Header Ads

Header ADS

Grand Strategy: রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য অর্জনে সমন্বিত রূপরেখা

 


Grand Strategy-কে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কৌশলগত পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা শুধু রাষ্ট্রের সামরিক শক্তিমত্তার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। এটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, তথ্যগত এবং সামরিক ক্ষমতাকে একত্রিত করে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের একটি সমন্বিত কৌশলগত রূপরেখা। এর মূল উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের প্রভাব বজায় রাখা, শক্তি ভারসাম্য রক্ষা করা এবং সম্ভাব্য সংঘাত ও হুমকি মোকাবিলায় প্রাক-প্রস্তুতি গ্রহণে রাষ্ট্রকে দিকনির্দেশিকা প্রদান করা। 

সামরিক (Military) এবং সামুদ্রিক (Maritime) Strategy কে Grand Strategy-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ গণ্য করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতীয়মান যে, শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনী ছাড়া কোনো রাষ্ট্র বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোয় নিজেদের প্রভুত্ব ও প্রভাব স্থায়ী করতে পারেনি, এবং এই আধুনিক সামরিক শক্তি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের Grand Strategy অনুসারের গড়ে ওঠে। 

Grand Strategy কী

রাষ্ট্রের সামগ্রিক নীতি ও ক্ষমতার সমন্বয়ে রাষ্ট্রের Grand Strategy নির্ধারিত হয়। এটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য নির্ধারিত হয়। প্রখ্যাত কৌশলবিদ John Lewis Gaddis তার বিখ্যাত On Grand Strategy গ্রন্থে Grand Strategy এর সংজ্ঞায় বলেন, “Grand Strategy is the alignment of potentially unlimited aspirations with necessarily limited capabilities”। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের অসীম আকাঙ্ক্ষা ও সীমিত সক্ষমতার মাঝে সমন্বয় করার কৌশলই Grand Strategy। 

Hal Brands তার বিখ্যাত What Good Is Grand Strategy? গ্রন্থে Grand Strategy এর সংজ্ঞায় বলেন, “Grand Strategy is a purposeful and coherent set of ideas about what a nation seeks to accomplish in the world, and how it should go about doing so.” অর্থাৎ, “Grand Strategy হলো সুসংবদ্ধ ও উদ্দেশ্যমূলক চিন্তার এক সমষ্টি, যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র নির্ধারণ করে সে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কী অর্জন করতে চায় এবং কীভাবে সেই লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব।” 

এছাড়াও, Barry R. Posen ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত তার The Sources of Military Doctrine নামক প্রবন্ধে Grand Strategy এর সংজ্ঞায় বলেন, “A state’s grand strategy comprises its theory about how it can best ‘cause’ security for itself.” অর্থাৎ, “গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সেই তাত্ত্বিক ধারণা, যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র সিদ্বান্ত গ্রহণ করে কীভাবে সে নিজের নিরাপত্তা ও স্বার্থকে সর্বোত্তমভাবে নিশ্চিত করতে পারবে।” 

ঐতিহাসিকভাবে Grand Strategy এর দুইটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। যথাঃ সামরিক কৌশল (Military Strategy) এবং সামুদ্রিক কৌশল (Maritime Strategy)। এ পর্যায়ে আমরা উভয় কৌশল সম্পর্ক সংক্ষেপে জানবো। 

Military Strategy হলো সামরিক শক্তি ব্যবহারের এমন একটি কৌশল, যা প্রতিপক্ষের সক্ষমতা ও ইচ্ছাকে হ্রাস করে এবং জাতীয় লক্ষ্য অর্জন পর্যন্ত চালিত হয়। Antulio Echevarria-এর মতে, এটি “the practice of reducing an adversary’s physical capacity and willingness to fight, and continuing to do so until one’s aim is achieved” (Military Strategy: A Very Short Introduction, 2017)। 

আরও বিস্তৃতভাবে, Army University Press-এর প্রবন্ধে বলা হয়েছে, "Military Strategy is the art and science of developing and using the political, economic and psychological powers of a nation, together with its armed forces, during peace and war, to secure national objectives”। অর্থাৎ, এটি শুধু যুদ্ধে সীমাবদ্ধ নয়, শান্তিকালেও রাষ্ট্রের জাতীয় লক্ষ্য ও নিরাপত্তা অর্জনের জন্য সামগ্রিক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

Maritime Strategy হলো সমুদ্রশক্তি ব্যবহারের কৌশলগত নীতি, যা রাষ্ট্রকে সমুদ্রপথ, নৌবাহিনী ও সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করে। Julian Corbett-এর Principles of Maritime Strategy বইয়ে বলা হয়েছে, Maritime Strategy একটি রাষ্ট্রকে সামুদ্রিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য সুরক্ষা এবং প্রতিপক্ষের নৌশক্তি মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়। James R. Holmes-এর A Brief Guide to Maritime Strategy আরও সমসাময়িক প্রেক্ষাপট এবং আধুনিক সমুদ্রকৌশলের প্রয়োগ তুলে ধরে, যা রাষ্ট্রনেতা ও সামরিক কমান্ডারদের কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।

Grand Strategy এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

Grand Strategy- এর ধারণা মানুষের রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজ্ঞতার গভীর ঐতিহাসিক শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মূল ভিত্তি হলোঃ একটি রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের সামরিক শক্তিমত্তা যথেষ্ট নয়; বরং সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, এমনকি সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাদানগুলিকে একত্রে ও সমন্বিতভাবে গুরুত্ব দিতে হয়। এই চিন্তাধারা মানবসভ্যতার প্রাচীন যুগ থেকেই ক্রমে বিকাশ লাভ করেছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সাম্রাজ্য, যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে।

প্রাচীন যুগঃ কিভাবে এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে যুদ্ধ শুধু সামরিক সংঘর্ষ নয়, বরং সামরিক মিত্রতা, অর্থনৈতিক শক্তি, নৌবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব এবং রাজনৈতিক কৌশলের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল তা প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাসে রচিত গ্রিক ঐতিহাসিক ও কৌশলবিদ থুসিডাইডিসের-এর Peloponnesian War গ্রন্থে বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে, চীনের দার্শনিক ও সামরিক কৌশলবিদ  সান জু (Sun Tzu) তার Art of War-এ দেখিয়েছেন যে কিভাবে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণের জন্য সামরিক ধোঁকা, তথ্যনিয়ন্ত্রণ, সময়োপযোগী আক্রমণ এবং মানসিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, রোমান সাম্রাজ্য সামরিক বিজয়ের পাশাপাশি আইন প্রণয়ন, সড়কব্যবস্থা উন্নয়ন, প্রশাসনিক দক্ষতা বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সমন্বয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা নিছক সামরিক কৌশলের বাহিরে এক ধরনের গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজির উদাহরণ হয়ে গৃহীত হয়। 

মধ্যযুগ ও প্রাক-আধুনিক যুগঃ মধ্যযুগে ইসলামী খিলাফত আরব উপদ্বীপ থেকে উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। এই খিলাফত কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের মাধ্যমে নয়, বরং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়ায়। অন্যদিকে, মঙ্গল সাম্রাজ্য সামরিক দাপটের পাশাপাশি এশিয়া-ইউরোপের বিস্তীর্ণ বাণিজ্যপথ (সিল্ক রোড) নিয়ন্ত্রণ করে একটি কৌশলগত নেটওয়ার্ক তৈরি করে। ইউরোপে আবিষ্কার যুগে স্পেন, পর্তুগাল, পরে নেদারল্যান্ডস ও ব্রিটেন সমুদ্রপথ আবিষ্কার করে উপনিবেশ স্থাপন করে, যেখানে নৌবাহিনী, বাণিজ্য, উপনিবেশ প্রশাসন ও সামরিক উপস্থিতির সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদে উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার Grand Strategy প্রয়োগ করা হয়। ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফালিয়ার শান্তি চুক্তি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে এবং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা ঘটে। এর ফলে প্রতিটি রাষ্ট্রকে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং বহির্বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সমন্বিত কৌশল গ্রহণ জরুরি হয়ে ওঠে, যা রাষ্ট্রের গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি বিকাশের প্রয়োজনীতা আরও বাড়িয়ে দেয়। 

আধুনিক যুগঃ অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতক Grand Strategy এর বাস্তব প্রয়োগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। Napoleon Bonaparte সামরিক উদ্ভাবন (Mass Conscription, Corps System) এবং প্রশাসনিক সংস্কার একত্র করে ইউরোপে এক অভূতপূর্ব প্রভাব বিস্তার করেন। একই সময়ে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বৈশ্বিক গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজির উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে ওঠে। নৌবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব, শিল্পবিপ্লব থেকে আসা অর্থনৈতিক শক্তি, উপনিবেশ নেটওয়ার্ক এবং ভারসাম্য নীতির (Balance of Power diplomacy) সমন্বয়ে ইংরেজরা প্রায় শতাব্দীরও বেশি সময় বিশ্বে প্রভুত্ব কায়েম রাখে। এভাবে আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে, গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি আর কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের ধারণা হিসেবে নয়, বরং সামরিক, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, কূটনীতি এবং সাম্রাজ্যবাদ ব্যবস্থাপনার সমন্বিত কাঠামো হয়ে ওঠে।

বিংশ শতক: বিংশ শতকে গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি পূর্ণাঙ্গ অর্থে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ধারণায় পরিণত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) প্রমাণ করে যে একটি রাষ্ট্রকে যুদ্ধ জয়ী হতে কেবল সেনাবাহিনী নয়, বরং শিল্প, অর্থনীতি, প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক উন্নয়নকে সমানভাবে প্রাধান্য দিতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি (বৃটেন, আমেরিকা, সোভিয়েত ও ফ্রান্স) “Europe First” নীতির মাধ্যমে সুসংগঠিত গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি প্রয়োগ করে, যার ফলে জার্মানি ও জাপানের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা সম্ভব হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে স্নায়ুযুদ্ধ (১৯৪৭–১৯৯১) গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি ধারণাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র Grand Strategy হিসেবে Containment Policy গ্রহণ করে, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিরোধ, অর্থনৈতিক সহায়তা (Marshall Plan), নিরাপত্তা জোট (NATO) এবং মতাদর্শিক প্রতিযোগিতা প্রভৃতি সব একসাথে ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়নও নিজস্ব গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি পরিচালনা করে, যেখানে সামরিক বিস্তার, আকাশ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, এবং মতাদর্শ প্রচার ছিল মূল চালিকা শক্তি।

সমসাময়িক বিশ্ব: স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে  Grand Strategy নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রান্ড স্ট্রাটেজির ভবিষ্যত নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র কি বৈশ্বিক প্রাধান্য ধরে রাখতে পারবে? যদি পারে, তাহলে তাকে কি “retrenchment” (সংকোচন) নীতি গ্রহণ করবে, নাকি লিবারেল ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার নীতিকেই অনুসরণ করবে। অপরদিকে, চীন তার নিজস্ব গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি তৈরি করছে, যেখানে অর্থনৈতিক কূটনীতি (Belt and Road Initiative), প্রযুক্তিগত আধিপত্য, সামরিক আধুনিকায়ন এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার প্রাধান্য পাচ্ছে। রাশিয়াও সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি কূটনীতি, সাইবার যুদ্ধ, এবং সামরিক হস্তক্ষেপের (যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ) মাধ্যমে তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ফলে, বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায়ও গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি কেবল রাষ্ট্রের একটি নীতি নয়, বরং স্নায়ুযুদ্ধ কালের মত, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে আবারও শুরু করেছে।

Grand Strategy-এর উদ্দেশ্য

Grand Strategy একটি রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের এক সর্বজনীন পরিকল্পনা, যেখানে সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উপাদানগুলোকে সমন্বিতভাবে ব্যবহার করা হয়। তবে, Grand Strategy কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণীত হয়। যথাঃ 

দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণঃ Grand Strategy রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করে। একটি রাষ্ট্র যদি কেবল স্বল্পমেয়াদী সমস্যার সমাধানে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তাৎক্ষণিক সাফল্য অর্জন সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রভাব টেকসই হয় না। তাই Grand Strategy অত্র রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণে গুরুত্ব দেয়। এর একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ হলো স্নায়ুযুদ্ধকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Containment Policy। এই নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব প্রতিহত করার পাশাপাশি ইউরোপ ও এশিয়ায় স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সাথে জোট গড়ে তোলে, যেমনঃ Central Treaty Organization (CENTO), এবং Southeast Asia Treaty Organization (SEATO)। কৌশলটি শুধু সামরিক প্রতিরোধে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি অর্থনৈতিক সহায়তা (যেমন মার্শাল প্ল্যানের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের পুনর্গঠন) এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের দিককেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণেই সফল হয়নি, বরং পশ্চিমা বিশ্বে তার দীর্ঘমেয়াদী নেতৃত্ব ও প্রভাবও সুসংহত করতে পেরেছিল।

শক্তি ও সম্পদ বণ্টনে সমন্বয়ঃ Grand Strategy রাষ্ট্রের শক্তি ও সম্পদ বণ্টনকে সমন্বয় করে। একটি রাষ্ট্র যদি তার সামরিক শক্তি, অর্থনীতি, কূটনীতি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে আলাদাভাবে ব্যবহার করে তবে তা কার্যকর নাও হতে পারে। কিন্তু Grand Strategy এই সব উপাদানকে একটি সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে এনে জাতীয় লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করে। এর ফলে রাষ্ট্র তার সীমিত সম্পদ সর্বাধিক দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পারে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। এই ধারণাটির একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি পাওয়া যায় Alfred Thayer Mahan এর বিখ্যাত গ্রন্থ The Influence of Sea Power upon History (1890)-এ। Mahan এর ভাষায়, সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য রুটের নিরাপত্তা এবং নৌবাহিনীর আধিপত্য একটি রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম করে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হলো উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের নৌবাহিনী-কেন্দ্রিক গ্রান্ড স্ট্রাটেজি। ব্রিটেন তার শক্তিশালী নৌবাহিনীর মাধ্যমে শুধু উপনিবেশ স্থাপনেই সফল হয়নি, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। 

বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাঃ Grand Strategy রাষ্ট্রকে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করে। আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেবল সামরিক সংঘাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর পরিধি বিস্তৃত হয়ে অর্থনৈতিক সংকট, সাইবার আক্রমণ, তথ্য-প্রযুক্তি কেন্দ্রিক ঝুঁকি এবং কূটনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে একটি রাষ্ট্র যদি শুধু সামরিক কৌশলের উপর নির্ভরশীল হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে সে স্ট্রাটেজি কার্যকর ও টেকসই হবে না। Grand Strategy এই সমস্ত উপাদানকে সমন্বিতভাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে জটিল ও বহুমাত্রিক নিরাপত্তা পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা। বিশেষ করে 5G নেটওয়ার্ক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), এবং সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের একটি অংশ। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে উভয় রাষ্ট্রই বৈশ্বিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে চায়। তাই এই প্রতিযোগিতা আধুনিক যুগে Grand Strategy-এর বহুমাত্রিক রূপকে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে।

নিরাপত্তা ও শক্তির ভারসাম্য রক্ষাঃ Grand Strategy একটি রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের কৌশল আন্দাজ করতে চেষ্টা করে এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করে নিজ নিরাপত্তা ঝুঁকি কমায়। জাতীয় নিরাপত্তার এই কাঠামোগত দৃষ্টিভঙ্গি একটি রাষ্ট্রকে কেবল সামরিক প্রতিরক্ষা নয়, বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়েও টেকসই অবস্থান ধরে রাখার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণে সহায়তা করে। এর একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ হলো ১৯৪৭ সালের মার্কিন National Security Act। এই আইনের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা দপ্তর (Department of Defense), সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (CIA) এবং National Security Council প্রতিষ্ঠা করা হয়। এগুলো শীতল যুদ্ধকালীন মার্কিন Grand Strategy-এর কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম করে। একইভাবে, NATO (North Atlantic Treaty Organization)-এর গঠনও ছিল পশ্চিমা শক্তির Grand Strategy-এর একটি সুস্পষ্ট প্রতিফলন। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যৌথ প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তার রোধে সফল হয়েছিল।

রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব বিস্তারঃ Grand Strategy রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করে। একটি রাষ্ট্র যদি কেবল সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে, তবে তা স্বল্পমেয়াদে কার্যকর হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব বিস্তারের জন্য অর্থনৈতিক প্রভাব, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং নীতি প্রণয়ন সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। Grand Strategy এই সব উপাদানকে সমন্বিতভাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে বৈশ্বিক পর্যায়ে শক্তিশালী অবস্থান অর্জনে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে হলো ব্রিটেনের "Two Power Standard" নীতির উদাহরণটি দেওয়া যেতে পারে। উনবিংশ শতকে এই নীতির মাধ্যমে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীকে এমনভাবে শক্তিশালী করা হয়েছিল যাতে তারা একসাথে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিরুদ্ধেও টিকে থাকতে সক্ষম হয়। এর ফলে তৎকালীন ব্রিটেন বৈশ্বিক সামুদ্রিক মহাশক্তি (Maritime Superpower) হিসেবে দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব ধরে রাখে। অন্যদিকে, সমসাময়িক সময়ে চীনের Belt and Road Initiative (BRI) তার ভবিষ্যৎ Grand Strategy-এর একটি আধুনিক রূপ। এ উদ্যোগের মাধ্যমে চীন অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ব্যবহার করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, যা তাকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত করতে সহায়ক।

দূরদর্শী ও স্থিতিশীল নীতি গ্রহণঃ Grand Strategy রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি ও স্থিতিশীল নীতি গ্রহণে উৎসাহিত করে। তাৎক্ষণিক লাভ বা স্বল্পমেয়াদী সুবিধার পরিবর্তে এটি বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দেয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব (সরকার) আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তারের কৌশল তৈরিতে উদ্যোগী হয়। ফলে রাষ্ট্র কেবল বর্তমান সমস্যার সমাধানেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং ভবিষ্যতের পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতি ও শক্তির ভারসাম্য মোকাবিলায়ও প্রস্তুত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Indo-Pacific Strategy এর এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। এই কৌশল কেবল বর্তমান চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিক্রিয়া নয়, বরং আগামী কয়েক দশক ধরে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বজায় রাখার এক মহাপরিকল্পনা। 

Grand Strategy এর উপাদান

কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্রের Grand Strategy নির্মিত হয়। যথাঃ 

ক। জাতীয় স্বার্থ ও উদ্দেশ্য: Grand Strategy-এর মূল ভিত্তি হলো রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থ। এটি রাষ্ট্রকে স্বল্পমেয়াদী সুবিধার বাইরে গিয়ে বৃহত্তর কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। ইতিহাসে প্রতীয়মান হয় যে রাষ্ট্রগুলো সামরিক ও সামুদ্রিক কৌশল প্রয়োগ করেছে শুধু যুদ্ধ জেতার জন্য নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় লক্ষ্য রক্ষার জন্য। উদাহরণস্বরূপ, উনবিংশ শতকে ব্রিটেনের Grand Strategy ছিল বাণিজ্যিক পথের নিরাপত্তা ও উপনিবেশ রক্ষা করা। সমসাময়িক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের Indo-Pacific Strategy তাদের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং চীনের প্রভাব প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত। একইভাবে, চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভও (BRI)। 

খ। সামরিক শক্তি: Grand Strategy-এর অন্যতম প্রধান উপাদান হলো সামরিক শক্তি। এটি কেবল প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করে না, বরং প্রতিরোধ ক্ষমতা (Deterrence), শক্তি প্রদর্শন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রস্তুতির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে কৌশলগতভাবে শক্তিশালী করে তোলে। প্রাচীন রোম সামরিক শক্তির মাধ্যমে সাম্রাজ্য বিস্তার ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছিল। সমসাময়িক উদাহরণ হিসেবে, NATO ইউরোপে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সামরিক জোটের কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। সামরিক শক্তির মূল লক্ষ্য হলো জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর কৌশলগত পরিকল্পনা ব্যাহত করা। 

গ. সামুদ্রিক শক্তিঃ Alfred Thayer Mahan তার বিখ্যাত গ্রন্থ The Influence of Sea Power upon History (1890)-এ উল্লেখ করেন যে সামুদ্রিক শক্তি Grand Strategy-এর এক প্রধান চালিকা শক্তি। ইতিহাসে, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য British Royal Navy-এর মাধ্যমে সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও রাজনীতি পরিচালনা করেছিল। Mahan সামুদ্রিক শক্তির (Sea Power) মূল উপাদান হিসেবে তিনটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন: সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ (Command of the Sea), নৌশক্তি ও বাণিজ্যের সম্পর্ক (Naval-Commercial Nexus) এবং কৌশলগত নৌঘাঁটি (Naval Bases) স্থাপন। আধুনিক যুগে এই নীতি অনুসরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন নৌবাহিনীর Carrier Strike Groups এবং চীনের Maritime Silk Road উদ্যোগ তাদের জাতীয় স্বার্থ ও বৈশ্বিক প্রভাব নিশ্চিত করতে সমুদ্রশক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। 

ঘ। অর্থনীতি ও সম্পদ: অর্থনীতি Grand Strategy-এর প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত। সামরিক ও সামুদ্রিক শক্তি কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে প্রয়োজন রাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেন তাদের শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution)-এর মাধ্যমে নৌবাহিনী আধুনিকীকরণ করেছিল। সমসাময়িক সময়ে, চীন তার Belt and Road Initiative (BRI)-এর মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে GDP এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য শক্তি ব্যবহার করছে, যা চীনের আন্তর্জাতিক প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে, দুর্বল অর্থনীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল, যদিও সোভিয়েতের সামরিক শক্তি ছিলো বিশাল। সুতরাং, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছাড়া Grand Strategy কার্যকারিতা অনিশ্চিত হয়ে পরে।  

ঙ। কূটনীতি ও জোট: Grand Strategy কেবল সামরিক বা সামুদ্রিক কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক জোটকে (Alliance) অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গুরুত্ব দেয়। যেমনঃ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শক্তিশালী জোট গঠন সামরিক সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। আধুনিক যুগে, যুক্তরাষ্ট্র QUAD (Quadrilateral Security Dialogue) এবং AUKUS-এর মতো সামরিক-সামুদ্রিক জোট ব্যবহার করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বজায় রাখছে। এই ধরনের জোট বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের কৌশলগত পরিকল্পনা ব্যাহত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

চ। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: প্রযুক্তি Grand Strategy-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ছাড়া কোনো Grand Strategy দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হয়ে ওঠে না। ইতিহাসে নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণে স্টিমশিপ, গানপাউডার এবং সাবমেরিন যেমন বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছিল, আধুনিক যুগে সামরিক ও সামুদ্রিক কৌশলে সাইবার যুদ্ধ (Cyber Warfare), Artificial Intelligence (AI), স্যাটেলাইট সিস্টেম এবং অত্যাধুনিক ড্রোন ইত্যাদি Grand Strategy-কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র AI-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করছে, এবং চীন Hypersonic Missiles দ্বারা তাদের কৌশলগত শক্তি বৃদ্ধি করছে। 

ছ। ভৌগোলিক ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান: ভূগোল Grand Strategy-এর একটি মৌলিক উপাদান। রাষ্ট্রের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ বা Chokepoints-এর কাছে থাকলে কৌশলগত সুবিধা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, মালাক্কা প্রণালী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য ও সামুদ্রিক কৌশলের কেন্দ্রীয় দিক। ইতিহাসে, ব্রিটিশরা সুয়েজ খাল এবং জিব্রাল্টার দখল করে বৈশ্বিক সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। সমসাময়িক সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র Diego Garcia ঘাঁটি ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করছে।

জ। Soft Power এর সমন্বয়: Grand Strategy কেবল Hard Power (সামরিক ও সামুদ্রিক শক্তি)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; Soft Power-এর ব্যবহারও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাংস্কৃতিক প্রভাব, শিক্ষা, মানবিক সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা রাষ্ট্রের বৈশ্বিক কৌশলের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র Hollywood, শিক্ষা বৃত্তি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ইত্যাদি প্রচারের মাধ্যমে তাদের Soft Power ব্যবহার করে। সমসাময়িক সময়ে, চীন Confucius Institute এবং Silk Road সাংস্কৃতিক প্রকল্প ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। Soft Power সামরিক শক্তিকে নৈতিক ও বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করে এবং দীর্ঘমেয়াদে Grand Strategy-এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। 

Grand Strategy:  বঙ্গোপসাগরের প্রেক্ষাপটে

বঙ্গোপসাগর দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চল। এটি ভারত মহাসাগরের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থান করায় যে কোনো রাষ্ট্র যদি এখানে প্রভাব বিস্তার করে, তবে তারা একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার মূল ভূখণ্ড, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার এবং ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ Chokepoints যেমনঃ মালাক্কা প্রণালী, হরমুজ প্রণালী এবং সুয়েজ খালের উপরও প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে। ফলে Grand Strategy-এর আলোচনায় বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। যেমনঃ 

সামরিক প্রাসঙ্গিকতা: বঙ্গোপসাগরের সামরিক প্রাসঙ্গিকতা বহুস্তরীয়। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্য ও জ্বালানি পরিবহন এই অঞ্চলের সমুদ্রপথ (Sea Lines of Communication, SLOCs) ব্যবহার করে সম্পন্ন হয়। ফলে অত্র অঞ্চলের যে কোনো সামুদ্রিক সংঘাত বা অবরোধ (blockade) সরাসরি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। ভারত ও চীন উভয়ই বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে তাদের নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ করছে উপস্থিতি জোরদার করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত Andaman & Nicobar Command থেকে সমগ্র বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল নজরদারি করছে, এবং চীন “String of Pearls” কৌশল অনুসরণ করে মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে বন্দর উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে। একই সঙ্গে জলদস্যু, মানবপাচার, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের মতো অপ্রচলিত নিরাপত্তা (non-traditional security) ঝুঁকিও অঞ্চলকে কৌশলগতভাবে জটিল করেছে।

অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা: বঙ্গোপসাগরের অর্থনৈতিক গুরুত্বও উল্লেখযোগ্য। এই অঞ্চলে মৎস্য, তেল-গ্যাস, খনিজ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার ইতিমধ্যেই নিজেদের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছে এবং সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারে প্রাধান্য দিচ্ছে। চট্টগ্রাম, মংলা, কক্সবাজার, কলকাতা, কিয়াউকফিউ ও সিটওয়ের মতো বন্দর আঞ্চলিক বাণিজ্যকে গতিশীল করছে। উদাহরণস্বরূপ, Myanmar-China Pipeline এবং India-Bangladesh Offshore Gas Exploration বঙ্গোপসাগরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ Energy-Security Hub-এ পরিণত করেছে।

আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা ও কৌশলগত ভারসাম্য: আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত তার "Act East Policy" এবং SAGAR Vision এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় ও বঙ্গোপসাগরীয় সমুদ্র অঞ্চলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, অপরদিকে চীন Belt and Road Initiative (BRI)-এর মাধ্যমে মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বিস্তার করছে। যুক্তরাষ্ট্র Indo-Pacific Strategy ব্যবহার করে চীনের প্রভাব ব্যালান্স করার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি, BIMSTEC, IORA এবং Indian Ocean Naval Symposium (IONS)-এর মতো আঞ্চলিক সংগঠনগুলো সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতাকে আরও জটিল করেছে।

বাংলাদেশের কৌশলগত ভূমিকাঃ বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগর Grand Strategy-এর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা বিরোধ মীমাংসা শেষে বাংলাদেশ প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গকিমি সমুদ্র এলাকা অর্জন করেছে, যা ব্লু ইকোনমি (Blue Economy) সম্ভাবনা উন্মোচিত করেছে। Forces Goal 2030 অনুযায়ী, বাংলাদেশ আধুনিক সাবমেরিন, ফ্রিগেট, পেট্রোল ভেসেল ও কোস্টগার্ড সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে চলছে। পাশাপাশি, ব্লু ইকোনমি নীতির মাধ্যমে সামুদ্রিক সম্পদকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোঃ বঙ্গোপসাগর ঘিরে চলমান আঞ্চলিক শক্তি ও কৌশলগত সমীকরণ বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি (Balanced Grand Strategy) অনুসরণ করছে, অর্থাৎ ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র, তিন পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে সামুদ্রিক ও ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। তবে, সামগ্রিকভাবে, বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক বাংলাদেশের Grand Strategy এর অভাব রয়েছে, যা গুরুত্ব সহকারে বাংলাদেশের বিবেচনা করা উচিত। 

উপসংহারঃ 

Grand Strategy একটি রাষ্ট্রকে তার দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক প্রভাব এবং বৈশ্বিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য একটি বহুমাত্রিক কৌশলগত কাঠামো প্রদান করে। এটি কেবল সামরিক শক্তি বা নৌকৌশলে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনীতি, কূটনীতি, তথ্য ও প্রযুক্তি, মানবসম্পদ, শক্তি ও পরিবেশ নীতি এবং soft power এর মতো উপাদানগুলোকে সমন্বিত করে রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। একটি কার্যকর Grand Strategy রাষ্ট্রকে স্বল্প ঝুঁকিতে তার জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ দেয়। এটি বাহ্যিক হুমকি মোকাবিলার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, সামাজিক সংহতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করে। এছাড়াও, এটি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাব বিস্তার, বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণ এবং শান্তি ও নিরাপত্তায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ প্রদান করে। সর্বোপরি, Grand Strategy রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুসংগত নীতি ও প্রস্তুতির কাঠামো প্রদান করে।



-বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 







No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.