Economic Statecraft: জাতীয় স্বার্থ আদায়ের অর্থনৈতিক কৌশল
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্ব রাজনীতিতে অর্থনীতি কেবল উন্নয়নের মাধ্যম নয়, বরং রাষ্ট্রের কৌশলগত শক্তি অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার। জাতীয় স্বার্থ অর্জন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে থাকে। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় Economic Statecraft বা অর্থনৈতিক কূটকৌশল বা অর্থনৈতিক শাসন কৌশল। মূলত, এটি এমন এক কৌশল যেখানে একটি রাষ্ট্র বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সাহায্য, আর্থিক সহায়তা (Aid) কিংবা নিষেধাজ্ঞার (Sanction) মতো পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। ইতিবাচকভাবে অর্থনৈতিক কূটকৌশল দ্বারা সহযোগিতা, উন্নয়ন ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার হয়; আবার নেতিবাচকভাবে এটি প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে কাঙ্ক্ষিত নীতি গ্রহণে বাধ্য করে। আধুনিক বিশ্বে অর্থনীতি ও কূটনীতির এই সমন্বিত ব্যবহার রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা কৌশল অর্জনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
Economic Statecraft কী?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তি, সম্পদ এবং নীতি-নির্ধারণ ক্ষমতাকে কৌশলগত স্বার্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রয়োগের প্রক্রিয়াকে Economic Statecraft বলে। এটি এমন এক বহুমাত্রিক কৌশল, যা কূটনীতি, সামরিক শক্তি, তথ্য ও নিরাপত্তার সঙ্গে সমন্বয় করে রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। সহজ করে বললে, অর্থনৈতিক উপকরণকে শক্তি রূপে ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের প্রক্রিয়াকে Economic Statecraft বলে।
রাষ্ট্রের জাতীয় ও কৌশলগত স্বার্থ আদায়ে Economic Statecraft পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান কৌশলনীতি গ্রহণ করে। পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র (রাষ্ট্র- ক) অন্য রাষ্ট্রকে (রাষ্ট্র- খ, গ, ঘ…) নানা ইতিবাচক সুবিধা প্রদান করে যাতে সেই রাষ্ট্র (রাষ্ট্র- খ, গ, ঘ…) তার (রাষ্ট্র-ক) কাঙ্ক্ষিত নীতি বা আচরণ গ্রহণ করে। এই ইতিবাচক সুবিধার মধ্যে রয়েছে trade incentives অর্থাৎ বাণিজ্যে শুল্ক ছাড়, development aid বা উন্নয়ন সহায়তা প্রদান, FDI (Foreign Direct Investment) অর্থাৎ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ, এবং market access বা তাদের পণ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার প্রদান করা। এই ধরনের কৌশল সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গঠনে ব্যবহৃত হয়, যেখানে বিনিময়ে রাজনৈতিক সমর্থন বা সহযোগিতা আশা করা হয়।
অন্যদিকে, শাস্তি প্রদানে নেতিবাচক কৌশল গ্রহণ করা হয়, যেখানে একটি রাষ্ট্র (রাষ্ট্র- ক) অন্য রাষ্ট্রকে (রাষ্ট্র-খ, গ, ঘ…) বাধ্য করে তাদের আচরণ পরিবর্তনের জন্য। এ ক্ষেত্রে প্রধানত sanctions বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যেমন: কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করা, ব্যাংকিং চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া, বা প্রযুক্তিগত সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া। এছাড়া financial barriers বা আর্থিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলা হয়, এমনকি নিজ দেশে (রাষ্ট্র-ক) থাকা শাস্তিপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পদও শাস্তিদাতা দখলে নি্তে পারেন যার বড় উদাহরণ ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশি্যার বৈদেশিক সম্পদ কব্জা করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। নেতিবাচক কৌশল সাধারণত সেই পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা হয়, যেখানে বন্ধুত্ব বা সহযোগিতা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া সম্ভব নয়, বরং চাপে ফেলে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়।
এই দুটি কৌশলই একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কখনো পুরস্কার দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে, আবার কখনো শাস্তি দিয়ে কঠোরভাবে অন্য রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। ফলে, অর্থনৈতিক কৌশল আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়, যা কূটনৈতিক সম্পর্ক গঠনে এবং বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তাত্ত্বিকভাবে, Economic Statecraft প্রধানত তিনটি মাত্রায় কার্যকর হয়, যা একটি রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের উপর শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করে। প্রথমত, Economic Statecraft এর উপাদানগত দিক, যেখানে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক উপকরণ যেমন: বাণিজ্য সুবিধা, নিষেধাজ্ঞা, উন্নয়ন সহায়তা বা সরাসরি বিনিয়োগ প্রয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে দ্রুত ও প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। দ্বিতীয়ত, Economic Statecraft এর কাঠামোগত দিক। এই পর্যায়ে প্রভাব নির্ধারিত হয় বাজার, প্রযুক্তি ও আর্থিক নির্ভরতার মাধ্যমে। একটি দেশ যদি অন্য দেশের জন্য অপরিহার্য পণ্য বা প্রযুক্তির উৎস হয়ে ওঠে, তবে সেই দেশ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়, কারণ নির্ভরশীল রাষ্ট্র অপরিহার্য পণ্য, প্রযুক্তি বা বাণিজ্যের জন্য উৎস রাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, Economic Statecraft এর প্রাতিষ্ঠানিক দিক, যেখানে প্রভাব বিস্তার করা হয় আন্তর্জাতিক সংস্থা, নিয়ম-কানুন, মানদণ্ড ও নীতিগত কাঠামোর মাধ্যমে। যখন একটি রাষ্ট্র এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন তা বিশ্বব্যাপী দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। এই ত্রিমাত্রিক কাঠামো রাষ্ট্রকে কৌশলগতভাবে এমন এক ক্ষমতা প্রদান করে, যার মাধ্যমে কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতি, নিরাপত্তা ও কূটনীতিতেও তার শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার সম্ভব হয়।
Economic Statecraft এর ঐতিহাসিক বিবর্তনঃ
Economic Statecraft-এর ধারণা মোটেও আধুনিক নয়; বরং এর শিকড় প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রনীতির গভীরে নিহিত। প্রাচীনকাল থেকেই অর্থনৈতিক উপকরণকে সামরিক শক্তির বিকল্প বা সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে বাণিজ্য, সম্পদ নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক অবরোধ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে আধুনিক যুগে বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি ও রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতার কারণে Economic Statecraft আরও সুসংহত ও কৌশলগত হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
Economic Statecraft এর প্রাথমিক উদাহরণ পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো অ্যাথেন্স কর্তৃক গৃহীত “Megarian Decree” (৪৩২ খ্রিস্টপূর্ব), যেখানে স্পার্টার মিত্র মেগারার সাথে বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই অর্থনৈতিক অবরোধের উদ্দেশ্য ছিল স্পার্টাকে রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলা, যা পরবর্তীতে পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রোমান সাম্রাজ্যও অর্থনৈতিক শুল্ক, বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে তার কূটনীতি ও সামরিক অভিযানের সাথে একত্র করে, যা সাম্রাজ্যের বিস্তৃত প্রভাব ধরে রাখতে সহায়ক ছিল।
মধ্যযুগে সামুদ্রিক নগররাষ্ট্র যেমন ভেনিস ও জেনোয়া, অর্থনৈতিক অবরোধ, বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক শক্তিকে ভূরাজনৈতিক কৌশলের প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে। বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির চেয়ে অনেক সময় বেশি কার্যকর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো অর্থনৈতিক কৌশলকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করে। এ সময় অর্থনৈতিক শক্তি কেবল রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির উৎস ছিল না, বরং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে দুর্বল করার একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডস তাদের উপনিবেশগুলোতে বাজার নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিক একচেটিয়াকরণ (monopoly), শুল্কনীতি এবং কাঁচামালের একচ্ছত্র ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির উত্থান রোধ করত। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ব্রিটেনের Navigation Acts (১৬৫১–১৬৬০)। এই আইন অনুযায়ী ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো কেবল ব্রিটিশ জাহাজের সাথে বাণিজ্য করতে বাধ্য ছিল। এর ফলে একদিকে ব্রিটেন তার সামুদ্রিক শক্তি ও নৌবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ সক্ষম হয়, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী নেদারল্যান্ডসের বাণিজ্যিক আধিপত্যকে কার্যকরভাবে দুর্বল করে।
একইভাবে, ফরাসি ঔপনিবেশিক নীতি কফি, চিনি এবং তুলার মতো কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন ও বাণিজ্যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, যা বৈশ্বিক বাজারে ফরাসি প্রভাব বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখে। নেদারল্যান্ডসও Dutch East India Company (VOC)-এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মসলা বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাপে রাখে। এসব কার্যক্রম শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং উপনিবেশিক শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সরাসরি অবদান রাখে। এছাড়াও, শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী যুগে অর্থনৈতিক শক্তি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও ক্ষমতার রাজনীতির কেন্দ্রীয় উপাদানে পরিণত হয়। শিল্পায়নের ফলে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কাঁচামাল, বাজার ও প্রযুক্তিগত সুবিধা দখলের প্রতিযোগিতা তীব্র হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক সুরক্ষা/ রক্ষণশীল নীতি (protectionism) এবং শুল্ক আরোপ আন্তর্জাতিক কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে কাজ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে অর্থনৈতিক অবরোধ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকে দুর্বল করার একটি প্রধান হাতিয়ার। মিত্রশক্তি জার্মানির ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক অবরোধ (economic blockade) আরোপ করে, যা খাদ্য ও কাঁচামালের প্রবাহ ব্যাহত করে দেশের শিল্প ও সামরিক সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইতিহাসবিদদের মতে, এই অর্থনৈতিক অবরোধ জার্মানির যুদ্ধপরাজয়ের অন্যতম নির্ণায়ক কারণ ছিল। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক কৌশলের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে। Great Depression (১৯৩০-এর দশক) এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রণীত Smoot-Hawley Tariff Act (১৯৩০) যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে যা বৈশ্বিক বাণিজ্যকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে কেবল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কই নয়, বরং রাজনৈতিক উত্তেজনাও বৃদ্ধি পায়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অর্থনৈতিক কৌশলের কার্যকারিতা ও প্রভাবকে অভূতপূর্ব মাত্রায় প্রকাশ করে। এ সময় যুদ্ধক্ষেত্রের সামরিক লড়াইয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পদ, বাণিজ্যপথ ও অবরোধই রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত টিকে থাকা ও পরাজয়ের অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। নাৎসি জার্মানি ইউরোপে দখলকৃত অঞ্চলগুলোর ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক শোষণনীতি চালু করে। তারা কাঁচামাল, শিল্পসম্পদ ও শ্রমশক্তিকে জোরপূর্বক ব্যবহার করে তাদের যুদ্ধযন্ত্রকে চালু রাখার চেষ্টা করে। একইভাবে, জাপানও পূর্ব এশিয়ায় “Greater East Asia Co-Prosperity Sphere” গড়ে তুলে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্প্রসারণে চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে, মিত্রশক্তি অর্থনৈতিক অবরোধ ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে জার্মানি ও জাপানের যুদ্ধক্ষমতাকে দুর্বল করার চেষ্টা চালায়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু করার আগেই জাপানের ওপর তেল ও লোহা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জাপানের শিল্প ও সামরিক কার্যক্রম তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল; ফলে এই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জাপানকে বিকল্প পদক্ষেপ বেছে নিতে বাধ্য করে, ১৯৪১ সালে Pearl Harbor আক্রমণের মাধ্যমে যার সরাসরি প্রতিফলন ঘটে। তাছাড়া, মিত্রশক্তি জার্মানির বাণিজ্যপথে naval blockade আরোপ করে খাদ্য ও শিল্পপণ্যের প্রবাহ চরমমাত্রায় ব্যাহত করে। এর ফলে জার্মান অর্থনীতি ধসে পড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা হ্রাস পায়।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় (১৯৪৭–১৯৯১) Economic Statecraft আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান উপাদানে পরিণত হয়। সামরিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই অর্থনৈতিক সাহায্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং নিষেধাজ্ঞাকে প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে Marshall Plan প্রবর্তনের মাধ্যমে যুদ্ধবি্ধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই নয়, বরং পশ্চিম ইউরোপকে সোভিয়েত প্রভাববলয় থেকে দূরে রাখা এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি মজবুত করা সম্ভব হয়। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংক, IMF এবং General Agreement on Tariffs and Trade (GATT)-এর মাধ্যমে একটি উদারনৈতিক (liberal) বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলনের প্রচেষ্টা চালায়। অপরদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯ সালে Council for Mutual Economic Assistance (COMECON) গঠন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে একীভূত করা এবং পশ্চিমা অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে তাদের নিরাপদ রাখা। COMECON সোভিয়েত জ্বালানি সম্পদ, কাঁচামাল এবং শিল্পপ্রযুক্তিকে মিত্র রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতির সাথে যুক্ত করে একটি বিকল্প অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলে। স্নায়ুযুদ্ধকালে দুই মহাশক্তির পারস্পারিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তাদের নিয়মিত কৌশল হয়ে ওঠে।
১৯৯০-এর দশকের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক নতুন বাস্তবতার সূচনা ঘটায়, যেখানে সামরিক সংঘাত তুলনামূলকভাবে কম হলেও অর্থনৈতিক উপকরণ ব্যবহারের প্রবণতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। বিশ্বায়ন (globalization) এবং অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা (economic interdependence) রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করে, যা অর্থনৈতিক কৌশলকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিস্তার এ সময় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র ইরান, ইরাক ও উত্তর কোরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোর ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঠেকাতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কেবল এর অর্থনীতিকেই দুর্বল করেনি, বরং কূটনৈতিক আলোচনায় অংশগ্রহণেও দেশটিকে বাধ্য করেছে। একইভাবে, ইরাকের বিরুদ্ধে ১৯৯০–২০০৩ সময়কালে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ইতিহাসে অন্যতম বড় উদাহরণ। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এরূপ অবরোধের যৌক্তিকতাকে অনেক বিশারদেরা প্রশ্ন করছেন। অন্যদিকে, এই সময়ে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি চীন এক ভিন্ন ধরনের Economic Statecraft এর সূচনা করে। ২০১৩ সালে চীনের ঘোষিত Belt and Road Initiative (BRI) মূলত বিনিয়োগ, ঋণ প্রদান ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়। BRI শুধু বাণিজ্য সম্প্রসারণ নয়, বরং চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধিরও হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
একবিংশ শতাব্দীতে অর্থনীতি কেবল রাষ্ট্রের কৌশলগত হাতিয়ার নয়, বরং ভূরাজনীতির কেন্দ্রীয় স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি-নির্ভরতা এবং জ্বালানি নিরাপত্তা আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছে, যেখানে Economic Statecraft সামরিক শক্তির বিকল্প নয়, বরং কার্যকর পরিপূরক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো চলমান যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ (US-China Trade War)। ২০১৮ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতায় উভয় রাষ্ট্র একে অপরের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ, প্রযুক্তি স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিয়োগ সীমিত করার মতো শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বাণিজ্য যুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও বৈশ্বিক বাজারে চীনের প্রভাব সীমিত করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে চীনও শুল্কারোপের পাশাপাশি বিকল্প বাজার ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য পশ্চিমা মিত্ররাষ্ট্রসমূহ রাশিয়ার বিরুদ্ধে একযোগে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর থেকেই রাশিয়ার ব্যাংকিং, জ্বালানি এবং প্রতিরক্ষা খাতকে লক্ষ্য করে বহুমাত্রিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর এ নিষেধাজ্ঞা আরও বিস্তৃত ও কঠোরতর রূপ নেয়। যেমন: রাশিয়ার প্রধান ব্যাংকসমূহকে আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা SWIFT থেকে বাদ দেওয়া, রাশিয়ান জ্বালানি রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, এবং প্রযুক্তি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা। একবিংশ শতাব্দীতে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রতিযোগিতা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রযুক্তি খাতে আধিপত্য বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র চীনা কোম্পানি, যেমন: Huawei ও TikTok-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একইসাথে, ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়, যার মাধ্যমে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে যুদ্ধ বন্ধে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালানো হয়। এ ছাড়া, কোভিড-১৯ মহামারির সময় দেখা যায় কিভাবে ভ্যাকসিন কূটনীতি এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এসব উদাহরণ আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও প্রযুক্তি-নির্ভর কূটনীতির জটিল ও পরিবর্তনশীল বাস্তবতা তুলে ধরে।
Economic Statecraft-এর গুরুত্ব যে কারণে অধিক
১. বিশ্বায়নঃ আধুনিক বিশ্বায়নের (Globalization) ফলে রাষ্ট্রের অর্থনীতি এতটাই আন্তঃসংযুক্ত (interdependence) হয়ে উঠেছে যে, একটি রাষ্ট্রের নীতি বা সিদ্ধান্ত সরাসরি অপর রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থাকে প্রভাবিত করে। ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার, বহুজাতিক কোম্পানির (Multinational) উত্থান, বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ এবং বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার সূচনা রাষ্ট্রগুলোকে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার জালে আবদ্ধ করে। এর ফলে অর্থনীতি কেবল বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের একটি কার্যকর উপকরণে পরিণত হয়। এই পারস্পরিক নির্ভরতা এক রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ব্যবহার করে অপরের নীতি ও আচরণ প্রভাবিত করার সুযোগ করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, চীন তার Belt and Road Initiative (BRI) প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, ঋণ এবং বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে। এর মাধ্যমে চীন কেবল অর্থনৈতিক সুবিধাই নয়, বরং কৌশলগত স্বার্থও অর্জন করছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ দাবী করেন। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র তার Dollar-based global financial system-এর ওপর আধিপত্য বজায় রেখে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, আর্থিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে প্রবেশাধিকার সীমিত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করছে।
২. সরাসরি সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি কমানোঃ পারমাণবিক অস্ত্র, আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইনের অবজ্ঞা সামরিক সংঘাতকে আরও ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। ফলশ্রুতিতে, রাষ্ট্রগুলো স্বার্থ আদায়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিকল্প হিসেবে অর্থনৈতিক কৌশলকে একটি “low-cost, high-impact” অপশন হিসেবে গ্রহণ করে। এই প্রবণতার ফলে আর্থিক ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা কেবল বাণিজ্য-অর্থনীতির উপকরণ হিসেবেই নয়, বরং কৌশলগত চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিপক্ষের নীতি ও আচরণকে প্রভাবিত করার কার্যকর মাধ্যম হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যিক অবরোধ বা আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো সরাসরি সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি এড়িয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল, সামাজিকভাবে চাপগ্রস্ত ও কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, যা আন্তর্জাতিক বৈধতা ও বহুপাক্ষিক সমর্থন অর্জনের জন্য জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নীতি তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা হ্রাসের মাধ্যমে তাদের পারমাণবিক কার্যক্রমে চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে গৃহীত হয়; এই নীতিগুলোর লক্ষ্য রাষ্ট্রের অর্থনীতি, সামাজিক পরিস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ নীতি প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করা, যা আধুনিক Economic Statecraft-এর এক স্পষ্ট এবং শক্তিশালী দৃষ্টান্ত।
৩. বহুমাত্রিক কৌশলের প্রয়োজনঃ আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেবল সামরিক শক্তি বা প্রচলিত কূটনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি অর্থনীতি, প্রযুক্তি, তথ্যযুদ্ধ (Cyber Warfare) এবং কূটনৈতিক বহুবিদ সম্পর্কের সমন্বিত প্রয়োগের উপর ভিত্তি করে বিকশিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে Economic Statecraft কেবল একটি স্বতন্ত্র কৌশলগত হাতিয়া হিসেবে না থেকে, বরং comprehensive national power (CNP)-এর এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রণোদনা, কূটনৈতিক চাপ এবং তথ্য প্রচারণা ব্যবহার করে বহুমাত্রিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার কিভাবে সামরিক অভিযানের পাশাপাশি জ্বালানি রপ্তানি (energy supply), ব্যাংকিং সেক্টর এবং তথ্যযুদ্ধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে টার্গেট রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা যায় তা রাশিয়ার চলমান Hybrid Warfare কৌশলে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে কূটনৈতিক চাপ ও সামরিক প্রতিরোধের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সমন্বিত কৌশল (Comprehensive Strategy) তৈরি করেছে, যা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের এক বহুমাত্রিক প্রকৃতিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
৪. অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নির্ভরতাঃ আধুনিক বিশ্বে কোনো রাষ্ট্র সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই খাদ্য, জ্বালানি, প্রযুক্তি এবং বাজারের জন্য অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। এই আন্তঃনির্ভরতা (interdependence) আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে আরও জটিল এবং বহুমাত্রিক করে তুলেছে। এর ফলে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুর্বলতা বা প্রয়োজন বা নির্ভরশীলতাকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিল করতে পারে। অর্থাৎ, আন্তঃনির্ভরতা কেবল সহযোগিতার মাধ্যম নয়, বরং রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের যৌথভাবে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতি গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশেষত ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া দখল এবং ২০২২ সালের ইউক্রেন আক্রমণের পর। একইভাবে, চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর উপর তার বাজার ও প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার মাধ্যমে অত্র দেশগুলোর কূটনৈতিক অবস্থান ও নীতিকেও প্রভাবিত করছে, যা আধুনিক Economic Statecraft-এর কার্যকারিতাকে প্রমাণ করে।
Economic Statecraft এর বৈশিষ্ট্য কী কী?
কিছু বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে Economic Statecraft ধারণাটি বিকশিত হয়েছে। যথাঃ
অর্থনৈতিক উপায়ে প্রভাব বিস্তারঃ Economic Statecraft-এর প্রধান লক্ষ্য রাষ্ট্র বা অ-রাষ্ট্রীয় actor-এর আচরণ প্রভাবিত করতে অর্থনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করা। এই অর্থনৈতিক হাতিয়ারের মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, বিদেশী বিনিয়োগ (FDI), ঋণ, আর্থিক সহায়তা, উন্নয়ন প্রকল্প এবং বাজারে প্রবেশাধিকারের নিয়ন্ত্রণ। এই হাতিয়ারগুলো শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করে না, বরং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকর প্রক্রিয়ারূপে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরান ও উত্তর কোরিয়ার ওপর দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত রাখতে চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, চীনের তার Belt and Road Initiative (BRI) প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, ঋণ প্রদান এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি ও অর্থনীতি ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে।
দ্বৈত কৌশল – সুবিধা ও চাপঃ আধুনিক Economic Statecraft‑এ রাষ্ট্রগুলো প্রায়শই “carrot and stick” নীতি অনুসরণ করে, যার মাধ্যমে একদিকে তারা অর্থনৈতিক প্রণোদনার (carrot) মাধ্যমে সহযোগিতা গড়ে তোলে, অন্যদিকে চাপ (stick) প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ বা নির্ভরশীল রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। এই কৌশলে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র (যেমন রাষ্ট্র-ক) নির্ভরশীল রাষ্ট্রসমূহকে (যেমন রাষ্ট্র-খ, গ, ঘ...) উন্নয়ন সাহায্য, বিনিয়োগ, বাজারে প্রবেশাধিকারের সুযোগ কিংবা বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করে নিজেদের রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ আদায় করতে চায়। একইসাথে, যখন লক্ষ্য রাষ্ট্র তাদের কাঙ্ক্ষিত নীতি বা আচরণ প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়, তখন নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যিক অবরোধ বা আর্থিক সীমাবদ্ধতার মতো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই দ্বৈত কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো নির্ভরশীল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিকে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের কৌশলগত কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, যাতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরবর্তী পক্ষটি তুলনামূলকভাবে নমনীয় ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা Economic Statecraft‑এর “carrot and stick” কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। একদিকে, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চীনকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উন্নতি করতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) সদস্যপদ, প্রযুক্তি স্থানান্তর, এবং মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার (carrot) ইত্যাদির মাধ্যমে সহায়তা করেছে। চীন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার পেছনে অত্র প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র উচ্চপ্রযুক্তি খাতে চীনের ক্রমাগত উত্থানকে তার প্রযুক্তি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখছে এবং তাই চীনের সেমিকন্ডাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), এবং টেলিকম খাতে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, চীনা কোম্পানি (যেমন Huawei, TikTok)‑এর উপর নিষেধাজ্ঞা এবং বিদেশি বিনিয়োগ স্ক্রীনিং চালু করা ইত্যাদি stick কৌশল যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করছে।
পরোক্ষ চাপ ও সীমিত ঝুঁকিঃ সরাসরি সামরিক সংঘাতের পরিবর্তে অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হলো Economic Statecraft-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই পদ্ধতি রাষ্ট্রকে তুলনামূলকভাবে কম খরচ এবং সীমিত ঝুঁকিতে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ প্রদান করে, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের সীমার মধ্যে বৈধতা বজায় রাখে। উদাহরণস্বরূপঃ ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা দেশগুলো (যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তা রাশিয়ার অর্থনীতিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা শুধু রাশিয়ার আর্থিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডই সীমিত করেনি, বরং আন্তর্জাতিক প্রভাব ও নীতিনির্ধারণেও একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে কাজ করেছে, যা সরাসরি সামরিক সংঘাতের প্রয়োজনীয়তা কমিয়েছে। যদিও, এত বড় অর্থনৈতিক চাপ সত্বেও, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং এখনো তা চালু রেখেছে।
কূটনীতি ও কৌশলের সমন্বয়ঃ Economic Statecraft কেবল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের সীমাবদ্ধ নয়; এটি সামরিক, কূটনৈতিক, নিরাপত্তা এবং তথ্যনীতির সঙ্গে সমন্বিত একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো কেবল অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে না, বরং টার্গেট রাষ্ট্রের নীতি, আচরণ এবং কৌশলগত সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক টানাপোড়ন এক পর্যায়ে এমন জায়গায় পৌঁছায়, যেখানে চীন কূটনৈতিক অসন্তোষের প্রতিক্রিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার কয়লা, বার্লি, ওয়াইনসহ বেশ কিছু পণ্যের উপর আমদানি সীমাবদ্ধতা শুল্ক আরোপ করে। যদিও এটিকে অর্থনৈতিক বলে মনে করা হয়, তবে এটি ছিল একটি বিশেষ কৌশলগত বার্তা, যার মাধ্যমে চীন অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
অভিযোজন ক্ষমতাঃ Economic Statecraft প্রকৃতপক্ষে একটি গতিশীল ও প্রেক্ষাপট নির্ভর কৌশল, যার সফলতা নির্ভর করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশ, আন্তর্জাতিক সংকট, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং প্রতিপক্ষের প্রতিক্রিয়ার উপর। এই কৌশলের অন্যতম প্রধান শক্তি হল এর অভিযোজনক্ষমতা, অর্থাৎ পরিবর্তিত বাস্তবতায় দ্রুত কৌশল পুনর্গঠন ও নতুন বাস্তবতায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা। উদাহরণস্বরূপ, COVID-19 মহামারীর সময় রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা (supply chain) পুনর্বিন্যাস করে এবং আর্থিক নীতি দ্রুত সমন্বয় করে অর্থনৈতিক কূটনীতির অভিযোজিত ব্যবহার প্রদর্শন করে। অন্যদিকে, চীনের “Digital Silk Road” উদ্যোগ প্রযুক্তি ও ডিজিটাল অবকাঠামোর মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর ওপর দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করছে, যা অর্থনৈতিক সহায়তার আড়ালে রাজনৈতিক ও তথ্যপ্রযুক্তিগত প্রভাব খাটানোর অভিযোজিত রূপ। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক Export Control Regulations (বিশেষত সেমিকন্ডাক্টর ও AI খাতে) প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে একটি অভিযোজিত রক্ষণমূলক নীতি হিসেবে কাজ করছে।
দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত প্রভাবঃ Economic Statecraft কেবল স্বল্পমেয়াদি চাপ বা তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহৃত হয় না; বরং এটি রাষ্ট্রগুলোর দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তা কাঠামোর পুনর্গঠন সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, জাপানের "Official Development Assistance (ODA)" কৌশলের কথা বলা যায়। জাপান বহু দশক ধরে তার ODA নীতির মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত প্রভাব তৈরি করেছে। যদিও এটি মূলত উন্নয়ন সহযোগিতার একটি শান্তিপূর্ণ রূপ হিসেবে উপস্থাপিত, তবে এর মাধ্যমে জাপান ওইসব দেশে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় করেছে, বিশেষত চীনের প্রভাব মোকাবেলায় একটি ভারসাম্য তৈরি করতে চেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে বন্দর, রেলপথ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জাপানের বিনিয়োগ শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং কৌশলগত সহযোগিতার রূপ নিয়েছে, যার মাধ্যমে সমুদ্র নিরাপত্তা, সরবরাহ চেইন স্থিতিশীলতা ও আঞ্চলিক মিত্রতা গড়ে তোলা হয়েছে। এই উদ্যোগগুলো চীনের Belt and Road Initiative-এর একটি "Soft-balancing" কৌশল হিসেবেও বিবেচিত হয়। ফলে, জাপানের ODA কেবল উন্নয়ন সহযোগিতা নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি Economic Statecraft-এর সূক্ষ্ম উদাহরণ, যা শান্তিপূর্ণ প্রভাব বিস্তার এবং আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
Economic Statecraft-এর প্রধান হাতিয়ার ও উদাহরণসমূহ
ক. নিষেধাজ্ঞা (Sanctions)ঃ Sanctions বা নিষেধাজ্ঞা, Economic Statecraft-এর সবচেয়ে পরিচিত এবং শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত। এর মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্র বা অ-রাষ্ট্রীয় actor-এর আর্থিক, বাণিজ্যিক এবং প্রযুক্তিগত কার্যক্রম সীমিত করে তার নীতি, কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং আন্তর্জাতিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটি প্রায়শই সরাসরি সামরিক সংঘাতের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারের কাঠামোর মধ্যে টার্গেট রাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের ধরন হতে পারে নানাবিধ, যেমন: শুল্ক ও বাণিজ্য সীমাবদ্ধতা, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেন নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক বিনিয়োগে বাধা, উচ্চ-প্রযুক্তি পণ্য ও সফটওয়্যারের সরবরাহ সীমিতকরণ, এমনকি আন্তর্জাতিক লজিস্টিক ও বাণিজ্যিক অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
উদাহরণ হিসেবে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর নিষেধাজ্ঞা উল্লেখযোগ্য। এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইরানের তেল রপ্তানি সীমিত করা হয়, যা সরকারের রাজস্ব ও আর্থিক সক্ষমতাকে খর্ব করে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকারে বাধা ও উচ্চ-প্রযুক্তি সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে উভয় রাষ্ট্রের সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে। একইভাবে, ভেনেজুয়েলায় নিকোলাস মাদুরোর শাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি PDVSA’র ওপর নিষেধাজ্ঞা, সরকারি সম্পদ জব্দ এবং আমেরিকান কোম্পানির বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা আরোপের ফলে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়ে, মুদ্রাস্ফীতি চরমে ওঠে এবং বিদেশি সাহায্য বাধাগ্রস্ত হয়। আবার, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) দেশটির সামরিক নেতৃত্ব এবং সামরিক মালিকানাধীন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ কমে যায়, উন্নয়ন সহায়তা স্থগিত হয় এবং সামরিক জান্তা আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়ে।
খ. অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহায়তাঃ অর্থনৈতিক সাহায্য ও বিনিয়োগ রাষ্ট্রগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি কেবল আর্থিক সহযোগিতা নয়, বরং লক্ষ্য রাষ্ট্রের নীতি, আন্তর্জাতিক অবস্থান এবং কৌশলগত সম্পর্ক প্রভাবিত করার একটি কার্যকর মাধ্যম। উন্নয়ন প্রকল্প, অবকাঠামো নির্মাণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো টার্গেট রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক সমর্থন ও কৌশলগত নির্ভরতা তৈরি করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Millennium Challenge Corporation (MCC) প্রোগ্রাম উল্লেখযোগ্য। আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে MCC-এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন, অবকাঠামো এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো হয়েছে। যেমনঃ মরোক্কো ও মাদাগাস্কারের গ্রামীণ বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ প্রকল্প তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে এবং তারা মার্কিন কূটনীতির জন্য নির্ভরযোগ্য সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত। MCC প্রকল্পের মাধ্যমে আফ্রিকার অত্র রাষ্ট্রগুলোকে কৌশলগতভাবে যুক্ত করা এবং আমেরিকার প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার "Global Gateway" উদ্যোগের সাহায্যে আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি, সবুজ জ্বালানি এবং স্বাস্থ্যখাতে বিশাল বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। এর মাধ্যমে ইউরোপ চীনের Belt and Road Initiative-এর একটি বিকল্প মহা প্রকল্প তৈরি করতে চাইছে, এবং একই সঙ্গে বৈশ্বিক দক্ষিণের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ইউরোপীয় মূল্যবোধ, টেকসই উন্নয়ন ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যখাত ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি প্রকল্প EU-এর প্রতি আফ্রিকানদের সমর্থন বাড়িয়েছে এবং এই অঞ্চলে ইইউ-এর কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
গ. বাণিজ্য চুক্তিঃ বাণিজ্য চুক্তি রাষ্ট্রগুলোর জন্য কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে কার্যকর। এগুলো কেবল অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করে না; বরং লক্ষ্য রাষ্ট্রের নীতি, আন্তর্জাতিক অবস্থান এবং কৌশলগত সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। চুক্তির মাধ্যমে লক্ষ্য রাষ্ট্রকে আর্থিক, বাণিজ্যিক বা বাজার সুবিধা দেওয়া হয়, যা তাদের নীতি ও আচরণে পরিবর্তন আনার জন্য প্রণোদনার মতো কাজ করে। অর্থাৎ, সরাসরি চাপ বা জোরের পরিবর্তে সুবিধার মাধ্যমে কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করা হয়। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের Comprehensive Economic and Trade Agreement (CETA) শীর্ষক কানাডার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির কথা উল্লেখযোগ্য। এই চুক্তি কেবল বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছে না, বরং পরিবেশ, মানবাধিকার এবং নীতি ক্ষেত্রে কানাডাকে ইউরোপীয় মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে সাহায্য করেছে। চুক্তির মাধ্যমে কানাডা আর্থিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা পেয়েছে, যা তার নীতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থানকে ইউরোপীয় মূল্যবোধ এবং কৌশলগত লক্ষ্যগুলোর সাথে মেলাতে সাহায্য করেছে।
ঘ. বিনিয়োগ ও অবকাঠামো প্রকল্পঃ রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তার এবং কৌশলগত প্রাধান্য অর্জনের জন্য বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এই ধরনের প্রকল্প কেবল অর্থনৈতিক সুবিধাই দেয় না, বরং অংশগ্রহণকারী দেশের রাজনৈতিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করে। বর্তমানে চীনের Belt and Road Initiative (BRI) এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। BRI প্রকল্পের মাধ্যমে চীন প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী দেশের বন্দরে বিনিয়োগ, রেলপথ, সড়ক ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ঋণ প্রদানের মাধ্যমে কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করছে। এই প্রকল্পগুলো অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর অর্থনৈতিক নির্ভরতা তৈরি করে, যা চীনের আন্তর্জাতিক প্রভাব এবং কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের BRI প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানে Gwadar Port ও বিদ্যুৎ প্রকল্প, শ্রীলঙ্কায় Hambantota Port এবং নেপালের রেলপথ ও সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প চীনের কৌশলগত প্রাধান্য ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিশ্চিত করছে। অন্যদিকে, চীনের BRI-এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া যৌথভাবে “Blue Dot Network (BDN)” চালু করেছে, যার লক্ষ্য টেকসই, স্বচ্ছ এবং উচ্চমানের অবকাঠামো বিনিয়োগের মাধ্যমে অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলা। একইভাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের “Global Gateway” উদ্যোগও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবুজ জ্বালানি, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে, যা কেবল উন্নয়ন সহযোগিতা নয়, বরং চীণের প্রকল্পের বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৌশলগত স্বার্থ সংরক্ষণ করা।
ঙ. বাজার প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণঃ বাজার প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ হলো Economic Statecraft-এর একটি কার্যকর কৌশল, যার মাধ্যমে টার্গেট রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট শিল্প, প্রযুক্তি কিংবা পণ্য খাতের বাজারে প্রবেশাধিকারে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়। এই নিয়ন্ত্রণ টার্গেট রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং কৌশলগত প্রভাবকে খর্ব করার মাধ্যমে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের নীতিগত প্রভাব বিস্তার করে। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র চীনা কোম্পানি Huawei-কে মার্কিন সফটওয়্যার, চিপসেট ও নেটওয়ার্কিং যন্ত্রাংশ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং বিশ্বব্যাপী মিত্র রাষ্ট্রগুলোকেও 5G নেটওয়ার্কে Huawei নিষিদ্ধ করতে চাপ প্রয়োগ করে। এর ফলে চীনের উচ্চ-প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন মন্থর হয় এবং Huawei-এর বৈশ্বিক বাজার সংকুচিত হয়ে পড়ে, যা কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত প্রাধান্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। আবার, ২০২০ সালে COVID-19 নিয়ে তদন্ত দাবি করায় চীন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন পণ্য, যেমন: বার্লি, ওয়াইন, বিফ এবং কয়লা ইত্যাদি আমদানিতে অঘোষিতভাবে শুল্ক ও বিধিনিষেধ আরোপ করে। চীনের বাজারে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার কৃষি ও খনি খাত অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়ে। এটি চীনের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়ার প্রতি একটি রাজনৈতিক বার্তা কৌশল হিসেবে কাজ করে।
উপসংহার:
Economic Statecraft আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং রাষ্ট্রীয় কৌশলের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত। এটি রাষ্ট্রকে সরাসরি সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি না নিয়ে অর্থনৈতিক উপকরণের সাহায্যে আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ প্রদান করে। এই অর্থনৈতিক শাসনকৌশল অর্থনৈতিক শক্তি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো প্রকল্প এবং আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে টার্গেট রাষ্ট্রের নীতি, আচরণ এবং আন্তর্জাতিক অবস্থান প্রভাবিত করে। carrot-and-stick নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রণোদনা বা শাস্তির মাধ্যমে কার্যকরভাবে টার্গেট রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রীয় কৌশলে Economic Statecraft রাষ্ট্রকে low-cost influence, strategic flexibility, এবং long-term advantage অর্জনের সুযোগ দেয়। এটি কেবল অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার নয়, বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, কূটনীতি এবং শক্তি ভারসাম্যের সঙ্গে সমন্বয় করে রাষ্ট্রের সামগ্রিক ক্ষমতা ও বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধি করে। একই সঙ্গে Economic Statecraft রাষ্ট্রগুলোর দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনা এবং বহুমাত্রিক নীতি প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এটি সামরিক ও কূটনৈতিক হাতিয়ারগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে রাষ্ট্রের শক্তি বিস্তারকে কার্যকর করে এবং টার্গেট রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ করে দেয়।
-বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


No comments