্তিকে কেবল নৌবাহিনী ও বাণিজ্যের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করেছেন। তবে, আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি, অর্থনীতি, কূটনীতি, Soft Power, তথ্য ও নেটওয়ার্ক ক্ষমতার ওপরও রাষ্ট্রের শক্তি নির্ভর করে। অর্থাৎ, নৌবাহিনী একটি রাষ্ট্রের শক্তি অর্জনের একক উপাদান নয়, বরং রাষ্ট্রের শক্তি বহুমাত্রিক ও অন্তর্নিহিত।

চতুর্থত, Mahan এর Sea Power তত্ত্ব কখনো কখনো আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে বৈধতা প্রদান করে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাঁর ধারণা ব্যবহার করে উপনিবেশ দখল ও নৌবাণিজ্য সম্প্রসারণকে যৌক্তিকতা প্রদান করে। ফলে, সমুদ্রশক্তি তত্ত্ব কেবল প্রতিরক্ষা বা বাণিজ্য নিরাপত্তারই কৌশল নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নীতি হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে। 

Mahan এর Sea Power Theory-এর সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা 

Mahan-এর Sea Power Theory–এর আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা এখনও বৈশ্বিক রাজনীতি ও সামরিক কৌশলে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজও তার নৌবাহিনীকে বৈশ্বিক শক্তির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন নৌবাহিনী প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নৌপথ ও Chokepoint নিয়ন্ত্রণ করে, যা দেশটিকে বৈশ্বিক নেতৃত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের নৌ-শক্তি আধুনিকরণ ও সম্প্রসারণ এবং চীনের Belt and Road Initiative–এর মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসোফিক অঞ্চলের সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা Mahan-এর Sea Power তত্ত্বের আধুনিক প্রতিফলন। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কৌশলগত নৌপদক্ষেপ শুধু সামরিক শক্তি নয়, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করে।

বিশ্বের কৌশলগত চোক পয়েন্টস, যেমন মালাক্কা প্রণালী, হরমুজ প্রণালী এবং সুয়েজ খাল, আজও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর নীতি ও সামুদ্রিক নীতি নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এই প্রণালীগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শক্তি স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। মাহানের ধারণা কেবল সামরিক কৌশল নয়; এটি ব্লু ইকোনমি (Blue Economy) এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তার আধুনিক কৌশলগত বিশ্লেষণেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ, নৌশক্তি এবং সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে একযোগে কার্যকর হচ্ছে। 

উপসংহারঃ 

Mahan-এর Sea Power Theory বিশ্ব ভূ-রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অবদান হিসেবে বিবেচিত। Mahan-এর ভাষায়, সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ এবং শক্তিশালী নৌবাহিনী রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক শক্তি, অর্থনৈতিক প্রাধান্য এবং রাজনৈতিক প্রভাব অর্জনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য সক্ষমতা প্রদান করে। ইতিহাসে ব্রিটেন, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ এই ধারণার প্রভাবকে স্পষ্ট করে, যেখানে নৌশক্তির আধুনিকরণ ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাষ্ট্র বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে সক্ষম। 

Mahan-এর সমুদ্রশক্তি তত্ত্ব শুধু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আধুনিক ইন্দো-প্যাসিফিক ভূ-রাজনীতি, দক্ষিণ চীন সাগরের নৌশক্তির প্রতিযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথের কৌশলগত গুরুত্বও ব্যাখ্যা করতে সহায়ক। মার্কিন নৌবাহিনী ও চীনের সামুদ্রিক কৌশল এবং গুরুত্বপূর্ণ চোক পয়েন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিযোগিতা Mahan-এর তত্ত্বকে আজও প্রাসঙ্গিক করে তোলে। 


-

বদিরুজ্জামান

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়




No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.